নন্দীগ্রাম আসলে যা ঘটেছিল #১৯: বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য: নন্দীগ্রামে যে ভয়ঙ্কর রাজনীতি চলছে তা বেশি দিন চলতে পারে না

আগের পর্ব যেখানে শেষ হয়েছিল: সোনাচূড়ায় নিজের বাড়ির সামনে ২০০৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে খুন হয়ে গেলেন ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটির দোর্দণ্ডপ্রতাপ নেতা নিশিকান্ত মন্ডল! কিন্তু কেন……

 

২০০৯ সালের ২২ সেপ্টেম্বর। দুর্গাপুজোর আর দু’দিন বাকি, জমজমাট সোনাচূড়া মোড়। দোকানে দোকানে ভিড়। বাড়ি থেকে সবে বেরিয়ে রাস্তায় এসে দাঁড়ালেন নিশিকান্ত মন্ডল। আচমকা যেন মাটি ফুঁড়ে বেরিয়ে এল কয়েকজন। ভিড়েই মিশেছিল অনেকক্ষণ ধরে। গায়ে জড়ানো চাদরের ভেতর থেকে বের করল আগ্নেয়াস্ত্র, পরপর গুলি করল নিশিকান্ত মন্ডলকে। মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটির দোর্দণ্ডপ্রতাপ নেতা। যেখানে তাঁর বাড়ি, সেখানেই খুন হলেন তিনি।

দীর্ঘদিন যাবৎ সশস্ত্র আক্রমণ চালিয়েও যাঁর টিকি ছুতে পারেনি দুর্দান্ত সিপিআইএম বাহিনী, সেই নিশিকান্ত মন্ডল কিনা খুন হয়ে গেলেন নন্দীগ্রামে ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটির সদর দফতর সোনাচূড়ায়! এই খুনের ঘটনায় মূহুর্তের মধ্যে থম মেরে গেল নন্দীগ্রাম। সাময়িক বিহ্বলতা কাটিয়ে পূর্ব মেদিনীপুর জেলা থেকে, রাজ্য তৃণমূল কংগ্রেস নেতারা কোনওক্রমে বললেন, এই খুন করেছে সিপিআইএম। কিন্তু তাঁদের কথা নন্দীগ্রামের মানুষ বিশ্বাস করল কি?

 

নিশিকান্ত মন্ডলের খুনের খবর কলকাতায় এসে পৌঁছেছিল সন্ধে সাড়ে সাতটা-আটটা নাগাদ। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তখন দক্ষিণ কলকাতার এক মণ্ডপে পূজোর উদ্বোধন করতে যাচ্ছেন। গাড়িতে বসেই খবর পেলেন তৃণমূল নেত্রী। উদ্বোধন সেরেই রাতে ছুটেছিলেন কলকাতায় গলফ গ্রিনে মহেশ্বেতা দেবীর বাড়ি। মহেশ্বেতা দেবীর বিশেষ প্রিয়পাত্র ছিলেন নন্দীগ্রামের এই তৃণমূল কংগ্রেস নেতা। এক সময় নন্দীগ্রাম থেকে পালিয়ে কিছুদিন ছিলেনও মহেশ্বেতা দেবীর বাড়িতে। কিন্তু কেন খুন হলেন নিশিকান্ত মন্ডল? কার এত সাহস হল, তৃণমূল কংগ্রেসের কব্জায় থাকা সোনাচূড়ায় গিয়ে ভরসন্ধ্যায় পঞ্চায়েত সদস্য নিশিকান্ত মন্ডলকে খুন করার?

 

নিশিকান্ত মন্ডলের খুনের ব্যাপারে সেইদিন এবং তার পরেও আমি নন্দীগ্রামের অনেকের সঙ্গে কথা বলেছি। এই খুন নিয়ে কী বলেছিলেন মধুসূদন মন্ডল, তা তাঁর বয়ানে লিখব।

‘নিশিকান্ত মন্ডলের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় ৩ জানুয়ারি, ২০০৭। সোনাচূড়ায়। নিশিদা তখন ওই এলাকায় নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন আন্দোলনের। তারপর আমরা একসঙ্গে অনেক লড়াই করেছি। এমনকী ১০ নভেম্বরও সোনাচূড়া থেকে যে মিছিল হয়েছিল তার সামনের সারিতে আমি, নিশিদা একই সঙ্গে ছিলাম। যদিও মিছিল খানিকটা এগোনোর পর আমি খেয়াল করেছিলাম, আদিত্য বেরা, সবুজ প্রধান এবং আমি ছাড়া আর কোনও নেতা সামনের সারিতে নেই। নিশিদা বিপদ বুঝে পেছনের দিকে চলে গিয়েছিলেন। আমি থেকে গেলেও সেদিন অনেকে একসঙ্গে নন্দীগ্রাম ছাড়ে। ১০ তারিখ বিকেলে গৌরাঙ্গ এবং সুকুমার ১০-১২ জন সঙ্গীকে নিয়ে নন্দীগ্রাম থেকে বেরিয়ে যায়।

