Lockdown: আমরা হয়তো বাড়িতে ভালোই আছি, কিন্তু গরিব মানুষ? শ্রমিক? দিন হিসেবে যাঁরা টাকা রোজগার করেন, তাঁরা?
সারা দেশ মারণ করোনাভাইরাসের থাবায় জর্জরিত। আমাদের দেশসহ গোটা পৃথিবীতে আক্রান্ত হয়েছেন লক্ষ-লক্ষ মানুষ। অনেকে প্রাণ হারিয়েছেন। এই অবস্থায় গোটা অর্থনীতি কার্যত থমকে গেছে। কবে যে এই ভাইরাসের প্রকোপ থেকে বিশ্ব রেহাই পাবে তার উত্তর নেই কারও কাছেই।
২৩ এপ্রিল রাত ৮ টার সময় যখন প্রধানমন্ত্রী লকডাউনের কথা ঘোষণা করেন, তখন অলরেডি রাজ্য সরকারের ঘোষিত লকডাউন চলছিল। স্বাভাবিকভাবেই সেই সময়টায় সাধারণ মানুষের মধ্যে বেশ ব্যস্ততা ও হুড়োহুড়ি লক্ষ্য করা গিয়েছিল। আমার পারিপার্শ্বিক ঘটনাক্রম দেখে ও শুনে বেশ কিছুদিন আগে থেকেই মনে হচ্ছিল, সাধারণ জীবন এই ভাবে চলবে না। কোথাও গিয়ে একটা ধাক্কা আসবে এবং সাধারণ জনজীবন ব্যাহত হবে। তাই লকডাউন ঘোষণার বেশ কিছুদিন আগে থেকেই অল্প অল্প করে কিছু নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র দোকান থেকে কিনে এনে রাখছিলাম।
কিন্তু এ তো গেল আমার কথা। আমি একা থাকি। তাই নিজেকে নিয়ে হয়ত অতটা সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়নি। কিন্তু একবার তাঁদের কথা ভাবুন, যাঁদের বাড়িতে ৪-৫ জন সদস্য রয়েছেন, অথচ রোজগেরে মানুষ একজন। বা যাঁরা প্রতিদিনের কাজের হিসেবে টাকা রোজগার করেন। সেই পরিবারগুলোর কি সত্যিই অনেক খাবার কিনে রাখার মত সাধ্য আছে? সুতরাং এই লকডাউনের জেরে সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়েছেন সেই সমস্ত মানুষ।
আমি একটি কলেজে অধ্যাপনা করি। এই লকডাউনের জেরে স্বাভাবিকভাবেই আমার ছাত্রছাত্রীদের খুবই সমস্যার মধ্যে পড়তে হয়েছে। সিলেবাস শেষ করা থেকে শুরু করে পরীক্ষা নেওয়া, সব কিছুই আটকে রয়েছে। তবে মাঝে কিছুদিন অনলাইন প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে তাঁদের কিছু ক্লাস নেওয়ার চেষ্টা করেছি। আমার কিছু ছাত্রছাত্রীকে সাইকোডায়নামিক্স-এর উপর কোর্স করাচ্ছিলাম কিছুদিন আগে। এখন ঘরে সপ্তাহে একদিন করে তাঁদের সঙ্গে বসে সেই সমস্ত বিষয় নিয়ে অনলাইনের মাধ্যমে আলোচনা করছি।
আর এই লকডাউনের জেরে সব থেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন আমার কাছে থেরাপি করতে আসা মানুষজন। কারণ আমার কাছে নানা রকমের মানুষ তাঁদের জীবনের নানান সমস্যা নিয়ে আসেন। তাঁদের কাউন্সেলিং হয়। সেই সব কিছুই এখন বন্ধ। তবে খুব সিরিয়াস বিষয় হল, আমি অনলাইনে কিছু থেরাপি করার চেষ্টা করছি। কিন্তু তাতেও কিছু সমস্যা আছে। এই ধরনের থেরাপিতে অনেক ব্যক্তিগত কথা মানুষ ডাক্তারকে বলেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এই অনলাইন মাধ্যমে সেসব কথা তাঁরা বলতে ইতস্তত বোধ করছেন। সে ক্ষেত্রে সমস্যা আরও বাড়ছে।
