নন্দীগ্রাম আসলে যা ঘটেছিল #১৪: লক্ষ্মণ শেঠ বললেন, সিআরপিএফ আসছে, ২-১ দিনে নন্দীগ্রাম উদ্ধার করতে হবে

আগের পর্ব যেখানে শেষ হয়েছিল: ২০০৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটির সঙ্গে দফায় দফায় সংঘর্ষ হয় সিপিআইএমের গড়বেতা, কেশপুর বাহিনীর। কীভাবে হয়েছিল এমনই এক সংঘর্ষ রানিচকে, নিজের মুখে জানাচ্ছিলেন সিপিআইএম বাহিনীর সেনাপতি মাস্টারদা………

 

সিপিআইএম-মাওবাদী সংঘর্ষ: মাস্টারদার বয়ানে

‘রানিচক ও সাতেঙ্গাবাড়ি, এই দুই অঞ্চলের মাঝে একটা বড়ো মাঠ ছিল। একপাশে একটা ছোট খালের মতো। রাতের অন্ধকারে আমাদের ছেলেদের মাঠের আলে, পুকুর পারে, বাড়ির পেছনে পোস্টিং করে দিলাম। তারপর ওই অন্ধকারে শুরু হল অপেক্ষা, কখন ভোর হয়। সবাইকে বলে দিয়েছিলাম কেউ যেন কথা না বলে, এমনকী বিড়ি-সিগারেটও  যেন না ধরায়। হাল্কা আলো ফুটতে দেখলাম, ওই মাঠের মাঝখানে একটা বাড়ি রয়েছে। আমাদের ছেলেরা যেখানে আলে পুকুরের ধারে পজিশন নিয়েছিল, সেখান থেকে বাড়িটা ৩৫০-৪০০ মিটার দূরে। মাঝখানে ফাঁকা মাঠ, আবার বাড়িটার পেছনে ধান ক্ষেত, তারপর সাতেঙ্গাবাড়ি। প্রথমে বুঝতে পারিনি, মাঠের মাঝখানের বাড়িটায় মাওবাদীরা লুকিয়ে ছিল রাত থেকেই, সেটা বুঝতে পারলাম সকালে আমার একটা ছোট্ট ভুলের পরে। আমাদের ছেলেরা আলের ধারে যেখানে যেখানে বন্দুক নিয়ে মাটিতে শুয়েছিল, তাদের সব কিছু ঠিকঠাক আছে কিনা শেষবারের মতো দেখে নিচ্ছিলাম ভোরের আলো ফুটতেই। আমাদের একটা ছেলে বন্দুক লোড করে রেখেছিল। কিন্তু আমরা কখনই গুলি চালানোর দরকার না পড়লে আগে থেকে বন্দুক লোড করে রাখতাম না। আমি বুঝতে পারিনি ও একদম বন্দুক লোড করে রেডি হয়ে বসে আছে। ওর বন্দুকটা আমি হাতে নিয়ে দেখতে গিয়ে হঠাৎ গুলি বেরিয়ে গেল। ঠিক করেছিলাম, ওরা আক্রমণ না করা পর্যন্ত অপেক্ষা করব। কারণ আমরা যে ওদের খবর পেয়ে আগে থেকেই বড়ো দল নিয়ে রেডি আছি তা ওরা জানতো না। আমি জানতাম, ওরা ভাববে আমাদের বাহিনী অসতর্ক আছে। সোজা রানিচক দখল করতে এগিয়ে আসবে। তাতে ওদের টার্গেট করতে আমাদের সুবিধা হবে। কিন্তু হঠাৎ বন্দুক থেকে গুলি বেরিয়ে যাওয়ায় পুরো প্ল্যান গণ্ডগোল হয়ে গেল। মাওবাদীরাও আচমকা গুলির আওয়াজের জন্য প্রস্তুত ছিল না। কিন্তু আমার হাত থেকে ভুল করে গুলি বেরিয়ে যাওয়ায় কোনও পক্ষেরই আর কিছু করার ছিল না। ওরাও সাতেঙ্গাবাড়ির দিক থেকে গুলি চালিয়ে জবাব দিল। শুরু হয়ে গেল যুদ্ধ। ওটাই  নন্দীগ্রামে আমার নিজস্ব বাহিনীর সঙ্গে মাওবাদীদের প্রথম মুখোমুখি এনকাউন্টার।

 

