আন্দ্রে গার্সিয়া শুধুমাত্র ভারতের মানুষের কথা ভেবে তৈরি করল বিশেষ সিগার। সেটা ২০০৭ সাল। ভারতে ব্যবসা করতে গেলে নাকি দাম কম রাখতেই হয়। আর দাম কমাতে গিয়ে মানের সঙ্গেও করতে হয় আপোস। এটাই প্রচলিত ধারণা। কিন্তু সেই ধারণাকে মানলেন না অভীক। মাঝারিয়ানায় যে কোনওদিনই বিশ্বাস নেই অভীকের। ঠিক করলেন, ভারতেও উৎকর্ষের সঙ্গে আপোস নয়। একবার মান সম্বন্ধে ক্রেতার মনে সন্দেহ তৈরি হলে, আর ফিরবে না ভরসা, একেবারে গোড়া থেকে জানতেন অভীক।
শুধুমাত্র ভারতের কথা ভেবে তৈরি করলেন ২৭টি ব্লেন্ড। শুরু হল ভারতে আন্দ্রে গার্সিয়ার পথ চলা। এজন্য ডমিনিকান রিপাবলিকে কারখানা কিনলেন অভীক রায়। সিগার তৈরি হয়ে আকাশপথে ভারতে। এখন দেশের প্রায় সবকটি লাক্সারি হোটেলে মিলবে আন্দ্রে গার্সিয়া সিগার। তাজ গ্রুপ থেকে ম্যারিয়ট কিংবা হায়াত, আন্দ্রে গার্সিয়ার সিগার পাবেন সবকটি লাক্সারি হোটেলেই। পাশাপাশি কলকাতা ক্লাব হোক কিংবা দিল্লি-বম্বের কোনও অভিজাত ক্লাব, দেশের নামি ক্লাবগুলোতেও একচ্ছত্র আধিপত্য আন্দ্রে গার্সিয়ারই।
ক্যালকাটা ক্লাবে মাইক হাতে
সম্প্রতি ২২ শে শ্রাবণ ছবিতে প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়কে যে সিগার খেতে দেখা যায়, তা আন্দ্রে গার্সিয়ার। তবে গড়িয়াহাটের পানের দোকানে যে কখনওই আন্দ্রে গার্সিয়া পাওয়া যাবে না, সেটা অভীক জানিয়ে দেন নিজেই। সিগার ব্যবসায়ে স্থানমাহাত্ম্য মস্তবড় ব্যাপার। ছেলেবেলায় দেশপ্রিয় পার্কের মাঠেও দ্রুত সাফল্যের লক্ষ্যে ছোটেনি অভীক, বড় হয়েও তার তারতম্য হয়নি। টিকে থাকতে মাঝারিয়ানার উপর কোনওদিনই আস্থা রাখেননি সিগার দুনিয়ার রোলস রয়েজ বলে পরিচিত আন্দ্রে গার্সিয়ার কর্ণধার।
বব ফ্রান্সব্লোর সঙ্গে
সিগার তৈরি হয় ৩টি করে পাতা দিয়ে। একদম বাইরে থাকে wrapper। এজন্য বাছা হয় একেবারে নিখুঁত, মসৃণ পাতা। সিগার রসিকরা যে কোনও সিগারের মান কেমন, তা বিচার করেন wrapper-এ হাত বুলিয়ে। এরপরের স্তরের নাম binder। নাম শুনেই বুঝতে পারছেন, সিগারের বাঁধুনি নির্ভর করে এই binder-এর উপর। এরপর একেবারে ভিতরের অংশ এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, filler। filler-এর উপরই নির্ভর করে সিগারটি ঠিক কতটা লম্বা হবে এবং আকৃতি কী রকম হবে। এই তিনটি আলাদা আলাদা অংশকে পরপর মুড়ে তৈরি হয় সিগার। আর কোন তিনরকম পাতাকে একসঙ্গে মুড়ে ফাইন সিগার তৈরি হবে, সেটাই হল মুনশিয়ানা। সাধারণত সিগার মাপা হয় ইঞ্চি কিংবা সেন্টিমিটারে। কিন্তু সিগার রসিকরা সিগারকে