নন্দীগ্রাম আসলে যা ঘটেছিল #১২: নন্দীগ্রামে পৌঁছলেন গৌরাঙ্গ নামে এক যুবক, তিনিই তেলেগু দীপক, মাওবাদী নেতা
আগের পর্ব যেখানে শেষ হয়েছিল: ২০০৭ সালের ১৪ মার্চ পুলিশ অভিযানে ১৪ জনের মৃত্যুর পর বিকেলে কলকাতা থেকে নন্দীগ্রামে রওনা দিলেন মমতা ব্যানার্জি। চন্ডিপুরের মোড়ে তাঁর কনভয় আটকে দিল সিপিআইএম……
১৫ মার্চ, ২০০৭
১৫ মার্চ ২০০৭, সকাল সাড়ে নটা নাগাদ চন্ডিপুর মোড় থেকে বাঁদিকে ঘুরে নন্দীগ্রামের রাস্তা ধরল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কনভয়। প্রথম অবরোধর মুখে তিনি পড়লেন হাঁসচড়ায়, তারপর রেয়াপাড়া মোড়ে।
নন্দীগ্রাম ২ নম্বর ব্লকের এই হাঁসচড়া, রেয়াপাড়া, খোদামবাড়ি এবং আশপাশের এলাকায় তখনও সিপিআইএমের প্রভাব যথেষ্টই বেশি। দু’জায়গাতেই ১০০-১৫০ জন করে পুরুষ-মহিলার বিক্ষোভ। রাস্তায় গাছের গুঁড়ি ফেলা। সিপিআইএমের এই কর্মী-সমর্থকরা লাগাতার স্লোগান দিচ্ছেন, ‘বাইরের কাউকে নন্দীগ্রামে ঢুকতে দেওয়া হবে না।’ তার সঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে উদ্দেশ্য করে টানা অশ্রাব্য গালিগালাজ! অবরোধকারী কোনও কোনও মহিলা পা থেকে জুতো খুলে তৃণমূল নেত্রীকে দেখাচ্ছেন। এই যে মহিলাদের সামনে এগিয়ে দিয়ে তৃণমূল নেত্রীকে অশ্লীল ভাষায় আক্রমণ এবং হেনস্থা করা, এটাও সিপিএআইমের সংগঠিত এবং পরিকল্পিত একটা কৌশল। নন্দীগ্রামে ঢোকার আগেই বিরোধী নেত্রীর মনোবল ভেঙে দাও। দু’জায়গাতেই এক-দেড় ঘণ্টার বেশি সময় আটকে থাকলেন রাজ্যের ভাবী মুখ্যমন্ত্রী। পুরো সময়টাই চোয়াল শক্ত করে বসে থাকলেন গাড়ির সামনের সিটে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে তাঁর নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা দুই পুলিশ অফিসার কুসুম দ্বিবেদী এবং স্বরূপ গোস্বামী। কুসুম এবং স্বরূপ গাড়ি থেকে নেমে তৃণমূল নেত্রীর সামনে দাঁড়িয়ে। যে কোনও সময় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় শারীরিকভাবে আক্রান্ত হতে পারেন, এমন পরিস্থিতি তখন নন্দীগ্রামের ২ নম্বর ব্লকের হাঁসচড়া মোড় থেকে শুরু করে রেয়াপাড়া ছাড়িয়ে প্রায় টেঙ্গুয়া পর্যন্ত।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কনভয়ে সেই সময়ে জেলা পুলিশের একটা বা দুটো গাড়ি। সব মিলিয়ে ৫-৬ জন পুলিশ অফিসার ও কর্মী। তাঁরা কীভাবে অবরোধ সরাবেন, কী করবেন, কিছুই জানেন না। শুধু দিশেহারার মতো সিনিয়র অফিসারদের ফোন করছেন। ততক্ষণে রাজ্যজুড়ে খবর হয়ে গিয়েছে, ১৪ মার্চ পুলিশের গুলিতে ১৪ জনের মৃত্যুর পরদিনও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে নন্দীগ্রামে ঢুকতে দিচ্ছে না সিপিআইএম। আগাগোড়া মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় গাড়ির সামনে আমি দাঁড়িয়ে। মাঝেমধ্যেই কথা বলছি তাঁর সঙ্গে। পুলিশ কর্মীদের কাছে অনবরত ফোন আসা এবং তাঁদের অস্থির অবস্থা দেখে বুঝতে পারছি, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ঘেরাও করে রাখা নিয়ে তোলপাড় হচ্ছে রাজ্যের প্রশাসনিক মহল। দীর্ঘ ফোনের পর তৃণমূল নেত্রীর কনভয়ে কর্তব্যরত অফিসারদের কাছে নির্দেশ এল, তারপর রাস্তায় ফেলে রাখা গাছের গুঁড়ি সরিয়ে অবরোধ তোলার উদ্যোগ নিল পুলিশ। কিন্তু ওই ৫-৬ জন পুলিশ অফিসার ও কর্মচারী কীভাবে শাসকদলের ঝাণ্ডা হাতে ১০০-১৫০ লোকের এমন পরিকল্পিত অবরোধ তুলবেন? পুলিশ অবরোধ তোলার কথা বলতে গেলেও সিপিআইএম কর্মীরা তা কিছুতেই মানবেন না। আবার শুরু হল নানা জায়গায় ফোন। শেষমেশ নিজেরাই অবরোধ তুলে নিলেন সিপিআইএমের কর্মীরা। বুঝলাম, কোনও জায়গা থেকে নির্দেশ এসেছে অবরোধ তোলার।
