বিজেপি বিরোধী দলগুলির স্টিয়ারিং কংগ্রেস নয়, মমতার হাতে, উত্তর প্রদেশে জোটের পর ১৯ শে জানুয়ারির ব্রিগেড এই ইঙ্গিতই দিচ্ছে
জ্যোতি বসুর পর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, বিরোধীদের সর্বভারতীয় সমাবেশ করছেন ব্রিগেডে। জ্যোতি বসুর পিছনে ছিল সিপিএমের মতো রেজিমেন্টেড পার্টি। সিপিএমের বদলে মমতাই এই মুহূর্তে বাংলার মূল শক্তি। চালিকা শক্তি বিজেপি এবং কংগ্রেস বিরোধী দলগুলির। আর সেই কারণেই মমতার ডাকে আজ সাড়া দিয়েছে বিজেপি বিরোধী প্রায় সব রাজনৈতিক দল। তৃণমূল নেত্রী নিজেই জানিয়েছেন, ১৯ জানুয়ারি ব্রিগেডের সমাবেশে ২০ জন বিরোধী নেতা আসবেন বলে তাঁকে জানিয়েছেন। সেই তালিকায় আছেন কুমারস্বামী, দেবগৌড়া, ফারুক আবদুল্লাহ, অখিলেশ যাদব, চন্দ্রবাবু নাইডু, অরবিন্দ কেজরিওয়াল, তেজস্বী যাদব, এম কে স্ট্যালিনের মতো নেতারা। আসতে পারেন যশবন্ত সিনহা, শত্রুঘ্ন সিনহা, রাম জেঠমালানির মতো বিজেপির বিদ্রোহীরা। মায়াবতী, অখিলেশ নিজেরা না এলেও প্রতিনিধি পাঠাতে পারেন। এই যে কলকাতায় শক্তির ভারসাম্য দেখানোর একটা মহড়া হবে, এর পিছনে আছে মমতারই মডেল।
শনিবার বারবেলায় মমতা মডেলকে সামনে রেখে উত্তর প্রদেশে জোট ঘোষণা করে ফেলল সমাজবাদী পার্টি এবং বহুজন সমাজ পার্টি। পাঠককে এই প্রসঙ্গে মনে করিয়ে দিই, ২০১৬ সালে বিধানসভা নির্বাচনে বিপুল জয়ের পর ২১ শে জুলাই শহিদ সমাবেশে মমতা বলেছিলেন, বিজেপির বিরুদ্ধে যে যেখানে শক্তিশালী, সে সেখানে লড়বে। গত বছর দিল্লিতেও বিরোধীদের প্রতিটি মিট-এ মমতা একই বার্তা দিয়েছেন। লখনউতে শনিবার জোটের আসন বন্টনের ঘোষণার সময়, অখিলেশ-মায়াবতী অমেঠি ও রায়বরেলিতে প্রার্থী না দেওয়ার ইঙ্গিত দিয়ে মমতার একের বিরুদ্ধে এক প্রার্থীর মডেলেও সিলমোহর দিলেন। এর আগে উত্তরপ্রদেশের তিনটি লোকসভা, ফুলপুর, গোরক্ষপুর ও কৈরানার উপনির্বাচনে এই মডেল অনুসরণ করে জয় পেয়েছেন বিরোধীরা। পরস্পর শত্রুতা ভুলে বন্ধুতার ফলে এই জয় পেয়েছিল বলেই কংগ্রেসকে দূরে রেখে এসপি এবং বিএসপি আজ জোটবন্ধনে সায় দিয়েছে। ১৯৯৩ সালে উত্তর প্রদেশে জোট বেঁধেছিল সপা এবং বসপা। তখন উত্তরপ্রদেশে সরকার গড়ে এই জোট। সেই জোটের নেতৃত্বে ছিলেন কাঁসিরাম ও মুলায়ম সিংহ যাদব। আবার সেই জোট গড়া হল। এর ফলে ভোট ভাগাভাগি সরল পাটিগণিত মেনে হবে না রসায়ন মেনে, তা বলে দেওয়ার মতো বিশেষজ্ঞদের দলে আমি নেই। আমি শুধু বলতে পারি, বিজেপি ফিরে এলে যে সাড়ে সব্বনাশ হবে এই বোঝাপড়ার ওপর দাঁড়িয়ে এককাট্টা হয়েছেন বুয়া-ভাতিজা। আর এই জোট আরও একটা জিনিস পরিষ্কার করে দিয়েছে, ভোটের আগেই জোটের কোনও গ্র্যান্ড ন্যারেটিভ হচ্ছে না। মোদ্দা কথা, কোনও ধরাবাঁধা ছকে বিজেপি বিরোধী শক্তিগুলোর কোনও সমবায় হবে না। এক এক জায়গায় এক একরকম পারমুটেশন-কম্বিনেশন চলবে।
