পাহাড় থেকে নেমে সমুদ্রের ধারে ঘর পেতেছিলাম। বিয়ের আগে ছিলাম দার্জিলিংয়ে। বিয়ের পরে এলাম আমার স্বামীর ঘর করতে বম্বে। ছ’য়ের দশকের বোম্বাই বা বম্বে এখনকার মুম্বইয়ের থেকে অনেকটাই অন্যরকম ছিল।
আমার স্বামী বিয়ের আগে থেকেই বম্বেতে ছিলেন। ওখানে চার্চ গেট স্টেশনের কাছে বম্বে সচিবালয়ের সামনে ফোরশোর রোডে। একজন পার্শি মহিলার ফ্ল্যাটের খানিকটা অংশ ভাড়া নিয়ে থাকতেন। ফ্ল্যাটটা খুব সুন্দর আর বড়, একদম সমুদ্রের পাড়ে। নারিম্যান পয়েন্টের কাছে। আমাকে নিয়ে উনি ওখানেই উঠলেন। আমাদের ভাগে ছিল বসার ঘর, একটা শোওয়ার ঘর আর বাথরুম। তিনটে ছোট ছোট ব্যালকনি। দুটো থেকে আরব সাগর দেখতে পেতাম। রান্নাঘর ছিল কমন। তখনও এয়ার ইন্ডিয়ার বাড়ি বা ওবেরয় শেরাটন তৈরি হয়নি। কোলাবা পয়েন্ট আর নারিম্যান পয়েন্ট দুটোই দেখা যেত আমাদের বাসস্থান থেকে। এই জায়গাটা ছিল বম্বের সবচেয়ে অভিজাত এলাকার মধ্যে একটি।
বম্বে এলে লোকেরা যে সব দ্রষ্টব্য জায়গায় যায়, এখানে থাকার সময়ই আমি তা দেখে নিয়েছিলাম। আমাদের বাড়ির ঠিক সামনেই ছিল জিমখানা। ওখানে প্রায়ই বিয়ের জন্য ভাড়া হোত। অনেক সময় সিনেমা আর্টিস্ট বা রাজনৈতিক নেতারাও আসতেন বিশাল গাড়ি চড়ে। আমি বারান্দা থেকে দেখতাম। তখন ওখানে বিয়ের কোনও ভোজ হোত না, শুধু কোল্ড ড্রিঙ্ক আর আইসক্রিম দিত। অতিথিরা সবাই সুন্দর পোশাক পরে বিয়ে বাড়িতে আসতেন, নব দম্পতিদের অভিনন্দন জানিয়ে ঠান্ডা পানীয় আর আইসক্রিম খেয়ে চলে যেতেন। আমার খুব অবাক লাগত।
আমরা যে পার্শি মহিলার বাড়িতে ছিলাম, উনি চকোলেট বানাতেন বাড়িতেই। চকোলেট বানানোর মেশিন ওনার শোওয়ার ঘরে থাকতো, কারোর সামনে বানাতেন না। আমাকে মাঝে মাঝে দিতেন। খুব ভাল স্বাদ আর সুন্দর গন্ধ। চার্চ গেটের অনেক দোকানে পাঠাতেন। ওনার রান্নাঘরে উনুনের মতন দেখতে একটা জায়গায় চব্বিশ ঘণ্টা আগুন জ্বলত। পার্শিরা অগ্নির উপাসক।
আমরা যেখানে ছিলাম, সেখান থেকে অনেক জায়গা হাঁটা পথেই ছিল। যেমন চার্চ গেট, এরোস সিনেমা হল, বম্বে বিশ্ববিদ্যালয়, জে জে স্কুল অফ আর্টস, তাজমহল হোটেল, ইন্ডিয়া গেট, কোলাবা কজওয়ের সারি সারি দোকান, ব্রেবোর্ণ স্টেডিয়াম। কুপারেজ মাঠ ছিল আমাদের বাড়ির পেছনেই। আমি হেঁটে হেঁটে এই সব জায়গায় যেতাম। উনি নিয়ে যেতেন লাল রঙের ডবল ডেকার বাসে বা মাসের প্রথম দিকে কদাচিত হলুদ কালো রঙের ফিয়াট ট্যাক্সিতে। মেরিন ড্রাইভও ছিল হাতের কাছেই। মেরিন ড্রাইভে গিয়ে নীচু পাঁচিলে বসে ভুট্টা খেতে খেতে আরব সাগরের উত্তাল টেউয়ের আসা-যাওয়া দেখতে পেতাম। বর্ষা আসার আগে সাগরের রঙ কীরকম পাল্টে যেত। ঘোলাটে হয়ে যেত। আমি ব্যালকনি থেকে দেখে আনমনা হয়ে যেতাম। বাড়ির সব কাজ মনে হয় পড়েই থাকতো।
মেরিন ড্রাইভে লেখক।