জানুয়ারি মাসে আন্দোলন শুরুর সময় থেকেই আমরা স্থানীয় মানুষদের থেকে টাকা তুলতে শুরু করেছিলাম। মূলত অস্ত্র এবং গুলি কেনার জন্য। এছাড়া আন্দোলনে অনেক টাকা খরচ হোত। ১৪ মার্চের পর বাইরে থেকেও অনেক সাহায্য আমরা  পেয়েছিলাম। কিন্তু তারপর থেকেই সিপিআইএম যেভাবে আক্রমণ বাড়িয়ে দিল, তাতে ওদের সঙ্গে পাল্লা দিতে গেলে প্রচুর ভাল বন্দুক এবং গুলির দরকার, তা সবই বুঝতে পারছিলাম। নন্দীগ্রামে ৮-১০ জন এক্স আর্মি-ম্যান ছিলেন, তাঁদের কাছে লাইসেন্সড বন্দুক ছিল। আমরা প্রায় ২৫০ জনের বাহিনী তৈরি করেছিলাম। তাদের অনেককেই ভাল বন্দুক দিতে হয়েছিল। ১৪ মার্চের পর গৌরাঙ্গ, মানে তেলেগু দীপক কিছু অস্ত্র নিয়ে এসেছিল। তার পরেও আরও বন্দুকের দরকার ছিল। সেই বছর মাঝামাঝি আমরা ১৮ টা বন্দুক কিনি। মূলত রাইফেল কেনা হয়েছিল। এক একটা বন্দুকের দাম পড়েছিল  এক লক্ষ ২৫ হাজার টাকার কাছাকাছি। এর সঙ্গে কেনা হয়েছিল প্রচুর গুলি। সেই সময় একসঙ্গে প্রায় ৩০ লক্ষ টাকা খরচ হয়েছিল। এই টাকার বেশিরভাগটাই নন্দীগ্রামে চাঁদা তোলা এবং বাইরের সাহায্য। কে বা কারা সাহায্য করেছিলেন তা বলা যাবে না। কিন্তু প্রায় সব টাকারই হিসেব রাখতেন নিশিকান্ত মন্ডল। গৌরাঙ্গ, সুকুমারও নিজস্ব উদ্যোগে বেশ কিছু টাকা জোগাড় করেছিল।

নভেম্বরের ৯-১০ তারিখ নাগাদ আমরা বুঝতে পারছিলাম, সিপিআইএমের এই বাহিনীর সঙ্গে বেশিদিন লড়াই চালিয়ে যাওয়া মুশকিল। কারণ, আমাদের গুলি শেষ হয়ে গিয়েছিল। একদম হাতে গোনা কিছু গুলি সামান্য কয়েকজনের কাছে ছিল, কিন্তু তা দিয়ে যুদ্ধ সম্ভব ছিল না। তখন আলোচনা করে ঠিক হয়েছিল, সমস্ত বন্দুক নিশিদা এবং আরও দু’জনের কাছে ভাগাভাগি করে রেখে দেওয়া হবে। পরে দরকার মতো নিয়ে নেওয়া হবে। নিশিদা ছাড়া বাকি দুজনের নাম বলব না। কারণ, তাঁরা এখনও নন্দীগ্রামেই থাকেন। তাঁদের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হতে পারে। এর মধ্যে গৌরাঙ্গ, সুকুমারদের আনা বন্দুকও ছিল। কারণ, গৌরাঙ্গ এবং সুকুমার বা সুদীপ চোঙদারদের পক্ষে ১০ নভেম্বর বন্দুক নিয়ে নন্দীগ্রাম ছাড়া অসম্ভব ছিল। সমস্ত রাস্তায় পাহারা ছিল সিপিআইএমের। বন্দুক ছাড়াও আমাদের তোলা প্রচুর টাকা ছিল নিশিদার হেফাজতে। এরকম বন্দোবস্ত করে বন্দুক এবং টাকা নিশিদার কাছে রেখে ১০ তারিখ যে যার মতো পালিয়ে যায়। আমি ধানক্ষেতে টানা দু’দিন লুকিয়ে ছিলাম, সিপিআইএম বাহিনী আমার খোঁজ পায়নি। তারপর পরিস্থিতি ঠান্ডা হলে প্রায় মাসখানেক বাদে আবার রাজনৈতিক কাজকর্ম শুরু করেছিলাম নন্দীগ্রামে। জানতাম সিআরপিএফ এসেছে। সিপিআইএম অত বাড়াবাড়ি করতে পারবে না। গোপনে গোপনে পঞ্চায়েত ভোটের প্রস্তুতি নিতে হবে।

নিশিকান্ত মন্ডলও সোনাচূড়া ছেড়েছিল ১০ নভেম্বর। বেশ কিছুদিন বাদে ফিরে আসার পর আমি নিশিকান্ত মন্ডলের কাছে গিয়ে টাকা ফেরত চাইলাম। অনেক টাকা রাখা ছিল ওঁর কাছে। বন্দুকও ফেরত চাওয়া হল। কিন্তু নিশিকান্ত মন্ডল বলে, ওঁর কাছে টাকা নেই, খরচ হয়ে গেছে। বন্দুকও চুরি হয়ে গেছে। এর পরেই আন্দোলনকারীদের একটা বড় অংশ ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে ওঁর ওপর। বারবার চাওয়া সত্বেও টাকা ফেরত দেয়নি নিশিকান্ত মণ্ডল। এরই মধ্যে পঞ্চায়েত ভোট এসে পড়ে। নিশিকান্ত মণ্ডল তৃণমূল কংগ্রেসের টিকিটে জিতেও যান। তারপরেই আচরনে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছিল নিশিকান্ত মন্ডলের এবং ওখানকার কয়েকজন তৃণমূল কংগ্রেস নেতার। সোনাচূড়া পঞ্চায়েতে কয়েকজনকে চাকরি দেওয়া নিয়েও দুর্নীতির অভিযোগও ওঠে তাঁর বিরুদ্ধে। এই ঘটনাগুলোকে কেন্দ্র করে ওঁর বিরুদ্ধে এলাকার মানুষের রাগ আরও বাড়তে থাকে।

