আমার ছোটবেলার দার্জিলিংয়ের গল্প অনেক করলাম। আরও কত বাকি রয়ে গেল। আমাদের ছোটবেলার সঙ্গে শিলিগুড়ির স্মৃতিও অনেক আছে। কিছু সেই গল্প না করলে লেখাটা অসম্পূর্ণ রয়ে যাবে।
আমরা যখন একদম ছোট ছিলাম তখন শীতকালেও আমরা দার্জিলিংয়েই থাকতাম। আমাদের যাওয়ার কোনও জায়গা ছিল না। যদিও কলকাতায় আমাদের আত্মীয়-স্বজনরা থাকতেন। কিন্তু কারও বাড়িতে এতগুলো ছেলে-মেয়ে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে আমার বাবার আপত্তি থাকত। আর আমার বাবার তখন নতুন প্র্যাকটিস, ওনার পক্ষে কোথাও যাওয়া সম্ভব ছিল না। প্র্যাকটিসের জন্য বাবুকে প্রায়ই যেতে হতো শিলিগুড়ি, জলপাইগুড়ি। ওখানে ওনার থাকার খুব অসুবিধা ছিল। তাই আমার বাবা ঠিক করলেন, শিলিগুড়িতে একটা আস্তানা বানাবেন। একটা জমির খোঁজও পেলেন। এবারে ওখানে বাড়ি করবেন কী করে? কে দাঁড়িয়ে থেকে বাড়ি করে দেবে? বাবুর ক্লায়েন্টদের মধ্যে ইন্দ্রসেন আর ভীমসেন নামে দুই ভাই ছিলেন। ওনারা পাঞ্জাবি, শিলিগুড়িতে থাকতেন। ওনাদের বাড়িও তৈরি হচ্ছিল সেই সময়। ওনারা বাবুকে বললেন, ওনারাই দেখাশোনা করে বাবুর বাড়ি করিয়ে দেবেন। শিলিগুড়িতে আমাদের বাড়ি শুরু হলো। আমি তখন ক্লাস ফাইভে পড়ি। তখন বাড়ি শেষ হয়নি, দুটো ঘর, বাথরুম আর রান্নার জায়গা তৈরি হয়েছে। মা বললেন, গৃহপ্রবেশ করে নেবেন, তাহলে আমরা শীতের ছুটিতে ওখানে গিয়ে থাকতে পারব। আমাদের খুব আনন্দ, এতদিন শীতের ছুটিতে কোথাও যেতাম না। ছুটি শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অনেক লোক ট্রাঙ্ক-বিছানা নিয়ে রোজই বাজারের ট্যাক্সি স্ট্যান্ড বা রেল স্টেশনে যেতেন। নীচের দেশে চলে যেতেন ।
আমরা হাঁ করে ওদের যাওয়া দেখতাম। কখনও-কখনও মাকে বলতাম, মা চলো না আমরাও যাই। মা চুপ করে থাকতেন। এবারে গৃহপ্রবেশের দিন ঠিক হলো । কিন্তু তখন আমার অ্যানুয়াল পরীক্ষা শুরু হয়েছে। ঠিক হলো, আমি আমাদের ছোটবেলার আয়া, যাঁকে আমরা নানা বলতাম, তাঁর সঙ্গে থেকে যাব। মায়েরা তিন দিন পরে ফিরে আসবেন।
সেই বার থেকে আমাদের শীতের ছুটিতে শিলিগুড়ি যাওয়া শুরু হলো। দার্জিলিং থেকে এসে আমরা ভাই-বোনেরা মুক্ত বিহঙ্গের মতন হয়ে যেতাম। খোলা মাঠ আর মাঝে মাঝে কুল গাছ, পেয়ারা গাছ। ছুটে-ছুটে বেড়াতাম। কখনও কুল পাড়ছি, কখনও কচি পেয়ারা। কোথাও বাড়ি তৈরির জন্য বালির স্তুপ। সেখানে গিয়ে বালির ওপরে খেলা। মা আমাদের আনন্দ দেখে বিশেষ কিছু বলতেন না। দার্জিলিংয়ের সঙ্গে এর কোন মিল নেই। শিলিগুড়ি ছিল আধা গ্রাম, আধা মফঃস্বল শহর। ওখানে আমাদের পাড়ায় আমাদের বাড়িটাই পাকা ঢালাই করা ছাদ দিয়ে তৈরি। বাকি বাড়িগুলিতে ছিল টিনের চাল। কোনও কোনওটা ছিল বাঁশের বেড়া দেওয়া ঘর। আমরা রোদে ঘুরে-ঘুরে কালো হয়ে যেতাম। ওখানে তখন বিদ্যুৎও ছিল না। লণ্ঠন জ্বালানো হতো। তখন একজন ভদ্রলোক ছিলেন, সবাই ওঁকে বুড়োদা বলত। মায়েরাও বুড়োদা, আমরাও বুড়োদা। উনি বিশেষ কোনও কাজ করতেন না। উনি সকাল থেকে আমাদের বাড়িতে এসে যেতেন। মায়ের বাজার করে দিতেন। মাছ, সব্জি ইত্যাদি। আমাকে মাছ কাটা শেখানোর জন্য কুয়োর পারে বঁটি নিয়ে বসে আমাকে এক গাদা ছোট মাছ এনে কাটতে বলতেন। আমি ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে সেই মাছ কাটতাম। অনেক কাজ শিখেছিলাম তখন। লণ্ঠন পরিষ্কার করা, উঠোন ঝাঁট দেওয়া ইত্যাদি। দার্জিলিংয়ে এই সব ভাবাই যায় না ।