সাতেঙ্গাবাড়ি এবং রানিচকের সীমানায় মাওবাদীদের সঙ্গে আমাদের এই লড়াই চলেছিল সারাদিন, সন্ধে পর্যন্ত। ভোরে লড়াই শুরু হওয়ার কিছুক্ষণ পরই বুঝতে পেরেছিলাম, মাঠের মাঝখানে বাড়িটায় কয়েকজন লুকিয়ে রয়েছে। মাওবাদীদের প্ল্যান ছিল, ভোর হতেই মাঠের মাঝখানের বাড়িতে লুকিয়ে থাকা লোকেরা রানিচক আক্রমণ করবে। তারপর পেছন থেকে অন্যান্যরা মাঠ পেরিয়ে এসে এলাকা দখল করবে। কিন্তু আমরা বড়ো বাহিনী নিয়ে আগে থেকে এসে বসে থাকায় ওদের প্ল্যান ভেস্তে যায়। মাঠের মাঝখানে বাড়িতে থাকা মাওবাদীরা বিপদে পড়ে যায়,  কারণ ওরা পড়ে গিয়েছিল দু’পক্ষের গুলি বিনিময়ের একদম মাঝখানে। আমার হাত থেকে গুলি ছিটকে যাওয়ার পর প্রথমে ওরা কিছুটা থমকে যায়। তারপর গুলি চালায়, আমরাও জবাব দিই। মাঝখানে পড়ে যায় ওই বাড়ির লোকেরা। আমাদের ছেলেরা সবাই আলের আড়ালে মাটিতে শুয়ে পজিশন নিয়েছিল। আমরা ওই বাড়ি টার্গেট করে ফায়ারিং শুরু করি। এরপর আর ওদের কিছু করার ছিল না। বুঝে যায়, বাড়িতে বসে থাকা মানে কিছুক্ষণের মধ্যে নিশ্চিত মৃত্যু।  উপায় না দেখে কয়েকজন ওই বাড়ি থেকে বেরিয়ে পেছনের মাঠ দিয়ে পালাতে চেষ্টা করে। তাতে আমাদের আরও সুবিধা হয়ে যায়। আমাদের কিছু ছেলের নিশানা একদম অব্যর্থ। মাঠ দিয়ে পালানোর সময় বেশ কয়েকজন আমাদের গুলিতে মারা যায়। পরপর কয়েকজনকে চোখের সামনে গুলিবিদ্ধ হতে দেখে সাতেঙ্গাবাড়ির দিকে থাকা ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটির যোদ্ধারা একেবারে থমকে যায়। যারা গুলিবিদ্ধ হয়ে পড়ে গিয়েছিল, তাদের তুলে নিয়ে যেতেও পারছিল না ওরা। সেদিন আমাদের কেউ সারাদিন কিছু খায়নি। বিকেল পর্যন্ত এক নাগাড়ে দু’পক্ষের মধ্যে গুলি বিনিময় চলে। তখনও পর্যন্ত আমাদের কোনও ক্ষয়-ক্ষতি হয়নি, কিন্তু বুঝতে পারছিলাম, ওদের বেশ কয়েক জনের মৃত্যু হয়েছে। এতে ওদের মনোবলও ভেঙে গিয়েছিল। ঠিক সন্ধের মুখে ওরা একটা শেষ বেপরোয়া চেষ্টা করল। রানিচকের পাশে একটা ছোট খাল ছিল। মাওবাদীদের কয়েকজন লুকিয়ে খাল দিয়ে হেঁটে এবং সাঁতরে এসে আমাদের আক্রমণ করে। কিন্তু খাল থেকে রানিচকের মাঠে ওঠার আগেই ওরা আমাদের চোখে পড়ে যায়। গুলি চালাতে ওরা পিছু হঠে। ওরা আবার খাল দিয়ে ফিরে যাওয়ার সময় রানিচকের বাসিন্দা, আমাদের দুই সমর্থক ওদের চোখের সামনে পড়ে যায়। তাদের মাওবাদীরা একজনের খোঁজ নেওয়ার নাম করে ডাকে। ছেলে দু’জন সিপিআইএমের অ্যাকশন স্কোয়াডের সক্রিয় সদস্য না হলেও আমাদের সাহায্য করত। ওরা বুঝতে পারেনি, বোকার মত মাওবাদীদের সঙ্গে কথা বলতে যায়। মাওবাদীরা ওই দু’জনকে তুলে সাতেঙ্গাবাড়িতে নিয়ে গিয়ে সেই রাতেই মেরে ফেলে। তারপর অন্ধকার হলে সেদিনের মতো লড়াই থামে। মাওবাদীরা তো রানিচক দখল করতে পারলই না, বরং ওদের সেদিনই সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছিল। পরে রাতে আমরা সাতেঙ্গাবাড়ি থেকে খবর পেয়েছিলাম, সেদিনের যুদ্ধে ওদের ১৩ জনের মৃত্যু হয়েছিল। তার মধ্যে দু’জন মহিলাও ছিল, কিন্তু সেদিন সকাল থেকে সন্ধে পর্যন্ত সামনা সামনি লড়াইয়ের পর মাওবাদীরা বুঝে গিয়েছিল, আর বেশিদিন নন্দীগ্রাম দখলে রাখতে পারবে না। রানিচক দখল করতে গিয়ে ওদের যে ক্ষয়-ক্ষতি হয়েছিল তা ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটি আগে থেকে আঁচ করতে পারেনি। ১৩ জনের মৃত্যুর ফলে ওদের মনোবল বিরাটভাবে ধাক্কা খেয়েছিল। বুঝে যায় সিপিআইএম বাহিনীর সঙ্গে মুখোমুখি লড়াই করে জেতা মুশকিল আছে।’

টানা বলে থামলেন মাস্টারদা। আবার সিগারেট ধরালেন

সাতেঙ্গাবাড়ি-রানিচক সীমানায় সিপিআইএমের সঙ্গে মাওবাদীদের এই যুদ্ধের পরে বেশ কিছুদিন আর বড়ো কোনও লড়াই হয়নি। এই সংঘর্ষের পর ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটিও খানিকটা দুর্বল হয়ে পড়ে, অন্যদিকে দুর্গাপুজোও এগিয়ে আসছিল। দুর্গাপুজোর পর পরই ছিল ইদ। পুজোর ঠিক আগে মাস্টারদা নন্দীগ্রামের সিপিআইএম নেতা অশোক গুড়িয়াকে বলেন, ‘পুজোর মরশুমে তো ছেলেদের বাড়ি যাওয়া দরকার, আপনাদের ছেলেরা কি পারবে এলাকা রক্ষা করতে?’ মাস্টারদা চেয়েছিলেন, দুর্গাপুজোর সময় হিন্দু ছেলেদের বাড়ি পাঠিয়ে দেবেন, কিছু মুসলিম ছেলে থেকে যাবে। আবার পুজো হয়ে গেলে তারা নন্দীগ্রামে ফিরে যাবে, মুসলিম ছেলেরা ইদের সময় বাড়ি যাবে। অশোক গুড়িয়া তখন জবাবে বলেছিলেন, ‘পুজোর মরশুমে কোনও গণ্ডগোল হবে না। আপনি সবাইকে বাড়ি পাঠিয়ে দিন। চিন্তার কিছু নেই।’

