‘টোটে’ রেসকোর্সের সবচেয়ে চালু বেটিং, যা চার্চিল শুরু করেছিলেন ১৯২৮ সালে। কলকাতায় বেটিং শুরু ১০ টাকা থেকে
আমাদের দেশে বেটিং আইনসিদ্ধ না হলেও রেসের মাঠে কিন্তু বেটিং আইনত স্বীকৃত। কলকাতা রেসের মাঠে দু’প্রকারের বেটিং হয়। প্রথমটা টোটে (tote বা totaliser), যেটা ক্লাবের পক্ষ থেকে করা হয়, আর দ্বিতীয়টা হল লাইসেন্স প্রাপ্ত বুকমেকারদের কাছ থেকে বেটিং করা।
এক্ষেত্রে বলে রাখা ভাল, ১৯২৮ সালে ইংল্যন্ডের মাটিতে উইনস্টন চার্চিলের তৎপরতায় প্রথম টোটের আত্মপ্রকাশ ঘটে। ভারত যেহেতু তখন ইংল্যন্ডের উপনিবেশ, তাই এদেশেও আইন করে টোটে পাশ করানো হল। আর তখন থেকে আজ পর্যন্ত এই ‘টোটে’ই চলে আসছে কলকাতা রেসকোর্সে।
‘টোটে’ বেটিং করতে গেলে কয়েকটি জিনিস আপনাকে মাথায় রাখতে হবে। ঠিকঠাকভাবে হিসাব করতে না পারলে আপনার সর্বস্বান্ত হওয়ার আশঙ্কাও রয়েছে। ‘টোটে’তে সর্বনিম্ন ১০ টাকার বেটিং করা যায়, আর সর্বোচ্চ আনলিমিটেড। যত টাকা খুশি। ধরে নেওয়া যাক, আপনি ‘উইন’ খেলতে চাইছেন। মানে, আপনি যে ঘোড়ার উপর টাকা লাগাবেন তাকে জিততে হবে। প্রত্যেক ঘোড়ার নির্দিষ্ট দরও রয়েছে। তারপরে আসা যাক ‘প্লেস’এ। ‘প্লেস’এর ক্ষেত্রে আপনি যে ঘোড়াটির উপর বাজি রাখবেন তাকে প্রথম, দ্বিতীয় বা তৃতীয়ের মধ্যে থাকতে হবে। এটিতে অবশ্য মনে রাখা দরকার আট রেসের দৌড়ের ক্ষেত্রে প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় এই তিনটি প্লেসে বাজি ধরতে পারেন। বারো রেসের দৌড়ের ক্ষেত্রে প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় এবং চতুর্থ পর্যন্ত বাজি ধরা যায়। আর সাত রেসের দৌড়ের ক্ষেত্রে প্রথম ও দ্বিতীয় ধরা হয়। এরপরে আসা যাক ‘ফোরকাস্ট পুল’এ। এক্ষেত্রে অবশ্য আপনি যে দুটি ঘোড়ার ওপর বাজি ধরবেন সে দুটি ঘোড়ারকে প্রথম ও দ্বিতীয় স্থানে থাকতেই হবে এবং কোন ঘোড়াটি দ্বিতীয় আর প্রথম হবে সেটিকেও আপনাকে ঠিক করে রাখতে হবে। আবার আপনি ‘কুইনেলা পুল’ও খেলতে পারেন। এর নিয়মটি অনেকটাই ‘ফোরকাস্ট পুল’এর মতো। কিন্তু ফারাক একটাই। তা হল, আপনার দুটো ঘোড়া পছন্দ করলেই হবে আর তার মধ্যে কোনটি প্রথম আর কোনটি দ্বিতীয় হবে তা নির্দিষ্ট করে চিহ্নিত করার প্রয়োজন নেই। তাছাড়া ‘সেকেন্ড হর্স পুল’ রয়েছে, যেখানে শুধুমাত্র দ্বিতীয় স্থানের জন্য, অর্থাৎ, আপনি যে ঘোড়াটিতে বাজি ধরবেন তাকে দ্বিতীয় হতে হবে।
