নন্দীগ্রাম আসলে যা ঘটেছিল #৮: গড়বেতা, কেশপুরের সশস্ত্র বাহিনী এনে নন্দীগ্রাম উদ্ধার করতে হবে, বললাম লক্ষ্মণ শেঠকে
আগের পর্বে কী ঘটেছিল: ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটি নন্দীগ্রামে দখল করছে নতুন এলাকা, তার মোকাবিলায় কীভাবে প্রস্তুতির সিপিআইএমের?
মাস্টারদা
নন্দীগ্রাম পুনরুদ্ধারে সিপিআইএম রাজ্য নেতৃত্ব দায়িত্ব দিল পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা পার্টিকে। পূর্ব মেদিনীপুর পার্টিকে সাহায্য করতে গড়বেতার এক পার্টি সদস্যকে পুরো অপারেশনের দায়িত্ব দিল পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা সিপিআইএম। বন্দুক চালানোয় অত্যন্ত দক্ষ, যুদ্ধে প্রশিক্ষিত এবং পার্টির প্রতি একশো শতাংশ একনিষ্ঠ, মাঝবয়সী ওই ব্যক্তি ১৯৯৮ সাল থেকে ২০০১ পর্যন্ত পশ্চিম মেদিনীপুরের বিস্তীর্ণ এলাকায় তৃণমূল কংগ্রেসের সঙ্গে লড়াইয়ে প্রধান ভূমিকা নিয়েছিলেন। তিনি ছাত্র জীবনে এনসিসি প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন। শুধু নিজে অস্ত্র চালানোতে দারুণ দক্ষ তাই নয়, যে কোনও অনভিজ্ঞ লোককে অস্ত্র প্রশিক্ষণ দিতেও তাঁর পারদর্শিতা অসামান্য। তাঁর কথায়, ‘আমি যুদ্ধের সময় কখনও হাতে বন্দুক নিতাম না। খুব দরকার পড়েছে, নিজে আক্রান্ত হয়েছি এমন পরিস্থিতিতে দু-একবার বন্দুক হাতে নিতে হয়েছে’।
জিজ্ঞেস করেছি, ‘কেন’?
হেসে তাঁর জবাব, ‘আসলে আমার নিশানা অব্যর্থ। যাকে তাক করব লাগবেই। কিন্তু মানুষ মারতে ইচ্ছা করে না। যুদ্ধের সময় আমি বন্দুক নিলে অনেক লোক মারা যাবে। আমরা তো মানুষ মারতে চাই না। নানা সময় দল আক্রান্ত হয়েছে। এলাকা বেদখল হয়েছে। বাধ্য হয়ে ছেলেদের ট্রেনিং দিতে হয়েছে, অস্ত্র হাতে নিতে হয়েছে। যুদ্ধ করতে হয়েছে। জীবনে বহু যুদ্ধ লড়েছি, কখনও হাতে বন্দুক নিয়ে লোক মারতেও হয়েছে, কিন্তু সবই পার্টির জন্য।’
এমন অব্যর্থ নিশানা হল কীভাবে?’ জিজ্ঞেস করলাম।
‘কম বয়সে এখানে এনসিসি ট্রেনিংয়ে আমার পারফরমেন্স দেখে ওরাই আমাকে পাঠিয়েছিল পুণেতে। সেখানে শুধু রাইফেল নয়, আমি এলএমজি (লাইট মেশিন গান) চালানোর ট্রেনিংও নিয়েছি। এখনও আমি চাইলে এলএমজি চালাতে পারি।
নন্দীগ্রাম অপারেশনের অনেকদিন পর এই ব্যক্তির সঙ্গে আমি দেখা করেছিলাম পশ্চিম মেদিনীপুরের একটি জায়গায়। অত্যন্ত গোপনে। কারণ তখন পশ্চিমবঙ্গে রাজনৈতিক পালাবদল হয়ে গিয়েছে। ২০১১ বিধানসভা নির্বাচনউত্তর বাংলায় স্বাভাবিকভাবেই তিনি ঘরছাড়া। ওই ব্যক্তির পরিচয় তখন জানাজানি হলে, তাঁর জীবন সংশয় হতে পারে। তাঁর এবং তাঁর পরিবারের নিরাপত্তার জন্যই তাঁর নাম লেখা সম্ভব নয়। নন্দীগ্রামে ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটির সঙ্গে প্রায় ১১ মাস ধরে সিপিআইএমের যে যোদ্ধারা তাঁরই নেতৃত্বে লড়াই করেছিল, তাদেরও অধিকাংশই তাঁর আসল নাম, পরিচয় জানতো না। নন্দীগ্রামে সিপিআইএমের সশস্ত্র বাহিনী তাঁকে ডাকতো মাস্টারদা বলে। নন্দীগ্রাম-খেজুরির কোনও কোনও সিপিআইএম নেতা তাঁকে ডাক্তার বলেও সম্বোধন করতেন। ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটিতে সেই সময় প্রশিক্ষিত এক্স-আর্মিম্যান থেকে শুরু করে দুর্ধর্ষ মাওবাদী সকলেই ছিল এবং এই শক্তির সঙ্গে সিপিআইএম টানা লড়েছিল মাস্টারদার নেতৃত্বে। পুরো লেখাতে আমিও তাঁকে মাস্টারদা বলে সম্বোধন করব।
২০১৪ সালে আমি মাস্টারদার সঙ্গে দেখা করি পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার একটি জায়গায়। তৃণমূল কংগ্রেসের হাতে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কায় তার আগে কয়েক বছর ঘর ছাড়া ছিলেন মাস্টারদা। বহুদিন কলকাতাতেও ছিলেন এক গোপন আস্তানায়।
আগের দিন ফোনে বলা ছিল, পরদিন ট্রেনে আমি যাব। পশ্চিম মেদিনীপুরের ওই ছোট্ট স্টেশনে ট্রেন পৌঁছনোর এক মিনিটের মধ্যেই মাস্টারদার ফোন, ‘ওভারব্রিজে উঠে দক্ষিণদিকের সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসুন, আমি লাল রঙের মোটরসাইকেলে বসে আছি।’ স্টেশন থেকে বেরিয়ে রাস্তায় পা রাখতেই সামনে লাল মোটরসাইকেলে স্টার্ট দেওয়া। ফুল শার্ট, হেলমেটে মুখ ঢাকা। বললেন, ‘বসে পড়ুন।’ পিছনের সিটে বসতেই মোটরসাইকেল চালিয়ে দিলেন। রাস্তা, বাজার, গলি পেরিয়ে একটা বাড়ির সামনে গিয়ে থামল মোটরসাইকেল, নামলাম দুজনে।
‘আসুন’ আমাকে নিয়ে ওই বাড়িতে ঢুকে পড়লেন। তাঁকে অনুসরন করে এগোলাম। বাড়ির দোতলায় একটা ঘরে গিয়ে বসলাম দু’জনে। লম্বা পেটানো চেহেরা, ৫০ এর কাছাকাছি বয়েস, চওড়া কাঁধ এবং কব্জি। গাল ভাঙা, পকেট থেকে বের করে একটা সিগারেট ধরালেন মাস্টারদা। আগে কয়েকবার ফোনে কথা হয়েছে, কিন্তু সামনে থেকে দেখিনি কখনও। দেখছি আর ভাবছি, এই লোকটাই অন্তত তিনটে বড়ো রাজনৈতিক লড়াইয়ে সিপিআইএমের সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান কমান্ডার ছিলেন। ১৯৯৮ থেকে ২০০০ সালের গড়বেতা-কেশপুর, ২০০৭ সালে পুরোটা নন্দীগ্রাম এবং ২০০৯ থেকে ২০১১ সালে লালগড়-শালবনি- ধেড়ুয়া-এনায়েতপুরে মাওবাদীদের সঙ্গে লড়াইয়ে সিপিআইএমের সশস্ত্র বাহিনীকে নেতৃত্ব দিয়েছেন মাস্টারদা।
শুরু হল কথাবার্তা প্রথমে খানিকটা এলোমেলোভাবে। তারপর মাস্টারদা শুরু করলেন।
‘ফেব্রুয়ারির একদম শুরুর দিকে, তারিখ মনে নেই, জেলা পার্টি থেকে