সিপিআইএম অবরোধ তোলার পর ফের চলতে শুরু করল মমতা বন্দোপাধ্যায়ের কনভয়। এই দুই অবরোধে আড়াই-তিন ঘণ্টা ধরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে উদ্দেশ্য করে যে অশালীন গালিগালাজ করছিলেন সিপিআইএম কর্মীরা, যেভাবে তাঁকে নন্দীগ্রামে ঢুকতে বাধা দেওয়া হচ্ছিল, তার থেকে একটা জিনিস সেদিনই স্পষ্ট হয়ে যায়, নন্দীগ্রামের সাধারণ মানুষের থেকে কতটা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল শাসক দল। যেনতেন প্রকারে তারা চাইছিল, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নন্দীগ্রাম ঢোকা আটকাতে। সিপিআইএম বুঝতে পারছিল, তৃণমূল নেত্রী একবার নন্দীগ্রামে ঢুকে জমি লড়াইয়ে নেতৃত্ব দিতে শুরু করলে শুধু গায়ের জোরে, বন্দুক দিয়ে আন্দোলন ঠেকানো অসম্ভব হয়ে পড়বে৷ সেদিন দুই অবরোধে চোয়াল শক্ত করে নন্দীগ্রামে ঢোকার জেদ নিয়ে স্থির মুখে গাড়িতে বসেছিলেন তৃণমূল নেত্রী। জানতেন নার্ভ ফেল করে ফিরে যাওয়া মানেই অ্যাডভান্টেজ সিপিআইএম। মাটি কামড়ে পড়ে থাকতে হবে। এক ইঞ্চি জমিও ছাড়া যাবে না, কারণ লড়াইটা শুধুমাত্র নন্দীগ্রামের হাঁসচড়া থেকে ভাঙাবেড়া দখলের নয়। ২০০৬ সালের মে মাসে ৩০ টা বিধানসভা আসন জেতার ঘটনা মাত্র ১০ মাসেই অতীত হয়ে গিয়েছে, ক্লোজড চ্যাপ্টার। নতুন ময়দানে শুরু হয়েছে ২০১১ সালের লড়াই। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জানতেন, সিঙ্গুর দিয়ে যে জমি আন্দোলনের সূত্রপাত, তা সংহত করতে হবে নন্দীগ্রামে। কারণ, নন্দীগ্রাম আচমকা শান দেওয়া অস্ত্র তুলে দিয়েছে হাতে। কৃষি এবং বাস্তুজমি রক্ষা করতে গিয়ে ১৪ জন সাধারণ মানুষের মৃত্যু সামান্য কোনও বিষয় নয়। বাংলার রাজনীতিতে বিরলতম ঘটনা। সেদিনই তৃণমূল নেত্রী বুঝেছিলেন, ১৪ মার্চ, ২০০৭ পরবর্তী বাংলায় একটাও ছোটখাটো অনিচ্ছাকৃত ভুল মানে প্রবল পরাক্রান্ত প্রতিপক্ষ সিপিআইএমেরর বিরুদ্ধে দীর্ঘ ধারাবাহিক লড়াইয়ে প্রায় নিশ্চিত জয়ের থেকে দূরে সরে যাওয়া। এবং তিনি ঠিকই বুঝেছিলেন।
হাঁসচড়া এবং রেয়াপাড়ার পর আর কোনও সমস্যায় পড়তে হয়নি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে। কিন্তু গাড়ি যত এগোচ্ছে তত বুঝতে পারছি নন্দীগ্রামের ভিতরের অবস্থা প্রচণ্ড উত্তপ্ত। নন্দীগ্রাম বাজারের কাছে পৌঁছানোর একটু আগেই অফিস থেকে কেউ ফোন করে বলল, আগের দিনের গুলি চালানোর ঘটনা নিয়ে কলকাতা হাইকোর্টে সিবিআই তদন্তের নির্দেশ হয়েছে। নন্দীগ্রাম বাস স্ট্যান্ডের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় দেখলাম, রাস্তার বাঁদিকে সিপিআইএমের পার্টি অফিস দাউদাউ করে জ্বলছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের গাড়ির ঠিক পিছনে একটা পুলিশের গাড়ি, তার পরেই আমার গাড়ি। রাস্তার জায়গায় জায়গায় বিক্ষুব্ধ মানুষের জটলা। মাঝে-মাঝেই দাঁড়িয়ে যাচ্ছে তৃণমূল নেত্রীর গাড়ি। মানুষ ঝাঁপিয়ে পড়ছেন তাঁর গাড়িতে। ‘দিদি আমাদের বাঁচান, সিপিআইএম আর পুলিশ এলাকা দখল করে নিচ্ছে, সিপিআইএম প্রচণ্ড অত্যাচার করছে,’ অভিযোগ জানাচ্ছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে। নন্দীগ্রাম