২০০৭ সালে নভেম্বর মাসে পুলিশ আমাদের একাধিক আন্দোলনকারীকে গ্রেফতার করে। তাঁদের ছাড়ানোর দাবিতে ২০০৯ সালের মাঝামাঝি সোনাচূড়ায় রিলে অনশনে বসেছিলেন বেশ কয়েকজন আন্দোলনকারী। আমিও ছিলাম ওই রিলে অনশনে। সেখানে নিশিকান্ত মন্ডলকে ডাকা হয়েছিল, কিন্তু তিনি আসেননি। বরং আমি সেই সময় টাকা চেয়ে কয়েকবার তাগাদা দেওয়ায়, আমাকে ধরতে পুলিশ পাঠিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। শুধু তাই নয়, আমাকে ধরতে তৃণমূল কংগ্রেসের কিছু কর্মী এবং নেতা এলাকায় পাহারারও বন্দোবস্ত করে। তখনই কয়েকজন আন্দোলনকারীর মধ্যে আলোচনা শুরু হয়, ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটির টাকা এবং বন্দুক নিয়ে তিনি যা করেছেন, তাঁকে ছেড়ে দেওয়া ঠিক হবে না। শাস্তি প্রাপ্য বেইমান নিশিকান্ত মন্ডলের। সেদিন ছিল ২২ সেপ্টেম্বর, সন্ধেবেলা নন্দীগ্রামের এক জায়গায় ছিলাম। সন্ধে সাতটা নাগাদ একজন এসে খবর দিল, কাজ হয়ে গেছে। বুঝলাম, আন্দোলনকারীদের টাকা নিয়ে বিশ্বাসঘাতকতা করা নিশিকান্ত মন্ডল শেষ।’

আলিপুর আদালত চত্বরে প্রিজন ভ্যানে বসে হুবুহু এই কাহিনী আমাকে বলেছিলেন মদুসূদন মন্ডল। এর পর তো তাঁকে জিজ্ঞেস করা যায় না, কে খুন করল নিশিকান্ত মন্ডলকে। যদিও মদুসূদন মন্ডল নিজে থেকেই বলেছিলেন, ‘এর চেয়ে বেশি জানতে চাইবেন না, কিছু বলতে পারব না। শুধু এটুকু বলতে পারি, নিশিকান্ত  মন্ডলকে কার্বাইন দিয়ে খুন করা হয়েছিল। কার্বাইনটা পুলিশ পরদিন একটা পুকুর থেকে উদ্ধার করে। ওই কার্বাইন দিয়ে কয়েক বছর আগে পুরুলিয়ার বান্দোয়ানে সিপিআইএম নেতা রবি করকেও খুন করা হয়েছিল।’ রবি করের খুনের ঘটনা জানা ছিল আমার। ২০০৬ সালে বিধানসভা ভোটের আগে তাঁকে খুন করেছিল মাওবাদীরা।

নিশিকান্ত মণ্ডলকে কে খুন করেছিল, কেন খুন করেছিল, তা আজও সরকারিভাবে অজানা। পুলিশ তদন্ত করে দোষীদের ধরতে পারেনি। প্রশ্ন শুধু একটাই, যে কার্বাইন দিয়ে সিপিআইএম নেতা রবি করকে খুন করা হয়েছিল, তা যে মাওবাদীদের তা সবারই জানা। তাহলে সেই অস্ত্রই কেন ব্যবহার করা হল  নিশিকান্ত মন্ডলকে খুন করতে? যদিও বা ব্যবহার করা হল, তা কেন খুনি মৃতদেহের পাশের পুকুরে ফেলে দিল, যেখানে জানাই কথা পুলিশ তা উদ্ধার করবে এবং সহজেই জেনে যাবে এই অস্ত্রের ইতিহাস! তবে কি অন্য কেউ তেলেগু দীপক বা তার কোনও সঙ্গীর ২০০৭ সালের নভেম্বরে নন্দীগ্রামে রেখে যাওয়া অস্ত্র দিয়ে নিশিকান্ত মন্ডলকে খুন করে তার দায় মাওবাদীদের ঘাড়ে চাপাতে চেয়েছিল? তাই কি অস্ত্রের এই দুর্মূল্যের বাজারে ইচ্ছে করেই কার্বাইনটা ফেলে দেওয়া হয়েছিল কাছাকাছি পুকুরে? নাকি দু’বছর পর মাওবাদীরাই নন্দীগ্রামে ঢুকে নিশিকান্ত মণ্ডলের বিচার করে ‘বদলা’ নিয়েছিল? কে সে, তার পরিচয় আজও জানা যায়নি। মধুসূদন মন্ডল আমাকে যে ঘটনা বলেছিলেন, তার মধ্যেই কি লুকিয়ে রয়েছে নিশিকান্ত মন্ডলের মৃত্যু এবং খুনির রহস্য? ২০১১ সালে রাজ্যে ক্ষমতায় এসেছে তৃণমূল কংগ্রেস। তারপর দীর্ঘদিন কেটে গেলেও অমীমাংসিতই রয়ে গিয়েছে ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা নেতা নিশিকান্ত মণ্ডলের খুনের রহস্য।

