জেলা সম্পাদককে সরানোর চেষ্টা! রবীন দেবকে বার্তা, তাঁর ঘনিষ্ঠ নেতার বিরুদ্ধে কমিশন গড়ল পূর্ব মেদিনীপুর সিপিএম
এ যেন সরাসরি চ্যালেঞ্জ ৩১ আলিমুদ্দিন স্ট্রিটকেই। আর চ্যালেঞ্জ জানালো কিনা পূর্ব মেদিনীপুর জেলা সিপিএম!
আলিমুদ্দিনের শীর্ষ নেতাদের ঘনিষ্ঠ রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য, সম্প্রতি দলের কেন্দ্রীয় কমিটিতে জায়গা পাওয়া রবীন দেবের অত্যন্ত কাছের হলদিয়ার এক সিপিএম নেতার বিরুদ্ধে তদন্ত কমিশন গঠন করল পূর্ব মেদিনীপুর জেলা পার্টি। পূর্ব মেদিনীপুরের সিপিএম সম্পাদকমণ্ডলী সম্প্রতি হলদিয়ার নেতা শ্যামল মাইতির বিরুদ্ধে এক সদস্যের তদন্ত কমিশন গঠন করেছে, যা ওই জেলার আপামর সিপিএম নেতা-কর্মীর কাছে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ব্যাপার। কারণ, রবীন দেব এই মুহূর্তে রাজ্য পার্টির পক্ষ থেকে পূর্ব মেদিনীপুর জেলার দায়িত্বে। এবং তাঁরই অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ নেতার বিরুদ্ধে তদন্ত কমিটি গড়া যে রবীন দেবের বিরুদ্ধেই সরাসরি অনাস্থা প্রকাশ তা ভালোভাবেই বুঝতে পারছে মুজফফর আহমেদ ভবন। শুধু যে শ্যামল মাইতির বিরুদ্ধে তদন্ত কমিশন গড়া হয়েছে তাই নয়, রবীন দেবকে পূর্ব মেদিনীপুরের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়ার দাবিও তুলছেন ওই জেলার কোনও কোনও নেতা।
কিন্তু কবে, কীভাবে এই গোটা ঘটনার সূত্রপাত? কী কারণেই বা কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য রবীন দেবের ঘনিষ্ঠ এই নেতার বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করার এমন নজিরবিহীন পদক্ষেপ নেওয়ার হিম্মত দেখাল পূর্ব মেদিনীপুর জেলা সিপিএম?
সূত্রের খবর, দলের মধ্যে উপদল করাসহ একাধিক অভিযোগের জেরে বেশ কিছু বছর আগে হলদিয়ার প্রাক্তন যুব নেতা শ্যামল মাইতির বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নিয়েছিল পূর্ব মেদিনীপুর পার্টি। তখন জেলার সর্বেসর্বা ছিলেন লক্ষ্মণ শেঠ। সেই সময় আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের পক্ষ থেকে পূর্ব মেদিনীপুরের দায়িত্বে ছিলেন সূর্যকান্ত মিশ্র এবং দীপক দাশগুপ্ত। ২০১৪ সালে রবীন দেবকে ওই জেলার দায়িত্ব দেওয়া হয়। রবীন দেব দায়িত্ব পাওয়ার পরই দলে প্রত্যাবর্তন ঘটে শ্যামল মাইতির। এবং দ্রুত উত্থান শুরু হয় দলের মধ্যে। জায়গা পেয়ে যান দলের জেলা সম্পাদকমণ্ডলীতেও। সম্প্রতি নামে এবং বেনামে পূর্ব মেদিনীপুর জেলা পার্টি এবং আলিমুদ্দিন স্ট্রিটে একাধিক অভিযোগ জমা পড়ে শ্যামল মাইতির বিরুদ্ধে। জেলার জনৈক সিপিএম নেতা সতীনাথ চক্রবর্তীসহ একাধিক ব্যক্তি অভিযোগ করেন, দলের হোল টাইমার হওয়া সত্ত্বেও শ্যামল মাইতি হলদিয়ায় পরিবহণ, ঠিকাদারি, কারখানায় জিনিসপত্র সাপ্লাইসহ নানা ধরনের ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত। যা দলের ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্থ করছে। এই ধরনের একাধিক অভিযোগ জমা পড়ার পর জুলাই মাসে শেষ দিকে পূর্ব মেদিনীপুর জেলা সম্পাদকমণ্ডলীতে তাঁর বিরুদ্ধে তদন্ত কমিশন গড়ার সিদ্ধান্ত হয়। জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য কাঞ্চন মুখার্জি তদন্ত শুরু করেন।
