পদত্যাগী আইএএস গোপীনাথন: তিনটে ফিক্সড ডিপোজিট ভাঙিয়ে চলছে, আর মাত্র দু’মাসের রসদ পড়ে আছে, তারপর ভাবব কী করব

কান্নন গোপীনাথন চিন্তিত মুখে ফোনে কথা বলছেন কেরলে তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে। বাড়ির পোষা কুকুর কামড়েছে কান্নন-পুত্রকে। ছেলেকে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাওয়ার আগে কান্নন তাঁর স্ত্রীকে বলছেন, কুকুরের ভ্যাকসিনেশনের তারিখ খুঁজে বের করতে।

কান্নন গোপীনাথন, সামান্য একটা ব্যাকপ্যাক সম্বল করে চলে এসেছেন কলকাতায়। সন্তোষপুরের একটি সাদামাটা ফ্ল্যাটে বসে কথা বললেন thebengalstory র সঙ্গে। অল ইন্ডিয়া পিপলস ফোরামের ডাকে দু’দিনের কলকাতা সফরে এসেছেন তিনি। স্কুটারের পিছনের সিটে বসে অনেকটাই চষে ফেলেছেন এই শহর। গত অগাস্টেই জম্মু-কাশ্মীরের মানুষের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হরণের প্রতিবাদে আইএএস পদ থেকে ইস্তফা দিয়েছেন। তারপর থেকেই মানবাধিকারের দাবিতে চলছে তাঁর ভারত ভ্রমণ।

প্রশ্ন: ৭ বছর চাকরি করে আইএএসের চাকরি ছেড়েছেন। এবার আপনি মানুষের সমস্যা, ইস্যুগুলোকে ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে চাইছেন। আপনার কি কখনও মনে হয়নি, আমলাতন্ত্রের মধ্যে থেকেও আপনি সমাজে পরিবর্তন আনতে পারতেন? আপনাদের মতো মানুষ ভরসা হারালে আমলাতন্ত্র চলবে কী করে?

গোপীনাথন: আসলে আমাদের দেশের আমলাতন্ত্র ভিতর থেকে ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ছে। সবচেয়ে বড় কথা, যদি ঠিকমতো কাজ না করানো হয় তাহলে আমলাতন্ত্র অত্যন্ত বিপজ্জনক একটা ব্যাপার হয়ে ওঠে। এর একমাত্র কারণ, আমলাতন্ত্র সহ সরকারি অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলোর হাতে প্রচুর ক্ষমতা দেওয়া থাকে। যদি কোনও সরকার মানুষের কাজে দুর্বল আমলাতন্ত্রকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ব্যবহার করে, তাহলে আখেরে গণতন্ত্রই দুর্বল হয়। যার পরিণামে গণতন্ত্র ভেঙেও পড়তে পারে।

প্রশ্ন: আমার মনে পড়ছে একজন আইএএস অফিসারের কথা। তিনি একবার তাঁর এক সহকর্মীকে নিয়ে রসিকতা করে বলেছিলেন, তিনি মন্ত্রীকে সামলাতে পারেন না। সেই ভদ্রলোকই বরাবর মন্ত্রীদের সঙ্গে লড়ে গিয়েছেন দুর্নীতির ইস্যুতে। আপনার কি মনে হয় না, ইস্তফা দেওয়ার বদলে, একজন আমলা হয়ে মন্ত্রীদের উপর প্রভাব বিস্তারের মাধ্যমে কাজ করিয়ে নেওয়াটাই বেশি কার্যকর?

গোপীনাথন: ব্যাপারটা দৃষ্টিভঙ্গির। আমার বিবেক কী বলছে তা আমাকে শুনতেই হবে। তারপর সিদ্ধান্ত নেব আমার নৈতিক অবস্থানের উপর দাঁড়িয়ে। ব্যাপারটা এরকম নয় যে, কাজ করতে গিয়ে আমাকে কোনও সমস্যার মুখে পড়তে হয়েছে। বরং বলতে পারি, আমার কাজের পরিসরটি যথেষ্টই ভালো ছিল। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকারের এক কলমের খোঁচায় কাশ্মীরে হাজার হাজার মানুষ মতপ্রকাশের অধিকার হারিয়ে ফেললেন। আপনি দেশকে ভালোবাসানোর জন্য সাধারণ নাগরিকের মাথায় বন্দুক ঠেকিয়ে হুমকি দিতে পারেন না।