নিশিকান্ত মন্ডলের খুনের খবর নন্দীগ্রাম থানা যখন জানতে পারে, তখন প্রায় সন্ধে ৭টা। সাড়ে সাতটা নাগাদ পুলিশ সোনাচূড়া বাজারের কাছে গিয়ে দেখে, নিশিকান্ত মন্ডলের মৃতদেহ রাস্তায় পড়ে। সারা শরীর ভেসে যাচ্ছে রক্তে। মুখ, চোয়াল থেকে পেট পর্যন্ত গুলিতে ঝাঁঝরা একটা মৃতদেহ পড়ে আছে রাস্তায়। খুনের পেছনে যে তীব্র প্রতিশোধস্পৃহা রয়েছে তা গুলি চালানোর ধরন দেখেই মনে করেছিলেন পুলিশ অফিসাররা। এবং তাঁরা সেটা জানতেনও। তৃণমূল কংগ্রেস নেতা নিশিকান্ত মন্ডলের ওপরে যে মাওবাদী হুমকি রয়েছে তা জানত পূর্ব মেদিনীপুর জেলা পুলিশ। বিভিন্ন স্থানীয় সুত্র মারফত নন্দীগ্রাম থানার অফিসাররা ২০০৯ সালে লোকসভা ভোটের পর থেকেই খবর পাচ্ছিলেন, মাওবাদীরা তাদের জমা রেখে যাওয়া অস্ত্র এবং টাকা ফেরত চাইছে নিশিকান্ত মন্ডলের কাছে। পুলিশের কাছে খবর ছিল, ২০০৭ সালের  ৯ নভেম্বর শেষ যা হিসেব হয়েছিল, তাতে নিশিকান্ত মন্ডলের কাছে আন্দোলনকারীদের আড়াই লক্ষ টাকা রাখা ছিল। তার সঙ্গে জমা ছিল অন্তত ১২-১৪ টা রাইফেল। তার মধ্যে কয়েকটা ছিল তেলেগু দীপকের নিজের আনা বন্দুক, কিন্তু তা ফেরত না পেয়ে তাঁকে হুমকি দিচ্ছিল মাওবাদীরা। বিশেষ করে ২০০৮ সালের শুরুতে আবার নন্দীগ্রামে গিয়েছিলেন তেলেগু দীপক। গোপনে পৌঁছন এবং নিজের মতো করে রাজনৈতিক কাজ শুরু করেন। এমনকী তার পরের বছর ২০০৯ সালে লোকসভা ভোটের আগেও তেলেগু দীপক একাধিকবার নন্দীগ্রামে গিয়েছিলেন। কিন্তু তখন তেলেগু দীপক, মধুসূদন মন্ডলের সঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেসের নেতাদের তিক্ততা চরমে পৌঁছেছিল।

নন্দীগ্রাম থানার এক অফিসার নিশিকান্ত মন্ডলকে একাধিকবার সতর্কও করেন এবং তাঁকে সাবধানে থাকতে বলেন।

সেই বছর, মানে ২০০৯ সালের জুলাই মাসের মাঝামাঝি ২-৩ জন নিশিকান্ত মন্ডলকে একদম তাঁর বাড়ির সামনে তাড়া করে। ধরতে পারলে হয়তো মেরেই দিত। নিশিকান্ত মন্ডল দ্রুত মোটরসাইকেলে চেপে পালাতে চেষ্টা করেন। কিন্তু একটু এগিয়েই একটা বাঁক নিতে গিয়ে তিনি মোটরসাইকেল থেকে পড়ে যান। কিছুটা জখমও হন। স্থানীয় সোর্স মারফৎ এখবর জানতে পারেন পূর্ব মেদিনীপুরের এক সিনিয়র অফিসার। তিনি নিশিকান্ত মন্ডলের বাড়ি চলে যান এই ঘটনার পরদিন। জানতে চান, কেন তিনি এই দুর্ঘটনার খবর পুলিশকে জানাননি। নিশিকান্ত মন্ডল ওই অফিসারকে বলেন, বিষয়টা নিয়ে নাড়াচাড়া না করতে। খুন হওয়ার দু’দিন আগেও নন্দীগ্রাম থানার এক অফিসার নিশিকান্ত মন্ডলকে সাবধান করেছিলেন এবং একা একা ঘোরাঘুরি করতে না বলেছিলেন। সেই কথা না শোনারই মাশুল দিতে হয়েছিল ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্যকে। এবং পুলিশের তদন্তে উঠে এসেছিল, নিশিকান্ত মন্ডলের খুনের পেছনে ছিল তাঁর পুরনো সহযোগীরাই।