‘টানালা পুল’ও রেসের মাঠের অন্যতম খেলা, যেখানে আপনাকে তিনটি ঘোড়া বেছে নিতে হবে। সেই তিনটি ঘোড়াকে প্রথম, দ্বিতীয় এবং তৃতীয় হতে হবে এবং এখানে সিকয়েন্স মেইনটেইন করতে হবে। আর এক রকমের টানালা হয়, যেখানে আপনার পছন্দ করা ঘোড়াগুলির মধ্যে প্রথম স্থানটি স্থির রাখলেন আর পরের দুটোর জায়গা পরিবর্তন হলেও হতে পারে।
সবথেকে আকর্ষণীয় হল জ্যাকপট, যেখানে আপনি পাঁচ-পাঁচটা রেসের জন্য বাজি ধরবেন। আর যদি সব রেসে আপনার বাজি ধরা ঘোড়াগুলি জিতে যায় তাহলে কেল্লা ফতে। আপনি এক নিমিষে মালামাল হয়ে যেতে পারেন। কিন্তু ভাগ্য সব সময়ে সাথে নাও থাকতে পারে। সুপার জ্যাকপটের নিয়মটা একইরকম, শুধু এক্ষেত্রে রেসের সংখ্যা ছয় হয়।
অন্যদিকে রয়েছে প্রাইভেট বুকমেকার। এখানে শুধুমাত্র উইন আর প্লেসের জন্য খেলা হয়। সর্বনিম্ন আপনি ১০০ টাকার খেলতে পারেন কিন্তু এক্ষেত্রে ট্যাক্সের পরিমাণ একটু বেশি। ১০০ টাকাতে আপনাকে যা ট্যাক্স দিতে হবে ১০০০ টাকাতেও সমপরিমাণ ট্যাক্স দিতে হবে। তাই এখানে বাজি ধরার অঙ্কটা অনেক বেশি।
এখন প্রশ্ন হল ‘টোটে’ আর বুকমেকারদের মধ্যে পার্থক্যটা কোথায়? ‘টোটে’র ক্ষেত্রে একটি রেসে যে পরিমাণ টাকা বিনিয়োগ করা হয়, সেই টাকা থেকে একটা অংশ ক্লাব নেয়। কিছুটা সরকার ট্যাক্স হিসাবে গ্রহণ করে আর বাকিটা বিজয়ীদের মধ্যে ভাগ করা হয়। অবশ্য যে যত পরিমাণ টাকা বিনিয়োগ করেছে সেটার উপর তার প্রাপ্য অংশ নির্ভর করে। অন্যদিকে, বুকমেকারদের হিসাবটা আলাদা। রেসের আগেই জানিয়ে দেওয়া হয় কত বিনিয়োগ করলে কী পরিমাণ টাকা পাওয়া যেতে পারে। আর হ্যাঁ, দুটো ক্ষেত্রেই রেস শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই কিন্তু আপনি আপনার প্রাপ্য অংশ পেয়ে যাবেন।
জকিরা প্রাণপণে ছুটছে, কেউ কাউকে এক ইঞ্চিও জমি ছাড়ছে না, এরকম অভিজ্ঞতা কলকাতা শহরের রেসের মাঠে গিয়ে লাইভ দেখতে চান? ঘোড়াগুলোর সামনাসামনি আপনি আগে কখনও হয়েছেন? কিংবা একটা টানটান পরিস্থিতি, চাপা উত্তেজনা, কোন ঘোড়া জিতবে, কে হারবে, হারলে কতটা ক্ষতি হবে, জিতলেই বা লাভের অংশ কী হবে? নিজের চোখে এসব দেখেছেন কখনও? দেখতে চাইলে অবশ্য আপনাকে যে একবার অন্তত রেসের মাঠে যেতেই হবে। তবে হ্যাঁ, যে কোনও দিন গেলেই হবে না। যেতে হবে মঙ্গলবার, কেন না আপাতত সপ্তাহে একমাত্র মঙ্গলবারই কলকাতা রেসের মাঠে ঘোড়দৌড় হয়। আর অন্য দিনগুলো? হ্যাঁ, অন্য দিনগুলোতেও রেসের আসর বসে বটে, তবে সেগুলো অনুষ্ঠিত হয় বাঙ্গালোর, মুম্বই, হায়দরাবাদ, মাইসোরে। আর আপনি কলকাতার রেসের মাঠে বসে জায়ান্ট স্ক্রিনে সেগুলো লাইভ দেখতে পারবেন, বাজিও ধরতে পারবেন। এক্ষেত্রেও বাজি ধরার নিয়ম নীতিগুলো যদিও একই।