এরপর খানিকটা অনিচ্ছা সত্ত্বেও মাস্টারদা কেশপুর, গড়বেতা, চন্দ্রকোণার সব ছেলেকে নিয়ে পুজোর সময় পশ্চিম মেদিনীপুরে ফিরে গিয়েছিলেন। এবং যে আশঙ্কা করে গিয়েছিলেন তাই সত্যি হয়েছিল পুজোর মধ্যে। নবমীর দিন সকালে ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটি রানিচক আক্রমণ করে। নন্দীগ্রামে সিপিআইএমের স্থানীয় ছেলেরা কোনও প্রতিরোধই করতে পারেনি। মাওবাদীদের নেতৃত্বে ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটি রানিচক বাজারে ঢুকে ব্যাপক লুঠপাট করে। সিপিআইএম কর্মীদের বাড়ি এবং পার্টি অফিসে ভাঙচুর করে, একটা সিনেমা হল পুড়িয়ে দেয়। সিপিআইএমের লোকজন ভয়ে পালিয়ে যায়। কিন্তু রানিচকে ক্যাম্প না করে সেদিনই মাওবাদীরা আবার সাতেঙ্গাবাড়ি ফিরে গিয়েছিল।

পুজোর পরে মাস্টারদা আবার সশস্ত্র বাহিনী নিয়ে পৌঁছন নন্দীগ্রামে। পুজোর পর থেকেই ব্যাপক অভিযান শুরু করে দিয়েছিল সিপিআইএম। পশ্চিম মেদিনীপুরের সিপিআইএমের সশস্ত্র বাহিনী আরও শক্তি নিয়ে হাজির হয় নন্দীগ্রামে। পাশাপাশি, নন্দীগ্রামের ১ নম্বর ব্লকে ঢোকা ও বেরনোর সমস্ত রাস্তায় পাহারা বসাতে শুরু করে  সিপিআইএম। প্রশিক্ষিত সিপিআইএম বাহিনীর হাতে থাকা আধুনিক অস্ত্র এবং নন্দীগ্রাম চারদিক আস্তে আস্তে অবরুদ্ধ হয়ে যাওয়ার ফলে মাওবাদীরা পিছু হঠতে শুরু করে। মাওবাদীদের বাইরের সাহায্য এবং গুলির সাপ্লাই বন্ধ করতে নতুন কৌশল নেয় সিপিআইএম। নন্দীগ্রামে ঢোকার সমস্ত রাস্তায় পাহারা বসিয়ে দেয় তারা। হলদি নদী এবং তেরাপেখিয়া ঘাট বা কাঁথির দু’নম্বর ব্লকের পেটুয়া থেকে নৌকো করে গুলি যেত ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটির জন্য। নদী এবং খালেও নজরদারি শুরু করে দিয়েছিল সিপিআইএম। তাদের পরিকল্পনা ছিল, চারিদিক থেকে নন্দীগ্রামকে অবরুদ্ধ করে মাওবাদীদের কোণঠাসা করে ফেলার। সেই সময় থেকেই ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটির গুলির ভাঁড়ারে টান পড়তে শুরু করে। সিপিআইএমও বুঝতে পারছিল, ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটির পক্ষে এই লড়াই বেশি দিন চালানো সম্ভব হবে না। তাই অক্টোবরের মাঝামাঝি থেকেই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পুরো নন্দীগ্রাম পুনর্দখলের প্ল্যান করে ফেলেন সিপিআইএম নেতারা।

 

১০ নভেম্বর ২০০৭, অপারেশন সূর্যোদয়

 

নভেম্বরের ১০ তারিখ নন্দীগ্রাম পুর্নদখল সম্পূর্ণ করেছিল সিপিআইএম বাহিনী। ফেব্রুয়ারির গোড়ায় শুরু হয়েছিল যে অপারেশন, তা শেষ করতে লেগেছিল ১০ মাসেরও কিছু বেশি সময়।

সিপিআইএমের ভাষায়, এটাই অপারেশন সূর্যোদয়। ১১ নভেম্বর দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য শ্যামল চক্রবর্তী বলেছিলেন, ‘নন্দীগ্রাম সন্ত্রাসমুক্ত হয়েছে। নতুন সূর্যোদয় হয়েছে নন্দীগ্রামে।’ গোটা রাজ্য তখন তোলপাড়। তার মধ্যেই দু’দিন বাদে মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য মহাকরণে বললেন, ‘দে হ্যাভ বিন পেইড ব্যাক বাই দেয়ার ওন কয়েন।’ মহাকরণে দাঁড়িয়ে খোদ মুখ্যমন্ত্রী দলীয় স্তরে প্রতিশোধ এবং প্রতিহিংসার রাজনীতিকেই কি আইনি বৈধতা দিয়েছিলেন সেদিন? ১৩ নভেম্বর এ’কথা বলে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য কি তাঁর দলকে বার্তা দিয়েছিলেন, কেউ ইট ছুড়লে পালটা পাথর ছুড়ুন, সরকার নিষ্ক্রিয় থাকবে। রাজ্যের প্রশাসনিক সদর দফতর থেকে মুখ্যমন্ত্রী কোন রাজনৈতিক বার্তা দিতে এই ঘোষণা করেছিলেন, তার উত্তর লক্ষ লক্ষ বামপন্থী মানুষের কাছে সেদিন ছিল না। সিপিআইএম পলিটব্যুরো সদস্য এবং মুখ্যমন্ত্রীর এই বার্তা ভয়ানক পরিস্থিতির জন্ম দিল বাংলায়। সিপিআইএমের নন্দীগ্রাম পুনর্দখলের পর মুখ্যমন্ত্রীর এই আইন হাতে তুলে নেওয়ার প্ররোচনা কার্যত গৃহযুদ্ধের দিকে ঠেলে দিয়েছিল রাজ্যেকে।

বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের এই মন্তব্যের পর দুটো জিনিস ঘটল। প্রথমত, নন্দীগ্রাম, সিঙ্গুর, জঙ্গলমহল, দার্জিলিংসহ উত্তরবঙ্গ এবং রাজ্যের নানা জায়গায় রাজনৈতিক সংঘর্ষ দ্রুত গতিতে বেড়ে গেল। হিংসা, খুনোখুনি ব্যাপক আকার নিতে শুরু করলেও পুলিশ বা প্রশাসন তা নিয়ন্ত্রণ করতে কোনও ব্যবস্থাই নিল না। বলা যেতে পারে, নিতে পারল না। কোনও কোনও পরিস্থিতিতে পুলিশকে ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেওয়া হলেও, পুলিশ তা পালন করতে সরাসরি অস্বীকার করতে শুরু করল। দ্বিতীয়ত, তৃণমূল কংগ্রেসকে অগণতান্ত্রিক দল বলার নৈতিকতা হারিয়ে ফেলল সিপিআইএম এবং সরকার। তাই, নভেম্বরে সিপিআইএমের নন্দীগ্রাম পুনরুদ্ধারের পর বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য সহ সিপিআইএম নেতারা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিভিন্ন আন্দোলন বা কার্যকলাপকে বেআইনি এবং অগণতান্ত্রিক বলা সত্বেও, তা মানুষের কাছে বিশ্বাসযোগ্য হয়নি। বরং যত দিন এগিয়েছে ততই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতি সমর্থন বেড়েছে মানুষের। ১৪ মার্চ পুলিশ অভিযানের পর গোটা রাজ্যেই সরকারের ভূমিকা নিয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া তৈরি  হয়েছিল। কিন্তু পুলিশকে নিষ্ক্রিয় রেখে নভেম্বরে সিপিআইএম যেভাবে নন্দীগ্রাম দখল করেছিল, তা আরও তীব্র শাসক বিরোধী জনমত তৈরি করল। সরকার এবং শাসক দলের বিরুদ্ধে মহাজোট গড়ে নভেম্বরের ১১-১২ তারিখ থেকে রাস্তায় নামল কলকাতা। যা মোকাবিলার কোনও রাস্তা জানা ছিল না বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, বিমান বসুদের।

কিন্তু কীভাবে হল অপারেশন সূযোদয়ের পরিকল্পনা?

২০০৭ অক্টোবরের শেষ, নভেম্বরের শুরু। তখন গোটা রাজ্যে সিপিআইএমের জোনাল কমিটির সম্মেলন চলছে। ২০০৮ সালের রাজ্যে সম্মেলনের প্রস্তুতি হিসেবে। পূর্ব মেদিনীপুরেও শুরু হয়েছিল জোনাল সম্মেলন। পূর্ব মেদিনীপুর জেলার সিপিআইএমের সম্পাদক সুধীর গিরি সেই সময় গুরুতর অসুস্থ। তাঁর জায়গায় জোনাল সম্মেলনগুলো পরিচালনা করছিলেন লক্ষ্মণ শেঠ। নভেম্বরের ২-৩ তারিখ হবে, এমনই একটা জোনাল সম্মেলন চলাকালীন লক্ষ্মণ শেঠকে কলকাতা থেকে মোবাইলে ফোন করেছিলেন সিপিআইএমের কেন্দ্রীয় কমিটির এক সদস্য। তিনি ছিলেন দলের শ্রমিক সংগঠন সিটুর নেতা। লক্ষ্মণ শেঠও সিটুর নেতা ছিলেন। দুজনের মধ্যে সম্পর্ক ভাল ছিল। ওই নেতা লক্ষ্মণ শেঠকে বলেন, ‘তোমাকে আর জোনাল মিটিং করতে হবে না, তুমি তাড়াতাড়ি কোনও একটা সেফ অফিসে গিয়ে বসো যেখানে ল্যান্ড ফোন আছে। গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে।’