১৯৪৭ সালের অগাস্ট নাগাদ যখন হায়দরাবাদ, জুনাগড় এবং কাশ্মীর ভারতের অন্তর্ভুক্ত হল, সর্দার বল্লভ ভাই প্যাটেল রাজ্যগুলোর অন্তর্ভুক্তির প্রয়াসটি এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। তিনি রাজন্যবর্গের কাছে আবেদন রেখেছিলেন, তাঁরা যেন রাজত্ব নিয়ে ভারতে অন্তর্ভুক্ত হন, যেখানে প্রতিরক্ষা, বিদেশ মন্ত্রকের ভার সরাসরি চলে যাবে ভারত রাষ্ট্রের হাতে। আপনি বলতেই পারেন, সর্দার প্যাটেলও তো বন্দুক তাক করেছিলেন। কিন্তু তা কখনওই নাগরিকদের দিকে নয়, ওই রাজ্যগুলোর রাজাদের দিকে। কিন্তু এখন কী হচ্ছে? আমরা দেখছি, এই দেশের বাসিন্দাদের মাথায় বন্দুক ঠেকানো হচ্ছে। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা ঘর থেকে বেরতে পারছেন না। সব ধরনের যোগাযোগ ব্যবস্থা থমকে রয়েছে। মানুষের দুর্দশা দিন দিন বাড়ছে। এই সিস্টেমের অংশ হিসেবে নিজের কাছে এই কাজের জবাবদিহি করতে হত। আমি তা করতে পারিনি।

প্রশ্ন: এই অবস্থায় একটা প্রশ্ন না করে পারছি না, রাজনীতিতে যোগ দিচ্ছেন কবে?

গোপীনাথন: এখনও সিদ্ধান্ত নিইনি। রাজনীতিতে যোগ দিতে আমি যে খুব উৎসুক, এমনটাও নয়। আমার মনে হয়, আমরা এখানে মূলধারার রাজনৈতিক দল এবং সংসদীয় রাজনীতিরই কথা বলছি। আসলে আমরা সংসদীয় বৃত্তের বাইরে মানুষ কী বলছেন কিংবা কী ভাবছেন, তাকে মোটেও পাত্তা দিই না। মানুষের কাজ হল সরকারকে প্রতিনিয়ত প্রশ্ন করে যাওয়া। আমি বুঝি না, কেন মানুষ সরকারের ক্ষেত্রে এতটা রক্ষণশীল মনোভাব নেয়। যেন তাঁর সদ্যোজাত শিশু! সরকারের হাতে প্রভূত ক্ষমতা এবং সম্পদ, তাহলে প্রশ্ন করতে সাধারণ মানুষের মধ্যে এত রক্ষণশীলতা কেন? পাশাপাশি, ভেবে দেখার সময় এসেছে, আমাদের কাজ কি কেবলই একটি সরকার নির্বাচন কিংবা ভোট দিয়ে তাকে ফেলে দেওয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ, নাকি এর বাইরেও একটা পরিসর আছে?
মূলধারার রাজনীতি নিয়ে আমার কতগুলো সমস্যা আছে। রাজনৈতিক দলগুলো সবচেয়ে বেশি কথা বলে এমন ইস্যুতে, যেগুলো মানুষের ভাবনার মধ্যেই নেই, যেমন জাতি, শ্রেণি কিংবা ধর্ম। অথচ কর্মসংস্থান, খাদ্য এবং অর্থনীতি নিয়ে তাদের মুখ থেকে একটা কথাও বেরয় না।

প্রশ্ন: একজন আইএএস অফিসার হিসেবে আপনি কাজ করতেন, যে পদ থেকে ইস্তফা দিয়েছেন। এখন আপনি নতুন চোখে দুনিয়া দেখছেন। পার্থক্য কিছু বুঝছেন?

গোপীনাথন: আগেও মানুষের সমস্যাই আমার চোখে পড়ত। আপনি যদি সরকারের অংশ হন, তাহলে সেই সমস্যাগুলোই আপনার কাছে পৌঁছবে খুব সাজনো গোছানো কায়দায়। আর মুদ্রার উল্টো পিঠে, সমস্যাগুলো বাস্তবিকই অনেক বেশি গোলমেলে ও ঝামেলাপ্রবণ। মানুষের যে কত কত শত সমস্যা। আসলে তাঁদের সেই সমস্যাগুলো থেকে মুখ ফিরিয়ে দেওয়ার একটা প্রক্রিয়া চলছে।
যখন নোটবন্দি হল, মানুষকে জিজ্ঞেস করা হচ্ছিল, আপনি কি সমাজ থেকে কালো টাকা মুছে যাক এটা চান না? স্বাভাবিকভাবেই উত্তর আসত, হ্যাঁ, অবশ্যই। কিন্তু প্রশ্ন করা উচিত ছিল, কালো টাকা আসলে কী? মানুষকে বোঝানো দরকার ছিল, কালো টাকা মানে সত্যিই কালো রঙের টাকা নয়, বরং সেই টাকার লেনদেন। লেনদেনের উপরই নির্ভর করে কালো টাকা কিংবা সাদা টাকা।

