ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের একশো বছর! সৌধ তৈরিতে লর্ড কার্জন বরাদ্দ করেন ১.০৫ কোটি টাকা, পাথর আসে অধুনা পাকিস্তানের মাকরান থেকে
ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল। বাঙালির আবেগের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত এই সৌধ পাক্কা একশো বছর ধরে কলকাতার হাজারো ইতিহাসের সাক্ষী! সিনেমার দৃশ্য হোক বা কলকাতার ল্যান্ডমার্ক, এই শহরের ছবি মানেই ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল (Victoria Memorial)। আর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর থেকে সুভাষচন্দ্র বসু বা গান্ধীজি, ব্রিটিশ আমল থেকে ১৯৪৬ সালের দাঙ্গা, স্বাধীনতা থেকে নকশাল আন্দোলন, বাম-ডান রাজনীতির ওঠাপড়া, সব ঘটনা পেরিয়ে একশো বছরের দোরগোড়ায় ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল।
আসলে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল (Victoria Memorial) একটা ল্যান্ডমার্ক। এর ইতিহাসটাও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। ইংল্যান্ডের রানি ভিক্টোরিয়ার স্মৃতিতে নির্মিত হয়েছিল এই বিশাল ইমারত। রানি ভিক্টোরিয়ার মৃত্যু হলে ১৯০১ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি কলকাতার টাউন হলে আয়োজন করা হয়েছিল এক স্মরণসভার। আর সেখানেই রানির স্মৃতিতে একটি বিশাল ইমারত নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। তখন বড়লাট ছিলেন লর্ড কার্জন। তিনি ইতিহাস সচেতন ব্যক্তি হিসাবে যথেষ্টই প্রসিদ্ধ ছিলেন। মূলত তাঁর উদ্যোগেই এই ইমারত তৈরির কাজ শুরু হয়। তাছাড়াও কার্জন সাহেব চেয়েছিলেন, যেহেতু কলকাতা তৎকালীন ভারতের রাজধানী ছিল, সেই কারণে ব্রিটিশদের নির্মিত কোনও স্থাপত্য এই শহরে থাকুক। তিনি আরও চেয়েছিলেন এই ইমারতকে ‘a standing record of our wonderful history’ হিসেবে চিহ্নিত করতে।
কিন্তু এত বড় ইমারত নির্মাণের জন্য যেমন অর্থের প্রয়োজন ছিল, সেই সঙ্গে প্রয়োজন ছিল অতি দক্ষ প্রযুক্তিবিদেরও। প্রাথমিকভাবে স্থাপত্যটি নির্মাণ করার জন্য ৬৪ একর জমি বরাদ্দ করা হয়। ময়দান সংলগ্ন অঞ্চলের জমি চিহ্নিত করা হয়েছিল। প্রায় ১ কোটি ৫ লক্ষ টাকা বরাদ্দ করা হয়। এই বিপুল পরিমাণ অর্থের জন্য বিভিন্ন ব্যক্তির কাছ থেকে সাহায্য নেওয়া হয়েছিল। প্রায় প্রত্যেকেই এই আবেদনে সাড়া দিয়েছিলেন এবং অর্থ সংগ্রহ করতে কোনও সমস্যা হয়নি।
