বাঙালির বড়দিন মানে কিন্তু হাঙ্গেরি থেকে কলকাতায় আসা কালমান সাহেবের ফ্রোজেন ফুড কিংবা বেকবাগানে চামনসের ফ্রেশ সসেজও
বাঙালির খাবারের বিভাজন তিনভাগে বিভক্ত, চব্য, চোষ্য আর লেহ্য। কিন্তু মাত্র এই তিন ধরনের মধ্যে বাঙালির খাবারের তালিকা বেশ লম্বা-চওড়া। ভোজন রসিক বাঙালি বরাবরই তার খাবার নিয়ে কম-বেশি অহংকারী। আসলে বাঙালির পাতে কোনও খাবার বাদ থাকে না যে! নীহাররঞ্জন রায় তাঁর বই ‘বাঙ্গালীর ইতিহাস, আদি পর্ব’তে বাঙালির খাদ্যাভ্যাসের বর্ণনা দিয়েছেন। অন্যদিকে, বাংলার অন্যতম প্রধান স্মৃতিকার ভট্ট ভবদেব বাঙালির খাবার নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে মনু-যাজ্ঞবল্ক্য-ব্যাস প্রমুখের কথা টেনে এনে বাঙালির মাংস প্রেমের কথার উল্লেখ করেন। শ্রীনাথচার্যও একইরকম বক্তব্যের অবতারণা করেছেন বটে। আবার একধাপ এগিয়ে জীমূতবাহন চর্বি ও তেলের কথা উল্লেখ করতে গিয়ে আমাদের স্বাদের ইলিশ মাছের তেলের কথা টেনে এনেছেন। ‘বৃহর্দ্ধম পুরাণে’ আমাদের পুঁটি মাছের উল্লেখ রয়েছে। শুধু কি তাই? মুকুন্দরাম চক্রবর্তী তাঁর ‘চণ্ডীমঙ্গল’ কাব্যে বাঙালির রকমারি খাবারের সন্ধান দিয়েছেন। ১৯৪৩ সাল নাগাদ সুকুমার সেন মহাশয় আমাদের খবারের একটি তালিকা প্রস্তুত করে গিয়েছিলেন, সেখানে কিছুই বাদ নেই আর কী !
সুলতানি যুগ, মোঘল যুগ বা তার পরে নবাবদের সময়ে থেকেই বাঙালির হেঁসেলে কিন্তু কাবাব জাতীয় খাবারের প্রবেশ ঘটতে থাকে। অযোধ্যার নবাব ওয়াজেদ আলি শাহ কলকাতায় এলে তাঁর সাথে সাথে নবাবের রাঁধুনিরাও কলকাতায় আসল, ফলে কলকাতা খাবারের দিক দিয়ে আরও সমৃদ্ধ হয়ে উঠল। এরপর পর্তুগিজ , ডাচ, ব্রিটিশ, ফরাসিদের রেসিপি আমাদের পাতে আসতে শুরু করে সপ্তদশ থেকে। কলকাতায় খাবারের বিশ্বায়নের ষোল কলা পূর্ণ হল।
ব্রিটিশরা পাকাপাকিভাবে কলকাতায় বাস করতে শুরু করলে বাঙালি নিজেকে জড়িয়ে ফেলল ইওরোপের খাবারের সঙ্গেও। সেকালে নামজাদা বাঙালি ব্যক্তিদের সাহেবরা নিজেদের খাবার চেখে দেখার জন্য নিমন্ত্রণ জানালেন, বাঙালি আপত্তি করল না। কেউ কেউ নাক সিঁটকালো ঠিকই, কিন্তু বেশিরভাগই গেলেন সাহেবদের পাড়ায় আর মজে গেলেন বিদেশি খাবারে। ব্যাস অমনি বাঙালি হইহই করে ছুটতে লাগল বিদেশি খাবারের দিকে। তাই বলে কি নিজেদের রেসিপি ভুলে গেল, সেটি কিন্তু নৈব নৈব চঃ। আসলে কখন যে কীভাবে বিদেশি খাবারগুলো আমাদের হেঁসেলে ঢুকে পড়ল সেই বির্তকে না যাওয়াই ভালো। বাঙালি নিজের মতো করে বানিয়ে নিল বিদেশি ডিস। আসলে এখানেই ঘটল মিশ্রণ।
