কলকাতার পুলিশ কমিশনার হগ সাহেবের মার্কেটে কমলালেবু আসতো প্যালেস্টাইন থেকে, বেকারি খুলেছিলেন বাগদাদের নাহুম পরিবার
আচ্ছা, কলিমুদ্দিনের কথা মনে করতে পারছেন? নিউ মার্কেটের কলিমুদ্দিন, যিনি কিনা ডালমুট বিক্রি করতেন, আর সেই ডালমুট খুব পছন্দের ছিল ফেলু মিত্তিরের। কিংবা ফেলু মিত্তিরের নিউ মার্কেট থেকে শীতের পোশাক কেনা! এরকম কতই না গল্প ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে নিউ মার্কেট জুড়ে। অসংখ্য দেশ-বিদেশের সিনেমার শুটিং হয়েছে এই নিউ মার্কেটে, শুধু তাই নয় একাধিক বাংলা সাহিত্যেও নিউ মার্কেটের প্রসঙ্গ এসেছে বারেবারে। রবীন্দ্র সাহিত্যে উল্লেখ আছে, বড় পরিবারের মহিলারা নাকি নিউ মার্কেট আসতেন ফল কিনতে। কিংবা রাজশেখর বসুর ‘বিরিঞ্চি বাবা’, যেখানে বলা হয়েছে, যদি খোঁজ করা যায় তাহলে হয়ত নিউ মার্কেটে জলহস্তীর মাংস পর্যন্ত পাওয়া যেতে পারে। বুদ্ধদেব গুহ তাঁর ‘হেমন্তবেলায়’ ঘটনার পরিপ্রক্ষিতে নিউ মার্কটের উল্লেখ করেন। সত্যজিৎ রায়ের ‘নেপোলিয়নের চিঠি’র রহস্যের কেন্দ্রবিন্দু তো সেই নিউ মার্কেটের তিনকড়ি বাবুর পাখির দোকান। তাছাড়াও সত্যজিৎ রায় বহু লেখায় বারবারই নিউ মার্কেটের প্রসঙ্গ টেনে এনেছেন। নিউ মার্কেট শুধু একটা সাধারণ বাজার নয়, বাঙালির কাছে নস্টালজিয়া, ঐতিহ্য, অহংকারও বটে। দেশ-বিদেশের পর্যটকরা কলকাতায় এসেছেন, অথচ নিউ মার্কেট দেখেননি, এমন সংখ্যাটা নেহাতই হাতে গোনা।
নিউ মার্কেট মানে শুধুই কি শপিং? না। এর বাইরে নিউ মার্কেটর অন্য একটা দিকও আছে যেটা আমাদের অনেকের কাছেই হয়তো অজানা। নিউ মার্কেটের পরতে পরতে রয়েছে ইতিহাস। কলকাতার সে ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে আছে ব্রিটিশ শাসনকালের এক অধ্যায়, বাঙালি উচ্চ-মধ্যবিত্তের জীবনযাত্রা থেকে শুরু করে হাল আমলের নানান কাহিনি। কোলাহল দূরে সরিয়ে রেখে যদি একটু শান্তভাবে সেই ইতিহাস অনুভব করার চেষ্টা করা যায়, তাহলে আপনি এখনও হয়ত ঘোড়ার গাড়ির আওয়াজ শুনতে পাবেন নিউ মার্কেটের দরজায় দাঁড়ালে। কথায় আছে, মেমসাহেবরা নাকি ঘোড়ার গাড়ি চেপেই নিউ মার্কেটে আসতেন শপিং করতে।
১৮৫৭ সালে সিপাহি বিদ্রোহের পর ভারতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনের অবসান ঘটে। ১৮৫৮ সালে আইন পাশ করে ভারত শাসনের অধিকার সরাসরি হাতে তুলে নেন ইংল্যান্ডের রাণী। কলকাতায় ইংরেজদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে। তখন তাঁদের সুবিধার জন্য প্রয়োজন ছিল একটি সুসংগঠিত বাজারের। বাজারের জন্য বেছে নেওয়া হয় এই চত্বরটিকে। এপ্রসঙ্গে বলে রাখা ভালো, ১৮৬৬-৭৬, এই সময়ে কলকাতার পুলিশ কমিশনার ছিলেন স্যর স্টূর্য়াট হগ আর পদাধিকার সূত্রেই তিনি ছিলেন কলকাতা মিউনিসিপালিটির চিফ এক্সিকিউটিভ অফিসার। হগ সাহেবের তৎপরতায় এই মার্কেট নির্মাণ শুরু হয়েছিল। মার্কেট তৈরির জন্য জমির দাম বাবদ ২ লক্ষ টাকা এবং নির্মাণের খরচ বাবদ ২.৫ লক্ষ টাকা ধার্য করা হয় সে যুগে। নির্মাণের দায়িত্ব দেওয়া হল ম্যাকিনটোশ বার্ন কোম্পানিকে। রিচার্ড রসকেল বেইন ছিলেন তখনকার খ্যাতনামা স্থপতি, যিনি তখন ইস্টার্ন ইন্ডিয়ান রেল কোম্পানিতে কর্মরত। বেইন সাহেবকে নকশা প্রস্তুতের দায়িত্ব দেওয়া হল। বিট্রেনের রেলের প্ল্যাটফর্মের আদলে নকশা বানালেন তিনি, যা অনেকাংশে হাওড়া স্টেশনের মতো দেখতে। নকশা বানানোর পারিশ্রমিক হিসাবে পেলেন প্রায় এক হাজার টাকা, যার তৎকালীন বাজার মূল্য ছিল অনেক।