অনেক আগে থেকেই মমতা বলে আসছেন, বিজেপির বিরুদ্ধে লড়াই হবে এক এক জায়গায় এক একরকম। উত্তর প্রদেশে যেমন লড়বেন অখিলেশ-মায়াবতী, বিহারে লড়বে লালু প্রসাদ যাদবের আরজেডি। কেরালায় লড়বে সিপিএম নেতৃত্বাধীন বামফ্রন্ট। দিল্লিতে লড়বে অরবিন্দ কেজরিওয়ালের আপ। তামিলনাডুতে লড়বে স্ট্যালিনের ডিএমকে। কর্ণাটকে বিজেপির বিরুদ্ধে লড়বে জেডিএস ও কংগ্রেস। টিআরএস লড়বে তেলেঙ্গানায় এবং অন্ধ্র প্রদেশে লড়বেন চন্দ্রবাবু নাইডু। মহারাষ্ট্রে এনসিপি-কংগ্রেস জোট লড়বে বিজেপির বিরুদ্ধে। এই ফর্মুলায় পশ্চিমবঙ্গের ৪২ টি আসনেই লড়বে তৃণমূল কংগ্রেস কেননা, এরাজ্যে তারাই প্রধান শক্তি। ঠিক তেমনই গুজরাত, মধ্য প্রদেশ, রাজস্থান, ছত্তিশগড়ের মতো চারটি বড় রাজ্যে লড়বে কংগ্রেস একাই। কেননা, এই চারটি রাজ্যে কোনও আঞ্চলিক দলের সেভাবে প্রভাব নেই। আর যে রাজ্যে যে দল নির্ধারক শক্তি, তার অঙ্কেই লড়তে হবে সম মনোভাবাপন্ন দলগুলোকে। ঠিক যেমন ২০১১ সালে বিধানসভা নির্বাচনে এরাজ্যে কংগ্রেসকে মানতে হয়েছিল তৃণমূলের আসন ভাগের সমীকরণ।
কিন্তু কংগ্রেস যে এই ফর্মুলা মানবে না, তা তারা বুঝিয়ে দিয়েছে। রাহুল গান্ধীর নির্দেশে সাংবাদিক বৈঠক করে গুলাম নবি আজাদ জানিয়ে দিয়েছেন, কংগ্রেস উত্তর প্রদেশে ৮০ টা আসনেই প্রার্থী দেবে। ফলে উত্তর প্রদেশে বিজেপি, অখিলেশ-মায়াবতী জোট এবং কংগ্রেস—এই ত্রিমুখী লড়াই কার্যত নিশ্চিত। এসপি-বিএসপি জোটকে স্বাগত জানিয়ে দুবাইয়ে বসে কংগ্রেস সভাপতি বলেছেন, ‘ওই দুই দলের নেতা-নেত্রীর প্রতি আমার গভীর শ্রদ্ধা রয়েছে। ওঁদের অধিকার আছে নিজেদের মতো সিদ্ধান্ত নেওয়ার। কিন্তু উত্তর প্রদেশের মানুষের জন্য কংগ্রেসেরও অনেক কাজ করার রয়েছে। আমরা নিজেদের মতো লড়াই করব।’ এটা ঠিকই বুয়া-ভাতিজার ডিকটার্মে উত্তর প্রদেশের মতো রাজ্যে কংগ্রেসের কর্মী-নেতাদের সামাল দেওয়া প্রায় অসম্ভব। বিশেষ করে তিন রাজ্যে কংগ্রেস ক্ষমতায় আমার পর। ফলে এখন ‘একলা চলা’ ছাড়া আর কী-ই বা করতে পারেন সনিয়া-রাহুল গান্ধীরা। মুলায়ম সিংহ যাদবের ভাই, চরম অখিলেশ বিরোধী শিবপাল যাদবের প্রগতিশীল সমাজবাদী পার্টি-লোহিয়ার সঙ্গে বড়জোর দু-একটা আসনে মিলিঝুলি হতে পারে। কিন্তু কংগ্রেস যতই বড়ফট্টাই করুক, ২০০৯ ছাড়া এই শতাব্দীর কোনও লোকসভা ভোটেই কংগ্রেস উত্তর প্রদেশে দুই অঙ্কের আসনে পৌঁছতে পারেনি।
তবে রাজস্থান, ছত্তিশগড়, মধ্য প্রদেশের ভোটের পর বিজেপি বিরোধীদের ‘মহাজোট’ গড়ার যে ব্যাপক জল্পনা শুরু হয়েছিল, এসপি-বিএসপি এবং কংগ্রেসের এই ঘোষণায় সেটা বড়সড় ধাক্কা খেল। শুধু তাই নয়, এর প্রভাবে অন্য রাজ্যেও কংগ্রেসের সঙ্গে আঞ্চলিক দলগুলোর জোট বা সমঝোতার সম্ভাবনা ভেস্তে যেতে পারে বলেও মনে হয়। রবিবারের পর উত্তর প্রদেশের যে চেহারা দাঁড়াচ্ছে তাতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ডাকা ১৯ জানুয়ারির বিরোধী সমাবেশ কোন খাতে বইবে তা রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের কাছে বড়ই কৌতুহলের। নিজেদের জোট ঘোষণা করতে গিয়ে অখিলেশ-মায়াবতী জানিয়েছেন, অতীতে দেখা গিয়েছে কংগ্রেসের সঙ্গে জোট করলে লাভ হয় না। তাঁদের অভিজ্ঞতা বলে, সপা-বসপার ভোট কংগ্রেস পায়, কিন্তু কংগ্রেসের ভোট সপা-বসপা পায় না। এই অভিজ্ঞতা আমাদের রাজ্যের