সামনে আবার বড়দিন। এ শহরে প্রথম ব্রিটিশরা বড়দিন পালন শুরু করেছিল। আর আজ আমরা সেই বড়দিনকে মজ্জাগত করে নিয়েছি। এখানেই বাঙালিকে তার সম্প্রীতির জন্য বাহবা দেওয়া ছাড়া উপায় নেই আসলে। ক্রিসমাস উইকটা জুড়ে আমাদের ফেস্টিভ সিজন। যীশুর জন্মদিন উপলক্ষ্যে জার্মানিতে প্রথম কেক কাটার রেওয়াজ শুরু হয়। আমারা সেটাও মজ্জাগত করেছি আজ । কিন্তু শুধু কেকে বাঙালি থেমে থাকবে এরকমটা ভাবার কোনও কারণ নেই। বড়দিন বলে কথা, আর বাঙালির পাতে একটু সালামি, সসেজ, হ্যাম, বেকন উঠবে না, সেটা তো আর হতে পারে না। এসব কিন্তু আমরা সাহেবদের কাছ থেকে নিয়েছিলাম, আর এখন এর মাতামাতি দেখলে বোঝার উপায় নেই, এর উৎপত্তি কোথায়।
ফ্রেশ পর্ক, মানে গোদা বাংলায় বলতে গেলে টাটকা শুয়োরের মাংস পেতে চাইলে তো অগুনতি দোকান ছড়িয়ে রয়েছে কলকাতা শহরজুড়ে। কিন্তু মশাই একটু পুরনো দোকানের কথা যদি বলতে হয়, তাহলে যাঁরা জানেন তাঁদের মুখে প্রথমেই যে নামটা আসবে সেটা হল চামনস। পার্ক সার্কাস মার্কেটে প্রায় আট দশক ধরে একইভাবে বাঙালির রসনার চাহিদা পূরণ করছে এই চামনস। ‘চামনসের প্রতিষ্ঠা করেছিল আমার দাদু , তখন অবশ্য চামনস নাম হয়নি, এই চামনস নামটা আমার বাবার নামানুসারে। নয় নয় করে ৭৭-৭৮ বছর হয়ে গেল এই দোকানের’, জানালেন চামনসের বর্তমান মালিক দেবশংকর। এখানে আসলে আপনার বাসি মাংসের কোনও ভয় নেই। আপনার সামনেই দেবশংকররা সসেজ বানিয়ে দেবেন। তার জন্য অবশ্য আপনাকে একটু সময় হাতে নিয়ে আসতে হবে।
সসেজ তো এখন কলকাতা, শহরতলিতে মোড়ে-মোড়ে পাওয়া যায়। কিন্তু মাছ, মাংস কেনার মতো সসেজটাও যদি চোখের সামনেই তৈরি হতে দেখেন, তবে বাড়তি একটা ভরসা হয়, এই যা। আর এই ভরসাতে ভর করেই দূর-দূর থেকে ক্রেতা পাড়ার দোকান ছেড়ে চামনসে হাজির হন সসেজ কিনতে। দেবশংকর বললেন, ‘বড়দিনের আগে আমাদের খুব রাশ থাকে, অনেক অর্ডার থাকে যে। এবারের বড়দিনে আমরা একটা স্পেশাল আইটেম রেখেছি, চামনস স্পেশাল আইটেম বলতে পারেন। পর্ক এগ মিল্ক সসেজ, তা ছাড়াও সাধারণ সসেজ তো রয়েছেই’। বড়দিনের আগে এই চামনসের মেনুটা না হয় একবার দেখে নেওয়া যাক। পর্ক এগ মিল্ক উইথ সসেজের দাম পড়বে ৪২০ টাকা প্রতি কেজি, চিকেন পর্ক সসেজের দাম মাত্র ৩৭০ টাকা প্রতি কেজি। ফ্যাটলেস চপ আর স্পেয়ার রিবসের দাম ৩০০ টাকা প্রতি কেজি, পর্ক বেলি কিনতে গেলে আপনার পকেট থেকে খসবে ৩৩০ টাকা প্রতি কেজি। আসলে বাঙালি খাওয়ার সময় পকেটের দিকে অতটা নজর রাখে না, হ্যাঁ তবে খাবারের কোয়ালিটি ভালো হওয়া চাই। আর সেই কোয়ালিটির জন্যই তো এখনও এশহরের বুকে চামনসের মতো দোকান মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে রয়েছে।
এ না হয় গেল চামনসের গল্প। বড়দিন উপলক্ষ্যে বাঙালির ফ্রোজেন ফুড খাওয়ার প্রবণতা বাড়ে। আর এই ফ্রোজেন ফুডের কথা বলতে গিয়ে কালমানের কথা বলতেই হয় । হগ মার্কেট থেকে ফ্রি স্কুল স্ট্রিট অথবা মির্জা গালিব স্ট্রিটের দিকে গিয়ে খাদ্য ভবন থেকে ডানদিকে কিছুটা এগোলেই ১৮, মির্জা গালিব স্ট্রিটে রয়েছে কালমান। ছোট্ট একটা সরু দোকান, কিন্তু যা ভিড় সে গল্পে না যাওয়াই ভালো। আচ্ছা কালমানে ঠিক কী পাওয়া যায় তা বলার আগে না হয় এদের ইতিহাসটা একটু জেনে নেওয়া যাক।