তাজমহল হোটেলের সামনেই ইন্ডিয়া গেটের ঠিক পাশে ছিল একটা ওপেন এয়ার রেস্তরাঁ। ওটা আমাদের খুব পছন্দের জায়গা ছিল। খাবারের খুব একটা দাম ছিল না, বিদেশি ধাঁচের খাবার পাওয়া যেত। আমরা ওখানে অনেক সময় কাটিয়েছি। আর তাজমহল হোটেলের পিছনের গলিতে ছোট্ট একটা রাস্তায় ঠ্যালা গাড়িতে বিক্রি হোত বিখ্যাত বড়ে মিঁঞার রকমারি কাবাব। খুব ভিড় লেগে যেত সন্ধ্যার সময়। বহু লোক গাড়ি করে এসে কাবাব খেত। বম্বে সেন্ট্রাল স্টেশনের কাছে এক্সেল সিয়ার রেস্তরাঁয় পাওয়া যেত তখনকার নতুন খাবার সিজলার। আমরা ওখানে মারাঠা মন্দিরে হিন্দি সিনেমা দেখে সিজলার খেতে যেতাম। কিংবা রবিবারের ব্রেক ফাস্ট ওখানেই সারা হোত। কোলাবা কজওয়েতে একটা ছোট্ট দোকান ছিল। ওখানে খুব ভাল গরম রুটি আর মাংস পাওয়া যেত। দোকানের মালিক ছিলেন অত্যন্ত ভদ্র। আমরা তৃপ্তি করে খাচ্ছি কিনা তার দিকে নজর রাখতেন।
সেই সময় যাঁরা আমার স্বামীর পরিচিত ছিলেন, তাঁরা বেশিরভাগই ওনার সিনিয়র। অনেকেই ছিলেন ওনার মতো শিবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের স্নাতক আর বিলেত ফেরত। আমি ছিলাম বয়সে সবচেয়ে ছোট। প্রায় সবাই আমাকে খুবই স্নেহ করতেন। নানারকমের আদব কায়দা শেখাতেন। এর মধ্যে অঞ্জনাদি আর সুবীরদার কাছে কত কিছু যে শিখেছিলাম, তা ভোলার নয়। ওনারা থাকতেন মালাবার হিলে। আমাকে সুবীরদা গাড়ি করে ওনাদের বাড়িতে নিয়ে যেতেন। অঞ্জনাদির দ্বিতীয় সন্তান হওয়ার সময় ওঁর বড় ছেলেকে সামলানোর দায়িত্ব আমাকে দিয়েছিলেন।
মাঝে মাঝেই সিনেমা দেখতাম। এরোসে মর্নিং শোতে ইংরাজি বা মারাঠা মন্দিরে হিন্দি। সিনেমা দেখার হাতেখড়ি বম্বেতেই হয়েছিল । সেই সময় হেমা মালিনী নতুন এসেছে সিনেমায়। হলের হোর্ডিংয়ে হেমা মালিনীর ছবিতে লেখা থাকত ‘ড্রিম গার্ল’। সায়রা বানু তখন ভারত সুন্দরী। তিনি বিয়ে করলেন দিলীপকুমারকে। আর এই সময়ই শর্মিলা ঠাকুর আর পতৌদির বিয়ে হল। হৃষিকেশ মুখার্জি হেমন্তবাবুকে কলকাতা থেকে আনলেন। আর অশোক কুমার আনলেন ছোট ভাই কিশোরকে। হৃষিকেশবাবু এনেছিলেন গীতা দত্তকেও।
এভাবে নানা কিছু দেখে আর শিখে বম্বেতে একটা বছর চোখের পলকে কেটে গেল। পার্শি মহিলার বাড়িতে কিছু কিছু অসুবিধা হচ্ছিল। নিজেরা ফ্ল্যাট নিয়ে থাকব বলে ঠিক হল। শহরতলিতে বাড়ি দেখছিলাম। এলাম নতুন গড়ে ওঠা চেম্বুরের নব জীবন সোসাইটির আবাসনে। চেম্বুরে আমাদের কিছু আত্মীয় থাকতেন। তাঁদের কাছাকাছি ফ্ল্যাট নেওয়া হল। চেম্বুরে অনেক বাঙালির সঙ্গে আলাপ আর বন্ধুত্ব হয়েছিল। যদিও এখনও আমার কাছে বম্বে মানে চার্চ গেটের এলাকা। চেম্বুরে তখন বেশিরভাগ সিন্ধি সম্প্রদায়ের লোক থাকত। ওরা ছিল ব্যবসায়ী। লম্বা আর সুন্দর দেখতে। তখন ওই সোসাইটির একটি মেয়ে, পুনম ধিল্লোঁ, মিস ইন্ডিয়া হয়েছে।