নিশিকান্ত মন্ডলের খুনের তদন্ত বন্ধ হয়ে গিয়েছে বহু আগেই। তদন্তে নেমে নন্দীগ্রাম থানা এবং পূর্ব মেদিনীপুরের পুলিশ কর্তারা জানতে পেরেছিলেন, কয়েকমাস ধরেই হুমকি দেওয়া হচ্ছিল নিশিকান্ত মন্ডলকে। নিশিকান্ত মন্ডল এবং স্থানীয় তৃণমূল কংগ্রেস নেতাদের সঙ্গে মধুসূদন মন্ডল এবং মাওবাদীদের বিরোধ মূলত বেঁধেছিল পঞ্চায়েত ভোটের আগে। পঞ্চায়েতে আসন দেওয়া নিয়ে। নন্দীগ্রামের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে। পঞ্চায়েত ভোটে তৃণমূল কংগ্রেস দুর্দান্ত রেজাল্ট করার পরই মাওবাদীরা বুঝে যায়, তাদের সশস্ত্র অংশগ্রহণ যে আন্দোলনকে চূড়ান্ত সাফল্য দিয়েছে, তার রাজনৈতিক ফসল ঘরে তুলে নিয়েছিলেন নিশিকান্ত মন্ডল, শুভেন্দু অধিকারীর তৃণমূল কংগ্রেস। এলাকায় প্রভাব কায়েম রাখতে নিশিকান্ত মণ্ডল এবং মধুসূদন মন্ডল, দুই দুর্দান্ত সংগঠকের মধ্যে ঠান্ডা লড়াই শুরু হয়ে যায়। নিশিকান্ত মন্ডল সিপিআইএম করতেন। পার্টি সদস্যও ছিলেন। নন্দীগ্রামের কৃষক সভার নেতা অশোক গুড়িয়ার সঙ্গে বিরোধের জেরে সিপিআইএম ছাড়েন। নন্দীগ্রামে আন্দোলন শুরু হওয়ার পর থেকেই সক্রিয়ভাবে তৃণমূল কংগ্রেসে যোগ দেন। সাংগঠনিক দক্ষতা  নিশিকান্ত মন্ডল এবং মধুসূদন মন্ডল, কারোরই কম ছিল না। মধুসূদন মন্ডলকে গ্রেফতার করার জন্য নন্দীগ্রামের সোনাচূড়া গ্রাম পঞ্চায়েত প্রধান নিশিকান্ত মন্ডল একাধিকবার পুলিশের ওপর চাপ দেন। কিন্তু পূর্ব মেদিনীপুর জেলা পুলিশ মধুসূদন মন্ডলকে গ্রেফতার করার  জন্য কখনই মহাকরণ থেকে সবুজ সঙ্কেত পায়নি। কেন পায়নি তাও এক রহস্য।

মধুসূদন মন্ডল এবং মাওবাদীরা যেমন নিশিকান্ত মন্ডলকে ‘শাস্তি’ দিতে চেয়েছিলেন, একইভাবে তৃণমূল কংগ্রেস নেতারাও চাইছিলেন বাইরে থেকে সোনাচূড়ায় এসে জাঁকিয়ে বসা মধুসূদন মন্ডলকে শায়েস্তা করতে। গড়চক্রবেড়িয়ার মোড়ে ডাকাবুকো তৃণমূল কংগ্রেসের নেতা সৈয়ম কাজি নিজে দলের ছেলে নিয়ে পাহাড়া দিতেন মধুসূদন মন্ডলকে ধরার জন্য। মধুসূদন যাতায়াতের সময়ও গড়চক্রবেড়িয়া এড়িয়ে চলতেন, কিন্তু সোনাচুড়ায় তখনও তাঁর প্রভাব ছিল যথেষ্টই। আর সেই কারণেই, ভরসন্ধ্যায় নিশিকান্ত মন্ডল খুনের ঘটনা আজও পুলিশের ভাষায়, এফআরটি। ফ্যাক্ট রিমেনস ট্রুথ। ঘটনা ঘটেছে ঠিকই, কেন ঘটছে তাও জানা, কিন্তু কে করেছে, তার হদিস নেই।

 

প্রশাসন, সিপিআইএম এবং গণশক্তি

রাজ্যে তো বটেই সিপিআইএমের নন্দীগ্রাম পুর্নদখল অভিযান প্রবল প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে দেশ এবং বিদেশে। বিরোধীরা লাগাতার অভিযোগ করেছিল, বহিরাগত সশস্ত্র বাহিনী এনে নন্দীগ্রাম অন্দোলনকে গলা টিপে খুন করেছে শাসক দল। শ্লীলতাহানি, ধর্ষণ, খুন থেকে শুরু করে মৃতদেহ লোপাট করে দেওয়া, কোনও কিছুই বাকি রাখেনি সিপিআইএমের ভাড়াটে যোদ্ধারা। এই অভিযোগ বারবারই অস্বীকার করেছে শাসক দল সিপিআইএম এবং সরকার। সিপিআইএমের দাবি ছিল, তৃণমূল কংগ্রেস এবং মাওবাদীদের গণতন্ত্র হত্যাকারী সশস্ত্র আন্দোলনের বিরুদ্ধে তীব্র জনরোষ তৈরি হয় নন্দীগ্রামে, যা কার্যত গণঅভ্যুর্ত্থানের চেহারা নেয় ২০০৭ সালের মাঝামাঝি থেকেই।

সিপিআইএম বারবারই জানায়, সশস্ত্র মাওবাদীদের সামনে কিছুই করতে পারছিল না নিরীহ গ্রামবাসী এবং ঘরছাড়ারা। শেষমেশ সাধারণ মানুষজন ঘরে ফিরতে মরিয়া হয়ে ওঠে এবং তাদের জেদ ও সম্মিলিত প্রতিরোধের সামনে মাওবাদীরা এলাকা ছাড়ে। সাধারণ মানুষের এই প্রতিরোধের সামনেই পিছু হঠতে বাধ্য হয় ভুমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটিও। হাফ ছেড়ে বাঁচে নন্দীগ্রাম।