মিটিং শেষ করেই লক্ষ্মণ শেঠ ফিরে গিয়েছিলেন হলদিয়ায়। তারপর ল্যান্ড লাইন থেকে ফোন করেন কলকাতায় ওই নেতাকে। দু’জনের মধ্যে বিস্তারিত কথা হয় নন্দীগ্রাম নিয়ে। ঠিক হয়, নন্দীগ্রাম পুনর্দখলের জন্য সর্বশক্তি দিয়ে আক্রমণ চালাতে হবে, কারণ, সময় আর বেশি নেই! নন্দীগ্রাম নিয়ে তখন রাজ্যে তোলপাড় অবস্থা। বিরোধীদের চাপের মুখে পড়ে পরিস্থিতি সামাল দিতে তার কয়েকদিন আগেই বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সরকার কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে সাহায্য চেয়েছিল। নন্দীগ্রামে মোতায়েন করার জন্য রাজ্যের পক্ষ থেকে চাওয়া হয়েছিল আধা সামরিক বাহিনী। আধা সামরিক বাহিনী মোতায়েনের দাবি নিয়ে শুভেন্দু অধিকারী সরাসরি দ্বারস্থ হয়েছিলেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী প্রিয়রঞ্জন দাসমুন্সির। কারণ, অক্টোবর থেকেই শুভেন্দু বুঝতে পারছিলেন, রাজ্য পুলিশের যা ভুমিকা এবং সিপিআইএম যেভাবে আক্রমণ শুরু করেছে, তাতে বেশি দিন নন্দীগ্রাম দখলে রাখা যাবে না। নভেম্বরের গোড়াতেই দিল্লি থেকে রাজ্য সরকারের কাছে প্রশাসনিক স্তরে খবর এসেছিল, সিআরপিএফ বাহিনী পাঠানোর ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হয়েছে। কয়েক দিনের মধ্যেই তা পাঠানো হবে। এব্যাপারে বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছিলেন প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সি। নন্দীগ্রামে সিআরপিএফ আসার খবর স্বাভাবিকভাবেই ৩১ আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের রাজ্য দফতরে জানিয়েছিলেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। এরপর আর দেরি করতে চায়নি সিপিআইএম। তারা চেয়েছিল, সিআরপিএফ পৌঁছানোর আগেই অপারেশন, মানে নন্দীগ্রাম পুনর্দখল শেষ করে ফেলতে। কারণ তারা জানত, রাজ্য পুলিশের নাকের ডগায় যেভাবে সশস্ত্র অভিযান চালানো সম্ভব হচ্ছে, তা কিছুতেই কেন্দ্রীয় বাহিনীর সামনে করা যাবে না। তাই যা করার, কয়েক দিনের মধ্যেই করতে হবে। ঠিক হয়েছিল, গড়বেতা-কেশপুরের দলকে সাহায্য করার জন্য দক্ষিণ ২৪ পরগনা, উত্তর ২৪ পরগনা, হুগলি থেকেও কিছু সশস্ত্র লোক পাঠানো হবে। সেই অনুযায়ী সিপিআইএমের দক্ষিণ ২৪ পরগনার বজবজ এবং মহেশপুর এলাকার এক প্রথম সারির নেতাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। তিনি মহেশপুর এবং আশেপাশের এলাকার কিছু কুখ্যাত দুষ্কৃতীকে তড়িঘড়ি পাঠিয়ে দিয়েছিলেন নন্দীগ্রামে। রাজারহাটের এক নেতাকে একই দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। নভেম্বরের ৪-৫ তারিখ থেকে নন্দীগ্রামে শুরু হল শেষ লড়াই।

নন্দীগ্রামের ১ নম্বর ব্লকের একদিকে হলদি নদী। বাকি তিনদিক দিয়ে একসঙ্গে আক্রমণ চালিয়েছিল সিপিআইএমের সমস্ত বাহিনী। এই আক্রমণের সামনে মাত্র ৪-৫ দিনই প্রতিরোধ গড়তে পেরেছিল মাওবাদীদের নেতৃত্বে ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটি। এবং ১৪ মার্চ ভোর থেকে যেভাবে সংবাদমাধ্যম এবং বাইরের জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা হয়েছিল নন্দীগ্রামকে, একই কায়দা নেওয়া হয়েছিল সেই সময়ও। নভেম্বরের ৫-৬ তারিখ থেকেই নন্দীগ্রামে ঢোকার সমস্ত রাস্তায় ব্যারিকেড করে দিয়েছিল স্থানীয় সিপিআইএম ক্যাডাররা। চন্ডিপুর মোড়েই ছিল সিপিআইএমের প্রথম বাহিনী। তারপর আরও কয়েকটা মোড়ে ছিল পাহারার বন্দোবস্ত। যাতে কেউ খেজুরি দিয়ে ঢুকতে না পারে, তার জন্য একইরকম পাহারার ব্যবস্থা ছিল হেঁড়িয়ার মোড়েও। অন্য দু’একটা রাস্তাও ছিল নন্দীগ্রামে ঢোকার। সেখানেও ছিল ব্যারিকেড। ৫-৬ দিন সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধি এবং বাইরের লোকেদের থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা হয়েছিল নন্দীগ্রামকে। এই পুরো সময়টা, মানে ১০-১১ নভেম্বর পর্যন্ত তমলুকের সাংসদ লক্ষণ শেঠের একমাত্র কাজ ছিল হলদিয়ায় কন্ট্রোল রুমে দিন রাত বসে থাকা। ফোনে অভিযানের পুঙ্খানুপুঙ্খ খবর নেওয়া এবং অভিযান পরিচালনা করা। প্রয়োজনীয় নির্দেশ দেওয়া এবং অভিযানের অগ্রগতির খবর কলকাতায় রাজ্য দফতরে জানানো। বেশিরভাগ কথাবার্তাই হোত ল্যান্ড ফোনে। রাজ্যের শীর্ষ নেতৃত্ব প্রতিদিন নন্দীগ্রামে অগ্রগতির সমস্ত খবরই রাখছিলেন মুজফফর আহমেদ ভবনের দোতলায় সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্যদের বসার ঘরে বসে।