বাজার, থানা পেরিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের গাড়ি সোজা ঢুকে গেল হাসপাতালে। বিডিও অফিসের ঠিক পেছনে হাসপাতাল। সেখানে ভর্তি আগের দিন পুলিশের গুলিতে জখম প্রচুর মানুষ। হাসপাতাল চত্বরে কয়েক হাজার মানুষের ভিড়। ভাঙাবেড়া, সোনাচূড়া এলাকার বহু মানুষ, যাঁরা আড়াই মাস ধরে আন্দোলন করছিলেন তাঁদের অনেকেই আগের দিন পুলিশ অভিযানের পর ঘরছাড়া হয়ে বিডিও অফিসের সামনে আশ্রয় নিয়েছেন। গাড়ি থেকে নেমে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সোজা ঢুকে গেলেন হাসপাতালে। আমার সঙ্গী ক্যামেরাম্যান সৌমেন পান ঢুকে গেল হাসপাতালে। আমি হাসপাতালের গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে আছি। কিছুক্ষণ পর ভিড়ের মধ্যে থেকে দু’একজন আমাকে চিনে ফেলল। শুরু করল চিৎকার, ‘দিনরাত শুধু সিপিএমের হয়ে দালালি, বেরিয়ে যা এখান থেকে।’ কে প্রথম আমাদের চ্যানেলকে গালিগালাজ করবে তার জন্য যেন অপেক্ষায় ছিল লোকজন। তখন আমি বুঝতে পারছি, আর উপায় নেই, এবার মার খেতেই হবে। আস্তে আস্তে উত্তেজিত জনতার সঙ্গে কথা বলতে বলতে এগোতে থাকলাম বিডিও অফিসের দিকে। মেরেকেটে ১০০ মিটার রাস্তা। বিডিও অফিসের পাশে একটা পুকুর। তার পাশ দিয়ে একটা সরু রাস্তা যাচ্ছে থানার দিকে। যত লোকের চিৎকার বাড়ছে ততই আমার হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসছে নিশ্চিত মারধরের আশঙ্কায়। যতই বিডিও অফিসের দিকে এগোচ্ছি, ততই লোকজন ঘিরে ধরছে আমাকে। সেই সঙ্গে সমানে গালিগালাজ। হঠাৎই ভিড়ের মধ্যে পেছন থেকে একজন জোরে ধাক্কা মারলো। সঙ্গে সঙ্গে আমি দৌড়ে শুরু করলাম বিডিও অফিসের পাশে ওই সরু রাস্তাটার দিকে। আর দৌড় শুরু করতেই পেছন থেকে তিন-চারটে ঘুষি পড়ল পিঠে এবং মাথার পেছনে। আমি তখন প্রাণপণে ছুটতে শুরু করেছি। ভিড়ের মধ্যেই কেউ একজন আমার হাত থেকে মাইকটা কেড়ে নিল। ভিড়ে প্রায় ১০০-১৫০ মিটার দৌড়ে গিয়ে থামলাম একদম নন্দীগ্রাম থানার সামনে গিয়ে। নন্দীগ্রামে কাজ করতে গিয়ে সেই আমার প্রথম মার খাওয়া। থানায় পৌঁছে হাঁফাতে হাঁফাতে প্রথম ফোন করলাম ক্যামেরাম্যান সৌমেনকে। পুরো ঘটনা জানিয়ে ওকে বললাম, ছবি হয়ে গেলে গাড়ি নিয়ে থানায় চলে আসতে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ফোন করলেন শোভন চট্টোপাধ্যায়, ‘তুই কোথায়, কী হয়েছে? মেরেছে তোকে?’
‘হ্যাঁ, এখন ঠিক আছি।’
‘দিদি তোকে খুঁজছে। আসলে কালকে এত বড়ো একটা ঘটনা ঘটে গিয়েছে, কেউ কারও কন্ট্রোলে নেই। তুই আমাদের সঙ্গে থাকলে এটা হতো না।’
শোভন চট্টোপাধ্যায় টানা বলে যাচ্ছে, আমি পেছন থেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের গলা পাচ্ছি। বললাম, ‘না না চিন্তার কিছু নেই। সব ঠিক আছে।’
শোভন চট্টোপাধ্যায় ভাবছিলেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে নন্দীগ্রামে ঢুকে তৃণমূলিদের হাতে আমি আক্রান্ত হয়েছি, মার খেয়েছি, এটা ভালো বিজ্ঞাপন হবে না। কিন্তু সেদিন ব্যাপারটা সেভাবে দেখিইনি আমি। বরং গোটা ঘটনাটাকে একটা পেশাগত সমস্যা হিসেবেই দেখেছিলাম। যা যে কোনও পেশাতেই কম-বেশি আছে। এই ধরনের মার খাওয়া, আক্রান্ত হওয়া, গালিগালাজ খাওয়ার বহু অভিজ্ঞতা আমার ওইদিনের আগে হয়েছে, পরেও হয়েছে। একই অভিজ্ঞতা হয়েছে আমার বহু সহকর্মীরও। কোনও খবরের কাগজ বা চ্যানেলের খবর পছন্দ না হলে সাংবাদিককে টার্গেট করা বাংলায় যে কোনও রাজনৈতিক দলের কর্মীদের খুবই স্বাভাবিক প্রবণতা। যা রাজনৈতিক মেরুকরণ তীব্র হলে প্রায়ই ঘটে থাকে।