সালটা ১৮৭৪। নতুন বছরের প্রথম দিনে সবার জন্য খুলে দেওয়া হল নিউ মার্কেট, তখন অবশ্য ক্রেতা বলতে শুধুই ছিলেন ব্রিটিশরা। হগ সাহেবের অক্লান্ত পরিশ্রম আর অদম্য উৎসাহ মার্কেট গড়ে ওঠার অন্যতম কারণ, আর সেই জন্যই নির্মাণের ২৮ বছর পর ১৯০৩ সালের ২রা ডিসেম্বর এই মার্কেটের নামকরণ করা হয় ‘হগ মার্কেট’। অবশ্য তৎকালীন বাঙালি সমাজের কাছে যা পরিচিত ছিল ‘হগ সাহেবের মার্কেট’ নামে। এরপরে অবশ্য প্রয়োজনের তাগিদে মার্কেটের সম্প্রসারণ করা হয়েছিল। ১৯০৯ সালে ৬ লক্ষ টাকা ব্যয় করে বর্তমান নিউ মার্কেটের উওর অংশ গড়ে তোলা হয়। ১৯৩০ সাল নাগাদ ইংল্যান্ডের হার্ডাসফিল্ড থেকে এক বিশালাকৃতি ঘড়ি নিয়ে এসে বসানো হল এই হগ মার্কেটে। কথায় আছে, পৃথিবীর মাত্র দু-জায়গায় এই একই রকমের ঘড়ি রয়েছে। প্রথমটি ইংল্যান্ড আর দ্বিতীয়টি কলকাতার নিউ মার্কেটে। কিন্তু কালের নিয়মে বর্তমানে ঘড়িটি বন্ধ। কারণ, রক্ষণাবক্ষনের অভাব, অকপট স্বীকারোক্তি সুকুমারবাবুর। পুরো নাম সুকুমার রায়। অল্প বয়সে ক্লক টাওয়ারে উঠে ঘড়িটি সামনে থেকে দেখেছেন তিনি। ঘড়ির বিশালাকৃতি যন্ত্রাংশ তাঁকে হতবাক করেছে। সুকুমার রায় এখন নিউ মার্কেটের শপকিপার ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের অন্যতম সদস্য। তাঁর নিজের দোকানও রয়েছে নিউ মার্কেটের পেছনের দিকে, যার বয়স মোটামুটি ১০০ বছর। সুকুমারবাবুর গলায় যথেষ্ট আক্ষেপ শোনা গেল, ‘আজকাল কলকাতা কর্পোরেশন ঠিকমতো পরিচর্যা করে না, রক্ষণাবেক্ষনের অভাবে ধুঁকছে মার্কেট। অনেক জায়গায় ছাদের অবস্থা বেশ ভয়ানক, যখন তখন বড়সড় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।
মার্কেটের শপকিপার ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক প্রদীপ চক্রবর্তী। তাঁর দোকানটি অবশ্য দুগ্ধজাত দ্রব্যের। দোকানটি ১৯৩৩ সালের, নিউ মার্কেটের অন্যতম পুরনো দোকান। পাশের দোকানটি প্রদীপ দের। প্রদীপবাবুর গলায় কিন্তু ইংরেজদের সম্পর্কে সুখ্যাতি শোনা গেল। তখনকার দিনে মার্কেটের ভিতর যাতে পাখি এসে না বসে তাই মার্কেটের উপর ছিল লোহার জালের বন্দোবস্ত। শুধু তাই নয়, ছিল আরথিং এর ব্যবস্থাও, যার নিদর্শন কিন্তু এখনও রয়েছে।
নিউ মার্কেটে কাঁচা আনাজের বাজারটি বেশ বড়। সব্জি মাণ্ডি হল পাইকারি বাজার, আর সব্জি পট্টি সাধারণ মানুষের জন্য। সব্জি পট্টি হয়ে সব্জি মাণ্ডি যেতে একটা সরু গলি পড়বে, সেই রাস্তার নাম প্রাইভেট রোড। কিন্তু এর আসল নাম দত্ত লেন। ১৬ নম্বর দত্ত লেনের বর্ধনদের বাড়িতে ২০০ বছর ধরে দুর্গা পুজো চলছে, যা এই এলাকার অন্যতম আকর্ষণ।
সব রকম নিত্যপণ্যের জন্য মার্কেটের বিভিন্ন অংশে আলাদা-আলাদা জায়গা করে দেওয়া হয়েছিল। এখনও সেই ট্র্যাডিশন চলে আসছে। ফলের জন্য আলাদা জায়গা, সব্জির জন্য আলাদা বাজার, মাংস এবং মাছ কিংবা মশলাপাতি, প্রত্যেকটি জিনিসের জন্যই আলাদা জায়গা রয়েছে নিউ মার্কেটে।