ওই  ৪-৫ দিনের মধ্যে সিপিআইএমের সঙ্গে মাওবাদীদের নেতৃত্বে ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটির সবচেয়ে বড়ো লড়াইটা হয়েছিল ৯ নভেম্বর। এই শেষ লড়াইয়ের বিবরণ আমি ফের লিখব মাস্টারদার মুখে, ঠিক যেভাবে তিনি আমাকে বলেছেন সেইভাবে।

 

শেষ লড়াই

 

‘নভেম্বরের ওই অভিযান শুরু হয়েছিল সাতেঙ্গাবাড়ি দিয়ে। মাত্র এক ঘন্টার মধ্যে আমরা সাতেঙ্গাবাড়ি দখল করেছিলাম। অথচ তার কয়েকদিন আগে পর্যন্ত ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটির শক্তিশালী ঘাঁটি ছিল সাতেঙ্গাবাড়ি। কিন্তু রানিচক আক্রমণের দিন ওদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। তা আর ওরা সামলে উঠতে পারেনি। পুজোর সময়ও ওরা সাতেঙ্গাবাড়ি থেকে এসে রানিচকে হামলা চালিয়েছিল। তখনও আমরা সোনাচূড়া, গড়চক্রবেড়িয়া, মহেশপুর এলাকায় ঢুকতে পারিনি।  নভেম্বরের অভিযানে আমরা প্রথম টার্গেট করেছিলাম সাতেঙ্গাবাড়ি। ভাবতেই পারিনি ওরা তেমন প্রতিরোধই করতে পারবে না। আমরা বড়ো বাহিনী নিয়ে আক্রমণ করলে কিছুক্ষণ গুলি চালিয়ে জবাব দিলেও দ্রুত পিছু হঠতে শুরু করে ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটি। রানিচক থেকে আমরা প্রায় বিনা প্রতিরোধে এক ঘন্টার মধ্যে সাতেঙ্গাবাড়ি ঢুকে গেলাম। সাতেঙ্গাবাড়ি হাতছাড়া হওয়ার পরই ওরা পিছু হঠতে শুরু করেছিল। তার দু’দিনের মধ্যেই খেজুরির দিক থেকে আমদের অন্য দল সোনাচূড়ার কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিল। আমরা বুঝতে পারছিলাম যুদ্ধ প্রায় শেষ, আর মাত্র কয়েকটা দিনের ব্যাপার। গোকুলনগর, অধিকারীপাড়া তখন আমাদের কব্জায়, ওই এলাকায় ওদের বাহিনী ঘরছাড়া হয়ে যায়। খবর পাচ্ছিলাম, ওদের গুলিও প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। এক মাস ধরে বাইরে থেকে গুলি ঢোকাতে পারেনি মাওবাদীরা। সব রাস্তায় আমাদের ব্যারিকেড ছিল। সাতেঙ্গাবাড়ি মাওবাদীদের হাতছাড়া হওয়ার পরই জানতাম, আমগেছিয়া এবং মহেশপুর এলাকা দখল করলেই পুরো ১ নম্বর ব্লক আমাদের কব্জায় চলে আসবে। কারণ, মহেশপুর, আমগেছিয়া হাতছাড়া হলে সোনাচূড়া, গড়চক্রবেড়িয়ায় ওরা কোনও প্রতিরোধই করতে পারবে না। যত দূর মনে পড়ছে, সেটা ছিল নভেম্বরের ৮ তারিখ। খেজুরির দিক থেকে আমাদের একটা বড়ো দল নন্দীগ্রামের সমস্ত ঘরছাড়াকে সঙ্গে নিয়ে মহেশপুর হাইস্কুলে পৌঁছে গেল। প্রায় দেড়শো জন ছিল ওই দলে। মহেশপুর হাইস্কুলে ৮ তারিখ বিকেলে চালু করা হয়েছিল অস্থায়ী ক্যাম্প। সেদিনই রাতে লক্ষণ শেঠ ফোন করে বলেছিলেন,  ‘মাস্টার, আর সময় নেই। দু’দিনের মধ্যে কেন্দ্রীয় বাহিনী এসে যাবে। যতটা এলাকা বাকি আছে কালকের মধ্যেই ঢুকে পড়তে হবে। সিআরপিএফ এসে গেলে আর কিছু করা যাবে না।’ আমি আমার বাহিনীর সঙ্গে রাতেই কথা বললাম। সবাইকে জানিয়ে দিয়েছিলাম, কালই শেষ যুদ্ধ। হেস্তনেস্ত করতে হবে একটা। যতই বাধা আসুক উদ্ধার করতেই হবে আমগেছিয়া এবং আশপাশের এলাকা।