আমার প্রতিবেশী ছিলেন একটি সিন্ধি পরিবার। ওঁদের ছিল কাপড়ের দোকান। এই শহরতলিতে এই সব মানুষের জীবনযাত্রা তখন ছিল খুবই সাধারণ। বোঝাই যেত না ওঁরা কী পরিমাণ অর্থ সম্পদের মালিক। ওঁদের মেয়েরা বাইরে বেরোনোর সময় খুব সেজেগুজে দল বেঁধে হাসাহাসি করতে করতে বের হোত। এই আবাসনটি ছিল খুব সুরক্ষিত আর পরিষ্কার। আবাসনের লোকেরা অনেক রাত পর্যন্ত ঘোরাঘুরি করত। রাত ১২ টার সময়ও মনে হোত, সবে সন্ধ্যা হয়েছে। আমি ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে দেখতাম কিংবা প্রতিবেশীদের বাড়িতে যেতাম। আমার স্বামী খুব ট্যুরে যেতেন। মাসে ১০ থেকে ১২ দিন বা তারও বেশি। তখন আমাদের টেলিফোন বা টেলিভিশন ছিল না। যোগাযোগ করার রাস্তা ছিল না। একা থাকতে শিখলাম। আমার বাবু একবার এসে আমাকে একটা ট্রানজিস্টার রেডিও কিনে দিয়েছিলেন। আমার বড় যাঁরা ছিলেন, তাঁরা আমাকে খুবই স্নেহ করতেন। তাঁদের কাছে অনেক রকমের রান্না শিখেছিলাম। সংসার করতে শিখলাম চেম্বুরেই।
বম্বের ডাব্বাওয়ালার কথা না লিখলে একটা উল্লেখযোগ্য অধ্যায় বাদ থেকে যায়। আমরা তখন চেম্বুরে থাকি। আমার স্বামীর অফিস ছিল ওয়রলিতে। সকাল ৭ টার মধ্যে বেরোতে হোত ওনাকে। অফিসে লাঞ্চ পৌঁছনোর জন্য ডাব্বাওয়ালা ঠিক করলাম। ডাব্বাওয়ালারা পুরো বম্বেতে সব অফিস, কারখানায় ডাব্বা নিয়ে যায়। ডাব্বা হোল এক ধরনের টিফিন ক্যারিয়ার। এই ডাব্বাগুলি কিনতে পাওয়া যেত। ডাব্বার ওপর কোনও চিহ্ন থাকত, যা দিয়ে ডাব্বাওয়ালারা সেগুলি চিনতে পারত। সকাল ৯ টার মধ্যে লাঞ্চ ডাব্বায় ভরে দরজার কাছে রেখে দিতে হোত। ওরা এক মুহূর্তও দাঁড়াত না। দুপুর ১২ টার মধ্যে ডাব্বা পৌঁছে যেত অফিসে। কোনও দিন এর অন্যথা হোত না। সব ডাব্বা একই রকম দেখতে ছিল, কিন্তু কোনও দিন ডাব্বা অদলবদল হোত না। আবার বিকেলে সাড়ে তিনটের মধ্যে ডাব্বা ফিরে আসত। বেল বাজিয়ে দরজার বাইরে রেখে চলে যেত।
একবার কোনও কারণে সকালে ডাব্বা রাখতে দু’ মিনিট দেরি হয়েছিল। ডাব্বাওয়ালা বেল বাজিয়ে চলে গেল। কী করি! আমিই ওঠালাম হাতে খাবার ভর্তি ডাব্বা। দিলাম দৌড় ডাব্বাওয়ালার খোঁজে। ধরলাম তাকে আবাসনের ভিতরেই। ধরালাম ডাব্বা তার হাতে।
আমাদের আবাসন ছাড়াও অন্য আবাসনের বাসিন্দা বাঙালিরা মিলে একটা ক্লাব করেছিলেন। এই ক্লাবের ম্যানেজিং কমিটিতে আমিও ঢুকেছিলাম। ডাঃ দেব নামে একজন গবেষক ক্লাবের সভাপতি ছিলেন। আমি ছিলাম কালচারাল সেক্রেটারি। একবার মিটিংয়ে কেউ একজন আমাকে কটাক্ষ করে কিছু বলাতে আমি খুব রেগে গিয়ে ইস্তফা দেব বললাম। ডাঃ দেব বললেন ‘তোমরা এটা কী করতাছ। মৈত্রেয়ীরে খ্যাপাইয়া দিলে ক্যান।’ যাই হোক পরে মিটমাট হয়ে গিয়েছিল। এই ক্লাবে কালী পুজো হোত। একবার প্রতিমা এলে, পুজো যখন শুরু হোল, তখন দেখা গেল ঠাকুরের হাতে খড়্গ নেই। উপায়? আমি পিজবোর্ড কেটে খড়্গ বানালাম। একবার এই ক্লাবের থেকে বর্ষামঙ্গল হয়েছিল। এর রিহার্সাল আর মঞ্চস্থ হওয়া পর্যন্ত খুব উত্তেজনা ছিল। আমার স্বামী ওখানে গান করলেন।