সিপিএম নেতাদেরও আছে। যদিও তাঁরা সেটা প্রকাশ্যে স্বীকার করেন না কংগ্রেস সম্পর্কে মোহ থেকে। যখন সবে কংগ্রেস-সিপিএম এরাজ্যে তৃণমূলকে হারাতে জোট করার ভাবনা বাতাসে ভাসাচ্ছে সেই ২০১৫ সালে এই প্রতিবেদক এক দৈনিকের পাতায় লিখেছিল, বাম-কংগ্রেস জোট হলে তৃণমূলের কিছু হারানোর নেই। তার অন্যতম একটি কারণ ছিল, বামেরা কংগ্রেসকে ভোট দিলেও, কংগ্রেসের সাধারণ ভোটার বাম প্রার্থীদের ভোট দেবে না। সূর্যকান্ত মিশ্রর প্রায় কোলে উঠে পড়ে মানস ভুইঞা ঠিক নিজের আসনটি অক্ষত রাখতে পারলেন, অথচ নারায়ণগড়ের গড় রক্ষা করতে পারলেন না সূর্যকান্ত মিশ্র। এমনকী, এই বাম-কংগ্রেস সমঝোতার পক্ষে কিছু মিডিয়া অল আউট প্রচার চালানোর পরেও বামেদের হাতে রইল সেই ঝান্ডা, রাজদণ্ড মমতার হাতেই।
এখনও আলিমুদ্দিনের নেতারা মনে করছেন, কংগ্রেসের সঙ্গে আসন সমঝোতা করলে সম্মানজনক আসন জিতে আসতে পারবেন। শোনা যাচ্ছে, দলের সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি কংগ্রেস সভাপতির সঙ্গে কথা বলে বল কিছুটা গড়াবার রাস্তা তৈরি করবেন। হতে পারে। কিন্তু একথা না বললে, পলিটিক্যালি ইনকারেক্ট হবে, সিপিএম ছাড়া দেশের আর কোনও দলই কংগ্রেসকে চার-পাঁচটি রাজ্যের বাইরে কোনও রাজনৈতিক শক্তি বলে মনে করে না। এমনকী, ডিএমকে প্রধান স্ট্যালিন, রাহুলকে প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী হিসাবে তুলে ধরার কথা প্রকাশ্যে বলা ছাড়া অন্য কোনও বিরোধী নেতা এমন কথা উচ্চারণ করেননি। দক্ষ রাজনীতিকের মতো চন্দ্রবাবু নাইডু থেকে অখিলেশ, সবাই এবিষয়টি এড়িয়ে গিয়েছেন। কোনও কোনও রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞ একটা বাইনারি প্রোপজিশন দাঁড় করাতে চান, হয় কংগ্রেমের সঙ্গে জোট করতে হবে, নয় বিজেপির সঙ্গে। অর্থাৎ, হয় এনডিএ নয় ইউপিএ। অথচ বাস্তবটা হচ্ছে, দেশে কোনও একটি রাজনৈতিক দল নেই, যার সব কটি রাজ্যে সম্মানজনক প্রতিনিধিত্ব করার মতো কোমরের জোর আছে। তথাকথিত দুই দল, বিজেপি এবং কংগ্রেসকে চার-পাঁচটি রাজ্যের বাইরে কোনও না কোনও আঞ্চলিক দলের হাত ধরে চলতে হয়। আর সেকারণেই বিহারের সাফল্য ধরে রাখতে অমিত শাহদের নতজানু হতে হয় নীতীশ-রামবিলাসের কাছে। নিজেদের জেতা আসন ছেড়ে দিতে হয়। কংগ্রেসকে হজম করতে হয় দেবেগৌড়া-কুমারস্বামীকে। যে উত্তর পূর্ব ভারতে কংগ্রস ছিল একচেটিয়া রাজনৈতিক শক্তি, তারা আজ সেখানে কোনও রাজ্যে ক্ষমতায় নেই। নাগরিক সংশোধনী বিলের ধাক্কায় বিজেপির অবস্থাও লবেজান। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে উত্তর-পূর্বে কী অবস্থা দাঁড়াবে বলা মুশকিল।
বিজেপি এবং কংগ্রেসকে বাদ দিয়েই নয়া সমীকরণ আজ তৈরি হচ্ছে জাতীয় রাজনীতিতে। এই রাজনৈতিক সিনারিওতে মমতার মডেল ১৯ জানুয়ারি ব্রিগেডের বিরোধী সমাবেশে সিলমোহর পাবে বলেই মনে হচ্ছে। একই সঙ্গে ভোটের ফলের পরে প্রধানমন্ত্রী ঠিক করার মমতার ফর্মুলাই রূপায়ণের নান্দীমুখ হবে এই সমাবেশে।
(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)
Comments are closed.