শিলিগুড়িতে মেয়েরা বেশি বের হতো না। আমরা বাইরে বাইরে ঘুরতাম। ওখানকার লোকেদের কাছে ওটা একটা দেখবার বিষয় ছিল। আমরা সন্ধ্যার সময়ও বাইরে যেতাম। মায়ের সংসারের কোনও জিনিস আনতে হলে, মাঠ পেরিয়ে একটা মুদির দোকান ছিল সেখানে যেতাম। আমি সবার বড়, তাই আমি লিডার, আর ভাই-বোনেরা লণ্ঠন হাতে নিয়ে আমার সঙ্গে যেত।
শিলিগুড়িতে এসে আমাদের খাদ্যের মধ্যে মুড়ি, চিড়ে ঢুকে গেল। মুড়ি আর পাটালি গুড় খেতে শিখলাম। শিলিগুড়িতে একটা সুগন্ধি চাল পাওয়া যেত। নুনিয়া বা কালো নুনিয়া চাল। খুব সুগন্ধি। মা মাঝে মাঝে সকালে নুনিয়া চালের ফ্যানা ভাত বানাতেন সকালের খাওয়ার জন্য। বাড়ির সবাই খুব ভালবেসে খেত। শুধু আমি ছাড়া। আমার সকালে ভাত খাওয়া একদম ভাল লাগত না। খুব আপত্তি করতাম। তাই আমি মুড়ি, চিড়ে খেতাম। আমি চাইতাম টোস্ট, ডিম এই সব খেতে ।
শিলিগুড়িতে এসে আমরা রিকশায় চলাফেরা করতাম আর খুব মজা পেতাম। আমাদের নানা সাইকেল রিকশায় চড়তে খুব ভালবাসত । আমাদের ভাই-বোনেদের কাউকে একজনকে নিয়ে যখন-তখন বের হয়ে যেত রিকশায় করে ঘুরে আসতে। নানার অনেক নেপালির সঙ্গে ভাব হয়েছিল। সেখানে ঘুরতে যেত। হঠাত শুনলাম নানা নকশালবাড়িতে জমি কিনে বাড়ি করবে। পরে নানা আমাদের বাড়ির চাকরি ছেড়ে নকশালবাড়িতে থাকতে চলে গিয়েছিল ।
শিলিগুড়িতে থাকার সময় সরস্বতী পুজো হতো। আমরা যখন ওখানে যেতাম, তখন প্রতিমা তৈরির কাজ চলত। আমাদের বাড়ির কাছেই এক জায়গায় প্রতিমা তৈরি হতো। আমরা অনেক সময় সেখানে গিয়ে প্রতিমা তৈরি করা দেখতাম। আমাদের বাড়িতে সরস্বতী পুজো হতো। পুজোর দিন ভোরবেলায় উঠে কাঁচা হলুদ আর গুড়-ছোলা ভেজানো খেতাম। আমের মুকুল আর কাঁচা দুধ দেওয়া হতো ঠাকুরের কাছে। পুরোহিত পাওয়া দুষ্কর ছিল। মা বের হয়ে কোনও বাড়ি থেকে পুরোহিত ডেকে প্রায় হাইজ্যাক করে নিয়ে আসতেন।
দার্জিলিংয়ে থাকার কারণে আমরা মোটর গাড়ি চড়তাম বছরে একবার শিলিগুড়িতে যাওয়ার জন্য। তাই গাড়িতে চড়তে ভয় পেতাম। বমি হওয়ার ভয়। প্লেন চড়া তো দূরের কথা। আকাশে এরোপ্লেন যেতে দেখতাম। এয়ারপোর্টে প্লেন কোনওদিন দেখিনি। তাই একবার আমার বাবা ঠিক করলেন আমাদের নিয়ে বাগডোগরায় বেড়াতে যাবেন। বাগডোগরা এয়ারপোর্টে গেলাম। একটা প্লেন এল। আমরা অবাক হয়ে দেখছি। প্লেন থেকে মানুষ নামছে। আমাদের মতন ছোট-ছোট মেয়েরা যারা দার্জিলিংয়ে কনভেন্ট স্কুলে পড়ত, তারা ছুটির পরে স্কুলের বোর্ডিংয়ে ফিরছে। একটা মেয়ে বোধ হয় তার স্যুটকেস খুঁজে পাচ্ছিল না। একা একাই গিয়ে কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলছিল। মেয়েটির বয়স ১২-১৩ বছর হবে। আমার বাবা খুব ইমপ্রেসড। আমাদের বলেছিলেন, দেখ তো মেয়েটা কী স্মার্ট। অবশেষে ওর স্যুটকেস উদ্ধার হলো।