বম্বেতে তখন পাবলিক বাসে যেতে হলে লাইনে দাঁড়াতে হোত। বাসে যতটা আসন থাকত ততজনই উঠতে পারত। তা না হলে পরের বাসের জন্য অপেক্ষা করতে হোত। বাস নিয়ে একটা ঘটনা মনে পড়ে। শিবসেনা দল তখনও তৈরি হয়নি। শহর খুবই শান্ত থাকত। কিছু দিনের মধ্যেই দলের আত্মপ্রকাশ হোল। সেই সময় এক বিকেলে আমরা চেম্বুর থেকে ইন্ডিয়া গেটে বেড়াতে এলাম। আর পছন্দের ওপেন এয়ার রেস্তরাঁতে খেয়ে, গল্প করে, ফেরার জন্য বাস স্টপে গেলাম। বাসে উঠলামও। টিকিট কাটার সময় কন্ডাক্টর বলল, রাস্তায় খুব গণ্ডগোল, বাস পুড়ছে। এই বাস অত দূর যাবে না। আমাদের বাস থেকে নেমে যেতে হোল। ট্যাক্সিও যেতে চাইল না। তখন আমরা পুরোনো বন্ধু অশোকদার বাড়িতে গেলাম। অশোকদারা আমাদের আগের বাড়ির কাছেই থাকতেন। বম্বেতে গণ্ডগোল, বাস পুড়ছে শুনে উনি হেসে অস্থির। টিভি নেই, তাই খবরও কেউ জানত না। আমরা রাতটা ওনার বাড়িতে কাটালাম। পরের দিন সকালে কাগজ পড়ে বললেন, তোমরা লোকাল ট্রেনে করে চলে যাও, এখনও ট্রেন চলছে। আমরা চার্চ গেট স্টেশন থেকে ট্যাক্সি ধরে চেম্বুরে পৌঁছলাম। এরপর খুবই গণ্ডগোল হয়েছিল। সাত দিন কোথাও বের হওয়া গেল না। সেই সুযোগে শিখলাম চালে, ডালে খিচুড়ি বানানো।
আমাদের চেম্বুরের ফ্ল্যাটটা ছোট ছিল। তবে এই ফ্ল্যাটেই আমাদের পরিবারের অনেকে এসে থেকেছেন। একবার আমার এক দেওর এল। ও মিলিটারিতে ছিল। এল প্রথমবার, না জানিয়ে। তখন এই রকমই হোত। কলিং বেল বাজল। খুলে দেখি এক মিলিটারি ধরাচূড়া পরা। ডাকাতের মত বিরাট গোঁফ। দিলাম দড়াম করে দরজা বন্ধ করে। বাইরে থেকে চেঁচিয়ে পরিচয় দেওয়ার পর দরজা খুললাম।
তখন এয়ার ক্রাফ্ট কেরিয়ার আইএনএস ভিক্রান্ত নতুন যোগ হয়েছে নৌ সেনা বিভাগে। আমার দেওর বাসু আমাকে নিয়ে গেল ভিক্রান্ত দেখাতে। জাহাজে প্লেন নামতে দেখলাম। আমি তো অভিভূত। যখন বাসু আমাকে জাহাজে নিয়ে যাচ্ছিল, তখন নৌ বাহিনীর ছোট-বড় সব অফিসার জাহাজের পাটাতনে লাইন করে দাঁড়িয়ে আমাকে স্যালুট দিলেন ।
স্যালুট নিয়ে একটা মজার কথা বলে লেখাটা শেষ করছি। তখন আমাকে বাড়ির কাজে সাহায্য করত অজিত নামে একজন। একবার আমার ছোট বোন পাকু এসেছে মা, বাবুর সঙ্গে। তার আগেই স্যালুট পেয়েছি। আমি সবাইকে বলছিলাম সে কথা, অজিতও ছিল সামনে। শুনে অজিত আমাকে বলল, বৌদি স্যালুট কী? পাকু বলল, স্যালুট জানিস না? স্যালুট হল, আলু, পেঁয়াজ, টমেটো, পটল দিয়ে একটা তরকারি!
পরে মাঝে মাঝেই অজিত আমাকে জিজ্ঞেস করত, বৌদি আজ স্যালুট বানাবো?
আমার বম্বে শহরে থাকা জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ অভিজ্ঞতা হয়ে আছে। স্যালুট বম্বে।