নন্দীগ্রাম আসলে যা ঘটেছিল #২২: থমথমে মুখে শুভেন্দু বেরোলেন সুফিয়ানের বাড়ি থেকে, ফের গেলেন বয়ালের মাঠে

আগের পর্ব যেখানে শেষ হয়েছিল: ১১ মাস ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটির কবজায় থাকার পর নন্দীগ্রাম উদ্ধার করল সিপিআইএম। তারপর এল ২০০৮ সালের পঞ্চায়েত ভোট। কিন্তু প্রশাসনের ওপর তখন আর কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই বুদ্ধদেব ভটাচার্যের………

 

পঞ্চায়েত ভোট ২০০৮

একথা আমি সবসময় মনে করেছি, সাংবাদিক জীবনে আমার সেরা শিক্ষকের নাম নন্দীগ্রাম এবং সেখানে বারবার যাওয়ার অভিজ্ঞতা। আর নিঃসংশয়ে, গোটা নন্দীগ্রাম পর্বে ২০০৭ এর নভেম্বরে সিপিআইএমের সশস্ত্র অভ্যুত্থানের সামান্য অংশের সাক্ষী থাকার মতোই আমার অন্যতম সেরা অভিজ্ঞতা পরের বছর, ২০০৮ সালের পঞ্চায়েত ভোট।

প্রায় দশ মাস তৃণমূল কংগ্রেসের নেতৃত্বে ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটি নামক এক বহুদলীয় জোটের হাতে বন্দি ছিল নন্দীগ্রাম। এই জোটে ছিল সশস্ত্র মাওবাদী থেকে শুরু করে মাত্র পাঁচ বছর বয়সে চোখের সামনে মানুষ খুন হতে দেখা শিশুও। এই বহুদলীয় আধিপত্য ভেঙেছে ২০০৭ সালের নভেম্বরে। তারপর নন্দীগ্রামে কায়েম হল রাজ্যের শাসক দল সিপিআইএমের একদলীয় শাসন ব্যবস্থা, যা অনেকটাই জরুরি অবস্থার সামিল। সাত মাস সিপিআইএমের হাতে অবরুদ্ধ থাকার পর ২০০৮ সালের মে মাসে নন্দীগ্রামের দুই ব্লকের মানুষের প্রথম পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ এল পঞ্চায়েত ভোটে। কোনও একটা পক্ষ নেওয়ার পরীক্ষা। পরীক্ষা এই কারণেই, এই ভোটেই তাকে ঠিক করে নিতে হবে কার সঙ্গে সে থাকবে। তৃণমূল কংগ্রেস না সিপিআইএম। কেন ঠিক করে নিতে হবে, এই দুই দলের মধ্যে কোনও একটিকে? কারণ, অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে নন্দীগ্রাম জানে, এই মাটিতে জীবনের পরোয়া করে না এমন পুরুষ পাওয়া যাবে, সম্মান-মর্যাদা গেছে একাধিকবার, তাও হার মানেনি এমন মহিলা পাওয়া যাবে। অবলীলায় মানুষ খুন করে দেবে এমণ যোদ্ধা পাওয়া যাবে, ধর্মনিরপেক্ষ মানুষও পাওয়া যাবে বিস্তর, কিন্তু রাজনৈতিক অবস্থানের কোনও পক্ষে নেই এমন একজনও পাওয়া যাবে না। নন্দীগ্রামে সবাই পুরোদস্তুর রাজনৈতিক এবং কোনও না কোনও দলের সঙ্গেই আছে। সেই ২০০৬ সালের শেষ থেকে। রাজ্যের আর পাঁচটা গ্রামীণ এলাকায় যে নিজস্ব সারল্য এবং জীবনযাত্রার যে নিস্তরঙ্গ গতি থাকে, সেই সময় থেকেই তা নন্দীগ্রামে লোপ পেয়েছে পুরোমাত্রায়। রাজনৈতিক অবস্থানই হয়ে উঠেছিল মানুষের প্রথম এবং একমাত্র পরিচয়, যা জটিল করে তুলেছিল পারস্পরিক সম্পর্ককে। জন্ম দিয়েছিল হিংসা এবং প্রতিহিংসার। পেট্রোরসায়ন শিল্পতালুক হয়নি, কিন্তু তা গড়ে তোলার উদ্যোগ কয়েক মাসের মধ্যে নন্দীগ্রামে এমন তীব্র রাজনৈতিক মেরুকরণের জন্ম দিয়েছিল, যেখানে কোনও বিষয়ে সহমত মানে এক পক্ষে, ভিন্নমত মানেই শত্রু। আর এমন শত্রু, যাকে খুন করতে হাত কাঁপবে না একটুও। এমনই শত্রু, বহুদিনের চেনা পাশের বাড়ির মহিলাকে শারীরিক অত্যাচার করতেও বুক কাঁপবে না। এই তীব্র রাজনৈতিক মেরুকরণই জন্ম দিয়েছিল তীব্র ঘৃণা, বিদ্বেষ এবং অবিশ্বাসের। যে ঘৃণা, বিদ্বেষ আর প্রতিশোধস্পৃহা আঠারো মাসেরও বেশি সময় বুকের মধ্যে চেপে রেখে ২০০৮ সালের ১১ মে নন্দীগ্রামে রাজনৈতিক সংগ্রামের মুখোমুখি হয়েছিল রাজ্যের দুই প্রধান দল, সিপিআইএম এবং তৃণমূল কংগ্রেস। যে ভোটের ফলাফল নতুন সমীকরণ তৈরি করেছিল বাংলার রাজনীতিতে। স্থাপন করেছিল নয়া দৃষ্টান্ত, যা কিন্তু মোটেও সহজ ছিল না। যে রেজাল্ট দেখিয়ে দিল, জনমত যদি তীব্র হয়, মানুষের সরকারবিরোধী অবস্থান যখন দৃঢ় হয় আর তার সঙ্গে যদি কাজ করে বদলা নেওয়ার জেদ, তবে সাত মাস  প্রায় জরুরি অবস্থা জারি থাকার পর সমস্ত বুথে নিশ্ছিদ্র নিয়ন্ত্রণ কায়েম করে এবং পুলিশ প্রশাসনের একশো শতাংশ সমর্থন থাকলেও ভোটে জেতা যায় না। আর সেই সঙ্গে এই ভোটের রেজাল্ট সিপিআইএমকে উত্তর দিয়েছিল বহুদিন ধরে মীমাংসা না হওয়া এক প্রশ্নের। অধিকাংশ মানুষের সমর্থন না নিয়ে স্রেফ শাসক দলের সুবিধাকে কাজে লাগিয়ে সংসদ বহির্ভূত কার্যকলাপ করলে সাময়িক সাফল্য মিলতেও পারে, কিন্তু তা ধরে রাখা দিনকে রাত করার মতোই অসম্ভব এবং অবাস্তব ভাবনা। বহিরাগতদের সশস্ত্র লড়াই সাফল্য পায় তখনই, যেখানে ক্লান্ত, শ্রান্ত যোদ্ধাদের জন্য খাবারের থালা, জলের গ্লাস এগিয়ে দেয় স্থানীয় সাধারণ মানুষ। কিন্তু সশস্ত্র বাহিনী আসছে এই ভয়ে, আশঙ্কায় যেখানে স্থানীয় মানুষ সদর দরজার বাইরে থেকে তালা-চাবি মেরে ঘরের ভেতরে লুকিয়ে বসে থাকে, সেখানে এই সংসদ বহির্ভূত লড়াইয়ের পরিণতি এক কথায়, ২০০৮ সালের ভোটে নন্দীগ্রামের ১৭ টা গ্রাম পঞ্চায়েতের রেজাল্ট।