কিন্তু নন্দীগ্রামে পুলিশ প্রশাসনকে দীর্ঘদিন একেবারে নিষ্ক্রিয় করে রেখে দলীয় ক্যাডারদের ব্যবহার করার যে সিদ্ধান্ত সিপিআইএম নিয়েছিল, তার মধ্যে তো লুকোছাপা কিছু ছিল না সেই ৫ জানুয়ারি থেকেই। নন্দীগ্রাম সহ গোটা রাজ্যের কাছেই এটা পরিষ্কার ছিল, সিপিআইএম এবং ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটি একে অন্যের বিরুদ্ধে মরণপন যুদ্ধে নেমেছে। সে যুদ্ধ শুরু হয়েছিল  জানুয়ারি মাসের ৫-৬ তারিখ থেকে। একদম প্রথমে এই যুদ্ধ ৩ জানুয়ারি নন্দীগ্রাম থেক উচ্ছেদ হওয়া কিছু সিপিআইএম কর্মী এবং খেজুরির কিছু সিপিআইএম কর্মীর যোথ বাহিনীর সঙ্গে শুরু হয়েছিল ভুমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটির। দু’পক্ষই আস্তে আস্তে শক্তিবৃদ্ধি করে। সিপিআইএমের স্থানীয় ছেলেদের সঙ্গে যোগ দেয় মাস্টারদার প্রশিক্ষিত পশ্চিম মেদিনীপুর বাহিনী। অন্যদিকে ভুমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটির শক্তিবৃদ্ধি করে মাওবাদীরা। কিন্তু সিপিআইএমের এই যে বহিরাগতদের নিয়ে লড়াইয়ের স্ট্র্যাটেজি, তা পার্টির কোন পর্যায়ে চূড়ান্ত হয়েছিল তা নিয়ে মুজফফর আহমেদ ভবনের সঙ্গে তমলুক জেলা পার্টির বরাবরই বিরোধ বেধেছে।  নভেম্বরের ১১-১২ তারিখ নন্দীগ্রাম পুনরুদ্ধার সম্পূর্ণ হওয়ার কয়েক সপ্তাহ পর দিল্লি গিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। দিল্লিতে গিয়ে সাংবাদিক বৈঠকে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য প্রথম বলেন, ‘নন্দীগ্রামে আমাদের প্রশাসনিক, সাংগঠনিক এবং রাজনৈতিক ব্যর্থতা হয়েছে।’ পরে এই একটি বাক্যই নন্দীগ্রাম নিয়ে সিপিআইএমের স্ট্যান্ডার্ড মূল্যায়ন হিসেবে উঠে আসে। প্রশাসনিক, সাংগঠনিক এবং রাজনৈতিক ব্যর্থতার কোনও বিস্তারিত ব্যাখ্যা সিপিআইএম নেতারা দেননি। পাশাপাশি, দিল্লির ওই সাংবাদিক বৈঠকে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য বলেছিলেন, ‘দে হ্যাভ বিন পেইড ব্যাক বাই দেয়ার ওন কয়েন’, এই কথা বলা তাঁর ঠিক হয়নি।

৩১ আলিমুদ্দিন স্ট্রিট বারবারই বলার চেষ্টা করেছে, নন্দীগ্রামে গণ্ডগোলের কোনও দায় রাজ্য পার্টির কিংবা রাজ্য নেতৃত্বের নেই। সবই হয়েছে, পূর্ব মেদিনীপুর জেলা পার্টির সিদ্ধান্তে। আর সেই কারণেই, ২০১৫ সালে কলকাতার প্রমোদ দাশগুপ্ত ভবনে সিপিআইএমের রাজ্য সম্মেলনে পেশ করা ‘বামফ্রন্ট সরকার একটা পর্যালোচনা (খসড়া)’ রিপোর্টে নন্দীগ্রাম প্রসঙ্গে ২৯ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে, ‘যদিও স্থানীয় নেতৃত্বের একাংশের অপ্রয়োজনীয় তৎপরতার ফলে মানুষের মনোভাব আমাদের বিরুদ্ধে গেছে।’

রাজ্য কমিটির এই এক বাক্যের ব্যাখ্যা চরম হাস্যকর এবং রাজ্য নেতাদের গা বাঁচানোর চেষ্টা বলেই জানিয়েছিলেন পূর্ব মেদিনীপুর জেলার নেতারা। কিন্তু লক্ষ্মণ শেঠ ২০১২ সালে পার্টির রাজ্য সম্মেলনে রাজ্য কমিটি থেকে বাদ যাওয়ার পর ওই জেলার কোনও নেতার পক্ষেই এই কথা প্রকাশ্যে বলার হিম্মত ছিল না। অথচ, নন্দীগ্রাম, খেজুরি, হলদিয়ার নেতারা প্রথম দিন থেকে সবই জানতেন।

আমি ব্যক্তিগতভাবে বরাবরই বিশ্বাস করি, কোনও স্থানীয় নেতৃত্বের একাংশের তৎপরতায় এত বড় কাণ্ড নন্দীগ্রামে ঘটেনি এবং ঘটা সম্ভবও নয়। ৩ জানুয়ারি যখন নন্দীগ্রামে পুলিশকে আটকে রাখা, মারধর করা, জিপ পোড়ানো, রাস্তা কাটা চলছিল, তার দুদিন আগে থেকেই গোটা দেশের সিপিআইএম নেতারা কলকাতায় উপস্থিত ছিলেন। দলের পলিটব্যুরো এবং কেন্দ্রীয় কমিটির মিটিংয়ের জন্য। কিন্ত লক্ষ্মণ শেঠ তখন ছিলেন হলদিয়ায়। কারণ, তখন হলদিয়া উৎসব চলছে। সেদিন সন্ধে, রাতের মধ্যে মুজফফর আহমেদ ভবনে নন্দীগ্রামের খবর মোটামুটি এসে পৌঁছেছিল। পরদিন ৪ তারিখ সকালে রাজ্যের সমস্ত শীর্ষ নেতাই ৩১ আলিমুদ্দিন স্ট্রিটে পৌঁছেছিলেন নিয়মমাফিক । তারপর নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে সেখান থেকেই দলের এক শীর্ষ নেতা লক্ষ্মণ শেঠকে ফোন করে বলেন, ‘নন্দীগ্রামে এত বড় গণ্ডগোল শুরু হয়েছে, আর আপনি উৎসব নিয়ে হলদিয়ায় ব্যস্ত? এখুনি খেজুরিতে যান। ঘরছাড়াদের জন্য ক্যাম্পের ব্যবস্থা করুন। খেজুরিতে গিয়ে বলুন, এই আক্রমণ মোকাবিলার জন্য প্রস্তুতি রাখতে হবে।’