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যখন হাসপাতালে আহতদের সঙ্গে কথা বলছিলেন, তখনই সেখানে দাবি ওঠে, যেখানে আগের দিন গুলি চলেছে সেখানে যেতে হবে তৃণমূল নেত্রীকে। ঘরছাড়ারা বারবার অনুরোধ করতে থাকেন, ‘আপনি একবার চলুন। দেখুন গিয়ে কী অবস্থা। সিপিআইএম সব এলাকা পুলিশ নিয়ে দখল করে নিচ্ছে।’ এর কিছুক্ষণ বাদে হাসপাতালে মধ্যেই অসুস্থ হয়ে পড়েন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁকে হাসপাতালেরই বেডে শুয়ে চিকিৎসা শুরু করেন চিকিৎসকরা। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি, দ্রুত এই খবর রটতে শুরু করে রাজ্যজুড়ে। শুরু হয়ে যায় নানান জল্পনা। কেউ কেউ রটিয়ে দেয় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আক্রান্ত হয়ে নন্দীগ্রাম হাসপাতালে ভর্তি। সকাল থেকেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ঘিরে যে বিক্ষোভ সিপিআইএম দেখাচ্ছিল এবং যেভাবে তাঁকে হেনস্থা করা হচ্ছিল, তার জেরেই তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েছেন বলে জানায় তৃণমূল কংগ্রেস নেতৃত্ব। সব মিলে আগুনে ঘি পড়ে যেন। নন্দীগ্রামের বিভিন্ন জায়গায় উত্তেজনা আরও বেড়ে যায় এক মুহূর্তে। ঘন্টাখানেক বাদে সন্ধের মুখে অ্যাম্বুলেন্স চেপে নন্দীগ্রাম হাসপাতাল ছাড়লেন তৃণমূল নেত্রী।
পুলিশ অভিযান এবং রাজনৈতিক সংঘর্ষ
১৪ মার্চের হঠকারী পুলিশি অভিযান এবং ১৪ জনের মৃত্যুর পর উত্তাল হয়ে উঠল রাজ্য। সিপিআইএমও নিশ্চিত হয়ে গেল, প্রায় মৃত্যুশয্যায় থাকা রাজ্য প্রশাসনকে দিয়ে রাজারহাটে একটা তথ্য প্রযুক্তি পার্কের শিলান্যাস কিংবা মোটামুটি সুষ্ঠুভাবে নন্দনে চলচ্চিত্র উৎসব আয়োজন যেতে পারে, কিন্তু তৃণমূল কংগ্রেসের নেতৃত্বে ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটির হাত থেকে নন্দীগ্রাম পুনরুদ্ধার করা সম্ভব হবে না। ১৩ মার্চ যখন পরের দিনের নন্দীগ্রাম অভিযানের জন্য পুলিশের চূড়ান্ত প্রস্তুতি চলছিল, সেদিন বিকেলেই খেজুরির সিপিআইএমের কামারদা পার্টি অফিসে মিটিং ডাকা হয়েছিল। রেয়াপাড়া থেকে গিয়েছিলেন মাস্টারদা। ডাকা হয়েছিল সিপিআইএমের ১০-১১ টা ক্যাম্পের লিডারদের। সেই মিটিংয়ে নন্দীগ্রাম, খেজুরির পাশাপাশি জেলার একাধিক শীর্ষ নেতাও উপস্থিত ছিলেন। সেই মিটিংয়ে সব ক্যাম্পের লিডারদের জানিয়ে দেওয়া হয় পরের দিনের পুলিশ অভিযানের কথা। ঠিক হয়েছিল, ভাঙাবেড়া ব্রিজের কাছে নবকুমার সামন্ত এবং তেখালি ব্রিজে স্বপন বেরার নেতৃত্বে সিপিআইএমের কিছু ছেলে থাকবে। তারা পুলিশের সঙ্গে থাকবে না, কিন্তু পুলিশ ঢোকার পর তারা নন্দীগ্রামে যাবে। সঙ্গে নিয়ে যাবে জানুয়ারি মাস থেকে ঘরছাড়া হয়ে থাকা পরিবারগুলোকে। ১৪ মার্চ পুলিশি অভিযান শেষ হওয়ার পর সিপিআইএমের ছেলেদের নন্দীগ্রামের ভিতরে ঢোকা এবং স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে সংঘর্ষের বহু নমুনা পরে পেয়েছিল সিআইডি। শুধু তাই নয়, ১৪ মার্চ নন্দীগ্রামে পুলিশের গুলিতে মৃত্যু হয়েছিল ৮ জনের। বাকি ৬ জনের মৃত্যু হয়েছিল বোমা, ছুরি, ভোজালির আঘাতে।