২০০৭ সালের ১৩ নভেম্বর। তেখালি ব্রিজের উপর দাঁড়িয়ে আছি। আগের দিন রাতে একটা খবর পেয়েছিলাম তমলুকের হোটেলে বসে। তেখালি ব্রিজের ওপর ইএফআর’এর একটা ক্যাম্প ছিল। খেজুরি থেকে সিপিআইএম বা নন্দীগ্রাম থেকে ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটি যাতে একে অপরকে আক্রমণ করতে না পারে তার জন্য সেই বছর মাঝামাঝি বসানো হয়েছিল ওই ক্যাম্পটা। তাতে দু’দলের আক্রমণ, প্রতি আক্রমণ খুব একটা থামেনি ঠিকই, কারণ, নন্দীগ্রামের বাকি অংশে যেভাবে রাজ্য পুলিশ নিষ্ক্রিয় হয়ে বসে ছিল, একইভাবে সেখানেও ৫-৬ জন ইএফআর জওয়ান নিষ্ক্রিয় হয়েই হয়ে বসে থাকতেন। কিন্তু ওদিকে যে ঠিক হয়েছে নভেম্বরের গোড়ায় সিপিআইএম বাহিনী নন্দীগ্রাম দখলে নামবে।  ইএফআর জওয়ানদের চোখের সামনে এসব করলে খুবই দৃষ্টিকটূ দেখায়। তাই সিপিআইএমের শেষ অভিযান শুরুর  ঠিক আগে রাজ্য পুলিশের ডিজি অনুপভূষণ ভোরা নিজে জেলার পুলিশ সুপার সত্যশঙ্কর পান্ডাকে ফোন করে বলেছিলেন, ইএফআর ক্যাম্প তুলে দিতে। নন্দীগ্রাম থানার ওসি আবার ডিজির এই নির্দেশের কথা জেনারেল ডায়েরিও করে রেখেছিলেন। তা নিয়ে পরে রাজ্য পুলিশ এবং সিআইডিতে বহু জলঘোলা হয়েছিল। ১২  নভেম্বর রাতে আমি খবর পাই, ডিজির নির্দেশে তেখালি ব্রিজের ইএফআর ক্যাম্প তুলে সিপিআইএমের সশস্ত্র বাহিনীকে নন্দীগ্রামে ঢোকার সুবিধা করে দিয়েছিল প্রশাসন। এই একটি ঘটনা সিপিআইএমের সশস্ত্র অভিযানের সঙ্গে প্রশাসনিক যোগসাজশের অব্যর্থ প্রমাণ। সেই খবর করতে ১৩ তারিখ গেলাম সেখানে। গিয়ে দেখি তেখালি ব্রিজের উপর দাঁড়িয়ে সিপিআইএম নেতা অশোক গুড়িয়া এবং অশোক বেরা। সাংগঠনিক শক্তি পুনরুদ্ধারের কাজ তদারকি করছেন। এগিয়ে গেলাম তাঁদের দিকে।