নিউ মার্কেটের ফলের সুখ্যাতি বহু দিনের। সন্দীপ চিনের ফলের দোকানের বয়স ১০০ বছর। ১৯১৮ সাল থেকে বংশ পরম্পরায় চলে আসছে। ১৯৩৫ সালের ক্যালকাটা মিউনিসিপাল গেজেটে দাবি করা হয়েছে, নিউ মার্কেটে কমলালেবু আসতো প্যালেস্টাইন থেকে। আমেরিকা থেকে আসত আপেল, লেবু আসত ইতালি থেকে, আর ফ্রান্স থেকে আমদানি হোত ফার্ন লিফ বিস্কুট।
বিফ রেঞ্জে আগে ছিল প্রায় ৮০ টি দোকান। এখন হাতে গোনা ১৬-১৭ টি রয়েছে। শেখ আলমগীরের দোকানের বয়সও ১০০ ছুঁই ছুঁই, বাবা-ঠাকুরদার পর নিজেই মাংসের দোকান সামলাচ্ছেন। মাছ ছাড়া আবার বাঙালির চলে না, মাছের বাজারটিও বেশ বড় এখানে। গোলামের দোকান থেকে প্রায় হাজার চারেক ডিম বিক্রি হয় রোজ। বাবর আলি সরদারের পুরনো দোকান চকোলেট এবং কেক প্রস্তুতকারী সরঞ্জামের। এক সময় বেশ খ্যাতি ছিল।
কেক প্রস্ততকারক ‘নাহুমস অ্যান্ড সনস’কে এক সময় সারা কলকাতা এক নামে চিনতো। ১৯০২ সালে বাগদাদ থেকে কলকাতায় এসে নাহুম ইজরায়েল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এই বেকারির। বর্তমান মালিক আইজ্যাক নাহুম। চৌরঙ্গির বাসিন্দা অতসী গাঙ্গুলি, বছর চল্লিশের এই গৃহবধু ছোট বয়স থেকেই বাবার হাত ধরে নাহুমের ফ্রুট কেক খেতে আসতেন। এখন নিজের মেয়ের জন্য ফ্রুট কেক নিয়ে যান। স্বাদ এবং মানে সেদিন আর এদিনের মধ্যে কোনও তফাত তিনি খুঁজে পান না। নাহুমের রিচ ফ্রুট কেক খেতে চাইলে আপনাকে ৪০০ গ্রামের জন্য খরচ করতে হবে ৩০০ টাকা। চকোলেট ব্রাউনির দাম পড়বে ৪০ টাকা, লাইট প্লাম কেক ৪০০ গ্রামের দাম মাত্র ২৫০ টাকা। কোয়ালিটির সঙ্গে কখনও কম্প্রোমাইজ করে না নাহুম, কাস্টমার স্যাটিসফেকশনই তাঁদের প্রধান উদ্দেশ্য, জানালেন নাহুমের ম্যানেজার জগদীশ হালদার।
এছাড়াও আরও অসংখ্য দোকান ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে নিউ মার্কেটে। কী পাওয়া যায় না নিউ মার্কেটে? কথায় আছে, বাঘের দুধও নাকি চাইলে পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু বর্তমান ঝাঁ চকচকে শপিং মলগুলির সাথে পাল্লা দিতে অনেক ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়ছে নিউ মার্কেট, সেটা স্বীকারও করছেন দোকানের মালিকরা। সেদিনের মতো সেরকম বাজারও এখন আর নেই। গাড়ি পার্কিংয়ের অসুবিধার জন্য অনেকে মুখ ফিরিয়েছেন নিউ মার্কেট থেকে। লাইট হাউস, এলিট, গ্লোবের মতো সিনেমা হলগুলি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় নিউ মার্কেট চত্বরের জৌলুস কিছুটা হলেও কমেছে। বিদেশি ক্রেতা বলতে এখন বেশিরভাগই বাংলাদেশের নাগরিক।
কিন্তু দুর্গা পুজো ,ঈদ, বড়দিন কিংবা কোন উৎসব মানেই বহু বাঙালি এখনও একবার হলেও নিউ মার্কেটমুখী তো হবেনই। হয়তো নতুন প্রজন্ম এখন আর সেভাবে আসছেন না, কিন্তু হঠাৎ একদিন ঘুরতে-ঘুরতে যদি আপনি হাজির হয়ে যান হগ সাহেবের মার্কেটে, আপনারও মনে হতে বাধ্য, কলকাতার ঐতিহ্য নিয়ে বেঁচে থাকুক নিউ মার্কেট, আর নিউ মার্কেটকে নিয়ে বেঁচে থাকুক বাঙালি।
Comments are closed.