কিন্তু এই গোটা ঘটনায় রবীন দেবের যোগ কোথায়? এমন দু’পাঁচটা তদন্ত কমিশন তো বিভিন্ন জেলা কমিটি মাঝে-মধ্যেই করে থাকে। সেগুলির সঙ্গে এই ঘটনার পার্থক্যই বা কী? আলিমুদ্দিন স্ট্রিট এবং পূর্ব মেদিনীপুর জেলা সূত্রে খবর, এই ঘটনার তাৎপর্য অনেক গভীরে।
গত বছর সেপ্টেম্বর মাসে পুরনো একটি মামলায় গ্রেফতার হন পূর্ব মেদিনীপুরের সিপিএম সম্পাদক নিরঞ্জন সিহি। প্রায় আড়াই মাস জেলে থাকার পর তিনি জামিন পান। কিন্তু জামিন পেলেও তিনি জেলায় ঢুকতে পারবেন না বলে নির্দেশ দেয় আদালত। সূত্রের খবর, নিরঞ্জন সিহি জেলে থাকার সময়ই তাঁকে সম্পাদকের পদ থেকে সরিয়ে শ্যামল মাইতিকে পূর্ব মেদিনীপুরের সম্পাদক করার উদ্যোগ নেন রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য রবীন দেব। ২০১৮ সালের শুরুতে পূর্ব মেদিনীপুরে সিপিএমের জেলা সম্মেলন হওয়ার কথা ছিল। সূত্রের খবর, গত বছর নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে নিরঞ্জন সিহি যখন আইনি কারণে জেলার বাইরে, তখন রবীন দেব তাঁকে সম্পাদকের দায়িত্ব থেকে সরাতে তৎপর হন। সূত্রের খবর, পূর্ব মেদিনীপুরের পার্টি সেন্টারে কাজ করা এক জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্যসহ আরও দু’একজনকে রবীন দেব বলেন, নিরঞ্জন সিহি যখন জেলার বাইরে, তাঁকে সরিয়ে শ্যামল মাইতিতে সম্পাদক করা হোক। কিন্তু জেলার অন্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্যরা সঙ্গে-সঙ্গে রবীন দেবের এই প্রস্তাব খারিজ করে দেন। শ্যামল মাইতির বিরুদ্ধে একাধিক অভিযোগ থাকায় তাঁকে সম্পাদক করা যাবে না বুঝে এরপর খেজুরিরর নেতা হিমাংশু দাসকে জেলা সম্পাদক করতে সচেষ্ট হন রবীন দেব। কিন্তু তাঁর সেই চেষ্টাও খারিজ করে দেন জেলার অধিকাংশ সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য। তারপর যখন পূর্ব মেদিনীপুরে জেলা সম্মেলন হয়, সেখানে সূর্যকান্ত মিশ্র, বিমান বসু, রামচন্দ্র ডোমদের উপস্থিতিতে সর্বসম্মতিতে জেলা সম্পাদক নির্বাচিত হন নিরঞ্জন সিহি।
কিন্তু তারপর থেকেই নিরঞ্জন সিহিকে জেলা সম্পাদকের পদ থেকে সরানোর রবীন দেবের এই উদ্যোগকে ভালো চোখে দেখছেন না পূর্ব মেদিনীপুরের একাধিক সিপিএম নেতা। তাঁদের অনেকরই মতে, এটা কার্যত দলের মধ্যে বিভেদ তৈরি করার মতো বিষয়। সূত্রের খবর, সম্প্রতি শ্যামল মাইতির বিরুদ্ধে একাধিক জমা পড়ার পর আর সময় নষ্ট করেননি ওই জেলায় রবীন দেব বিরোধী নেতাদের একাংশ। রবীন দেবকে স্পষ্ট বার্তা দিতে তড়িঘড়ি কমিশন গড়া হয় শ্যামল মাইতির বিরুদ্ধে। এখন রবীন দেবকে পূর্ব মেদিনীপুরের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়ারও দাবি তুলছেন জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর গরিষ্ঠ অংশ। এই অবস্থায় রবীন দেব কীভাবে ওই জেলা চালাবেন তা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে আলিমুদ্দিন স্ট্রিটে।
Comments are closed.