হলদিয়া উৎসব ফেলে লক্ষ্মণ শেঠ কিছু বাদেই খেজুরির দিকে রওনা দেন এবং সেখানকার নেতাদের নির্দেশ দেন, নন্দীগ্রামের ঘরছাড়াদের জন্য ক্যাম্প করতে এবং তৃণমূলের আক্রমণের মোকাবিলা করতে। তখনও ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটি তৈরি হয়নি। এরপর সেই ক্যাম্প থেকেই ৫ তারিখ রাতে প্রথমে বোমা এবং পরদিন রাত থেকে গুলি, বোমা ছোড়া শুরু হল নন্দীগ্রাম লক্ষ্য করে। ৭ তারিখ ভোরে সেই গুলিতেই নন্দীগ্রামে প্রথম তিনজনের মৃত্যু এবং শঙ্কর সামন্তকে খুন করে তার বদলা। কোন খবরটা জানতেন না রাজ্য নেতারা?

পশ্চিম মেদিনীপুর পার্টি গড়বেতা, কেশপুর, চন্দ্রকোণার সশস্ত্র বাহিনীকে পাঠাল নন্দীগ্রামে। এরপর দক্ষিণ ২৪ পরগনার কুখ্যাত দুষ্কৃতী সেলিম লস্কর দলবল নিয়ে ধরা পড়ল হলদিয়া থেকে। নন্দীগ্রাম অভিযানে গিয়েছিল সেও। ২০০৭ সালে পুজোর পরে উত্তর ২৪ পরগনায় রাজারহাট এলাকায় এক প্রভাবশালী সিপিআইএম নেতার ছত্রছায়ায় থাকা কিছু বাছাই করা সশস্ত্র দুষ্কৃতীকে পাঠানো হয়েছিল নন্দীগ্রামে। হুগলি থেকে কিছু ছেলেকে সেই সময়ই খেজুরিতে পাঠানো হয়েছিল। সেলিম লস্করকে সিআইডি হলদিয়া থেকে গ্রফতার করার পর সিপিআইএমের পূর্ব মেদিনীপুরে বহিরাগত পাঠানোর তত্ত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। যার জেরে এই গ্রেফতার নিয়ে তোলপাড় পড়ে গিয়েছিল পার্টিতে এবং প্রশাসনে। সিআইডি খবর পেয়েছিল দক্ষিণ ২৪ পরগনার কুখ্যাত দুষ্কৃতী সেলিম লস্কর হলদিয়ার এক গেস্ট হাউসে লুকিয়ে রয়েছে। কলকাতা থেকে রওনা দিয়ে সিআইডি অফিসাররা গভীর রাতে হলদিয়া পৌঁছেছিলেন। হলদিয়া থানায় গিয়ে তাঁরা সেখানকার স্থানীয় অফিসারদের সাহায্য চান। হলদিয়া থানা সেলিমের নাম শুনে জানিয়ে দিয়েছিল, সিআইডির সঙ্গে এই চল্লাশি অভিযানে তারা থাকতে পারবে না। নন্দীগ্রাম পুনরুদ্ধারে পূর্ব মেদিনীপুরে বহিরাগত পাঠানোর কোন খবরটা জানত না বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের প্রশাসন কিংবা পশ্চিম মেদিনীপুর, উত্তর ২৪ পরগনা, দক্ষিণ ২৪ পরগনা এবং হুগলি জেলার পার্টির শীর্ষ নেতৃত্ব?

সিপিআইএম পার্টির যে সাংগঠনিক কাঠামো তাতে এক জেলা কমিটির কোনও কাজ কিংবা সিদ্ধান্তে অন্য জেলা তো বটেই, রাজ্য কমিটি পর্যন্ত হস্তক্ষেপে করে না। সেখানে ৩-৪ টে জেলা থেকে লাইন দিয়ে সশস্ত্র রেড আর্মি নন্দীগ্রাম, খেজুরি যাচ্ছে। কালো গেঞ্জি, কালো হাফ প্যান্ট পড়ে গেরিলা কায়দায় মাসের পর মাস বন্দুক ধরে যুদ্ধ করছে, জানত না রাজ্য পার্টি? আর লক্ষ্মণ শেঠ কিংবা পূর্ব মেদিনীপুর জেলা পার্টির ‘স্থানীয় নেতৃত্বের একাংশ’ যদি রাজ্য শীর্ষ নেতৃত্বকে অন্ধকারে রেখে এত কিছু করার মতো প্রভাবশালীই হবেন, তবে তাঁকে তো ক্ষমতা থেকে চলে যাওয়ার পরেই রাজ্য কমিটি থেকে বাদ যেতে হোত না। আর সেই ‘স্থানীয় নেতৃত্বের একাংশে’রও পার্টিতে প্রমোশনই হোত! আসলে নন্দীগ্রামে কী ঘটেছে, কেন ঘটছে সবাই সব জানতেন। আর জানতেন বলেই ২০০৭ সালের ওই ১১ মাস কিংবা পরবর্তী সময়ের নন্দীগ্রাম নিয়ে কোনও বস্তুনিষ্ঠ মূল্যায়ন মুজফফর আহমেদ ভবনে করতে পারেনি।

