প্রিয়রঞ্জন, দীপা, সেলিমের পর রায়গঞ্জ কি মমতার? কংগ্রেস-সিপিএমের ভোটারদের তৃণমূলকে ভোট দিতে বললেন তৃণমূল নেত্রী
ছ’দিন ধরে উত্তরবঙ্গের ৪ টি লোকসভা কেন্দ্রে প্রচার চালানোর পর সপ্তম দিনে এসে গিয়ার চেঞ্জ করলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
৩ রা এপ্রিল কোচবিহার থেকে নির্বাচনী প্রচার শুরু করেছিলেন তৃণমূল নেত্রী। মিটিং করে ফেলেছেন কোচবিহার, আলিপুরদুয়ার, জলপাইগুড়ি, দার্জিলিং কেন্দ্রে। কিন্তু মঙ্গলবার রায়গঞ্জে পৌঁছে সরাসরি কংগ্রেস-সিপিএমের ভোটারদের কাছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আবেদন জানালেন তৃণমূলকে ভোট দিতে। বললেন, ‘ভিক্ষে নয় চাইছি ঋণ, রায়গঞ্জে টিএমসিকে ভোট দিন’।
কিন্তু রায়গঞ্জে গিয়ে কংগ্রেস-সিপিএমের ভোটারদের ভোট চাইলেন কেন মমতা? এই প্রশ্নের উত্তরের মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে রায়গঞ্জ আসনের পরিবর্তিত রাজনৈতিক সমীকরণের অঙ্ক এবং রসায়ন। যে সমীকরণ এবারের লোকসভা নির্বাচনে রাজ্যের সবচেয়ে রহস্যময় কেন্দ্র করে তুলেছে রায়গঞ্জকে। কিন্তু কেন?
সিপিএমের হাত থেকে ২০০৪ সালে রায়গঞ্জ পুনরুদ্ধার করেছিলেন প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সি। যদিও তাঁর মার্জিন বিরাট কিছু ছিল না। হাজার চল্লিশেক ভোটে সিপিএমকে হারিয়ে সংসদে গিয়েছিলেন প্রিয়রঞ্জন। কিন্তু তাঁর গুরুতর অসুস্থতার পর ২০০৯ সালে এই আসনে দাঁড়িয়ে সিপিএমকে এক লক্ষেরও বেশি ভোটে হারালেন স্ত্রী দীপা দাশমুন্সি। ২০০৯ সালেও বিশেষ রহস্য ছিল না। অসুস্থ প্রিয়রঞ্জনের আবেগ, তৃণমূলের সঙ্গে জোট এবং এইমসের স্বপ্ন, সব মিলে দীপা দাশমুন্সির জিততে বিশেষ সমস্যা হয়নি। কিন্তু ২০১৪ সালে এসে গোটা রাজ্যকে চমকে দিল রায়গঞ্জ। এই কারণে নয় যে সিপিএমের হেভিওয়েট প্রার্থী মহম্মদ সেলিম দীপা দাশমুন্সিকে দেড় হাজারের সামান্য বেশি ভোটে হারালেন। বরং এই কারণে, রাজ্যের শাসক দল তৃণমূলকে টপকে তিন নম্বরে উঠে এল বিজেপি। ২ লক্ষের বেশি ভোট পেল বিজেপি। শুধু তাই নয়, এই লোকসভার অন্তর্গত ইসলামপুর বিধানসভায় একেবারে সবাইকে টপকে সবচেয়ে বেশি ভোট পেলেন বিজেপি প্রার্থী নিমু ভৌমিক! কোন ইসলামপুর? হ্যাঁ, সেই ইসলামপুর, যার দাঁড়িভিট নামক এক জায়গা এবার রায়গঞ্জ লোকসভার সবচেয়ে আলোচিত ইস্যু। একমাত্র আলোচিত ইস্যু বললেও খুব একটা ভুল হয় না।