এই যেমন দিব্যরুপ। দিব্যরুপ রায়। পেশাগতভাবে যিনি কর্পোরেট সেক্টরে কর্মরত। অফিসে নাইট শিফট থাকলে নিয়ম করে রেসের মাঠে আসেন। তবে দিব্যরুপের এখানে আসার আসল কারণ ছবি তোলা, ফটোগ্রাফিটা তাঁর একটা নেশামাত্র। ‘হ্যাঁ, রেসের মাঠে এসে বাজি ধরার নেশাটা লাগবে লাগবে করছিল কিন্তু একটা ইনসিডেন্ট সব কিছু বদলে দিল’, অকপট স্বীকারোক্তি দিব্যরুপের। অভিজ্ঞতাটা বলার সময় চোখ-মুখজুড়ে একটা গ্লানি কাজ করছিল তাঁর। নিজের চোখের সামনে কারোওর প্রাণ হারাতে দেখেছিলেন তিনি। ভদ্রলোকের নামটা জানতে পারেননি, শুধু ঘটনাটির সাক্ষী হয়েছিলেন মাত্র। সেই ভদ্রলোকটি নিজের মেয়ের জন্য জমানো সমস্ত পুঁজি নিয়ে রেসকর্সে এসেছিলেন, ভেবেছিলেন ফাটকা খেলে মালামাল হয়ে বাড়ি ফিরবেন। কিন্ত ভাগ্যের পরিহাস, রেসের মাঠে জমানো সমস্ত টাকাই জলাঞ্জলি যায়। এই ধাক্কা নিতে পারলেন না ওই ভদ্রলোক। রেসের মাঠেই অসুস্থ হয়ে পড়েন। পরে জানা যায়, হাসপাতাল নিয়ে যেতে গিয়ে মৃত্যু হয় তাঁর। এই ঘটনার পর বহুবার রেসের মাঠে আসলেও বাজি ধরার সাহস হয়নি দিব্যরুপের।
কিংবা নিউ আলিপুরের রাজীব মালহোত্রা (নাম পরিবর্তিত), পেশায় ছিলেন মেরিন ইঞ্জিনিয়ার। এখন অবশ্য অবসর গ্রহণ করেছেন। উনি শেষ চল্লিশটি বছর ধরে নিয়মিত রেসের মাঠে আসছেন। সেদিন আর এদিনের রেসের মাঠের মধ্যে আকাশ আর পাতাল তফাত লক্ষ্য করেন। ‘সেদিনের রেসকোর্সে একটা স্পোর্টসম্যান স্পিরিটসুলভ মানসিকতা ছিল। রেসটা একটা খেলা ছিল, আর আজ পুরোটাই জুয়াতে পরিণত হয়েছে। অনেকাংশে ঘোড়ার মালিক আর জকিদের মধ্যে ফিক্সিংও থাকে’, জানালেন রাজীববাবু। কিন্তু তিনি স্টূয়ার্ডদের প্রশংসা করতেও ছাড়লেন না। স্টূয়ার্ডদের মূল কাজ হল, রেস পরিচালনা করা আর তাঁরা সেটা বেশ কড়া হাতেই করেন। অভিজ্ঞ স্টূয়ার্ডদের বুঝতে এতটুকুও অসুবিধা হয় না, কোনও ঘোড়ার মালিক বা জকি ফিক্সিং করেছেন কিনা, আর এটা যদি প্রমাণিত হয় তাহলে শাস্তিও মারাত্মক। এই যেমন, কিছু দিন আগেই রেসের মাঠে এক ঘোড়াকে ডোপিং করানোর অভিযোগ ওঠে, সেটা নিয়ে অবশ্য কম জলঘোলা হয়নি, এটাও জানালেন রাজীববাবু।
রেসের মাঠে কর্মকর্তারা এখনও পুরনো ট্রাডিশন আর আভিজাত্য বজায় রেখে চলেছেন। যেমন মক রেস। নিয়ম মেনে রেসকোর্স চত্বরে জকিসমেত ঘোড়াগুলিকে রাউন্ড করে ঘোরানো হয়। এর মূল উদ্দেশ্য অবশ্য রেসে আপনি কোন ঘোড়ার ওপর বাজি ধরবেন সেটা একবার যাতে পরখ করে নিতে পারেন। কিংবা রেস শেষ হওয়ার পর অভিজাত কায়দায় বিজয়ী জকিদের হাতে পুরস্কার তুলে দেওয়া একটা রীতি। এই সব আদব-কায়দা কর্তৃপক্ষ এখনও মেনে চলছে।