‘কী খবর, কেমন আছেন?’  জিজ্ঞেস করলাম।

‘ভালো। আর কোনও সমস্যা নেই। নন্দীগ্রামে শান্তি ফিরে এসেছে। সবাই বাড়ি ফিরেছে। এখন থেকে সব জায়গায় ঘুরে খোলা মনে কাজ করতে পারবেন,’ জবাব দিলেন অশোক গুড়িয়া।

‘কিন্তু আপনারা যা করেছেন, রাজনীতি, আন্দোলন তো দূরে থাক, এই লোকগুলো আর জীবনেও বিরোধী দল করার কথা ভাববে না। পঞ্চায়েত ভোটে তো আপনাদের বিরুদ্ধে প্রার্থীই দিতে পারবে না কেউ।’

‘না না। কী যে বলেন।’ জেলার কৃষক সভার নেতার চোখ-মুখে সেই ছদ্ম  বিনয়ীভাব আর উজ্জ্বল হাসি বাঁধিয়ে রাখার মতো।

‘দেখবেন, মিলিয়ে নেবেন আমার কথা। আপনাদেরই বিরোধী দলের ক্যান্ডিডেট ঠিক করে দিতে হবে। ‘

একথা শুনে গর্বিত মুখে ঘাড় নেড়েছিলেন নন্দীগ্রামের দুই সিপিআইএম নেতা। নন্দীগ্রামের মানুষের জেদ এবং মনের জোরকে আমি বেশ কয়েকবার খাটো করে দেখেছি। সিপিআইএমের সর্বাত্মক দখলদারির পর সেদিন তেখালি ব্রিজে দাঁড়িয়েও নন্দীগ্রামের মানুষকে যেভাবে আন্ডারএস্টিমেট করেছিলাম, তার সুদে-আসলে জবাব পেয়েছিলাম কয়েক মাস পরেই পঞ্চায়েত ভোটে। সিপিআইএমকে প্রত্যাখ্যানের প্রতিজ্ঞা কত তীব্র হতে পারে তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিলেন  নন্দীগ্রামের  দুই ব্লকের ১৭ টি গ্রাম পঞ্চায়েতের মানুষ।

অথচ তা দেখিয়ে দেওয়া অতটা সহজও ছিল না। বিশেষ করে নভেম্বরে সিপিআইএম নন্দীগ্রামের দখল নেওয়ার পর সেখানে বিরোধী রাজনীতিই কার্যত নিষিদ্ধ হয়ে গিয়েছিল। এবং বিরোধীদের জন্য অবস্থা কতটা খারাপ হয়েছিল তা বোঝার জন্য দুটো ঘটনাই যথেষ্ট।

পঞ্চায়েত ভোটের  ঠিক সাত দিন আগে আমি নন্দীগ্রামে যাই। একদিন বিকেলে অফিসে বসে আছি, খবর এল নন্দীগ্রামে এক মহিলাকে ধর্ষণ করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, প্রায় বিবস্ত্র করে তাঁকে ঘোরানো হয়েছে এলাকায়। তা নিয়ে এলাকায় তীব্র উত্তেজনা। তৃণমূল কংগ্রেস অভিযোগ করল, তাদের সমর্থক এবং জমির আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণকারী ওই মহিলাকে সিপিআইএম কর্মীরা ধর্ষণ এবং অত্যাচার করেছে ভোটের আগে এলাকায় আতঙ্ক সৃষ্টি করার জন্য। যথারীতি অভিযোগ অস্বীকার করল সিপিআইএম। শাসক দলের পালটা বক্তব্য, ধর্ষণের  মিথ্যে অভিযোগ সামনে এনে তাদের দলের কর্মীদের ভোটের আগে হেনস্থার চক্রান্ত করছে বিরোধীরা।

নন্দীগ্রামের মহিলাদের ওপর অত্যাচারের ঘটনা নতুন কিছু নয়। কিন্তু ভোটের ঠিক সাতদিন আগে এই অভিযোগ এবং পালটা অভিযোগকে কেন্দ্র করে নতুন করে উত্তেজনা ছড়াল নন্দীগ্রামে। কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ওই ঘটনা নিয়ে কলকাতায় এমন রাজনৈতিক চাপান-উতোর শুরু হল, মহাকরণে রাজ্য পুলিশের আইজি (আইন-শৃঙ্খলা) রাজ কানোজিয়া সিআইডি তদন্তের ঘোষণা করলেন। সেই রাতেই এক সপ্তাহের জন্য রওনা দিলাম নন্দীগ্রামের উদ্দেশ্যে। ভোট ১১ মে।

তমলুকে থাকছি, রোজ যাতায়াত করছি নন্দীগ্রামে। ভোটের ঠিক দু’দিন আগে বিকেল পাঁচটায় নিয়মমাফিক প্রচার শেষ। সেই দিনই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জনসভা করবেন নন্দীগ্রামে। তার আগে বা পরেও বহুবার দেখেছি, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নন্দীগ্রাম, হলদিয়া বা পূর্ব মেদিনীপুর জেলার অন্য কোথাও গেলে শিশির অধিকারী গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করতেন মেচেদা, তমলুক বা নন্দকুমারের মোড়ে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের গাড়ি পৌঁছালে তাঁর গাড়িতে উঠে যেতেন কিংবা একসঙ্গে কনভয়ে যেতেন। সেদিনও একই বন্দোবস্ত ছিল। দুপুর দুটো- আড়াইটা নাগাদ শিশির অধিকারী তৃণমূল নেত্রীকে নিয়ে নন্দীগ্রামে ঢুকেছিলেন। সেইদিনই সমাবেশ ছিল নন্দীগ্রামের ২ নম্বর ব্লকের বয়াল নামে একটা এলাকায়। আন্দোলনের উৎসস্থল গড়চক্রবেড়িয়া বা সোনাচূড়ায় সমাবেশ করার হিম্মত তখন ছিল না তৃণমূল কংগ্রেসের। সিপিআইএম বিরোধী জমি রক্ষা আন্দোলনের উৎপত্তিস্থল ওই সব এলাকায় প্রকাশ্যে পতাকা ধরারও লোক সেই সময় ছিল না বিরোধীদের।