এখন হাতে অনেকটা সময় রয়েছে। তাই কিছু বই পড়ছি। সিনেমা দেখছি। ফোনে বন্ধুবান্ধব ও আত্মীয়স্বজনদের খোঁজ নিচ্ছি। এছাড়াও বাড়ির সব কাজ, যেমন রান্না করা, বাসন মাজা থেকে ঘর ঝাড় দেওয়া ও মোছা, সব এখন আমাকেই করতে হচ্ছে।
খবরের কাগজ ও টিভিতে ইদানীং ভিন রাজ্যে কাজ করতে যাওয়া শ্রমিকদের কথা বারবার উঠে আসছে। সারা দেশের বিভিন্ন রাজ্যের সীমানায় এসে আটকে পড়েছেন তাঁরা। বাড়ি ফিরতে চাইছেন নিজের আপনজনের কাছে। কিন্তু ফিরতে পারছেন না। অনেকে পায়ে হেঁটে ৪০০-৫০০ কিলোমিটার পাড়ি দিচ্ছেন, তাঁদের কথাও আমাদের ভাবা উচিত। আমরা হয়ত নিজেদের বাড়িতে বেশ ভালোই আছি। কিন্তু সেই সব মানুষগুলোর কথাও একবার অন্তত আমাদের ভাবা উচিত, যাঁদের মাথার উপর ছাদ নেই। কোথায় যাবেন তাঁরা?
ইদানীং এই লকডাউনের ঘোষণা হওয়ার পর থেকেই আরও একটা জিনিস লক্ষ্য করেছি। অনেক মানুষই তাঁদের প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি খাবার ঘরে মজুত করে নিয়ে যাচ্ছেন। ফলে অন্যান্য মানুষ পড়ছেন বিপদে। অনেকেই দোকান থেকে ফিরছেন খালি হাতে। এর থেকেই বোঝা যায় কতটা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে পড়েছি আমরা। অন্যের প্রয়োজনের কথা ভাবছি না। এই কঠিন সময়ও শুধু নিজেরটা নিয়েই ব্যস্ত রয়েছি। তাই সবাইকে বলব, নিজে ভালো থাকাটা যেমন জরুরি, ঠিক তেমনই আপনার পাড়া-প্রতিবেশী সবাইকেই ভালো রাখার চেষ্টা করুন। বিপদে-আপদে তাঁদের পাশে দাঁড়ান। মনে রাখবেন, আপনার আশপাশের মানুষগুলো ভালো থাকলে আপনি ও আপনার পরিবার সবাই ভাল থাকবেন।
এখন সারাদিন বাড়িতেই রয়েছি বলতে গেলে। খুব দরকার না পড়লে বেরোচ্ছি না। আর সবাইকে বলব, তাঁরাও যেন যতটা সম্ভব বাড়িতেই থাকেন ও সরকারের নির্দেশ মেনে চলেন। জানি অনেক অসুবিধের সম্মুখীন হতে হচ্ছে। কিন্তু বিশ্বাস করুন, তাতেই সবার মঙ্গল। সবাইকে বলব, যে যেটা করতে ভালবাসেন তাই করে ভালো থাকার চেষ্টা করুন ও আপনার কাছের মানুষজনকেও ভাল রাখুন। কেউ বই পড়ে, কেউ সিনেমা দেখে, ছবি এঁকে বা রান্না করে ভাল থাকেন, সেটাই করুন। কিন্তু অবশ্যই এই কঠিন সময়ে ভাল থাকুন। সেটাই এখন সবচেয়ে বেশি জরুরি।
(অনুলিখন: অভিজিৎ দাস)
Comments are closed.