রাজনৈতিক দলের বয়ানে নন্দীগ্রাম নিয়ে সত্য কোনও দিনই উঠে আসবে না, জানতাম। ২০০৭ সালের পুজোর পর থেকে ১০ নভেম্বর পর্যন্ত ঠিক কী ঘটেছিল নন্দীগ্রামে, তা নিয়ে সিপিআইএম এবং তৃণমূল কংগ্রেসের অভিযোগ, পালটা অভিযোগের মধ্যে থেকে রাজ্যের সাধারণ মানুষের পক্ষে এটাও  বুঝে নেওয়া কঠিন ছিল, কে কতটা সত্যি কথা বলছে। দীর্ঘ ১১ মাস সময়কালে নন্দীগ্রামে ঘটা সমস্ত কাণ্ডকারখানা নিয়ে আমার ব্যাখ্যা কোনও রাজনৈতিক দলের পছন্দ নাও মনে হতে পারে, বিশেষ করে সিপিআইএমের। কিন্তু সেই সময় কী বলেছিল সিপিআইএমের মুখপত্র গণশক্তি পত্রিকা? গণশক্তিতে খবর পড়ে কী আদৌ আলোকপাত করা সম্ভব ছিল, নভেম্বর মাসের ১০-১২ দিনে কী ঘটেছিল নন্দীগ্রামে? নন্দীগ্রাম নিয়ে সিপিআইএম শীর্ষ নেতৃত্ব এবং প্রশাসন যে সবই জানত, তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ পার্টি মুখপত্র গণশক্তি পত্রিকা।

 

পড়ুন আগের পর্ব: নন্দীগ্রাম আসলে যা ঘটেছিল #১৮: সুদীপ চোঙদার, তেলেগু দীপক ১০ নভেম্বর জলপথে নন্দীগ্রাম ছাড়ল

৪-৫ নভেম্বর থেকে নন্দীগ্রাম দখলের শেষ লড়াই শুরু করেছিল মাস্টারদার বাহিনী। ৬ তারিখ সকাল থেকেই সেখানে প্রবেশের সমস্ত রাস্তায় নো-এন্ট্রি বোর্ড ঝুলিয়ে দিয়েছিল স্থানীয় সিপিআইএম ক্যাডাররা। সংবাদমাধ্যম থেকে শুরু করে যে কোনও বাইরের লোকের প্রবেশ নিষিদ্ধ হয়ে গিয়েছিল নন্দীগ্রামে। ঠিক সেই সময়, ৫ নভেম্বর বিকেলে হাওড়া ডুমুরজলা মাঠে সমাবেশ ছিল  সিপিআইএমের। হাওড়া জেলা সিপিআইএমের জেলা সম্মেলন উপলক্ষ্যে সমাবেশ। তারা তখন পূর্ণ শক্তিতে ক্ষমতায়। মাঠও ভরেছিল ভালই। মূল বক্তা বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য।

পরদিন ৬ নভেম্বর গণশক্তি পত্রিকায় প্রথম পাতায় লিড খবর, যার শিরোনাম, ‘নন্দীগ্রামে তৃণমূল সন্ত্রাস বেশি দিন চলবে নাঃ মুখ্যমন্ত্রী।’

খবরের প্রথম প্যারাগ্রাফ, ‘ভয় দেখিয়ে, খুন, সন্ত্রাস করে বেশি দিন টিকে থাকা যায় না, ইতিহাস থেকে  তৃণমূল কংগ্রেসকে এই শিক্ষা নিতে বললেন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। সোমবার সিপিআইএমের হাওড়া জেলা সম্মেলন উপলক্ষ্যে ডুমুরজলা ময়দানে অনুষ্ঠানিক প্রকাশ্য জনসমাবেশে মুখ্যমন্ত্রী হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, নন্দীগ্রামে যে ভয়ঙ্কর রাজনীতি চলছে তা কোনওমতেই বেশি দিন চলতে পারে না। যেমন চলেনি বাহাত্তরের সন্ত্রাস, কেশপুরের সন্ত্রাস।’  দুই বাক্যের প্রথম প্যারাগ্রাফ শেষ।

রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী এবং দলের পলিটব্যুরো সদস্য যে মন্তব্য করেছেন তাতে তো আপাতদৃষ্টিতে অন্যায় কিছু নেই। সত্যিই তো,  সন্ত্রাস বেশি দিন চলতে পারে না। তা একদিন শেষ হবেই। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রীর এই বক্তব্যের আগে ‘হুঁশিয়ারি’ শব্দটা কেন যোগ করল দলের মুখপত্র?

চলবে

(১৮ সেপ্টেম্বর থেকে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হচ্ছে নন্দীগ্রাম আসলে যা ঘটেছিল। প্রতি পর্বে লাল রং দিয়ে আগের পর্বের লিঙ্ক দেওয়া থাকছে)

Comments are closed.