৯ মে ২০০৮, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সমাবেশ নন্দীগ্রামে। ১১ মে রাজ্যে প্রথম দফার পঞ্চায়েত ভোট। সকালে তমলুক থেকে নন্দীগ্রামে না গিয়ে অপেক্ষা করছিলাম মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্য। ঠিক করেছিলাম, তৃণমূল নেত্রী এলে তাঁর সঙ্গেই নন্দীগ্রামে ঢুকব। সে কথা জানিয়েও দিয়েছিলাম তাঁকে। কখন, কোথায় সিপিআইএম বাহিনী তাঁর কনভয় আটকে দেয় কোনও ঠিক নেই। দুপুরে একদম তমলুক থেকেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের গাড়ির পিছু নিলাম। চন্ডিপুর মোড় দিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের গাড়ি ঢুকছে নন্দীগ্রামের দিকে। চারিদিকে লাল পতাকায় মোড়া। মাঝে মধ্যে দু’একটা ঘাস ফুলের ফ্ল্যাগ আছে লুকিয়ে চুরিয়ে। রাস্তায় লোকজন নেই বিশেষ। অসম্ভব গরম। কিন্তু তার জন্য নয়, রাস্তায় কেন লোকজন নেই তা পরে বুঝেছিলাম। সমাবেশস্থলে না গিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের গাড়ি সোজা গিয়ে থামল তৃণমূলের স্থানীয় প্রভাবশালী নেতা শেখ সুফিয়ানের বাড়িতে। বড়ো দোতলা বাড়ি। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, মুকুল রায়, শিশির অধিকারী বাড়ির ভেতরে ঢুকে গেলেন। আমার সঙ্গী ক্যামেরাম্যান শ্যামল জানা। দু’জনে সুফিয়ানের বাড়ির বাইরে গাছের নীচে দাঁড়িয়ে আছি। এক এক করে আরও কয়েকজন সাংবাদিকও এলেন সেখানে। সবাই একসঙ্গে গল্প করছি। প্রথমে ভেবেছিলাম, এতটা রাস্তা এই গরমে এসেছেন, সুফিয়ানের বাড়িতে একটু বিশ্রাম নিয়ে তৃণমূল নেত্রী কিছুক্ষণের মধ্যেই সমাবেশস্থলে যাবেন। কিন্তু তাঁর বাড়ি থেকে বেরোনোর কোনও নামগন্ধই নেই। বাইরে অপেক্ষা করছি, কিছুক্ষণ পরেই হন্তদন্ত হয়ে সুফিয়ানের বাড়িতে এলেন শুভেন্দু অধিকারী। প্রায় সওয়া তিনটে বাজে। সমাবেশের সময় দেওয়া হয়েছে তিনটে। পাঁচটায় প্রচার শেষ। তার মধ্যে সমাবেশ করতে হবে। শুধু তাই নয়, পাঁচটার পরে নন্দীগ্রামে থাকতেও পারবেন না মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, মুকুল রায়, শিশির অধিকারী, শুভেন্দু অধিকারী বা বাইরের কেউ। এমনই নির্বাচন কমিশনের নিয়ম। কোনও এলাকায় সেখানকার ভোটার এবং নির্বাচনের কাজে যুক্ত ব্যক্তি ছাড়া বাইরের কেউ ভোট শেষের ৪৮ ঘণ্টা আগে থেকে সেখানে থাকতে পারেন না। আমি মনে মনে হিসেব করছি, তৃণমূল নেত্রীকে সাড়ে চারটে, বড়জোর পৌনে পাঁচটার মধ্যে জনসভা শেষ করতেই হবে। নয়তো পাঁচটার মধ্যে নন্দীগ্রাম থেকে বেরোতে পারবেন না, সে ক্ষেত্রে নির্বাচনের নিয়মভঙ্গ হবে। অথচ প্রায় সাড়ে তিনটে বাজে, তিনি এখনও সুফিয়ানের বাড়িতে। হঠাৎ দেখি সুফিয়ানের এক ছেলে বাড়ির বাইরে এল।

‘দিদি কখন বেরোবে?’ এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম সুফিয়ানের ছেলেকে।

‘একটু পরেই বেরোবে, এত গরম। তাই অপেক্ষা করছে সবাই।’ জবাব দিয়ে সে দ্রুত বাড়ির ভেতরে ঢুকে গেল।