এই ৬ জনের মৃত্যুর কোনও দায় পুলিশ, মানে সরকার নিতে চায়নি। কিন্তু কীভাবে মৃত্যু হয়েছিল এই ৬ জনের? নন্দীগ্রামের বহু মানুষের অভিযোগ ছিল, সেদিন পুলিশ অ্যাকশন হয়েছিল খুব বেশি হলে আধ ঘণ্টা। তারপরই সিপিআইএমের কিছু সশস্ত্র ছেলে খেজুরির দিক থেকে তালপাটি খাল পেরিয়ে চড়াও হয় আন্দোলনকারীদের ওপর। সেই আক্রমণেই মৃত্যু হয় ওই ৬ জনের। এই অভিযোগ যে ভিত্তিহীন ছিল না, তা আমি অনেকদিন বাদে জেনেছিলাম। শুধু তাই নয় অনেক বছর পরে সিপিআইএমের খুব নির্ভরযোগ্য সূত্র মারফত আমি জানতে পারি, পুলিশ অভিযানের পর নন্দীগ্রামের মৃতদের দেহ লোপাটের ব্যবস্থাও করেছিল পার্টি ক্যাডাররা। পরিকল্পনা ছিল, কয়েকটা মৃতদেহ তুলে গোপনে হলদি নদীর ধারে নিয়ে যাওয়ার। তারপর নৌকায় চাপিয়ে মৃতদেহগুলোকে সমুদ্রে ফেলে আসার প্ল্যান হয়েছিল। তাতে সুবিধে হোত দুটো। এতজন মানুষের মৃত্যু হয়েছে, সেটা প্রচার হোত না। বলা হোত, লোকজন পুলিশ দেখে ভয়ে পালিয়ে গেছে। মৃতদেহ কোনওদিনই উদ্ধারও হোত না, ফলে প্রমাণ হোত না তাদের মৃত্যু হয়েছে। দ্বিতীয়ত, পুলিশের গুলি চালানোর বাইরেও ৬ জনের মৃত্যু হয়েছে সংঘর্ষে, তা কোনও দিনই জানাজানি হোত না। কিন্তু সিপিআইএমের জেলার শীর্ষ নেতৃত্বের এই প্ল্যানে বাধা দেন আইজি অরুণ গুপ্তা। পুলিশ অভিযান হয়েছিল, নির্দিষ্টভাবে বললে ২০-২৫ মিনিট। অভিযানের শেষে যখন এলাকা মোটামুটি শান্ত হয়েছে, অরুণ গুপ্তা এবং অন্য অফিসাররা দেখেন, যেদিকে গুলি চলেনি সেখানেও পড়ে আছে একাধিক মৃতদেহ। শুধু তাই নয়, বহু লোক ছুরি, ভোজালির আঘাতে জখম হয়ে পড়ে র়য়েছে। পুরো ঘটনা দেখে তাঁরা অবাক হয়ে যান। কীভাবে এমন সম্ভব? পুলিশ তো ছুরি, ভোজালি ব্যবহার করে না! কিন্তু এত বড়ো পুলিশ অভিযানের সময় এবং কিছুক্ষণ বাদে এতগুলো মানুষের মৃত্যু হল ছুরি, ভোজালির আঘাতে! ১৪ মার্চের পর রাজ্য প্রশাসনের অন্যতম সাফাই ছিল, পুলিশের গুলিতে তো ১৪ জনের মৃত্যু হয়নি, ৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। যেন পুলিশের উপস্থিতিতে নিজেদের মধ্যে খুন খারাবি করে ৬ জন সাধারণ মানুষের মৃত্যু খুব স্বাভাবিক ঘটনা।
১৪ মার্চ পুলিশ অভিযানের বেশ কিছুক্ষণ বাদে এক পুলিশ অফিসার আইজিকে প্রস্তাব দেন, কয়েকটা মৃতদেহ সরিয়ে দিলে ভালো হবে। আইজি তখন বিধ্বস্ত, ভাঙাবেড়া ব্রিজের কাছে একটা চেয়ারে বসে। গোটা ঘটনার আকস্মিকতায় বিহ্বল চোখ-মুখ, চেহারা। বিশ্বাসই করতে পারছেন না, কীভাবে এত লোকের মৃত্যু হল মুহূর্তের মধ্যে। কীভাবে শয়ে শয়ে পুরুষ মহিলা এভাবে জখম হল! তখন তাঁর কাছে পুরো ব্যাপারটা খুব অস্বাভাবিক লেগেছিল। ১৪ মার্চ অভিযানে ভাঙাবেড়া ব্রিজে ডিউটিতে ছিলেন এমন একজন জুনিয়র অফিসার অনেক বছর বাদে আমাকে বলেছিলেন, সেদিন পুলিশের পোশাক পরা প্রচুর লোক ছিল যাদের পায়ে জুতো ছিল না। এবং তারা নিশ্চিতভাবে শাসক দলের ক্যাডার। তৃণমূল কংগ্রেস এবং নন্দীগ্রামের মানুষ বারবারই এই চটি-পুলিশের অভিযোগ তুলেছিলেন, যদিও তার কোনও প্রমাণ ছিল না। কিন্তু একটা বিষয় নিয়ে কোনও সংশয় নেই, ১৪ মার্চ পুলিশ অভিযানের পর প্রচুর সিপিআইএমের লোক ভাঙাবেড়া এবং তেখালি ব্রিজ পেরিয়ে গোকুলনগর, সোনাচূড়া, গড়চক্রবেড়িয়ায় ঢুকে পড়েছিল আন্দোলনকারীদের সবক শেখাতে। যার প্রমাণ মিলেছিল অনেক মৃত এবং জখম ব্যক্তির আঘাতের ধরনে। ভোঁতা অস্ত্র, ধারালো ছুরি বা চাপারের যে আঘাতের চিহ্ন একশো’জনেরও বেশি পুরুষ, মহিলার শরীরে ছিল, ২০ মিনিটের পুলিশ অভিযানে তা হওয়া সম্ভব নয়।