আমরা একবার তিস্তা নদী দেখতে জলপাইগুড়িতে গিয়েছিলাম। তার আগে শুধু পাহাড় দেখেছি। নদী দেখিনি। বাবু আমাদের তিস্তার বাঁধে নিয়ে গিয়েছিলেন। শীতের ছুটিটা এইভাবেই কেটে যেত। এবার ঘরে ফিরতে হবে। স্কুল খুলে যাবে তাই দার্জিলিংয়ে ফেরা। ফিরলে পাড়ার ঠাকুমা মাকে বকতেন, বাচ্চাগুলিকে সব কালো আর রোগা করে নিয়ে এসেছ।
স্কুল খোলার দিন এসে যেত। সেটা মার্চ মাস। দার্জিলিংয়ে ঠান্ডা তখনও থাকত। তার ওপর মার্চ উইন্ড। খুব হাওয়া দিত। মাঝে মাঝে শিলাবৃষ্টি। কিন্তু স্কুল স্কুলের নিয়মে খুলে যেত। স্কুলের ক্লাসরুমে বসে বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকতাম। দেখতাম আমাদের স্কুলের চেরী ফুলের গাছটা ভরে গেছে গোলাপী রঙের ফুলে। রডোডেনড্রন গাছগুলি তখনও ফুলে ভরা।
স্কুল খোলার দিনে টিচাররা খুব গল্প করতেন আমাদের সঙ্গে। জিজ্ঞাসা করতেন ছুটিটা কীভাবে কাটালাম ইত্যাদি। অন্যান্য বছরে আমার বলার কিছু থাকত না। এবারে বললাম, আমরা শিলিগুড়ি গিয়েছিলাম। বেশিরভাগ মেয়েই বলত কলকাতায় গিয়েছিল। যাই হোক, আমি ওতেই সন্তুষ্ট ছিলাম।
এখন মনে হয় আমরা এত অল্পতে খুশি হতাম বলে আমাদের মা-বাবা তাঁদের সামর্থ অনুযায়ী আমাদের মানুষ করতে পেরেছিলেন।
ছোটবেলার গল্প এখানেই শেষ করছি। পাহাড়ের কোলে বড় হয়েছি, কাঞ্চনজঙ্ঘা আমার আজন্মের সঙ্গী। যা দেখার জন্য দূর দূর থেকে লোকেরা আসত। আমি তার নিত্য নতুন রূপ দেখেছি, অতি শিশুকাল থেকে। সূর্যোদয়, সূর্যাস্তের অপরূপ রঙ, জ্যোৎস্নার রাত্রে তার রূপোলি রং জানালার পর্দা সরিয়েই দেখতে পেতাম। সকালে ঘুম ভাঙলেই মহান হিমালয়ের দর্শন পেতাম। আবার কখনও মেঘের চাদরে পুরো শহরটাই ঢেকে থাকত। কাঞ্চনজঙ্ঘা বা হিমালয়ের এই দৃশ্য, এই রূপ আমার জীবনের সঙ্গে মিশে গেছে। ভাবতাম, এই পাহাড়, এই গাছপালা, এই ঝর্ণা, এই বিশ্ব প্রকৃতিকে নিয়েই আমার জীবন।
এখন পরিণত বয়সেও বহু বছরের পেছনে ফেলে রাখা স্মৃতি মনের মধ্যে উজ্জ্বল হয়ে আছে। আজও মনের চোখে ছোটবেলার দার্জিলিংকে দেখতে পাই। মনে হয় ওখানেই আমার জায়গা। প্রকৃতি আপন কোলে আমায় বারবার ডাক দেয়। কত দেশ ঘুরলাম, কত সুন্দর-সুন্দর দৃশ্য দেখলাম, কত মানুষ দেখলাম দেশে-বিদেশে। তবু মনে হয় আমার শান্তির আসন পাতা রয়েছে সেই শান্ত সমাহিত হিমালয়ের কোলে।
এখন আর দার্জিলিং যাওয়া হয় না। কিন্তু হিমালয় আমাকে নিরন্তর হাতছানি দেয়। যখনই কোনও সুযোগ আসে তখনই চলে যেতে ইচ্ছে করে। আর যখনই পাহাড়ের রাস্তা দিয়ে গাড়ি চড়ে যাই, মনে হয় এই তো এসে গিয়েছি নিজের জায়গায়। মনটা একটা অদ্ভুত শান্তিতে ডুবে যায়। কাউকে বোঝাতে পারব না, সে যে কী আনন্দ, চোখে জল এসে যায়। গলার কাছটায় ব্যথা করে। এ আমার নিজস্ব গোপন অনুভূতি।
(আগামী বুধবার তুরস্ক)