ইদানীং একটি প্রশ্ন খুব চলছে। তা এনআরসি সম্পর্কিত। প্রশ্ন করা হচ্ছে, আপনি কি চান না দেশ থেকে অনুপ্রবেশকারীদের বের করে দেওয়া হোক? এক্ষেত্রেও উত্তর আসছে, হ্যাঁ, অবশ্যই। কিন্তু আসল প্রশ্ন করা উচিত ছিল, কাগজপত্র না থাকলেই কি তাঁকে দেশ থেকে বের করে দেওয়া যায়? তখন কিন্তু উত্তরটা আর সহজ হ্যাঁ তেই আটকে থাকবে না। তখন মানুষ ভাবতে বাধ্য হবেন, ঠিক কী ধরনের নথি থাকা দরকার, এবং কেবলমাত্র সেই নথি দেখাতে না পারার অভিযোগে কাউকে অনুপ্রবেশকারী তকমা সেঁটে দেশ থেকে বের করে দেওয়াটা কতটা যুক্তিযুক্ত।
মানুষ যখন অনুপ্রবেশ করে, তখন প্রথম যে জিনিসটি তারা নিশ্চিত করে, তা হল সে দেশে থাকার প্রয়োজনীয় নথি। আর সাধারণ মানুষ, যারা দেশের প্রকৃত নাগরিক, তারা কিন্তু নথিপত্র নিয়ে মাথা ঘামায় না। কারণ তাদের সামনে আরও বড় চ্যালেঞ্জ। সেই চ্যালেঞ্জ কর্মসংস্থানের, সেই চ্যালেঞ্জ খাবার জোগাড়ের।

প্রশ্ন: আপনি বলছেন মানুষের সম্মিলিত শক্তির কথা। কীভাবে কোনও ব্যক্তি নিজের ক্ষমতায় কোনও কিছু করতে পারবেন বলে আপনার মনে হয়?

গোপীনাথন: এমন অনেক মানুষকে আমি নিজে জানি, যাঁরা হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে ফেক নিউজের বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে অপদস্থ হয়ে হাল ছেড়ে দিয়ে বসে আছেন। কিন্তু এই ছোট ছোট লড়াই থেকেও কেন আমরা মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছি? আমার তো মনে হয়, তাঁদের লড়াইয়ে থাকা উচিত। পালিয়ে না গিয়ে, হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে (তা সে পারিবারিক গ্রুপই হোক না কেন) থেকে শেষ পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যাওয়া উচিত। একজন মানুষের দৃঢ় কণ্ঠস্বর অনেক মানুষকে প্রভাবিত করতে পারে। মনে নেই, মুম্বইয়ের অ্যারেতে সবুজ বাঁচাও আন্দোলনকারীদের নাছোড় ধরনায় শেষ পর্যন্ত সুপ্রিম কোর্টকে হস্তক্ষেপ করতে হয়েছিল?
এই মুহূর্তে গোটা ব্যাপারটাই একটা রূপক প্রেক্ষাগৃহের আদল নিয়ে ফেলেছে। একমাত্র একটি গ্রুপের মানুষই কথা বলছে এবং সরকারকে তোষামোদ করে যাচ্ছে। বাকিরা উঠোন থেকে নিরুদ্দেশ। তাঁদের ফিরে আসতে হবে। সর্বোপরি প্রশ্ন করতে হবে।

প্রশ্ন: আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?

কান্নন: আমি সত্যিই জানি না। আমার তিনটি ফিক্সড ডিপোজিট ভাঙিয়ে এতদিন চলছিল। এখন আমার কাছে মাত্র দু’মাসের রসদ পড়ে রয়েছে। পেট চালাতে হয়ত আমাকে একটা চাকরি করতে হবে কিংবা এই সব থেকে দুরত্ব তৈরি করে একলাই নিজের কাজ করে যেতে হবে। এক জায়গায় আমি এই চাকরি করার কথাটা বলেছিলাম। তাতে এক মহিলা অত্যন্ত রেগে বললেন, যদি আরও একটি চাকরিই করতে হয়, তাহলে আগেরটা ছাড়লেন কোন সাহসে? কিন্তু তাও বলছি, এটা খুব একটা সহজ ব্যাপার না। জানেন তো, এমাসের শুরুতেই কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক আমার বিরুদ্ধে চার্জশিট পেশ করেছে…

ভবিষ্যতের পরিকল্পনা আমি এখনও করে উঠতে পারিনি। সারা দেশে ঘুরে বেড়াচ্ছি, এত কিছু জানছি, মানুষ আমার কথা শোনার জন্য আমন্ত্রণ জানাচ্ছে। বিতর্কে অংশ নিচ্ছি। এটা ঠিকই যে আমার যাতায়াত খরচ দিয়ে দিচ্ছেন উদ্যোক্তারা। কিন্তু এছাড়াও তো কিছু খরচ থাকে। আমি তো কোনও ধনী পরিবার থেকে আসিনি। ঘাড়ে অনেক পারিবারিক দায়িত্ব। আমাকে এসব কিছুই ভেবে দেখতে হয়। আশা করছি আগামী কয়েক মাসে ভেবে উঠতে পারব।

Comments are closed.