বাংলার মাটিতে বছরের পর বছর বিরোধী রাজনীতি করা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ভালোই জানেন, উর্বর মাটিতেই গাছ হয়, আর সেই গাছ জল-হাওয়া এবং সহায়ক পরিবেশ পেলে কীভাবে দ্রুত বেড়ে ওঠে। ইসলামপুর সহ গোটা রায়গঞ্জেই বিজেপি নামক এই গাছ সেভাবেই বিকশিত হয়েছে গত এক-দেড় বছরে। ভিত্তি একটা ছিলই, তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার, লাগোয়া বিহারের প্রভাব, একাধিক সাম্প্রদায়িক গণ্ডগোল এবং শেষমেশ দাঁড়িভিট কাণ্ড। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ভালো মতোই জানেন, রায়গঞ্জে কংগ্রেস-সিপিএমের দ্বিমুখী লড়াইয়ের পরিস্থিতি নেই আর। লড়াই এখানে যথার্থ অর্থেই চতুর্মুখী। এবং সম্ভবত রাজ্যের একমাত্র কেন্দ্র, যেখানে ৩০ শতাংশের কম ভোট পেয়েও জেতা সম্ভব।
আর তাই নির্বাচনী প্রচারের সপ্তম দিনে গিয়ে রায়গঞ্জ এবং ইসলামপুরের জনসভায় তৃণমূল নেত্রী আওয়াজ তুললেন, কংগ্রেস-সিপিএমকে ভোট দিয়ে ভোট নষ্ট করবেন না। বললেন, এখানকার মানুষ আগে কংগ্রেস-সিপিএমকে ভোট দিয়েছেন। কিন্তু এবার আমরাই বিজেপির বিরুদ্ধে লড়াই করছি। তৃণমূলই দেশে সরকার গড়বে। কংগ্রেস-সিপিএমের ভোটারদের কাছে আবেদন করছি, এবার দল বদলান। তৃণমূলকে ভোট দিন। তৃণমূলই বিজেপির সঙ্গে লড়ছে। সিপিএম-কংগ্রেস বিজেপির সঙ্গে লড়াই করতে পারবে না।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জানেন, রায়গঞ্জের বিজেপি বিরোধী ভোটারের কাছে এই একটা প্রশ্নেরই মীমাংসা হওয়া একমাত্র বাকি আছে। তা হল, কে বিজেপিকে হারাতে পারবে? এই প্রশ্নের উত্তরেই লুকিয়ে আছে রায়গঞ্জের কংগ্রেস এবং সিপিএম ভোটারদের কাছে তৃণমূল নেত্রীর আহ্বানের কারণ। ভোটারদের মমতা মনে করিয়ে দিয়েছেন, এবার ভোট হচ্ছে কেন্দ্রের বিজেপি সরকারকে বদলের, রাজ্যের নয়। আর বিজেপির বিরুদ্ধে লড়াই যে তৃণমূলই এরাজ্যে করছে, বারবার সেই স্লোগান তুলে এদিন ইসলামপুরের সমাবেশ থেকে বিজেপিকে আক্রমণ করতে গিয়ে গুজরাত দাঙ্গার কথাও এনেছেন তৃণমূল নেত্রী।
আসলে এই রায়গঞ্জ লোকসভা কেন্দ্রের দুটি জনসভায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এদিন পরিষ্কার করে দিয়েছেন, এটিই রাজ্যের একমাত্র কেন্দ্র যেখানে পাঁচ বছর আগে প্রথম বা দ্বিতীয় হওয়া দলের মধ্যে নয়, লড়াইটা হচ্ছে তৃতীয় এবং চতুর্থ হওয়া দলের মধ্যে। আর গত লোকসভায় প্রথম এবং দ্বিতীয় হওয়া দলের ভোট যেদিকে বেশি যাবে, সেই হাসবে শেষ হাসি।
Comments are closed.