আমার মনে ততক্ষণে অন্য সন্দেহ দানা বাঁধতে শুরু করেছে, তবে কি কিছু বড়সড় ঘটেছে নন্দীগ্রামে? বা রাজ্যের অন্য কোথাও? কিছু গোলমাল হল? শুভেন্দু অধিকারী ছিলেন বয়ালের মাঠে, যেখানে জনসভা হওয়ার কথা। তিনিই বা হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলেন কেন? নন্দীগ্রামে কখন কী ঘটে যায় কিছুই বলা যায় না। ফোন করলাম আমার অনেক দিনের চেনা নন্দীগ্রাম থানার এক পুলিশ অফিসারকে।

‘কী ব্যাপার বলুন তো, সাড়ে তিনটে বেজে গেল। কিছু ঘটেছে নাকি কোথাও। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এখনও মিটিংয়ের স্পটে যাচ্ছেন না।’ আমার মাথায় তখন ঘুরতে শুরু করেছে ব্রেকিং নিউজের হাতছানি। যদি কোথাও কিছু গণ্ডগোল হয়ে থাকে, যদি মিটিং বাতিল হয়, সবার আগে খবর করতে হবে।

‘না না, কিচ্ছু হয়নি। সব পিসফুল। এই তো শুভেন্দু এতক্ষণ বয়ালের মিটিং স্পটে ছিল। আমাদের ফোর্স আছে ওখানে।’ জবাব দিলেন ওই অফিসার।

‘তবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যাচ্ছেন না কেন বয়ালের মাঠে। এখনও সুফিয়ানের বাড়িতে বসে। আর তো সময়ও নেই বেশি।’

‘মিটিংয়ের মাঠে তো একটা লোকও হয়নি। শুভেন্দু এতক্ষণ মাইকে অ্যানাউন্স করছিল, তাতেও লোক আসছে না। মাঠ পুরো ফাঁকা। শুধু স্টেজে ৪-৫ জন লোকাল নেতা আছে। হয়তো সেই কারণে মিটিং শুরু হচ্ছে না।’

ওই পুলিশ অফিসারের সঙ্গে ফোনে কথা বলতে বলতেই শুভেন্দু অধিকারী বেরোলেন সুফিয়ানের বাড়ি থেকে। গাড়িতে ওঠার সময় জিজ্ঞেস করলাম, ‘মিটিং কখন শুরু হবে?’

‘এখনই হবে। আমি মাঠে যাচ্ছি, একটু পরে নেত্রী বেরোবেন, ‘গাড়িতে উঠে গেলেন দক্ষিণ কাঁথির বিধায়ক। মুখটা একটু থমথমে, গম্ভীর। বডি ল্যাঙ্গুয়েজও খুব একটা পজিটিভ নয়। বোঝাই যাচ্ছে গোলমাল হয়েছে কিছু। গোলমালটা কী তা আমার বিশ্বস্ত অফিসারের কাছে জেনেছি, কিন্তু ওঁকে কিছু বললাম না।

এতক্ষণে পরিষ্কার হল, মাঠে না গিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কেন সুফিয়ানের বাড়িতে বসে রয়েছেন। সঙ্গে সঙ্গে ভাবতে শুরু করেছি, এবার একটা জব্বর খবর হবে। হয়, লোকের অভাবে মিটিং করতে না পেরে নন্দীগ্রাম থেকে ফিরলেন মমতা, নয়তো, নন্দীগ্রামে ফাঁকা মাঠে মমতার সভা, এই গোছের কিছু একটা খবর হবে। তার জন্য মানসিক প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছি।

চারটের কিছু পরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বেরোলেন সুফিয়ানের ঘর থেকে, পেছনে শিশির অধিকারী এবং মুকুল রায়। যে দরজা দিয়ে বেরোলেন সেখানেই দাঁড়িয়েছিলাম ক্যামেরাম্যান শ্যামল জানাকে সঙ্গে নিয়ে। ঘর থেকে বেরোনো মাত্রই মাইক ধরলাম তৃণমূল নেত্রীর সামনে।

‘দিদি, ২০০৩ এর পঞ্চায়েত ভোটে রাজ্যে কংগ্রেস দ্বিতীয় হয়েছিল, তৃণমূল কংগ্রেস তৃতীয়। এবার ভোটে আপনি কী ফল আশা করছেন?  তৃণমূল কি দু’নম্বরে উঠে আসতে পারবে?’

‘রাজ্যে সন্ত্রাসের পরিবেশে ভোট হচ্ছে। তার মধ্যে অনেক জায়গা থেকে খবর পাচ্ছি, নিচুতলায় আমাদের কর্মীরা ঠিকমত প্রতীক বিলি করেনি। আমাদের অনেকে পারচেজ হয়ে গেছে। তার জন্য আমাদের রেজাল্ট হয়তো ভাল হবে না। কংগ্রেসের থেকে রেজাল্ট ভালো হবে বলে মনে হয় না।’

পঞ্চায়েতের লড়াই থেকে তৃণমূল কংগ্রেস নাম প্রত্যাহার করে নেবে, এমন কথা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বললেও ততটা অবাক হতাম না, যতটা হয়েছিলাম ওই উত্তর শুনে। এ তো লড়াইয়ের ঠিক আগে হার মেনে নেওয়া। তাও ঘরোয়া কোনও আলোচনায় নয়, একেবারে ক্যামেরার সামনে নির্মম স্বীকারোক্তি। যা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় চূড়ান্ত চরিত্র বিরোধী।