কালমান শুরু হয়েছিল ১৯৪০ সাল নাগাদ, দোকানের প্রতিষ্ঠাতা কালমান কোহারি নামে এক হাঙ্গেরিয়ান। যিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শুরুতে কলকাতায় আসেন, এখানকার নাগরিকত্ব নেন। প্রথম দিকে অবশ্য কালমান কোহারি সার্কাসে ট্রাপিজের খেলা দেখাতেন। পরে এই দোকান খোলেন। কালমান সাহেবকে আজ আমরা ভুলতে বসেছি, আমাদের জানা নেই, তিনিই প্রথম ব্যক্তি যিনি কলকাতা শহরকে দেখান, কীভাবে মাংস প্রক্রিয়াকরণ করতে হয়। আসলে সেই সময় ইওরোপে খাদ্য প্রক্রিয়াকরণের প্রবণতা ছিল, আর এই খাস কলকাতায় সেই পদ্ধতি শুরু করেছিলেন কালমান সাহেব। তখন ব্রিটিশদের রমরমা ছিল এচত্বরে। আর কালমানের কাছেই তো ব্রিটিশরা একমাত্র সুস্বাদু বিদেশি খাবার পেতেন। ‘কালমান সাহেব মারা যান ১৯৬৮ সাল নাগাদ, তারপর তাঁর স্ত্রী কয়েকদিন এই দোকান চালান। তিনি যখন দেশে ফিরে গেলেন তখন এই দোকান বিক্রি করে গেলেন আমার জামাইবাবু বিষ্ণুপদ ধরকে। আমার জামাইবাবু আগে এই দোকানের ম্যানেজার ছিলেন। এখন মালিক বলতে আমার দিদি রুমা ধর। আমি আর দিদি মিলেই এখন এই দোকান সামলাচ্ছি’, জানালেন জয় ঘোষ।
এবার না হয় আসা যাক কালমানের লম্বা মেনুতে। প্রায় ৩৬ রকমের ফ্রোজেন ফুড বিক্রি করেন এঁরা। মানে কী চান আপনি? জিভে জল আনা সব কোল্ড কাটসহ বিভিন্ন ধরনের মাংস রয়েছে এখানে। বিশাল তালিকার মধ্যে যেমন রয়েছে পর্ক-চিকেনের হ্যাম ও সালামি, তেমনই রয়েছে ধোঁয়ায় পাকানো কোলবাশ বা হাঙ্গেরিয়ান সসেজ। রয়েছে অক্স টাং, হাঁসের মেটে দিয়ে ডাক লিভার পাটে। বেকন মিট লোফ, পর্ক চপ, কুকড হ্যাম, চিকেন মিট বল, লিন কুকড হ্যাম, মিট লোফ, রোস্টেড টার্কি প্রভৃতি। আর দাম একদম সাধ্যের মধ্যে। তবে হ্যাঁ, কালমান নিজেদের কোয়ালিটি নিয়ে কোনও কম্প্রোমাইজ করে না, জানালেন অরিজিৎবাবু। অরিজিৎবাবুর গলফ গ্রিনের কাছে ট্রাভেলিস্থান নামে একটা ক্যাফে আছে। বললেন, ‘জানেন ক্যাফে যখন শুরু করি, তখন খুঁজতাম কোথায় ভালো সসেজ, সালামি পাওয়া যাবে। তারপর এই কালমানের সন্ধান পাই। এদের ফুড কোয়ালিটি আসলে মারাত্মক ভাল।’ কালমানের ক্রেতার তালিকায় রয়েছেন কলকাতা শহরের অনেক নামজাদা মানুষজন। মেনু দেখার পর ভাবছেন, এবারের বড়দিনে না হয় একবার কালমানটা ঘুরে যাবেন! চলেই আসুন, তবে হ্যাঁ পকেট ভর্তি করে আসবেন, কারণ ফেরার সময় ব্যাগ ভর্তি খাবার নিয়ে যেতে হবে যে!
সামনে ক্রিসমাস, আস্তে আস্তে সেজে উঠছে আমাদের শহর, আর সেই সঙ্গে তৈরি হচ্ছে এই চামনস, কালমানের মতো দোকানগুলোও। কারণ একটাই, বড়দিন মানে তো সৈয়দ মুজতবা আলি পড়া বাঙালির কাছে মামুলি একটা কেক কাটার উৎসব নয়। বড়দিন মানে, বছরের শেষ থেকে নতুন বছরে জমাটি ঠান্ডায় রকমারি খাওয়ারেরও মরশুম। আর তা কি কখনও পুরো হতে পারে সসেজ, সালামি, হ্যাম ছাড়া।
Comments are closed.