মাপেন ‘রিং গেজ’ অনুসারে। সারা পৃথিবীতে সিগারের কোনও নির্দিষ্ট মাপ নেই, বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন আকারের সিগার প্রচলিত। তবে বিখ্যাত কিছু আকার অবশ্যই রয়েছে। আন্দ্রে গার্সিয়া মূলত ৭ ইঞ্চির ‘চার্চিল সিগার’ তৈরি করে। উইনস্টন চার্চিলের আবার ৭ ইঞ্চি মাপের সিগার ছাড়া চলত না। ব্রিটেনের জেজে ফক্সে চার্চিল যে ইজিচেয়ারে বসে সিগারে সুখটান দিতেন, তা আজও সযত্নে রাখা আছে। সেই থেকে ওই সিগারের নামই হয়ে যায় ‘চার্চিল সিগার’। তাছাড়া সাড়ে ৫ ইঞ্চির ‘টোরো’, সাড়ে ৬ ইঞ্চির ‘টর্পেডো’, সাড়ে ৪ ইঞ্চির ‘শর্টি’ এবং ৫ ইঞ্চির ‘রোবুস্টু’ সিগার তৈরি করছে আন্দ্রে গার্সিয়া। সিগার মোড়ার ব্যাপারেও আছে বিভিন্ন প্রবাদ। হাতে মোড়া সিগারের কদর দুনিয়াজোড়া। আন্দ্রে গার্সিয়ার ডমিনিকান রিপাবলিকের কারখানায় সিগার মোড়ার কাজটি করেন হন্ডুরাসের এক জাদুকর। অভীক রায় তাঁকে এভাবেই বর্ণনা করেন। অভীকের মতে, দুনিয়ার সেরা সিগার শিল্পী হলেন তিনি। রোলিংয়ের পর শুরু আসল কাজ। সিগার দুনিয়ার পরিভাষায় যাকে বলে, ‘এজিং’। হ্যান্ড রোলিংয়ের পর সিগারকে একটি নির্দিষ্ট তাপমাত্রায়, মাপা আদ্রতায় রেখে দেওয়া হয় অন্তত দু’বছর। সাধারণত ২ বছরেই একটি সিগার পুরোপুরি তৈরি হয়ে যায়। কিন্তু এজিংয়ের সময় তাপমাত্রার তারতম্যের কারণে একটা সময় প্রচুর সিগার নষ্ট হত, অভীক হিউমিডার আনার পর থেকে পরিস্থিতি বদলে যায়। হাইগ্রোমিটার দেওয়া আন্দ্রে গার্সিয়ার ‘সিডার লাইনড হিউমিডার’, সিগার এজিং করাতে গোটা দুনিয়ায় একমেবাদ্বিতীয়ম। বহুমূল্য ওয়াইনের মতোই কিছু কিছু সিগারকে অবশ্য ১৫ বছর পর্যন্ত রেখে দেওয়া হয়।
এবার আসি আন্দ্রে গার্সিয়ার নামকরণে। অভীক এবং তাঁর ভাই একদিন বস্টনের এক কফিশপে বসে কফি খাচ্ছেন। আলোচনা চলছে সিগার নিয়ে। এমন সময় তাদের মাথায় আসে সিগার ব্র্যান্ডের একটি নাম দেওয়া উচিত। ভাই বলেছিলেন এমন নাম দেওয়া হোক, যাতে ইউরোপ এবং আমেরিকা, দু’য়েরই ছাপ থাকে। কী সেই নাম? ইউরোপে থাকাকালীন আন্দ্রে নামের সঙ্গে পরিচিত অভীক। মার্কিন অভিনেতা অ্যান্ডি গার্সিয়ার ভক্ত অভীকের নাম ঠিক করতে আর সময় লাগেনি। এভাবেই বস্টনের স্টারবাকসে কফি খেতে খেতে তৈরি হল আন্দ্রে গার্সিয়া।
ডাভিডফের শীর্ষ কর্তা রেনের সঙ্গে
