‘তুমি একটা ভালো কাকু’, মুন্নির এই ডাক আমাদের সমাজের মুখে যেন একটা জোর থাপ্পড়! এক সাংবাদিকের নির্মম অভিজ্ঞতা

শুক্রবারের গুমোট দুপুর। থানার চেয়ারে বসে তদন্তকারী অফিসারের অপেক্ষা করছি। যে মামলা প্রসঙ্গে অফিসারের কাছে এসেছি, তা এখনও বিচারাধীন। তাই মামলার ব্যাপার এখন খোলসা করতে পারব না। তো প্রতি সপ্তাহে একবার করে আমাকে এই থানায় আসতে হয়। এদিনও ছিল তেমনই একটা দিন। থানায় যে চেয়ারটিতে বসেছিলাম, সেটা আমার খুব চেনা। আগে বহুবার জিজ্ঞাসাবাদ পর্ব শুরুর আগে এখানে বসে অপেক্ষা করেছি। ওই চেয়ারে অপেক্ষারত আমি অল্প সময়ের জন্য সব কিছু থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে অন্তর্দর্শনে ব্যস্ত থেকেছি। কোনও স্টোরি বা নিউজ ব্রেকের মধ্যে আমি নেই এই সময়। এই বিচ্ছিন্ন সময়ে বসে নিজের সাংবাদিক জীবনের শুরুর কথা ভাবতাম। আর ভাবতাম সেখান থেকে কীভাবে ওই চেয়ারে বসে অপেক্ষা করছি আমি।
সেই মেয়েটি আমার পাশের চেয়ারে এসে না বসা পর্যন্ত ওই বিকেলটারও আমার কাছে আলাদা কোনও বিশেষত্ব ছিল না। একটা গাড় নীল ফ্রক, নাক-মুখ রুমালে ঢাকা মেয়েটি এসেছিল তাঁর বাবার সঙ্গে। ছোট্ট মুখখানা রুমালে এমনভাবে ঢাকা, মুখটাই প্রায় দেখা যাচ্ছে না। শুধু মেয়েটির কানে একজোড়া ছোট্ট দুল, কপালে কাজল টিপ আর ছোট করে কাটা চুল দেখতে পাচ্ছিলাম। তিনটে টানা চেয়ারের এক প্রান্তে বসেছিলাম আমি। মেয়েটি এসে বসেছিল ঠিক মাঝের চেয়ারটিতে। তার সঙ্গে ব্যাগটা আমার ও তার মাঝখানে সুন্দরভাবে গুছিয়ে রেখে বসল সে। দেখতে পেলাম, এক বোতল জল আর একটা বিস্কুটের প্যাকেট রয়েছে ব্যাগে। মেয়েটির বাবা এগিয়ে গেলেন সামনের ডেস্কে বসা পুলিশ অফিসারের সঙ্গে কথা বলতে।
খানিকক্ষণ পরে তিনি ফিরে এসে যে চেয়ারের সারিতে আমরা বসেছিলাম, তার একেবারে ডানদিকে বসে মেয়েকে বললেন, ”মুন্নি জল খাবি?” মুন্নি হালকা মাথা নেড়ে জানাল ‘না’।
এই চেয়ারের সারিগুলির একটি পায়া এমনভাবে ভাঙা যে, চেয়ারে বসা সবাইকেই একইভাবে পিছনের দিকে হেলে বসতে হবে যাতে, চেয়ারের সারিটা না দুলে যায়। কেউই পড়বে না, কিন্তু হঠাৎ ঝাঁকুনি হলে অস্বস্তি আর পড়ে যাওয়ার ভয় তো থাকেই। মুন্নির বাবা অবশ্য চেয়ারের অবস্থার কথা জানতেন না। তিনি বসার সময় যেই একটু নড়াচড়া করলেন ওমনি দুলে উঠল চেয়ারগুলো। ছোট্ট মেয়েটি প্রায় সামনের দিকে ঝুঁকেই পড়েই যাচ্ছিল। চেয়ার থেকে ঝুলন্ত তার ছোট্ট পা মেঝের স্পর্শ করায় বেঁচে গেল। আমি আমার ডানহাতটা বাড়িয়ে দিলাম যাতে পড়ে না যায় মুন্নি। আর সঙ্গে সঙ্গে পিছন থেকে মুন্নির বাবা ধরে ফেললেন মেয়েকে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, ”ঠিক আছো?” ভাঙা চেয়ারের সারিতে বসে এটাই মুন্নির সঙ্গে আমার প্রথম কথা বলা। আমি তখনও বুঝিনি সে ব্যাকুলতায় ভরা এক চিরস্মরণীয় অভিজ্ঞতার সূত্রপাত।
আমাদের বাঙালিদের মধ্যে সম্পর্ক চটজলদি গড়ে ওঠে। যতক্ষণ অপরদিকের মানুষটির সঙ্গে না আলাপ হচ্ছে, ঠিক ততটা সময় আপনি তাঁর কাছে অপরিচিত। কিন্তু মিনিট পাঁচেকের কথাবার্তায় আপনিই হয়ে যাবেন ‘দাদা’, ‘দিদি’, ‘কাকু’, ‘কাকিমা’ ইত্যাদি। আর সেই সম্বোধন নির্ভর করবে আপনার বয়স, লিঙ্গ আর চেহারার উপর। ”আমি ঠিক আছি কাকু’…মুন্নি প্রথম আমার দিকে তাকিয়ে কথা বলল। আমি খেয়াল করলাম মুন্নির কাজল কালো, গোলগোল চোখের কোণ চিকচিক করছে। কালো গোল গোল চোখের কোণে আটকে থাকা পিঁচুটি, যেন কোনও আর্তনাদে ভেঙে পড়ার প্রতীক। তাঁর ভাসমান চোখে লুকিয়ে আছে যেন এক জলশূন্য মৃত সমুদ্রের গভীরতা, এক অব্যক্ত যন্ত্রণা।
পুলিশ অফিসারের ডাক পড়ল। মেয়ের হাতে নিজের মোবাইল ফোনটা গুঁজে দিয়ে মুন্নির বাবা উঠে গেলেন। মোবাইল কেমন করে ‘আনলক’ করতে হয় তা এতদিনে জানা হয়ে গিয়েছে ছোট্ট মেয়েটির। সে ফটাফট মোবাইল খুলে সোজা ইউটিউবে গিয়ে একের পর এক ভিডিওতে ক্লিক করে যাচ্ছিল। সার্চ হিস্ট্রি অনুযায়ী ইউটিউব পেজে রেজাল্ট চলে আসে। মুন্নিকে টাইপ করে কিছু খুঁজতে হল না। তার আগেই নিজের মনমতো জিনিস পেয়ে গেল সে- ‘কীভাবে কাগজের নৌকো বানাবে’। মুন্নির চোখ ভিডিওতে।
আমি খেয়াল করলাম মুন্নির চোখ থেকে কয়েক ফোঁটা কান্না ওর বাবার মোবাইল ফোনের স্ক্রিনে ঝরে পড়ল। কান্না ছলছলে মুন্নির চোখ। বেশ হকচকিয়ে গেলাম। শান্তভাবে ওকে জিজ্ঞেস করলাম, ”কী হয়েছে মা?” এক মহিলা কনস্টেবল ততক্ষণে মুন্নির কাছে এসে দাঁড়িয়েছেন। মাতৃস্নেহে মুন্নির পিঠ চাপড়ে দিলেন তিনি। তবে কোনও কথা বললেন না। আমিও চুপ করে আছি। নিজের ব্যাগ থেকে একটা চকোলেট বের করে মুন্নির দিকে এগিয়ে দিলেন সেই কনস্টেবল। মুন্নি-ও সঙ্গে সঙ্গে চকোলেটের মোড়ক খুলে ঝপ করে মুখে পুরে ফেললো। মুন্নির কান্না থামালো চকোলেট। এদিকে মুন্নির বাবার ফোনের ইন্টারনেট স্লো হয়ে গিয়েছিল। দেখলাম ইউটিউবের ভিডিওটা থেমে গিয়েছে। আমি পকেট থেকে আমার ফোনটা বের করে ইউটিউবে একটা ওয়াইল্ড লাইফ ভিডিও চালিয়ে মুন্নির