রেসের মাঠে নিয়মিত আসেন সরদেশ সিংহ। সরদেশ সিংহ বিহারের বাসিন্দা, কর্মসূত্রে কলকাতায় থাকেন। রেসের মাঠের পাশ দিয়ে অফিস যাওয়ার সময় প্রত্যেক দিনই ভাবতেন, রেসের মাঠে ঢুকবেন, কিন্তু সাহস পাচ্ছিলেন না। হঠাৎ একদিন সাহস করে ঢুকেই পড়লেন, আর তারপর থেকে এখন তিনি প্রতি মঙ্গলবারই আসেন। এটা যেমন এখন কীরকম একটা নেশার মতো হয়ে পড়েছে তাঁর কাছে। তিনি এও বললেন, রেসের মাঠ থেকে কেউ কোনওদিন জিতে ফেরে না। আজ যদি কেউ জেতে, পরের দিন অবশ্যই হারবে। এই জেতার নেশাটাই মারাত্মক, যে একবার জিতে যায় সে বারবার রেসের মাঠে ফিরে আসবেই। আসলে এটা পুরোপুরিই সরদেশের ব্যক্তিগত উপলব্ধি, বিশ্বাসও বটে।
রেসের ক্যালেন্ডারের নিয়ম অনুযায়ী, দু’রকম রেস হয় কলকাতার মাঠে। মুনসুন মিটিং আর উইন্টার মিটিং। যেখানে সব ঘোড়াকে যাচাই করে নেওয়া হয় সারা মরশুম ধরে। ঘোড়ার পারফর্মেন্সের ওপর ভিত্তি করে তাদের নির্দিষ্ট পয়েন্টও দেওয়া হয়। আর এই পয়েন্টের উপর নির্ভর করে ঠিক করা হয় তাদের গ্রেডিং। ১-৫ এইভাবে ঘোড়াদের গ্রেডিং হয়। যে সমস্ত ঘোড়া প্রথম পর্যায়ে থাকে তাদের নিয়ে মরসুমের শেষে হয় ডার্বি। যেটা খুবই আকর্ষণীয়। আর ১ লা জানুয়ারির কথা না বললেই নয়। বছরের প্রথম দিনটায় রেসকোর্সে কার্নিভাল বসে। যেদিন ক্লাবের সদস্যদের ক্লাবের পক্ষ থেকে আমন্ত্রণ জানানো হয়।
কলকাতা রেসকোর্সে বুকমেকারদের মধ্যে অন্যতম আর জে অ্যান্ড কোম্পানি। কোম্পানির কর্মচারি রিয়াজ আলি আর মহম্মদ আক্রমের থেকে জানা গেল, এই রেসের মাঠ আসলে অনেকের কাছেই রুজি রুটি। মানে, যাঁরা বেটিং করতে আসেন তাঁদের মধ্যে এমন অনেকেই আছেন, যাঁরা প্রতিদিন রেসের মাঠে আসেন, আর এই রেসের মাঠ থেকে উপার্জিত অর্থেই তাঁদের সংসার চলে।
কলকাতা রেসকোর্সে বিনোদনের জন্য আপনি সব কিছুই পাবেন। আসলে আপনি যে প্রকারেরই খাবার খেতে চান, প্রায় সব কিছুরই ব্যবস্থা করে রেখেছে কর্তৃপক্ষ। দামও আপনার সাধ্যের মধ্যে। হার্ড ড্রিংক্সে হাল্কা গলা ভেজাতে চাইলে, তাও পেয়ে যেতে পারেন। আপনার রেস দেখতে যেন কোনওরকম অসুবিধা না হয় সেদিকে কিন্তু খেয়াল রেখেছে কর্তৃপক্ষ, আর এই রীতি ব্রিটিশ আমল থেকেই চলে আসছে।
রেসের মাঠের কথা শুনলে অনেকেই আবার ভ্রু কুঁচকোন! আপনাকে রেস লড়তে হবে না, কিন্তু এই অ্যাটমোস্ফিয়ারটাও যে উপভোগ্য সেটা জানার জন্য একবার হলেও রেসের মাঠে ঢুঁ মেরে যান। তবে হ্যাঁ, শখ হলে বেটিং করতেই পারেন, কিন্তু যদি সেটা নেশায় পরিণত হয় তাহলেই ঘোর বিপদ।
(ছবিঃ সপ্তর্ষি চৌধুরী)
Comments are closed.