ভবানীপুরের ছেলে অভীকের এই স্বপ্নসম উত্তরণের নেপথ্যে বরাবরই সবচেয়ে বড় ভূমিকা তাঁর মা-বাবার। বাবার স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে অভীক বলেন, বাবাকে পড়ানোর টাকা ছিল না ঠাকুরদার। বাঁকুড়ার ওন্দা ব্লকের মাদারবনি গ্রামের সন্তান অমিয়ভূষণ রায়। পড়াশোনা করার ইচ্ছেই অমিয়ভূষণবাবুকে টেনে নিয়ে আসে তালডাংরার হাড়মাসড়া উচ্চ বিদ্যালয়ে। কর্তৃপক্ষের কাছে পড়ার ইচ্ছে প্রকাশ করায়, তাঁকে বলা হয়েছিল, শর্ত একটাই, জীবনে কখনও দ্বিতীয় হওয়া চলবে না। বিদ্যালয়ের হস্টেলে কেবল প্রথম স্থানাধিকারীদেরই বিনামূল্যে থাকার ব্যবস্থা রয়েছে। জীবনে কখনও দ্বিতীয় হননি অমিয়ভূষণ রায়। পড়াশোনাতেও ছেদ পড়েনি কোনওদিন। চিরকাল যোগাযোগ অটুট ছিল নিজের স্কুলের সঙ্গে। তাই অবসরের পর নিজের সমস্ত সঞ্চয় দিয়ে ওই স্কুলেই তৈরি করে দিয়েছেন একটি লাইব্রেরি। আর কোনও পড়ুয়াকে বইয়ের অভাবে যেন শিক্ষায় ছেদ টানতে না হয়, অমিয়ভূষণবাবু নিজে তা নিশ্চিত করে গিয়েছেন।
বাবা-মায়ের সম্বন্ধে বলতে বলতেই অভীকের মনে পড়ে যায়, ছেলেবেলার একটি ঘটনার কথা। একদিন বাবা-মায়ের সঙ্গে ভবানীপুরের বাড়ি ফিরছিলেন অভীক। ভিড় বাসে অমিয়ভূষণবাবু টিকিট করার সুযোগ পাননি। খেয়াল করেননি কন্ডাক্টরও। এদিকে ভবানীপুর এসে পড়েছে। তাড়াহুড়ো করে নেমে বউ-ছেলেকে দাঁড়াতে বলে অধ্যাপক রায় ছুটেছিলেন চলন্ত ২২১ নম্বর বাসের পিছনে। ভাড়া দেওয়া হয়নি যে! প্রায় একটি স্টপেজ দৌড়ে অধ্যাপক রায় ভাড়া মিটিয়ে আবার হাফাতে হাফাতে ফিরে এসেছিলেন স্ত্রী-ছেলের কাছে। সেইদিনের ঘটনা গভীর ছাপ রেখে গিয়েছিল ছোট্ট অভীকের মনে। এই মানসিকতা কোনও দিন বদলাবে না, বলে দেন অভীক। মাটির কাছাকাছি দাঁড়িয়ে দুনিয়া শাসনের ফর্মুলা আজ অভীকের মুঠোয়। কিন্তু এখানেই থামতে চান না। তাঁর লক্ষ্য আরও দূরে। যখন আমেরিকা যান, একটি বিশেষ জায়গায় বিমানকর্মীরা ডেকে নিয়ে যান যাত্রীদের, কাচ ঘেরা করিডোরে আকাশ দেখাতে। যে আকাশের সৌন্দর্য বর্ণনা ভাষার অতীত। মার্কিন পরিভাষায় যাকে বলে ‘কাভু অল দ্য ওয়ে’। অর্থাৎ যার কোনও সীমা পরিসীমা নেই। ম্যারাথন রানার অভীক রায়ের জীবন দর্শনও ঠিক তাই। একটি করে মাইল ফলক ছোঁয়ার পরই নতুন লক্ষ্যের দিকে দৌড় শুরু। থেমে যাওয়া কথাটাই যে নেই অভীকের অভিধানে। দেশের বিভিন্ন ম্যারাথনে নিয়মিত অংশ নেন অভীক। তাঁর লক্ষ্য, বস্টন ম্যারাথনে অংশ নেওয়া। সেই লক্ষ্যে নিয়মিত চলছে অনুশীলন। অভীক জানেন, লেগে থাকলে বস্টন ম্যারাথনে অংশ নেওয়াটা কঠিন হবে না। জীবনের ম্যারাথনেও এভাবেই একের পর এক লক্ষ্য পেরিয়ে নতুন নতুন লক্ষ্য খুঁজে চলেছেন অভীক রায়। কিন্তু থামবেন কোথায়? অভীক রায় হেসে উত্তর দেন, কাভু অল দ্য ওয়ে! (শেষ)
Comments are closed.