চোখের সামনে রাখলাম। অমনি তাঁর হাতের ফোনটাকে সরিয়ে মুন্নির কান্নাভেজা চোখ নেমে এল পশুপাখির ভিডিওতে। যেন বরফ গলল… বাঘ, হাতি, অ্যামাজনের জঙ্গল, এমনকী অ্যানাকোন্ডার মাধ্যমে আমরা কথাবার্তা শুরু করলাম। মুন্নি আমায় জিজ্ঞেস করে যেতে থাকে আমি কখনও সিংহ দেখেছি কিনা, দেখলে তা কত বড় ছিল। তারপর হঠাৎ আমায় প্রশ্ন করল, ”তুমি জানো কাগজের নৌকো কেমন করে বানায়?” আমি বললাম, হ্যাঁ জানি তো। এরপর আবার গল্প অন্যদিকে ঘুরল। সরকারি স্কুলের পঞ্চম শ্রেণির পড়ুয়া মুন্নি বলে যেতে থাকে তার গ্রামের নাম, বন্ধুদের নাম, স্কুলের নাম ইত্যাদি। জানায়, বাড়ির একমাত্র খুদে সে, মায়ের চেয়ে বাবাকে বেশি ভালোবাসে। কারণটা হল, মা যখন তখন তাঁকে বকাবকি করেন। কিন্তু বাবা একেবারেই উল্টো। জানতে চাইলাম, করোনার জন্য স্কুল তো এখন বন্ধ। খেলাধুলো কিছু করা হয় নাকি? আমাদের কথাবার্তার মধ্যে এই প্রথমবার হাসির রেখা ফুটে উঠল মুন্নির মুখে। বলল, কিতকিত খেলি। কীভাবে প্রিয় বন্ধুকে কিতকিত খেলায় হারিয়েছে সানন্দে বলে যায় ছোট্ট মেয়েটি। মুন্নি জানায়, ছবি আঁকতে সে ভীষণ ভালোবাসে। এবারের জন্মদিনে তো একটা মোম রঙ গিফট করেছে বাবা। কোন রং সবচেয়ে প্রিয়? জিজ্ঞেস করতেই মুন্নির তুরন্ত জবাব, ‘হলুদ’। তারপর না জিজ্ঞেস করলেও মুন্নি তার প্যাস্টেল বক্সে থাকা সব রংয়ের কথা হুড়মুড়িয়ে বলে যায়। একটু আগে যে মেয়েটা কেঁদেকেটে একসা হচ্ছিল, সে এখন কত সহজে গল্প করছে! এটাই শিশুমন, মনে মনে ভাবলাম।
আমাদের গল্পগুজব চলছে। এই সময় মহিলা কনস্টেবলের একটা কথা কানে ভেসে এলো আমার। ”হ্যাঁ স্যার, আমি ওকে মেডিক্যালের (পরীক্ষা) জন্য নিয়ে যাচ্ছি।”
‘মেডিক্যাল’! খট করে শব্দটা মাথায় লাগল আমার। একটা খোঁচা লাগল। কিছুক্ষণের জন্য মুন্নির সঙ্গে আমার গল্প থমকে গেল। আমি ফের যখন মুন্নির দিকে মনোযোগ দিতে গেলাম, ততক্ষণে সে তার নিজস্ব কোনও ভাবনায় মগ্ন হয়ে পড়েছে, কেমন যেন অন্যমনস্ক…
একটু বাদেই মুন্নির ডাক পড়ল। বাবা আর মহিলা কনস্টেবল সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন। মুন্নি আস্তে আস্তে তাঁর ব্যাগ গুছিয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়ল। বাবাকে তাঁর মোবাইল ফোন এগিয়ে দিল। আর আমাকে ভীষণ মিষ্টি করে টাটা বলল। কিন্তু কয়েক পা এগিয়েই থমকে গেল মেয়েটি। আমার দিকে ঘুরে প্রশ্ন করল, ”তোমার কোনও টিচার ছিল?” আমি সহজভাবে বললাম, ”হ্যাঁ অনেকে ছিলেন, আর তাঁরা সব্বাই আমাকে খুব ভালোবাসতেন।” মুন্নি বলল, আমার একজনই শিক্ষক ছিলেন। কিছুক্ষণ চুপ হল মুন্নি। যেন তার সরল ভাবনার রেলগাড়ি আচমকা লাইনচ্যুত হয়েছে অতীতের ধাক্কায়। নিজেকে একটু গুছিয়ে নিয়ে বলল, মাস্টারমশাইকে খুব ভালবাসতাম।