‘আপনার এতদিনের সিঙ্গুর আন্দোলন, নন্দীগ্রাম ইস্যু, রিজওয়ানুর  রহমান কাণ্ড, এর তবে কোনও প্রভাবই পড়বে না পঞ্চায়েত ভোটে?’ পালটা  জিজ্ঞেস করলাম। ‘অবশ্যই এই সব আন্দোলনের প্রভাব ভোটে পড়া উচিত, কিন্তু রেজাল্ট কতটা কী হবে আমার সন্দেহ আছে।’  আগের প্রশ্নের মতোই প্রায় একই জবাব দিয়ে দ্রুত গাড়ির দিকে এগোলেন তৃণমূল নেত্রী। প্রায় সাড়ে চারটে বাজে। নন্দীগ্রামে থাকার সময় শেষ হয়ে আসছে।

বহু বছর ধরে দেখছি। কিন্তু ৯ মে ২০০৮, শেখ সুফিয়ানের বাড়িতে তাঁর যে চেহারা, বডি ল্যাঙ্গোয়েজ দেখেছিলাম, তা আর যাই হোক কোনওভাবেই মমতাসুলভ নয়। হতাশ, প্রায় ভেঙে পড়া চেহারা। মনের জোরটা কোনও অদৃশ্য শক্তি শুষে নিয়েছে। এমন হতোদ্যম অবস্থায় তৃণমূল নেত্রীকে কখনও দেখিনি। বিধানসভায় ৩০ আসন হয়ে যাওয়ার পরেও না।

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের গাড়ির পিছনে পিছনে রওনা দিলাম বয়ালে জনসভার মাঠের দিকে। ঠিক করে নিয়েছি, আমার খবর হয়ে গিয়েছে। জনসভায় এর থেকে বেশি কিছু বলা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পক্ষে সম্ভব নয়। মাঠের কাছাকাছি পৌঁছে গাড়ি থেকেই শুনতে পেলাম শুভেন্দু অধিকারীর গলা। তৃণমূল নেত্রী স্টেজে গিয়ে বসলেন। নির্বাচনী বিধি মেনে সময় দ্রুত শেষ হয়ে আসছে। মাঠে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ২০০-২৫০ জন লোক। অর্ধেকের বেশি মাঠ ফাঁকা। রাস্তায় ছোটখাট জটলা করে আরও ৮০-১০০ লোক ছড়িয়ে-ছিটিয়ে দাঁড়িয়ে। ক্লান্ত, হতাশ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় স্টেজে বসে শাড়ির আঁচল দিয়ে ঘাম মুছছেন। শুভেন্দুর পর বক্তৃতা শুরু করলেন শিশির অধিকারী, কিন্তু তা শুনে হাততালি দেওয়ার লোক কোথায়? যাঁরা আছেন, তাঁরাও অনেকটা শোকবার্তা শোনার মতো গম্ভীর মুখে কান খাড়া করে দাঁড়িয়ে। কাঁথির অধিকারী পরিবারের কর্তা যখন থামলেন, তখন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় হাতে মেরেকেটে ৮-১০ মিনিট সময়। আমার আর তখন বক্তৃতা শোনার কোনও দরকার নেই। আধ ঘন্টা আগে আমাকে যা বলেছেন, তা দেখানো শুরু হলে তোলপাড় পড়ে যাবে জানি। মঞ্চের পিছনে দাঁড়ানো ওবি ভ্যান থেকে শ্যামল সেই ইন্টারভিউ অফিসে পাঠাচ্ছে, আর আমি রাস্তায় ঘুরে ঘুরে লোকজনের সঙ্গে কথা বলছি। বোঝার চেষ্টা করছি, একদিন পরের ভোট নিয়ে তাঁরা কী ভাবছেন। ভয়ার্ত চোখে-মুখে এমনভাবে লোকজন বক্তৃতা শুনছেন, যেন অদৃশ্য কোন চোখ তাঁদের ফলো করছে। সেই মুহূর্তে মাঠে এবং রাস্তায় উপস্থিত লোকজনের মুখ- চোখ দেখে মনে হচ্ছিল, তৃণমূল নেতা-নেত্রীদের বক্তৃতা শুনলেই জরিমানা হবে, কিংবা বেত পড়বে গুনে গুনে। মাঠে আসার আগে পুলিশ অফিসারের সঙ্গে কথা বলে মনে হচ্ছিল, নন্দীগ্রামের লোকজন বোধহয় প্রত্যাখ্যান করেছে তৃণমূল নেত্রীকে বা তাঁর দলকে। তাই জনসভায় লোক হয়নি বিশেষ। মাঠে দেখছি, সত্যিই লোক নেই তেমন। কিন্তু যাঁরা আছে তাঁরা এত ভীত, সন্ত্রস্ত কেন? এ কি তৃণমূল কংগ্রেসকে প্রত্যাখ্যান, নাকি সিপিআইএমের ভয়ে মাঠে না আসতে পারা? আসলে মনে মনে সমর্থনটা ঠিকই আছে। এর উত্তর সেদিন পাইনি। পেয়েছিলাম ভোটের রেজাল্ট বেরনোর দিন। ওদিকে মঞ্চ থেকে সিপিআইএমকে তীব্র ভাষায় আক্রমণ করে ৮-১০ মিনিটে বক্তৃতা শেষ করে তাড়াতাড়ি গাড়িতে উঠে পড়লেন তৃণমূল নেত্রী। আমি আরও কিছুটা সময় থেকে গেলাম সেই মাঠ এবং সংলগ্ন এলাকায়। অনেকের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করলাম, কিন্তু কেউই কিছু বলছে না। আগের বছর ১২-১৩ নভেম্বর যেমন দেখেছিলাম নন্দীগ্রামের মানুষের চেহারা অনেকটা তেমনই, হীরক রাজার দেশের সেই দমবন্ধ করা পরিস্থিতি।