৯ তারিখ একদম সকালে আমরা ১৫-১৬ জন আমগেছিয়া ঢুকে গেলাম। সেখানেও বিশেষ বাধার মুখে পড়তে হয়নি। বরং পৌঁছে দেখেছিলাম বেশ কয়েকটা মোটরসাইকেলে কয়েকজন পালাচ্ছে। বড়ো লড়াইয়ের প্রস্তুতি নিয়ে গেছিলাম, কিন্তু কোনও বাধাই দিল না ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটি। তখনও বুঝতে পারিনি ওদের প্ল্যানটা কী? আমগেছিয়ায় কিছুক্ষণ থেকে আমরা চলে গিয়েছিলাম সোজা মহেশপুরে। খেজুরি সীমানায় তেখালি ব্রিজ থেকে মহেশপুর পর্যন্ত রাস্তার দু’দিকে গ্রাম তখন আমাদের দখলে চলে এসেছে। মহেশপুর হাইস্কুলে তখন জমজমাট চেহারা। আমাদের সব ছেলে ভর্তি। তার সঙ্গে ছিল নন্দীগ্রামের সিপিআইএমের স্থানীয় নেতারা, যারা বহুদিন ধরেই ঘরছাড়া ছিল। মহেশপুরে কিছুক্ষণ থেকেই দুপুরে আমি আবার ১৫-১৬ জনকে সঙ্গে নিয়ে আমগেছিয়া ফিরে যাই। আমাদের ছেলেরা সব রাস্তার ধারে বসেছিল। সকাল থেকে সব বেরিয়েছে, বিশ্রাম করছিল। দুপুর তখন তিনটে- সাওয়া তিনটে হবে। হঠাৎ দেখলাম প্রায় ১৮-২০ টা মোটরসাইকেল, সবকটাতে দুজন করে বসা জোরে চালিয়ে বেরিয়ে গেল। সবার হাতে, পিঠে দামী রাইফেল। চলে গেল নন্দীগ্রাম বাজারের দিকে। আমরা ভেবেছিলাম, ওরা পালিয়ে গেছে, ভুল ভেবেছিলাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই আবার মোটরসাইকেলের আওয়াজ পেলাম। কিছু বুঝে ওঠার আগেই দেখলাম আমাদের টার্গেট করে গুলি চালাতে চালাতে এগিয়ে আসছে মোটরসাইকেলগুলো। ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি। মাওবাদীরা যে এভাবে শেষ মরণকামড় দেবে তা আমি ভাবতে পারিনি। আমাদের ছেলেরা সঙ্গে সঙ্গে মাটিতে শুয়ে পড়ল। তারপর মাটিতে শুয়েই আমরাও গুলি চালাতে শুরু করলাম। ছেলেদের বললাম, যত গুলি আছে সব চালিয়ে দে, কিছুতেই হারা যাবে না। ওদের ছেলেরাও তখন মোটরসাইকেল থেকে নেমে বাড়ি, গাছের আড়াল থেকে গুলি চালাচ্ছে। মনে আছে, যখন এরকম গুলির লড়াই চলছে ঠিক সেই সময় আমাকে পশ্চিম মেদিনীপুরের এক নেতা ফোন করেছিলেন। তিনি তার কিছু আগেই জানতে পেরেছিলেন, আমাদের নন্দীগ্রাম অপারেশন শেষ হয়ে গেছে। ফোন করেছিলেন আমাদের খবর নিতে। বুঝতে পারেননি, হঠাৎই এমন একটা পরিস্থিতিতে পড়ে গেছি। তাঁকে বললাম, তাড়াতাড়ি ফোন ছাড়ুন, বিপদের মধ্যে আছি। এই শেষ লড়াইটা হেরে গেলে সর্বনাশ হবে। ওই আমগেছিয়ার পিচ রাস্তায় সেই দিন বিকেলে এক ঘন্টারও বেশি আমার বাহিনীর সঙ্গে মাওবাদীদের সরাসরি লড়াই হয়েছিল।

পড়ুন আগের পর্ব: নন্দীগ্রাম আসলে যা ঘটেছিল #১৩: গড়বেতা, কেশপুরের ১৫-১৬ টা সশস্ত্র ছেলেকে নিয়ে মাঝরাতে রওনা দিলাম রানিচক

মোটরসাইকেল থেকে নেমে ততক্ষণে ১৪-১৫ জন বাড়ির আড়াল থেকে দু’-পাঁচ মিনিট পরপর গুলি চালাচ্ছে। আমার ছেলেদের বললাম, বন্দুক খালি করে দে, একটাও যেন বেঁচে ফিরতে না পারে। ওটাই নন্দীগ্রামে আমার শেষ লড়াই। বিকেল সওয়া চারটে-সাড়ে চারটে নাগাদ, সন্ধে নামার ঠিক আগে ওদের দিক থেকে গুলি চালানো বন্ধ হয়েছিল। যতক্ষণ ওরা গুলি চালিয়েছে আমরাও জবাব দিয়েছিলাম। তারপর ওরা পালিয়ে যায়। ওরা বাড়ির আড়াল থেকে গুলি চালাচ্ছিল। কিন্তু ওদের থেকে আমাদের কাছে গুলি অনেক বেশি ছিল। জানতাম ওদের প্রায় সব এলাকা হাতছাড়া হয়ে গেছে, শেষ চেষ্টা করছে, কিন্তু বেশিক্ষণ পারবে না। আমাদের শুধু একটাই কাজ ছিল, ওরা যাতে এগোতে না পারে সেটা দেখা। আমাদের গুলির সামনে ওরা বেশিক্ষণ দাঁড়াতে পারেনি। সন্ধের ঠিক আগে আবার মোটরসাইকেল চালিয়ে বেরিয়ে গেল। সেই রাতে আমরা মহেশপুরেই থেকে গেছিলাম। সেই রাতেই, ৯ তারিখ  লক্ষ্মণ শেঠ এবং পূর্ব মেদিনীপুরের এক নেতাকে ফোন করে বললাম, পরদিন মানে ১০ তারিখ আমি গড়বেতা, কেশপুরের পুরো দল নিয়ে ফিরে যাব। আর একদিনও থাকব না নন্দীগ্রামে। কারণ, সিআরপিএফ ঢুকে গেলে সর্বনাশ হবে। আমাদের একটা ছেলেও যদি গ্রেফতার হয়ে যায় বিপদে পড়ে যাব। কিন্তু ১০ তারিখেও ফিরতে পারলাম না। কারণ, মহেশপুরের সংঘর্ষ। নভেম্বরের ৭-৮ দিনের শেষ লড়াইয়ে যে ঘটনা আমরা বারবার এড়িয়ে যেতে চেয়েছিলাম, তাই ঘটে গেল সেদিন। মৃত্যু হল একাধিক লোকের। ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটির গোপন পরিকল্পনা আঁচ করতে পারিনি আমরা।

