গত কয়েক সপ্তাহ ধরে এ দেশের অন্তত বারোটি রাজ্যে এটিএমে নোটের আকাল সংবাদের শিরোনামে এসেছিল। বিমুদ্রাকরণের পর ডিজিটাল ইন্ডিয়ার অভূতপূর্ব অগ্রগতি নিয়ে প্রচার যখন তুঙ্গে তখন টাকার এই হাহাকার আরও একবার সরকারি বক্তব্যের অন্তসারশূন্যতাকে প্রকট করে দিল। কাগজী নোট নিজের আকাল ঘটিয়ে প্রমাণ করল, সে আজও মরেনি। আমরা জানলাম, এখন বাজারে নগদ টাকার পরিমাণ বিমুদ্রাকরণের সময়ের থেকে বেশি। টাকার জোগান আরও বাড়ানোর জন্য টাঁকশালের কর্মচারীদের ছুটি আপাতাত বাতিল। ওদিকে ক্যাশলেস ভারতের যে স্বপ্ন, তা আরও দীর্ঘায়িত হল।
রাজ্যগুলিতে নোটের এই অভূতপূর্ব আকাল বিমুদ্রাকরণের স্মৃতিকে আর একবার ফিরিয়ে নিয়ে এসেছে। নোটের এই আকালের পিছনে যে বিমুদ্রাকরণের বেশ কিছুটা ভূমিকা রয়েছে তা নিয়ে বিশেষজ্ঞ্ররা মোটামুটি একমত। এই সূত্রেই মনে পরে গেল কয়েক মাস আগে প্রকাশিত এক গবেষণাপত্রের কথা। বিমূদ্রাকরণের প্রভাব নিয়ে যে অল্প কয়েকটি সিরিয়াস লেখা বেরিয়েছে, এটি তার মধ্যে একটা। গবেষকেরা তাঁদের সমীক্ষাতে এমন কতগুলি আকর্ষণীয় তথ্য আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন, যা এর আগে কোনও আলোচনায় উঠে আসেনি। সাম্প্রতিক নোটের আকাল এই তথ্যগুলিকে সর্বসমক্ষে আনার সুযোগ করে দিল।
সমীক্ষাটির শুরুর দিকে এক ইটভাটার ম্যানেজারের কথা বলা হয়েছে। বিমূদ্রাকরণের সময় ইটভাটার মালিক তাঁর ম্যানেজারের হাতে ১২ লক্ষ টাকা দেন। মালিকের পরামর্শ মত এই টাকার একটি অংশ ম্যানেজার একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানে এই শর্তে লগ্নি করেন যে, সেই টাকা তারা কেবলমাত্র দলিতদেরই ঋণ হিসাবে প্রদান করতে পারবে। তবে এ ক্ষেত্রে শর্ত থাকবে, ঋণগ্রহিতারা সেই ঋণ দিয়ে শুধুমাত্র ছোট মালবাহী ভ্যান কিনতে পারবে আর সেই ভ্যানে শুধুমাত্র ওই ইটভাটার মালিকের ইট নিয়েই শহরে সরবরাহ করতে পারবে। টাকার আর একটি অংশ দেওয়া হয় একটি মহিলা সেলফ হেল্প গোষ্ঠীকে। এক্ষেত্রে শর্ত থাকে, ওই স্বনির্ভর গোষ্ঠীটি এর বদলে তাদের এলাকার নদীর বালি তোলার কাজে ওই ইটভাটার মালিককে সাহায্য করবে।
এই রকম আরও বেশ কয়েকজন ব্যবসায়ীর উপর সমীক্ষা করে দেখা যায়, যে কালো টাকার আবসান তো দূর অস্ত, বিমূদ্রাকরণের সময় কালো টাকার মালিকেরা তাদের হিসাব বহির্ভূত টাকা এমনভাবে খরচ করেন, যা পরবর্তীকালে একমাত্র তাঁদেরই ব্যবসাবৃদ্ধি ও সামাজিক প্রভাব বৃদ্ধিতে সহায়ক হয়ে উঠেছে।