কিছুক্ষণ লোকজনের সঙ্গে অল্পস্বল্প কথা বলে আমিও গাড়িতে উঠে রওনা দিলাম তমলুকের দিকে। গাড়িতে উঠতেই মুকুল রায়ের ফোন।

‘বিতনু তুমি কোথায়’, রাজ্যের উৎকন্ঠা গলায় এনে জিজ্ঞেস করলেন তৃণমূল কংগ্রেসের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক।

‘নন্দীগ্রামেই আছি, বেরবো এবার।’

‘ধরো, দিদি কথা বলবে।’

‘হ্যাঁ দিদি বলুন’,  সোজা হয়ে বসলাম।

‘তোমরা কী দেখাচ্ছ, আমি বলেছি কংগ্রেসের থেকে আমাদের রেজাল্ট খারাপ হবে? কোনও খবর পছন্দ না হলে যতটা অ্যাগ্রেসিভ শোনায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের গলা, ততটা ঝাঁঝ না থাকলেও বুঝতে পারলাম, গাড়িতে যেতে যেতেই সুফিয়ানের বাড়ির বারান্দায় দেওয়া ইন্টারভিউয়ের কথা তাঁর কানে পৌঁছেছে। এবং স্বাভাবিকভাবেই তিনি যথেষ্ট বিরক্ত।

‘হ্যাঁ, আপনি তো তাই বলেছেন। দু’বার। আপনার বাইটই চলছে।’

‘আমি এমন বলেছি? আচ্ছা, ঠিক আছে। একটু দেখে নিও।’ ফোন রাখলেন রাজ্যের ভাবী মুখ্যমন্ত্রী।

৯ মে ২০০৮, একরাশ হতাশা আর পরাজয়ের আশঙ্কা নিয়ে পড়ন্ত বিকেলে যে নন্দীগ্রাম ছেড়েছিলেন বাংলায় সিপিএম বিরোধী লড়াইয়ের একমাত্র বিশ্বাসযোগ্য ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর, পূর্ব মেদিনীপুরের সেই মাটিই তার ঠিক দু’দিনের মাথায় তাঁকে দিয়েছিল তাঁর রাজনৈতিক জীবনের সেরা ইনসেনটিভ। আমি বিশ্বাস করি, ২০০৮ সালের পঞ্চায়েত ভোটের রেজাল্ট, বিশেষ করে নন্দীগ্রাম এবং পূর্ব মেদিনীপুরের রেজাল্টই এ রাজ্যে সিপিআইএম নেতৃত্বাধীন বাম সরকারের পতনের প্রথম পরিষ্কার ইঙ্গিত দিয়েছিল। সেই রেজাল্টই জানান দিয়েছিল, গ্রাম বাংলার মাটি সিপিআইএমের পায়ের তলা থেকে সরে যাচ্ছে দ্রুত। তখন তাদের ক্ষমতা থেকে সরে যাওয়া ছিল শুধুমাত্র ক্যালেন্ডারের দিন গোনার সামিল। যে সমস্ত সিপিআইএম নেতা পঞ্চায়েত ভোটে নন্দীগ্রাম এবং দক্ষিণবঙ্গের রেজাল্ট দেখেও ভাবছিলেন, ঠিক কোনও না কোনও ম্যাজিকে ২০১১ র নির্বাচনী বৈতরণী পার হয়ে যাবেন, তাঁরা মূর্খের স্বর্গে বাস করছিলেন। অন্যদিকে, সেই রেজাল্টেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বুঝে নিয়েছিলেন দুটি মৌলিক তত্ত্ব। প্রথমত, সিপিআইএম ক্যাডাররাও তাঁর দলের লক্ষ লক্ষ কর্মীর মতোই এই গ্রহের দু’হাত এবং দু’পাওয়ালা সাধারণ মানুষ। চোখে চোখ রেখে অস্ত্র ধরলে তারাও ভয় পেয়ে পালায়। দ্বিতীয়ত, জমি ইস্যুকে কেন্দ্র করে গ্রাম বাংলায় রাজনৈতিক মেরুকরণ এমনই তীব্র আকার নিয়েছে, তাতে শুধু পেশি শক্তি এবং প্রশাসনের ভরসায় তৃণমূল কংগ্রেসের দিকে নামা মানুষের সমর্থনের ঢল আটকানো যাবে না। নির্বাচনী রাজনীতিতে সিপিআইএম নামক মহীরূহ হারতে পারে না, বছরের পর বছর ধরে গড়ে ওঠা এই মিথ  ভেঙে দিয়েছিল নন্দীগ্রাম। সেই সঙ্গে জেলায় জেলায় তৃণমূল কংগ্রেস নেতারা বুঝে গিয়েছিলেন, রুখে দাঁড়ালে সিপিআইএমও ভয় পায়। আর শাসক দল ভয় পেলেই দিশেহারা হয়ে পড়ে দোর্দণ্ডপ্রতাপ প্রশাসনও। এই পঞ্চায়েত ভোটের রেজাল্ট এবং নন্দীগ্রামের হার না মানা শিক্ষাই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ফের একবার সিঙ্গুরে টাটা মোটর্স এবং সরকার বিরোধী আন্দোলনের তীব্রতা বৃদ্ধিতে অনুঘটকের কাজ করে। যার জেরে সেই বছরই তিন মাস বাদে ২৪ অগাস্ট তিনি সিঙ্গুরে টাটা মোটর্সের প্রস্তাবিত গাড়ি কারখানার পাশে দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ের ধারে অবস্থানে বসে পড়েন। যার মোকাবিলা কোন পথে করা হবে তা ভেবে বের করতে দিশেহারা হয়ে পড়ে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য প্রশাসন এবং মুজাফফর আহমেদ ভবন। ফলশ্রুতি, সেই বছরই অক্টোবর মাসে টাটা গোষ্ঠীর সিঙ্গুর ত্যাগ এবং রাজ্যজুড়ে জমি রক্ষার আন্দোলনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রায় রবিন হুড ইমেজ।