স্থাপত্যটির নকশা প্রস্তুত করেছিলেন বিখ্যাত ব্রিটিশ স্থপতি স্যার উইলিয়াম এমারসন এবং ১৯০২ সাল নাগাদ পরিকল্পনাটি অঙ্কনের ভার দেওয়া হয় ভিনসেন্ট নামে এক শিল্পীকে। নির্মাণের বরাত পেয়েছিল মার্টিন অ্যান্ড কোম্পানি। প্রায় ১০৩ মিটার লম্বা, ৭০ মিটার চওড়া এবং ৫৬ মিটার উচ্চতা বিশিষ্ট এই স্থাপত্য। তাজমহলে ব্যবহৃত সাদা মার্বেল পাথর এখানে ব্যবহার করা হয়েছিল। এই পাথর নিয়ে আসা হয় বর্তমানে পাকিস্তানের অন্তর্গত মাকরান অঞ্চল থেকে। যেহেতু কার্জন সাহেবের কাছে তাজমহল অত্যন্ত আকর্ষণীয় ছিল, সেই কারণে তিনি ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল নির্মাণের ক্ষেত্রে কোন খুঁত রাখতে চাননি। প্রাথমিকভাবে ঠিক হয়েছিল স্থাপত্যটি নির্মিত হবে রানি ভিক্টোরিয়ার স্মৃতিতে এবং অন্যদিকে এটি একটি সংগ্রহালয়েরও কাজ করবে।
সালটা ১৯০৬, জানুয়ারি মাস, কলকাতায় এলেন প্রিন্স অফ ওয়েলস পঞ্চম জর্জ। আর তাঁকে দিয়েই সেরে নেওয়া হল শিলান্যাস। এরপর কেটে যায় প্রায় ১৫ বছর। ১৯২১ সালে সর্বসাধারণের জন্য খুলে দেওয়া হল ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের দরজা। আপামর কলকাতাবাসী সাক্ষী রইলেন এক নতুন স্থাপত্যের। যা মুগ্ধ করল বাঙালিদের। দেশ-বিদেশ থেকে ছুটে এলেন পর্যটকরা। নির্মাণের প্রায় এক শতক পরেও একইভাবে দেশ-বিদেশের লক্ষ-লক্ষ মানুষের কৌতুহলের কেন্দ্রে ভিক্টোরিয়া। সন্ধের পর আলোর রোশনাইতে ভরে যায় ভিক্টোরিয়া। মনে হয় যেন এক রূপকথার স্থাপত্য।
কিন্তু এর ভিতরে ঠিক কী আছে? ইতিহাসপ্রেমী মানুষ কেন ভিড় জমান এখানে?
পশ্চিমের নামজাদা চিত্রশিল্পীদের ছবি স্থান পেয়েছে এই সংগ্রহালয়ে। এক শতক ধরে যা দর্শকদের মুগ্ধ করে আসছে। এই তালিকায় কে নেই? টিলি কেটল, জোহান জোফানি, উইলিয়াম হজ, এমেলি এডেন থেকে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর, যামিনী রায়, নন্দলাল বসু প্রমুখের আঁকা চিত্র এখানে স্থান পেয়েছে। অসংখ্য পাণ্ডুলিপিরও উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়, পুরনো কলকাতার দুষ্প্রাপ্য ছবির বিপুল সম্ভার রয়েছে এই ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে। তাছাড়া বিভিন্ন যুদ্ধে ব্যবহৃত অস্ত্রশস্ত্র, কামান প্রভৃতির দেখা পাওয়া যায় এখানে।
ঝাঁ-চকচকে এই স্মৃতিসৌধের সবথেকে আকর্ষণীয় অংশটি হল তার ডোম বা গম্বুজের অংশটি। এই গম্বুজের ঠিক উপরে রয়েছে সেই বিখ্যাত পরী। গম্বুজটি ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের ঠিক মাঝামাঝি জায়গায় অবস্থিত। গম্বুজের নীচে অবস্থিত হল ঘরটিকে কুইন্স হল হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। ঠিক এই ঘরের পাশ দিয়ে একটি ঘোরানো সিঁড়ির সাহায্যে গম্বুজের ভিতরের দিকে চারপাশে বারান্দা ধরে হেঁটে বেড়ানো যেতে পারে। আসলে এখানে রয়েছে বেশ কয়েকটি চিত্র। অবশ্য এই চিত্রগুলি ঠিক কী প্রকারের তা নিয়ে কিঞ্চিৎ মতপার্থক্য রয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে এগুলিকে ফ্রেস্কো