পূর্ব মেদিনীপুর জেলার এক পুলিশ অফিসার অভিযানের কিছুক্ষণ বাদে আইজি অরুণ গুপ্তাকে বলেন, ‘কেউ জানতেও পারবে না। পুলিশকে কিছুই করতে হবে না, অন্য লোক রেডি আছে। তারাই মৃতদেহ সরিয়ে দেবে। এতে রাজ্যজুড়ে ইমপ্যাক্টও কম হবে।’ সেদিন অভিযানের পরপরই সিপিআইএমের জেলার এক নেতা পুলিশকে এই প্রস্তাব দিয়েছিলেন। সেই অফিসার বিষয়টা জানান আইজিকে। কিন্তু প্রস্তাব শুনে তা তখনই খারিজ করে দিয়েছিলেন অরুণ গুপ্তা। জানিয়ে দেন, ‘অসম্ভব, প্রতিটা মৃত্যুর কথা থানার এফআইআরে থাকবে। সব মৃতদেহ হাসপাতালে পাঠাতে হবে।’ তখনই কয়েকজন পুলিশ অফিসারের প্রথম সন্দেহ হয়, তাঁদের অভিযানের সময় গোপনে নন্দীগ্রামে ক্যাডার ঢোকানোর প্ল্যান করেছিল সিপিআইএম। এই ষড়যন্ত্রে যে পুলিশের একাংশ যুক্ত তাও তাঁরা প্রথমে বুঝতে পারেননি। সেদিন ভোর থেকে যত অফিসার নন্দীগ্রামে গিয়েছিলেন, সবাই দেখেছেন, সিপিআইএম ক্যাডাররা কীভাবে সেখানে ঢোকার সমস্ত রাস্তায় ব্যারিকেড করেছিল। পুলিশের রাস্তা সারাইয়ের অভিযান কেন সিপিআইএম আড়াল করতে চাইছে সংবাদমাধ্যমের থেকে, সেই প্রশ্ন যে অফিসাররা এই ষড়যন্ত্রে ছিলেন না তাঁদের মাথায় কেন আসেনি, তাও এক বিস্ময়কর ব্যাপার। ১৪ মার্চ নন্দীগ্রাম অভিযানে যুক্ত একাধিক পুলিশ অফিসারই অনেক পরে বুঝতে পেরেছিলেন, কোথাও একটা বড়ো গোলমাল হয়ে গেছে, যা সাধারণত এই ধরনের আইন-শৃঙ্খলা সমস্যা মোকাবিলার সময় হয় না। এবং এর জন্য তাঁদের কয়েকজন সহকর্মীই দায়ী।
১৪ মার্চ পুলিশের একাংশের সঙ্গে যোগসাজশে নন্দীগ্রামে অস্ত্র হাতে ঢোকার যে প্ল্যান সিপিআইএম করেছিল তা আমার কাছে আরও স্পষ্ট হয় বেশ কয়েকবছর বাদে। দীর্ঘ দিন সরকার চালানোর সুবাদে মুজফফর আহমেদ ভবন জানত, কোন পুলিশ অফিসারকে দিয়ে কী কাজ হবে। অনেক ক্ষেত্রেই এই তালিকা অনুযায়ী পুলিশের পোষ্টিং হোত। ১৪ মার্চ পুলিশ অভিযানের ঠিক আগের দিন সিপিআইএমের এক প্রভাবশালী নেতা এবং মন্ত্রী ৩১ আলিমুদ্দিন স্ট্রিটে বার্তা দিয়েছিলেন, নন্দীগ্রামে আইজি অরুণ গুপ্তাকে যেন পাঠানো না হয়। তাঁকে পাঠানো হলে সর্বনাশ হবে। এই প্রশাসনিক হস্তক্ষেপ শোনেননি বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। ওই সিপিআইএম নেতা একথা নিজে আমাকে বলেছিলেন কয়েক বছর বাদে। সেই সঙ্গে আরও জানিয়েছিলেন, অরুণ গুপ্তা স্পটে থাকলে প্ল্যান অনুযায়ী কাজ করতে সমস্যা হতে পারে বলে তাঁকে সাবধান করেছিলেন ওই অভিযানেই দায়িত্বপ্রাপ্ত অন্য একজন সিনিয়র আইপিএস অফিসার। পুলিশ অভিযানের পর সিপিআইএম নেতাদের একাংশের পরামর্শ অনুযায়ী মৃতদেহ লোপাটের ব্যাপারে আইজি সম্মতি না দেওয়ায় অনেকেই তাঁর ওপর ক্ষুব্ধ ছিলেন। কিন্তু কারও কিছু করার ছিল না। ১৪ মার্চ সকাল থেকে মাস্টারদা নিজে ছিলেন খেজুরির কুঞ্জপুর এলাকায়। পার্টি অফিসের ছাদে বসে তিনি পুরো অভিযানের খবর রাখছিলেন। সেদিন রাতেই তিনি আবার রেয়াপাড়ায় সিপিআইএমের পার্টি অফিসে ফিরে যান।
