“বিস্মৃতি ছাপিয়ে” নির্মেদ, নিরাসক্ত স্মৃতিচারণের ভিতর দিয়ে সামাজিক ইতিহাসের উপাদান সংগ্রহের দিন বুঝি বা শেষ হয়ে গেল । যেহেতু কবিতার রসধারাতে তিনি সিক্ত ছিলেন, তাই কবিতার পঙতি দিয়েই তাঁর এই নীরব ত্বরণকে স্মরণ করা যেতে পারে। বিশ্বনাগরিক আলবার্ট সোয়াইৎজারের মৃত্যুর পর কবি অমিয় চক্রবর্তী লিখেছিলেন, ‘…..হঠাৎ ভোরের রোদে দেখি দিন রাত্রি ঢাকা। প্রয়াণী গেছেন রাত্রে, বিশ্ববাসী পরম আত্মীয়হারা।’
অশোক মিত্রর জীবদ্দশায় প্রকাশিত শেষ প্রবন্ধ সঙ্কলনটির প্রবন্ধগুলো পড়তে পড়তে অন্তরাত্মা যেন কেবল রবীন্দ্রমন্ত্রই উচ্চারণ করছিল, ‘তুমি যেও না এখনি। এখনো আছে রজনী। পথ বিজন তিমিরসঘন, কানন কন্টকতরুগহন-আঁধারা ধরণী।’ এই আঁধারা ধরণীর বুকে তিমির বিদায় উদার অভ্যুদয়ের বার্তাই যেন মূলত জীবনের অন্তিম পর্যায়ের দিনগুলিতে এসে নির্মোহ স্মৃতির খেয়াতে বসে আমাদের শুনিয়ে গেলেন অশোক মিত্র।
‘যা হারিয়ে যায়’ সঙ্কলনের প্রথম প্রবন্ধ। জীবন উপান্তে পৌঁছে একজন মানুষ কী দুর্দান্ত স্মৃতিধর হতে পারেন-এটা যাঁরা ব্যক্তিগতভাবে অশোক মিত্রকে দেখবার বা জানবার সুযোগ পাননি, তাঁরা এই প্রবন্ধ থেকে সেই সুযোগটা পেয়ে যাবেন। ‘মুখরস্কি থেকে মুখলার’ গ্রন্থ আলোচককেও স্মৃতিমেদুর করে দেয়। রাজনৈতিক চিন্তা- চেতনায় দুই বিপরীত মেরুর বাসিন্দা অন্নদাশঙ্কর রায় এবং অশোক মিত্রর সখ্যতা দেখবার দুর্লভ সুযোগ বর্তমান আলোচকের ঘটেছিল। দুই মেরুর বাসিন্দা কীভাবে সৎ গুণের তাগিদে বিপরীত ভাবনার মানুষের হৃদয় জয় করতে পারেন-এ সখ্যতা উপলব্ধি না করলে তা বোঝা সম্ভবপর নয়। ‘রমলা’ স্রষ্টা মনীন্দ্রলাল বসুর প্রতি অশোক মিত্রর শ্রদ্ধা এবং কর্তব্যবোধের যে কাহিনি আলোচ্য গ্রন্থের প্রবন্ধটিতে আছে, অন্নদাশঙ্করও অন্যত্র এ প্রসঙ্গের অবতারণা করে অশোকবাবুর প্রতি সবিশেষ শ্রদ্ধা অর্পণ করে গেছেন। এই প্রবন্ধে অশোক মিত্র লিখছেন, ‘আমার সন্দেহ, এই পর্যায়েই শান্তিনিকেতনের কোনও কোনও হোমড়াচোমড়াদের সঙ্গে তাঁর মন কষাকষি হয়’ (পৃষ্ঠা-২০)।
প্রকৃত ঘটনাটি হলো, অন্নদাশঙ্করের সঙ্গে কারও কোনও মন কষাকষি হয়নি। কিছু বিরোধ হয়েছিল তাঁর পত্নীর সঙ্গে ক্ষিতিমোহন সেনের। রবীন্দ্রনাথের জীবদ্দশার শেষ পর্যায়ে, যখন অনিল চন্দদের সবিশেষ ক্ষমতা, এই পর্বে ক্ষিতিমোহন সেন শান্তিনিকেতনে যথেষ্ট অপমানিত হলেও কবির মৃত্যুর পর রথীন্দ্রনাথের আমলে ক্ষিতিবাবু ও তাঁর পরিবার বিশেষ ক্ষমতাশালী হয়ে উঠেছিল। এই পর্যায়ে বাউল সংক্রান্ত বিষয়ে ক্ষিতিমোহন সেনের সঙ্গে অন্নদাশঙ্করের পত্নী লীলা রায়ের কিছু মতবিরোধ ঘটেছিল। অশোক মিত্র প্রসঙ্গটির এখানে অবতারণা করলেও বিস্তারিত কিছু বলেননি। অন্নদাশঙ্কর সম্পর্কে অশোক মিত্রর মূল্যায়ন, ‘বাঙালি উচ্চবর্গীয়দের মানসিকতায় যে দ্বিচারিতা জড়ানো তা তাঁর ( অন্নদাশঙ্কর) পুরোপুরি জানা হয়ে গেছে। অন্নদাশঙ্করের ভবিষ্যদবাণী অন্তত পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে খাঁজে খাঁজে মিলে গেছে।’ ( পৃষ্ঠা-২৩) এমন নির্মেদ এবং যথার্থ অন্নদাশঙ্কর মূল্যায়ণ যে আর কেউই করতে পারেননি তা নিঃসঙ্কোচে বলা যায়।
অন্নদাশঙ্করকে স্মরণ করতে গিয়ে রুশ প্রতিবিপ্লবী কোলচাক আর ডেনিকিনের নাম উল্লেখ করে অশোক মিত্র আমাদের চারপাশের প্রতিবিপ্লবী চরিত্রগুলিকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে গেছেন। তিনি লিখছেন, ‘বিষ্ণুবাবু ( কবি বিষ্ণু দে) কখনও ভাবতে পেরেছিলেন যে তাঁর প্রয়াণের কুড়ি বছরও পেরোবে না, তাঁর অতি স্নেহভাজন ভারতবর্ষের অগ্রগণ্যতম কমিউনিস্ট কবি হিসেবে যাঁর খ্যাতি, সেই সুভাষ মুখোপাধ্যায় এক চরম স্বৈরাচারিণী নেত্রীর অধীন সমাজবিরোধী সমাচ্ছন্ন দলের সঙ্গে গলাগলি সম্পর্কে জড়িয়ে পড়বেন? ( পৃ-২৫) এ জন্যেই তিনি অশোক মিত্র। এ জন্যেই তিনি তথাকথিত ভদ্রলোক নন, কমিউনিস্ট।
‘নাটকীয় মুহূর্ত’তে নিজের মন্ত্রী জীবনের অভিজ্ঞতায় এক আদিবাসী রমণীর মুখ থেকে শোনা তিরস্কার, ‘এত কম সময় লিয়ে আসিস কেনে?’ যেন আমাদেরও হৃদয়তন্তুকে সেই অমোঘ প্রশ্নের সামনে এনে দাঁড় করিয়ে দেয়,’সময় কারও যে নাই, ওরা চলে দলে দলে-গান হায় ডুবে যায় কোন কোলাহলে’র প্রশ্নের সামনে।
ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনে জাতীয় আন্দোলনের সশস্ত্র বিপ্লবী ধারা থেকে যাঁরা এসেছিলেন, তাঁদের প্রতি একটা বিশেষ রকমের শ্রদ্ধা ছিল অশোক মিত্রর। আলোচ্য গ্রন্থে তেমন ব্যক্তিত্বদের ভিতর কেবল সুধাংশু দাশগুপ্তকে নিয়ে তাঁর প্রয়াণলেখটিই সঙ্কলিত হয়েছে। ‘আদর্শের পবিত্রতা রক্ষাই যাঁর ধ্যান- জ্ঞান’ প্রবন্ধে বিপ্লবী বীর সুধাংশু দাশগুপ্ত সম্পর্কে অশোকবাবু লিখছেন, ‘তিনি শুধু জ্ঞানচর্চার সর্বাধ্যক্ষ নন, তিনি দ্বাররক্ষীও।… আদর্শের পবিত্রতা রক্ষায় তিনি এতটাই অনড় ছিলেন যে এঁর-ওঁর-তাঁর কাছে অপ্রিয়ভাজন হতে তাঁর আদৌ দ্বিধা ছিল না, তাত্ত্বিক পবিত্রতা রক্ষার লড়াই সুধাংশু দাশগুপ্তের কাছে দুরূহ রাজনৈতিক সংগ্রাম, সেই যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পশ্চাদপসরণ ঘোরতর কাপুরুষতা। (পৃষ্ঠা-১৯১) অশোক মিত্রও তাঁর জীবনে এই কাপুরুষতা এক মুহূর্তের জন্যে করেননি। সত্যব্রত সেন, সুবোধ রায়, সুচিত্রা মিত্রর প্রয়াণের পর অসামান্য কিছু প্রবন্ধ অশোক মিত্র লিখেছিলেন। সেগুলি এই সঙ্কলনে সংযুক্ত হলে সঙ্কলনটির উৎকর্ষতা আরও বাড়তো।
বিস্মৃতি ছাপিয়ে
অশোক মিত্র
আনন্দ
দাম–৩৫০ টাকা