বলল, মাস্টারমশাই আমাকে কাগজের নৌকো বানানো শিখিয়েছিলেন। বাবা আবার ডাক দিলেন মুন্নিকে। আমাদের বাক্যালাপ অসম্পূর্ণ রেখেই মুন্নিকে পা চালাতে হল। হাত নেড়ে টাটা করলাম।
যে পুলিশ অফিসারের সঙ্গে মুন্নির বাবা কথা বলছিলেন, কিছুটা কৌতূহল নিয়ে আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম, সব ঠিক আছে? তিনি বললেন, মুন্নি শারীরিক নির্যাতনের শিকার। আর অভিযুক্ত হলেন মুন্নির সেই মাস্টারমশাই। কিছুক্ষণের জন্য যেন স্তব্ধ হয়ে গেলাম আমি। নিজের কানকেই যেন বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। মুন্নির কান্নাভরা চোখের মধ্যে অব্যক্ত যন্ত্রণার ইতিবৃত্ত আস্তে আস্তে আমার চোখের সামনে সাফ হয়ে যাচ্ছিল। বুঝলাম, বাবা যখন কয়েক মুহূর্তের জন্য তাঁকে এক অপরিচিত ‘কাকু’-র পাশে বসিয়ে রেখে উঠে গিয়েছিলেন, তখন কেন কেঁদে ফেলেছিল বাচ্চা মেয়েটি।
মুন্নিকে কাগজের নৌকো বানানো শিখিয়েছিলেন ওই গৃহশিক্ষক। ছোট্ট মুন্নি নাকি সেই মানুষটিরই যৌন লালসার শিকার! কিন্তু আমার মাথায় ঢুকছে না, আমার পাশে বসে ইউটিউবে কেন কাগজের নৌকো বানানোই দেখছিল মুন্নি? আর কেনই বা তা দেখতে দেখতে কেঁদে ফেলল? হতে পারে এখনও কাগজের নৌকো বানানোর কৌশল শিখতে পারেনি মুন্নি। নাকি ও মনে মনে ভাবছিল, এই কাগজের নৌকোর নীরব দর্শকের ভূমিকার কথা, যখন এক দৈত্য দিনের পর দিন তাঁকে তার সামনে অত্যাচার করে গিয়েছে? এই কাগজের নৌকো কি শিক্ষকের প্রতি মুন্নির ভালবাসা, আস্থা আর বিশ্বাসের প্রতীক? পুলিশ অফিসারের কাছে জেনেছিলাম, মুন্নির বয়স মাত্র ১১। তাঁর শিক্ষকের বিরুদ্ধে যৌন নির্যাতনের অভিযোগ দায়ের করেছেন মুন্নির বাবা। তাই মুন্নিকে এখন মেডিক্যাল চেক-আপ করতে নিয়ে যাওয়া হল।
এই পুরো সময়টা আমি নিশ্চুপ, নীরব ছিলাম। এই প্রথম কোনও পকসো সার্ভাইভারকে এত কাছ থেকে জানছি আমি। একটু আগে যে মুন্নি আমার কাছে আর পাঁচটা বাচ্চার মতো সহজ-সরল ছিল, ওয়াইল্ডলাইফ ভিডিও দেখে যার কান্না ভোলানো যেত, আর পাঁচটা শিশুর মতো যে রং নিয়ে কথা বলতে ভালোবাসে, যে চকোলেট খেতে ভালোবাসে। এখন সে আমার কাছে একজন পকসো সার্ভাইভার, এক নির্যাতিতা শিশু!