১৪ মার্চের পর কয়েক দিন রীতিমতো টালমাটাল পরিস্থিতি চলল নন্দীগ্রামজুড়ে। কলকাতা থেকে নানান ধরনের মানুষের যাতায়াত শুরু হল সেখানে। কলকাতার কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রী থেকে শুরু করে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন, প্রকাশ্যে কোনও দলীয় রাজনীতি না করা বিভিন্ন পেশার কয়েকজন মানুষ যাতায়াত শুরু করেন নন্দীগ্রামে। কিন্তু কিছু দিনের মধ্যেই সংবাদমাধ্যম, রাজনৈতিক নেতা এবং তাদের যাতায়াত একটু একটু করে কমতে শুরু করে। পরিস্থিতি শান্ত হয়ে এল আস্তে আস্তে। এরপরই নন্দীগ্রাম এলাকা উদ্ধার এবং তা দখলে রাখার রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শুরু হল সিপিআইএমের গড়বেতা, কেশপুর বাহিনীর সঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেস এবং মাওবাদীদের নেতৃত্বে ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটির। যে লড়াই চলল ১০ নভেম্বর দুপুর পর্যন্ত। যে যুদ্ধে মৃত্যু হল বহু মানুষের। যে যুদ্ধের প্রকৃত খবর বা আসল মৃত্যুর হিসেব কোনও দিনই প্রকাশ্যে আসেনি। যে যুদ্ধে দু’তরফেই খরচ হয়েছিল লক্ষ-লক্ষ টাকা। বিনিময় হয়েছিল কয়েক হাজার রাউন্ড গুলি। যে যুদ্ধে নীরব ভূমিকা পালন করেছিল পুলিশ এবং প্রশাসন।
পড়ুন আগের পর্ব: নন্দীগ্রাম আসলে যা ঘটেছিল #১১: ‘এত রাতে নন্দীগ্রামে ঢোকা ঠিক হবে না’, মমতা ব্যানার্জিকে বললেন শোভন
সেই সময় নন্দীগ্রামের ১ নম্বর ব্লক প্রায় পুরোটাই ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটির দখলে। সাতেঙ্গাবাড়িও হাতছাড়া হয়েছে সিপিআইএমের। কিন্ত বিভিন্ন জায়গায় মাঝে মাঝেই গুলির লড়াই চলত দু’পক্ষের মধ্যে। জানুয়ারি থেকে কার্যত অবাধে এলাকার পর এলাকা দখল করে এগোতে থাকা ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটি প্রথম বড়সড় বাধার মুখে পড়ল এপ্রিলের গোড়ায়। প্রথম দিকে তৃণমূল কংগ্রেসের নেতৃত্বে ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটির আক্রমণের মুখে দিশেহারা হয়ে গিয়েছিল সিপিআইএম। কারণ, জানুয়ারির শুরুতে এই আন্দোলন শুরু হয়েছিল জমি রক্ষার জন্য। স্বাভাবিকভাবেই অধিকাংশ গ্রামবাসীর সমর্থন পেয়েছিল ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটি। কিন্তু অচিরেই তারা বুঝতে পারছিল শুধুমাত্র জমি রক্ষার আবেগকে হাতিয়ার করে সিপিআইএমের মতো শৃঙ্খলাবদ্ধ দল এবং প্রশাসনের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি লড়াই চালনো সম্ভব নয়। তাই অস্ত্রের আমদানি শুরু হয় নন্দীগ্রামে। একদিকে জমি রক্ষার জন্য সাধারণ মানুষের আবেগ, অন্যদিকে অস্ত্র হাতে পুরো নন্দীগ্রাম থেকে সিপিআইএমকে উৎখাতের ডাক দিয়ে খুব দ্রুত এলাকা বৃদ্ধি করতে শুরু করেছিল ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটি। এরপরেই এল ১৪ মার্চ। অপরিকল্পিত পুলিশ অভিযান। যার ফলশ্রুতিতে ১৪ জনের মৃত্যু এবং তার জন্যে তৈরি হওয়া দেশজুড়ে সহানুভূতির হাওয়া। অন্যদিকে, ১৪ মার্চের পর সিবিআই তদন্ত এবং ঘরে-বাইরে প্রবল সমালোচনার মুখে পড়ে পুলিশ প্রশাসন তখন চরম বেকায়দায়। সিনিয়র অফিসাররা মহাকরণ থেকে দৃঢ় নির্দেশ দিচ্ছিলেন না, বা কোনও নির্দেশ দিলেও নিচুতলার লোকজন তা অনেক ক্ষেত্রেই তা মানছিলেন না। নন্দীগ্রাম থানার কনস্টেবল থেকে শুরু করে রাজ্য পুলিশের ডিরেক্টর জেনারেল অনুপভূষণ ভোরা, প্রত্যেকেই বিতর্ক এড়িয়ে চলার সিদ্ধান্ত নিলেন। ফলে মাৎস্যন্যায় শুরু হল নন্দীগ্রামে। ততদিনে গড়বেতা এবং কেশপুর বাহিনীর উপস্থিতিতে অনেক শক্তিশালী হয়েছে সিপিআইএমের ক্যাম্পগুলো। আস্তে আস্তে শক্তিবৃদ্ধি করেছে ভুমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটিও। কারণ, এবার ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটির সঙ্গে সরাসরি যুক্ত হল মাওবাদীরা। নন্দীগ্রামের কোথাও কোনও আইনের শাসন নেই, প্রশাসন নেই। ডাইরেক্ট অ্যাকশনে নামল সিপিআইএম এবং ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটি।