পড়ুন আগের পর্ব: নন্দীগ্রাম আসলে যা ঘটেছিল #২১: একমাত্র সূর্য মিশ্রর সঙ্গে কথা বলবেন, পূর্ব মেদিনীপুরের এসপিকে মহাকরণে ডেকে বললেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য

কিন্তু ২০০৮ সালে পঞ্চায়েত ভোটের আগে পরিস্থিতি একেবারেই অনুকূল ছিল না তৃণমূল কংগ্রেসের পক্ষে। বরং ২০০৭ সালের ১০ নভেম্বর নন্দীগ্রামে সিপিআইএম বাহিনীর কাছে পর্যুদস্ত হওয়ার পর তৃণমূল কংগ্রেসের কাছে গোটা রাস্তাটাই ছিল কাঁটা বিছানো।  যেখানে বারবার পা কেটেছে, রক্তাক্ত হয়েছে সিপিআইএম বিরোধী লড়াই। এমনকী একদিন গাড়িতে চোখের জল ফেলেও নন্দীগ্রাম ছাড়তে হয়েছিল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে। ৯ মে’র কয়েক দিন আগের ঘটনা সেটা। পঞ্চায়েত ভোটের আগে নন্দীগ্রামে সিপিআইএমের জরুরি অবস্থা জারির আরও একটা উদাহরণ। যে ঘটনার একমাত্র সাক্ষী আমি, শোভন চট্টোপাধ্যায় এবং আমার সঙ্গী ক্যামেরাম্যান ভগীরথ শর্মা।

এপ্রিলের তৃতীয় সপ্তাহ, ২০০৮। পঞ্চায়েত ভোটের মাত্র কিছুদিন বাকি। নন্দীগ্রামের অধিকারীপাড়ায় মমতা বন্দোপাধ্যায়ের মিটিং। তৃণমূল নেত্রীর কালীঘাটের বাড়ি থেকে সকাল এগারোটা-সাড়ে এগারোটা নাগাদ তাঁর সঙ্গে রওনা দিলাম নন্দীগ্রামের উদ্দেশে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের গাড়ির ঠিক পিছনে তাঁর জন্য বরাদ্দ বুলেটপ্রুফ গাড়ি। তার পিছনের গাড়িতে আমি। আমাদের পিছনে কলকাতা পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের একটা লড়ঝড়ে অ্যাম্বাসাডর। আমাদের নিয়ে মোট চার গাড়ির কনভয়। আমার সঙ্গী ক্যামেরাম্যান ভগীরথ শর্মা। নন্দীগ্রামের কাছাকাছি পৌঁছে শুভেন্দুর সঙ্গে ফোনে কথা বলে জানলাম, ও সরাসরি অধিকারীপাড়ার মঞ্চে পৌঁছে যাচ্ছে। তৃণমূল নেত্রী গিয়ে সেখানে যোগ দেবেন। দুপুর আড়াইটে-তিনটে নাগাদ নন্দীগ্রামে ঢুকলাম। চারিদিক খাঁ খাঁ করছে, রাস্তায় একটাও লোক নেই। রাস্তার দু’ধারে বিভিন্ন জায়গায় লাল পতাকা,  ব্যানারের ছড়াছড়ি। এও সিপিআইএমের চূড়ান্ত আধিপত্য দেখানোর এক কৌশল, যা তার আগে, পরে বহুবার রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় দেখেছি। বিরোধী নেতা-নেত্রীদের একটা বার্তা দেওয়া, দেখো তোমার সঙ্গে স্থানীয় কোনও লোক নেই। এমনকী তোমাকে দেখার জন্যও রাস্তায় নেই কেউ। এখানে সবাই আমাদের সঙ্গে আছে। এ যেন অনেকটা কঠোর বার্তা, তোমাকে বয়কট করেছে স্থানীয় মানুষ। এই অভিজ্ঞতা দীর্ঘ বিরোধী রাজনৈতিক জীবনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আগেও বহুবার হয়েছে। এ প্রসঙ্গে দলীয় আধিপত্যবাদের একটা ঘটনা উল্লেখ করার লোভ সংবরণ করতে পারছি না, যদিও তা নন্দীগ্রাম সম্পর্কিত নয়।

চলবে

(১৮ সেপ্টেম্বর থেকে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হচ্ছে নন্দীগ্রাম আসলে যা ঘটেছিল। প্রতি পর্বে লাল রং দিয়ে আগের পর্বের লিঙ্ক দেওয়া থাকছে)

Comments are closed.