প্রায় ঘন্টাখানেক পর মুন্নিরা আবার থানায় ফিরল। আমাকে তখন জিজ্ঞাসাবাদ করছেন পুলিশ অফিসার। কিন্তু যে মুহূর্তে মুন্নি দিকে আমার চোখ গেল, নিজেকে সামলে রাখতে পারলাম না। অফিসারের কাছে কিছুক্ষণ সময় চেয়ে নিলাম আমি। চেয়ার থেকে উঠে মুন্নির বাবার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। তিনি হয়ত বুঝে ফেলেছিলেন যে, আমি মুন্নির কথা জেনে গিয়েছি। যদিও সাংবাদিক স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য ওনাকে প্রশ্ন করার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়িনি। আসলে আমি কোনও প্রশ্নই করিনি। কিন্তু মুন্নির বাবা নিজে থেকে বলতে শুরু করলেন। ” জানেন, ও আমার একটিমাত্র মেয়ে। প্রচণ্ড বিশ্বাস করতাম ওই শিক্ষককে। আমার গ্রামেরই গ্র্যাজুয়েট ছেলে। আমার মেয়েও ওকে খুব ভালোবাসত, কাকু বলে ডাকত। কিন্তু কিছুদিন ধরে আমি লক্ষ্য করছিলাম, মুন্নির ক্লাসে যেতে অনীহা। জেদ করছিল। এদিকে কেন যাবে না, সেটাও বলতে চাইত না। ওর মা বাড়ির কাজে ব্যস্ত থাকেন। আমিই মেয়ের সবচেয়ে কাছের, আমার কাছেই ওর সমস্ত বায়না। খেয়াল করলাম, ওকে আদর করতে গেলে নিজের পা চেপে রাখত। মাঝরাত্রে আচমকা ঘুম থেকে উঠে কাঁদতে শুরু করল একদিন। তারপর একদিন আমায় বলল কীভাবে ‘কাকু’ ওকে ছুঁত। ওর নিষ্পাপ মন তো বুঝতে শেখেনি ওর সঙ্গে কী হয়েছে। সেসব গুছিয়ে বলতেও পারে না। আমিও বলতে পারব না আমার মেয়ের সঙ্গে কী হয়েছে। বলতে বলতে কেঁদে ফেলেন মুন্নির বাবা।
জানলাম, মুন্নির বাবা ওই শিক্ষকের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলতেই গোটা গ্রাম দ্বিখণ্ডিত হয়ে যায়। অভিযুক্তের পরিবারের তরফে হুমকি আসে। সবাই মিলে একঘরে করে দেয় মুন্নির পরিবারকে। গ্রামাঞ্চলে এই ধরনের ঘটনা নিয়ে এক অদ্ভুত লুকোছাপা, জড়তা থাকে। অনেকে পুলিশের কাছে অভিযোগ জানাতে চান না, লুকিয়ে রাখেন। মেয়ে কিছু বললে সেসব বেমালুম চেপে যায় বাড়ির বড়রা। যদিও মেয়ের পাশে দাঁড়িয়ে মুন্নির বাবা থানায় যেতে দু’বার ভাবেননি। এর মধ্যে ওই শিক্ষকের খোঁজে গ্রামে গিয়েছিল পুলিশ। কিন্তু অভিযুক্ত ঘরছাড়া হওয়ায় সন্ধান মেলেনি।
মুন্নির বাবা যখন এই ঘটনার কথা বলছিলেন, দেখলাম পাশে দাঁড়ানো পুলিশ অফিসারের চোখে জল। তিনি মুন্নির বাবাকে কথা দিলেন, ওই শিক্ষকের সন্ধান মিলবেই, ন্যায্য বিচার পাবে মুন্নি।
আমাদের কথাবার্তা যখন চলছে, মুন্নি তাঁর নতুন ভালোলাগার জিনিস খুঁজে পেয়েছে। থানার সামনে একটা বাগান ছিল। দেখলাম, মুন্নি একমনে সন্ধ্যের হাওয়ায় গোলাপি রংয়ের গোলাপ ফুলের পাঁপড়ি ঝরা দেখছে। আমি ধীরে-ধীরে ওর কাছে গিয়ে হাঁটু গেড়ে বসলাম। একটা কথাও বলতে পারিনি আমি। আমার ভিজে যাওয়া চোখ নিজের ছোট্ট আঙুলগুলো দিয়ে মুছে দিল মুন্নি। ওর ছোঁয়ায় আমার নিজের ভাইপোর কথা মনে পড়ল। আমাদের পরিবারের