এবার সত্যিই মাওবাদী
১৪ মার্চের ক্ষত আস্তে আস্তে শুকোতে শুরু করেছে। ১৩ জন স্থানীয় মানুষের মৃত্যু (একজন মৃতের পরিচয় আজ পর্যন্ত জানা যায়নি) শোক ভুলে চোয়াল শক্ত হয়েছে ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটির। মধুসূদন মন্ডল, আদিত্য বেরাদের ট্রেনিংয়ে খোকন শীট, শ্রীকান্ত পাইক, রাধেশ্যাম গিরি, প্রকাশ মুনিয়ার মতো কয়েক ডজন সাহসী, বেপরোয়া যুবক ততদিনে পাকা যোদ্ধা বনে গিয়েছে। খোকন শীটকে প্রথম দেখেছিলাম ৭ জানুয়ারি বিকেলে। আমি তখন নন্দীগ্রাম থানার বাইরে বসে আছি। পুলিশ তাকে ধরে নিয়ে এসেছিল নন্দীগ্রাম থানায়। শঙ্কর সামন্তকে খুন এবং আরও কিছু অভিযোগে। পুরো না হলেও, প্রায় নিরীহ এক যুবক। মোটরসাইকেল সমেত ধরা পড়েছে পুলিশের হাতে। সঙ্গে আরও কয়েকজন। পুলিশ বলেছিল, খোকন শীটের কাছে বোমা পাওয়া গিয়েছে। তাদের ছাড়ানোর দাবি নিয়ে নন্দীগ্রাম থানায় সেদিন সন্ধ্যায় এসেছিল শুভেন্দু অধিকারী। তাঁর পেছনে প্রচুর লোক। চাপে পড়ে পুলিশ সেদিন খোকন শীটকে ছেড়েও দিয়েছিল। এক পঞ্চায়েত সদস্যের খুনের আসামীকে রাজনৈতিক চাপের মুখে পড়ে একরাতও থানায় আটকে রাখার হিম্মত যে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের পুলিশের নেই, তা সেই সন্ধ্যায় চোখের সামনে দেখেছিলাম। সেই খোকন শীটকে মাত্র সাড়ে তিন মাস বাদে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মিটিংয়ে দেখেছিলাম গড়চক্রবেড়িয়ায়। চিনতে অসুবিধে হচ্ছিল, এত দ্রুত একটা হিংস্রতা, কাঠিন্যও আনা যায় চেহারায়? এপ্রিলের শেষে খোকন শীটকে দেখে বুঝেছিলাম, সাড়ে তিন মাস আগে আন্দোলনের শুরুতেই কেন তাঁকে ছাড়াতে নিজে থানায় চলে গিয়েছিলেন শুভেন্দু অধিকারী!
এই প্রায় পাকাপোক্ত লড়াকু বাহিনীর সঙ্গে ১৪ মার্চের ঠিক পরে নন্দীগ্রামে গিয়ে যোগ দিলেন এক যুবক। সোজা সোনাচূড়া। কথা বললেন নিশিকান্ত মন্ডল, মধুসূদন মন্ডলের সঙ্গে। নিজের নাম বললেন গৌরাঙ্গ। টানটান চেহারা। ‘সিপিআইএমের এই গায়ের জোরে জমি নেওয়ার বিরুদ্ধে আমরা। নন্দীগ্রাম নিয়ে অনেক কিছু শুনেছি। আপলোগ যো লড়াই কিয়ে উসমে সামিল হোনা চাহতা হু হাম লোগ। আপনাদের সাহায্য করতে এসেছি। এই আন্দোলনকে আরও বড়ো চেহারা দিতে হবে। তার জন্য করতে হবে অস্ত্র নিয়ে লড়াই। আমরা জানি কীভাবে সিপিআইএমকে হারাতে হবে। বহুত লড়েছি ওদের সঙ্গে।’ ভাঙা ভাঙা বাংলা আর হিন্দিতে নিজের বায়োডেটা পেশ করেছিলেন মাঝবয়সী ওই ব্যক্তি। বহুদিন সিপিআইএম করেছেন নিশিকান্ত মন্ডল, এনসিসি ট্রেনিং থেকে শুরু করে এপিডিআর সবই করেছেন মধুসূদন মন্ডল। জহুরির চোখ তাঁদের। চিনতে ভুল হয়নি। দু’জনেই বুঝেছিলেন, এই লড়াইয়ে কাজে লাগবে গৌরাঙ্গকে। কাজে লাগবে তাঁর বাহিনীকে। এঁর হাতের কব্জি থেকে চোয়াল, চোখ থেকে কাঁধ বলে দিচ্ছে, যুদ্ধ এর রক্তে। বন্দুক এর কাছে খেলনার মতো। মানুষ খুন করা সামান্য ব্যাপার। যে কোনও সশস্ত্র লড়াইয়ে সেনাপতি হওয়ার সমস্ত যোগ্যতাসম্পন্ন এই গৌরাঙ্গই তেলেগু দীপক। শীর্ষ মাওবাদী নেতা।
চলবে
(১৮ সেপ্টেম্বর থেকে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হচ্ছে নন্দীগ্রাম আসলে যা ঘটেছিল। প্রতি পর্বে লাল রং দিয়ে আগের পর্বের লিঙ্ক দেওয়া থাকছে)
Comments are closed.