হিসেবে চিহ্নিত করা হলেও আদতে এগুলো সব কটি তৈলচিত্র। গম্বুজের ভেতরের পোর্টিকাতে চিত্রগুলি বিরাজমান। হিসেব করে দেখা যায়, চিত্রের সংখ্যা মোটামুটিভাবে ১২ টি। ১৮৩৭ সাল থেকে শুরু করে ১৯০১ সাল পর্যন্ত রানির জীবনের সঙ্গে জড়িত ঘটনাগুলিকে শিল্পী তাঁর শৈল্পিক চেতনায় ফুটিয়ে তুলেছেন। কোথাও দেখা যাচ্ছে ক্যান্টারবেরির প্রধান ধর্মযাজক লর্ড চেম্বারলেন কর্তৃক রানির নিকট রাজার মৃত্যু সংবাদ পৌঁছানো হচ্ছে, কোথাও আবার রানির সঙ্গে রাজার বিবাহের দৃশ্য, রানির অভিষেক অনুষ্ঠান, রাজকীয়ভাবে রানির বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা। একদিকে বাঘ এবং অন্যদিকে সিংহের সঙ্গে রানি উপবিষ্ট, আবার একটি চিত্রতে রানির শাসনের ৫০ বছর পূর্তিতে বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠান, রানির মৃত্যুর দৃশ্য ইত্যাদি সবই শিল্পী তাঁর ছবিতে ফুটিয়ে তুলেছিলেন।
মেমোরিয়ালের মূল গেট দিয়ে প্রবেশ করলে প্রথমেই রয়েছে রানি ভিক্টরিয়ার বিশাল মূর্তি এবং তার একদিকে একটি ব্রোঞ্জের বিশাল ফলক, যেটি ভাইসরয় লর্ড মিন্টোর স্মৃতিতে নির্মাণ করা হয়েছিল। এই পথ ধরে মূল সৌধের (Victoria Memorial) প্রবেশদ্বারের সামনে পৌঁছালে দেখা যাবে প্রবেশদ্বারে দু’পাশে দুটি ফলকে কিছু শব্দ খোদিত করা আছে। বাঁ দিকের মিনারের দরজার উপরে রোমান হরফে লেখা ‘ইন্দাস’ এবং ‘যুমনা’। ডান দিকের দরজার উপরে একইভাবে লেখা ‘গ্যাঞ্জেস’ এবং ‘কৃষ্ণা’। ভারতীয় উপমহাদেশের চারটে নদী সিন্ধু, যমুনা, গঙ্গা ও কৃষ্ণার নাম। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই চারটি নদী ভারতের ইতিহাসের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তাই হয়তো এর উল্লেখ এই ঐতিহাসিক সৌধে!
ভিক্টোরিয়ার (Victoria Memorial) গম্বুজের উপরে দণ্ডায়মান পরি আজ বহু বছর অকেজো। যখন এই স্মৃতি সৌধ খুলে দেওয়া হয়, তখন এই পরি নাকি নিদির্ষ্টভাবে ঘুরতো। ১৯৭৮ সাল নাগাদ প্রায় সাড়ে তিন টনের পরিটির ঘোরা বন্ধ হয়ে যায়। দেশ-বিদেশের বহু ব্যক্তি পরি সারানোর জন্য কলকাতায় আসেন। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের নিয়ে তৈরিও হয়েছিল একটি দল। পরবর্তীকালে কোনও এক সময় আবার পরির কিছু অংশ বিকল হয়ে যায়। গবেষণা করে জানা গিয়েছে, এই পরি ঘোরার জন্য নির্দিষ্ট গতিবেগের প্রয়োজন হয়। ময়দান অঞ্চলে হাওয়ার সেই গতিবেগ পাওয়া খুব দুষ্কর।
বাঙালির জন্য ভিক্টোরিয়া, নাকি ভিক্টোরিয়ার জন্য বাঙালি, সেই বিতর্কে না যাওয়াই ভালো। তবে বলাই যায়, বাঙালির জীবনের সঙ্গে রানি ভিক্টোরিয়ার স্মৃতিসৌধটি ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে প্রায় এক শতক ধরে।
প্রচ্ছদ: মেঘমালা গাঙ্গুলি
Comments are closed.