একমাত্র খুদে সদস্য সে। ভাবলাম, আজ মুন্নির জায়গায় যদি আমার ভাইপো হত? মুন্নিকে ভীষণভাবে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করল। কিন্তু পরিবারের বাইরে কারও ছোঁয়া ওর কেমন লাগতে পারে, এইসব ভেবে চাইলেও আমি ছোট্ট মুন্নিকে জড়িয়ে ধরতে পারলাম না। থানা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় মুন্নির একটা কথা আমার কানে বাজে-”তুমি একটা ভালো কাকু।”
NCRB এর রিপোর্ট বলছে, ২০১৮ সালে ২,২৪০ টি পকসো (POCSO) কেস রুজু হয়েছে শুধু পশ্চিমবঙ্গেই। নির্যাতিতার সংখ্যা ২,২৪৬ জন। যদিও থানায় দায়ের না হওয়ায় এমন আরও কত ঘটনা অজ্ঞতা, কুসংস্কার ইত্যাদির ফলে আমাদের অজানাই থেকে গিয়েছে। পুলিশের নজরে আসেনি। শিকারিদের হাতে ছিনতাই হওয়া শৈশবের দিনগুলো হারিয়ে যাবে। কিন্তু সেই করুণ গল্পগুলো হারাবে না। থানা থেকে বেরিয়ে আসার সময় আমার চোখে পড়ল থানার ভিতর একচিলতে ‘চাইল্ড-ফ্রেন্ডলি কর্নার’ আছে। অর্থাৎ, শিশুদের জন্য নির্ধারিত একটা জায়গা। আর তাতে সাজানো আছে খেলনা, টেডি বিয়ার ইত্যাদি। দেওয়াল জুড়ে সাঁটানো অতি পরিচিত সব কার্টুন। শিশু বয়সের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে একটা পরিবেশ তৈরির চেষ্টা আর কী। কাটখোট্টা পুলিশি কার্যালয়ে একটা মানবিক ছোঁয়া। কিন্তু ভাগ্যের পরিহাস এমনই যে থানায় এই রকম কোণেই পৈশাচিকতার শিকার হয়ে বসতে হয় মুন্নির মতো কত সহস্র শিশুকে। কিন্তু ওই শিশুদের অনেককেই কী অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে যেতে হয় তা বোঝার মতো বোধ আমাদের আছে কি? ন্যায় বিচার পেলেও তাঁদের মন থেকে এই ভয়ংকর অতীতটা মুছে দেওয়া যায় কি? তাঁরা কি পারে আবার কোনও পরিচিত কাকুকে সমানভাবে ভালোবাসতে, বিশ্বাস করতে?

থানা থেকে ফেরার সময় সেই চেয়ারগুলোর কাছে পৌঁছলাম। অন্যান্য দিনের থেকে আজকের পার্থক্য হল, থানা ছেড়ে যাওয়ার পরেও একটা ভাবনা আমার মধ্যে থেকে যাবে। আর একটা কথা আমাকে কুরেকুরে খাচ্ছিল- কীভাবে মুন্নির জীবন শুরু হয়েছিল আর কীভাবে ফুলের মতো একটি মেয়ে আমার পাশে, এই থানার চেয়ারে এসে বসেছিল। কী পরিণতি! ‘ভালো কাকু’, এই শব্দ দুটো আমার মোটেই প্রশংসাসূচক সম্বোধন মনে হয়নি। মনে হল, এই আমাদের সমাজের মুখে যেন একটা জোর থাপ্পড় এই ডাক। আমাদের মনে করিয়ে দেয়, কীভাবে এবং কেন একটি বাচ্চাকে ভাল এবং খারাপ স্পর্শের পার্থক্য শেখাতে হয়। এটাই জরুরি সত্য এবং নোংরা বাস্তব।

(নির্যাতিতা শিশুর নাম পরিবর্তিত এবং সনাক্তকরণের কোনও বিবরণ প্রকাশিত হয়নি)

(মূল প্রতিবেদনটি গত ৬ জুন timesnownews.com ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হয়, প্রতিবেদনটি লিখেছেন ওই সংবাদমাধ্যমের স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট তমাল সাহা)

Comments are closed.