পরদিন ১০ তারিখ সকালে ওরা আবার একটা মরিয়া চেষ্টা করল, যা আমাদের আন্দাজের মধ্যে ছিল না। ভাবতেই পারিনি ওরা হাজার হাজার মানুষকে জমায়েত করে আমাদের আক্রমণ করবে। সামনাসামনি লড়াই করে পারবে না বুঝে, সেই দিন সকাল ১০ টা নাগাদ একটা বড়ো মিছিল বের করেছিল ভুমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটি। প্রধানত, সোনাচূড়া, গড়চক্রবেড়িয়ার লোকজনকে নিয়ে মিছিল করে ওরা এগোচ্ছিল মহেশপুর হাইস্কুলের দিকে। মিছিলের সামনের দিকে ছিল অনেক মহিলা এবং বাচ্চা, তারপর ছিল পুরুষেরা, আর পেছনে ছিল কিছু সশস্ত্র লোক এবং মাওবাদীরা। ওদের প্ল্যান ছিল মিছিল করে এসে মহেশপুরে আমাদের ক্যাম্পে আক্রমণ করবে। তা হলেই গ্রামবাসীদের মধ্যে সংঘর্ষ হবে এবং সে ক্ষেত্রে ভাল রকমের প্রাণহানি  হতে পারে। কিন্তু নভেম্বরের শুরু থেকেই আমাদের টার্গেট ছিল যতটা পারা যায় কম রক্তপাত ঘটিয়ে নন্দীগ্রাম উদ্ধার করতে হবে। কারণ, মৃত্যু যতো বাড়বে ততই রাজ্য জুড়ে সমালোচনার ঝড় উঠবে। তাই ৭-৮ দিন ধরে যত জায়গায় অ্যাকশন হয়েছে একাধিক ক্ষেত্রে আমাদের ছেলেরা ওদের নাগালের মধ্যে পেয়েও কাউকে লক্ষ্য করে গুলি চালায়নি। বরং বেশিরভাগ সময়েই আমাদের ছেলেরা আকাশে গুলি চালাতে চালাতে কোনও এলাকায় ঢুকে তা দখল করেছে। আমার নির্দেশ ছিল সশস্ত্র মাওবাদীদের আক্রমণ করে এলাকা থেকে বের করে দিতে হবে। আমরা জানতাম সেই সময় মাওবাদীদের গুলির রসদ প্রায় শেষ। বেশিদিন যুদ্ধ চালাতে পারবে না। আমাদের টার্গেট ছিল মাওবাদীদের সঙ্গে লড়াই করতে গিয়ে যেন অহেতুক সাধারণ গ্রামবাসীর মৃত্যু না হয়। এই স্ট্র্যাটেজিতেই আমরা প্রায় বিনা রক্তপাতে গোকুলনগর, অধিকারীপাড়া, আমগেছিয়া, সাতেঙ্গাবাড়ি, মহেশপুর দখল করেছিলাম। কিছু লোক জখম হলেও কোনও প্রাণহানি হয়নি। কিন্ত ১০ তারিখ আমরা যখন দেখলাম বড়ো মিছিল এগিয়ে আসছে মহেশপুর হাইস্কুলের দিকে তখন আর কিছুই করার ছিল না। ওই মিছিল আমাদের প্ল্যান গণ্ডগোল করে দিল। বাধ্য হয়েই মিছিলে গুলি চালাতে হয়েছিল। কারণ, মহেশপুর ক্যাম্পে তখন গড়বেতা, কেশপুরের ১৫০ জনের মতো ছেলে। সঙ্গে প্রচুর অস্ত্র। ওদের মিছিলে মানুষ কয়েক হাজার। ওরা যদি ক্যাম্প পর্যন্ত চলে আসত তবে আমাদের পিটিয়ে মেরে ফেলত। অনেক অস্ত্র ওদের হাতে চলে যেত। এবং সেক্ষেত্রে এতদিন ধরে চালানো লড়াই পুরো ব্যর্থ হয়ে যেত। আবার এলাকা দখল করে নিত ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটি। গোটা রাজ্যে প্রচার হয়ে যেত, নন্দীগ্রাম দখল করতে আসা অন্য জেলার ছেলেদের অস্ত্র সমেত ধরে ফেলেছে সাধারণ মানুষ, গ্রামবাসীরা। আমাদের ক্ষয়ক্ষতি হোত প্রচুর, সেই সঙ্গে পুরো রাজ্যের সহানুভূতি এবং সমর্থন চলে যেত ওদের দিকে। প্রাণে বাঁচতে এবং পার্টিকে রক্ষা করতে গুলি চালিয়ে ওই মিছিলকে থামানো ছাড়া আর কোনও উপায় ছিল না।

 

চলবে

(১৮ সেপ্টেম্বর থেকে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হচ্ছে নন্দীগ্রাম আসলে যা ঘটেছিল। প্রতি পর্বে লাল রং দিয়ে আগের পর্বের লিঙ্ক দেওয়া থাকছে)

Comments are closed.