নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন এবং এনআরসি-এনপিআর নিয়ে উত্তাপের আবহে সিটিজেনশিপ বা নাগরিকত্ব নিয়ে দেশজুড়ে চলছে বিতর্ক। কোন দেশের, কোন ধর্মাবলম্বীরা ভারতের নাগরিকত্ব পাবেন, তাঁদের সংখ্যা কত, তা নিয়ে উত্তাল দেশের রাজনীতি। নাগরিকত্ব দেওয়ার এই সরকারি বিধি ব্যবস্থার প্রেক্ষিতে এবার চোখ ফেরানো যাক নাগরিকত্ব ফেরানোর তালিকায়। অবাক হলেন? আপাতদৃষ্টিতে এমন অবাক হওয়ার মতো ঘটনা ঘটবে বিদেশ মন্ত্রকের সাম্প্রতিক রিপোর্টের দিকে চোখ ফেরালে।
জানেন, ২০১৫ থেকে ২০১৯, এই ৫ বছরের সময়কালে ৫ লক্ষেরও বেশি মানুষ ভারতের নাগরিকত্ব ত্যাগ করেছেন?
ভারতের বিদেশ মন্ত্রকের তথ্য বলছে, জানুয়ারি ২০১৫ থেকে ২০১৯ সালের অক্টোবর মাস পর্যন্ত ৫ লক্ষ ৮০ হাজার মানুষ ভারতের নাগরিকত্ব ছেড়েছেন। আর ২০১৯ সালের প্রথম দশ মাসের মধ্যেই সেই সংখ্যা দাঁড়ায় ১ লক্ষ ১০ হাজারে।
কোন দেশের নাগরিকত্ব নিতে ভারতের সিটিজেনশিপ ছাড়ছেন মানুষ? তারও উত্তর রয়েছে বিদেশ মন্ত্রকের দেওয়া তথ্যে। এস জয়শঙ্করের মন্ত্রক জানাচ্ছে, ভারতের নাগরিকত্ব ছেড়ে মার্কিন নাগরিকত্ব গ্রহণ করার চাহিদা সবচেয়ে বেশি। ঠিক তারপরই রয়েছে অস্ট্রেলিয়া ও কানাডা।
প্রথম বিশ্বে পড়তে কিংবা চাকরি করতে গিয়ে সেখানেই পাকাপাকিভাবে থেকে যাওয়ার বৃত্তান্ত প্রত্যেকের পরিচিতির গণ্ডির মধ্যে কখনও না কখনও শোনা যায়। শেষ ৫ বছরের মধ্যে, ২০১৬ সালে ভারতের নাগরিকত্ব ছাড়ার যেন হিড়িক পড়ে গিয়েছিল। সে বছর ১ লক্ষ ৩০ হাজার মানুষ ভারতের নাগরিকত্ব ছাড়েন। অন্যান্য বছরগুলোর ক্ষেত্রে কম-বেশি সেই সংখ্যার এদিক ওদিক হয়েছে বটে, কিন্তু প্রতি বছরই কমপক্ষে ১ লাখ মানুষ ভারতের নাগরিকত্ব ছেড়ে অন্য দেশের নাগরিক হয়েছেন।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে থাকা ভারতীয় দূতাবাস থেকে তথ্য সংগ্রহ করে একটি পূর্ণাঙ্গ তালিকা তৈরি করেছে বিদেশ মন্ত্রক। তাতেই উঠে এসেছে এমন তথ্য।
ভারতের নাগরিকত্ব ছেড়ে মার্কিন নাগরিক হওয়ার ঝোঁক বরাবরই বেশি। গোটা তালিকার ৪৪ শতাংশ আবেদনই আমেরিকার নাগরিকত্ব নিতে ভারতীয় নাগরিকত্ব ছাড়ার। সেক্ষেত্রে গত ৫ বছরে সেই সংখ্যাটা আড়াই লক্ষ। ১ লক্ষের বেশি মানুষ ভারতের নাগরিকত্ব ছেড়ে অস্ট্রেলিয়ার নাগরিকত্ব নিয়েছেন এবং ৯৪,৮৭৪ জন কানাডার নাগরিকত্ব নিয়েছেন। অস্ট্রেলিয়া ও কানাডা মিলিয়ে ৩৩ শতাংশ মানুষ ভারতের সিটিজেনশিপ ছেড়েছেন। বাকি দেশগুলোর ক্ষেত্রে এই সংখ্যা ১.৩ লক্ষ। ৩৫,৯৮৬ জন ব্রিটেনের নাগরিকত্ব পেতে ভারতের নাগরিকত্ব ত্যাগ করেছেন।
কিন্তু ভারতের নাগরিকত্ব ছাড়ার এমন হিড়িক কেন? সমস্যাটা কোথায়?