গবেষকরা যে এলাকায় এই সমীক্ষাটি করছিলেন, সেখানকার দলিতদের মাত্র ৩৬ শতাংশের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট রয়েছে। বাঙ্কে না যাওয়ার পিছনে তাদের প্রধান যুক্তি এই যে, ব্যাঙ্কের কর্মচারীরা তাদের সাথে প্রায় কুকুর-ছাগলের মত ব্যবহার করেন। বিমূদ্রাকরণের সময় এই অসুবিধা আরও বেড়ে যায়। ফলত, ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থার প্রতি তাদের আস্থা আরও কমে যায়।
অপেক্ষাকৃত কম আয়যুক্ত পরিবারের মহিলারা তাঁদের নিজেদের বা স্বামীর অর্জিত টাকার একটি অংশ সঙ্গোপনে সরিয়ে রাখেন। তাঁদের স্বামীরা এই টাকা হাতে পেলে অচিরেই তা নেশার পেছনে খরচ করে ফেলেন। তাঁদের হাত থেকে সঙ্গোপনে সরিয়ে রাখা এই টাকা বাড়ি পাকা করা, বিয়ে বা অন্য কোনও পারিবারিক অনুষ্ঠানে লক্ষ্মীর ঝাঁপির কাজ করত। বিমূদ্রাকরণের সময় নিরুপায় হয়েই মহিলারা এই সঞ্চিত টাকা তাঁদের স্বামীদের হাতে তুলে দিতে বাধ্য হন। এর সামাজিক প্রভাব যে কোনও মতেই ভাল হয়নি তা বোধহয় বলার অপেক্ষা রাখে না।
বিমূদ্রাকরণের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল প্রাতিষ্ঠানিক আর্থিক ব্যবস্থার প্রসার। কিন্ত বিমূদ্রাকরণের সময় গ্রামগুলিতে নগদ অর্থের অভাবের কারণে অ-প্রাতিষ্ঠানিক ঋণের চাহিদা অনেকখানি বৃদ্ধি পায়। এই সময় বিভিন্ন ছোট-বড় সংস্থার মালিকেরা তাঁদের কর্মচারীদের সময় মত মাইনে না দিতে পারার কারনেও, এই অ-প্রাতিষ্ঠানিক আর্থিক ক্ষেত্রগুলির প্রসার আরও ত্বরান্বিত হয়। দলিতদের মধ্যে অ-প্রাতিষ্ঠানিক ঋণ গ্রহণের প্রবণতা ছিল অন্যদের তুলনায় বেশি।
সমীক্ষাটিতে লব্ধ ফলাফলগুলি আমাদের কতগুলি সত্যের সামনে দাঁড় করিয়ে দেয়। আমরা যাঁরা মূলত শহর বা শহরতলির বাসিন্দা তাঁরা আমাদের সমাজকে যেভাবে দেখতে অভ্যস্ত, বৃহত্তর ভারতের চারিদিকে ছড়িয়ে থাকা সামাজিক সম্পর্কের জালগুলি তার তুলনায় অনেক জটিল। তাই কোনও নীতি গ্রহণের আগে বা তার সম্ভাব্য ফল সম্পর্কে ধারনা করার আগে আমাদের এই সামাজিক বৈচিত্রের প্রকৃতি সম্পর্কে আরও বেশি ওয়াকিবহাল থাকা প্রয়োজন।
বিমূদ্রাকরণের ব্যর্থতার পিছনেও এই অজ্ঞতা একটি বড় ভুমিকা গ্রহণ করেছিল। কয়েক বছর আগে অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় এবং এস্থার ডুফ্লোর লেখা ‘পুয়োর ইকোনমিক্স’ বইটিতে লেখকদ্বয় দেখিয়েছিলেন, কী কারণে আমাদের কোনও নীতি গ্রহণের সময় তাকে আঞ্চলিক বা সামাজিক সম্পর্কের নিক্তিতে বিবেচনা করে ক্ষেত্রভেদে পরিবর্তিত ও পরিশোধিত করে নিতে হয়। দুঃখের কথা এই সত্য ভুলে গিয়ে ‘এক ভারত এক নীতি’ তৈরির স্বপ্নে সরকার আজ বিভোর। এর আবশ্যম্ভাবী কুফলগুলি কিন্তু একে একে দৃশ্যমান হতে শুরু করেছে।
(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)