সংশ্লিষ্ট দূতাবাসে যখন কেউ নাগরিকত্ব ছাড়ার আবেদন করেন, তখন ঠিক কী কারণে তিনি নাগরিকত্ব ত্যাগ করতে চাইছেন, তা গোপন রাখা হয়। ফলে ফর্মে লেখা কারণ জানা স্বভাবতই সম্ভব নয়। তবে মাইগ্রেশন এক্সপার্টরা বলে থাকেন, সাধারণত ভারতের মতো দেশের নাগরিকত্ব ছেড়ে প্রথম বিশ্বের দেশের নাগরিকত্ব গ্রহণ করার নেপথ্যে থাকে মূলত ৩ টি কারণ। প্রথমত, ভালো কেরিয়ার, দ্বিতীয় কারণ, অর্থ উপার্জনের সহজলভ্যতা এবং সর্বশেষ সন্তানের উজ্জ্বল ভবিষ্যত।
কেরলের সেন্টার ফর ডেভলপমেন্টাল স্টাডিজের (সিডিএস) অধ্যাপক তথা মাইগ্রেশন বিশেষজ্ঞ ইরুদায়া রাজন এসের মতে, আমাদের দেশের লোকেদের মধ্যে বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু সমস্যা হল তাঁরা এ দেশে থাকতে চান না। তাঁরা মনে করেন, দেশে ফিরলে বৃদ্ধি ব্যাহত হবে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আগে স্নাতকোত্তর স্তরে বিদেশে পড়তে যাওয়াই রেওয়াজ ছিল। কিন্তু ইদানীং নতুন ট্রেন্ড বিদেশ থেকে গ্র্যাজুয়েশন করা। অঙ্ক বলছে, একজন যত আগে বিদেশে পড়তে যাবে, ঋণের পরিমাণও ততই বাড়বে। স্বভাবতই তা শোধ দেওয়ার সময়সীমাও বৃদ্ধি পাবে। ফলে একবার বাইরে পড়তে গেলে, ফেরার সম্ভাবনা ক্রমেই কমে আসে। একটি সমীক্ষা বলছে, ভারত থেকে যত পড়ুয়া বছরে প্রথম বিশ্বের দেশগুলোতে পড়াশোনা করতে যায়, তার মধ্যে ৮০ শতাংশই আর ভারতে ফেরে না। ইরুদায়া রাজন এস বলছেন, আগামী ৫ বছরে এই সংখ্যাটা আরও বাড়বে।
শাহরুখ খানের স্বদেশ ছবির কথা মনে আছে? দেশের কল্যাণে কাজে লাগতে নাসার তারকাখচিত ভবিষ্যত ছেড়ে উত্তরপ্রদেশের গ্রামে ফিরেছিলেন মোহন ভার্গব। তা কি কেবল রিলেই বাস্তব, বাস্তবে নয়? বিদেশ মন্ত্রকের রিপোর্ট সেই প্রশ্নকে নতুন করে প্রাসঙ্গিকতা দিল।
Comments are closed.