আমাকে বলল, নন্দীগ্রামে যেতে হবে। ২০০৭ সাল। ওখানে ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটি এলাকা দখল করে নিচ্ছে। তা উদ্ধার করতে হবে ওদের হাত থেকে। আমাকে দায়িত্ব দেওয়া হল। বলা হল, একবার গিয়ে পরিস্থিতিটা দেখে আসতে। তারপর নিজের মতো করে পরিকল্পনা করতে। তার আগে আমি কোনও দিন নন্দীগ্রাম যাইনি। আমি নন্দীগ্রামে যাওয়ার আগে আমাদের জেলা পার্টির একজন নেতা বলেছিলেন, যা করার সাবধানে করতে। নন্দীগ্রাম ভয়ানক জায়গা। জিজ্ঞেস করেছিলাম, কেন? বলছিলেন, পূর্ব মেদিনীপুরের লোক আমাদের জেলার মতো না। একদম আলাদা। আসলে দুই মেদিনীপুর যখন এক ছিল তখন তিনি পার্টির কাজে অনেকবার নন্দীগ্রাম, খেজুরি গিয়েছিলেন। সেই অভিজ্ঞতা থেকেই বলেছিলেন, নন্দীগ্রাম ভয়ানক জায়গা।
পূর্ব মেদিনীপুর জেলা পার্টির শীর্ষ নেতৃত্বকে সব জানানো ছিল, আমি প্রথমে গেলাম হলদিয়া। আমাদের জোনাল অফিস শ্রমিক ভবনে গিয়ে দেখা করলাম লক্ষ্মণ শেঠের সঙ্গে। লক্ষ্মণদা বললেন, ‘বহু লোক ঘরছাড়া হয়ে গিয়েছে, এক নম্বর ব্লক প্রায় পুরোটা দখল করে নিয়েছে ওরা। হলদি নদীর ধারে জোলিংহাম বলে একটা জায়গা আছে, সেখানে ওরা অস্ত্র প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। কী করা যায়? এলাকা উদ্ধার করে ঘরছাড়াদের বাড়ি ফেরাতে হবে।’ লক্ষ্মণদার কাছে নন্দীগ্রামের ম্যাপটা ভালো করে বুঝলাম। বললাম, শুধুমাত্র বাইরে থেকে লোক এনে গুলি, বন্দুক চালিয়ে কিছু করা যাবে না। এভাবে এলাকা পুনরুদ্ধার করা যায় না। তাছাড়া বাইরে থেকে সশস্ত্র বাহিনী এনে এলাকা পুনরুদ্ধার করা গেলেও, তাতে কোনও লাভ হবে না। সেই এলাকা ধরে রাখতে পারবেন না। আমি অভিজ্ঞতা থেকে জানি, শুধুমাত্র বহিরাগত সশস্ত্র বাহিনী দিয়ে যুদ্ধ করলে, সেখানকার স্থানীয় মানুষের মধ্যে খারাপ প্রতিক্রিয়া হয়। কারণ বাইরের ছেলেদের ওই এলাকার প্রতি কোনও ভালোবাসা থাকে না। তারা এলাকার রাস্তাঘাট চেনে না, এলাকার কোন লোকটা ভালো, কে খারাপ তা জানে না। তাই অ্যাকশনের সময় অনেক ভুল হয়ে যায়। যে কোনও যুদ্ধে সেখানকার স্থানীয় মানুষের আস্থা অর্জন করা না গেলে, পরে ফল খারাপ হয়। আর সবচেয়ে বড়ো কথা, যারা স্থানীয় বাসিন্দা তাঁরা যদি নিজেদের এলাকা উদ্ধারে সক্রিয়ভাবে যুক্ত না হন, তার মানে বুঝতে হবে, ওই এলাকা উদ্ধার করার কোনও দরকার নেই। লক্ষ্মণবাবুকে বললাম, যা করার করতে হবে নন্দীগ্রামের স্থানীয় ছেলেদেরই।
উনি ব্যাপারটা বুঝলেন, কিন্তু বললেন, ‘এরা তো কোনওদিন লড়াই করেনি। মাওবাদী অস্ত্র নিয়ে ঢুকে পড়েছে, আমদের ছেলেরা ওদের সঙ্গে পারবে কী করে? আমাদের ছেলেরা ভয় পেয়ে যাচ্ছে।’
বললাম, কেন পারবে না, আপনাদের তো অনেক ছেলে ঘরছাড়া। আমাকে বাছাই করে ছেলে দিন, আমি অস্ত্র প্রশিক্ষণ দেব। লড়াই করা শিখতে হবে। আমাদের গড়বেতা, কেশপুরে যারা যুদ্ধ করেছিল, তারা সবাই অস্ত্র চালাতে জানতো নাকি? আক্রমণের মুখে পড়ে আত্মরক্ষার জন্য শিখতে হয়েছিল। এতে কিছুটা সময় লাগবে। কিন্তু এছাড়া কোনও উপায় নেই, চটজলদি একদিনে কিছু করা যাবে না। এটা করতে পারলে নন্দীগ্রাম পুনরুদ্ধার সফল হবে। এরপর উনি আমাকে বললেন, প্রয়োজন মতো ছেলে বেছে নিতে।
তখন নন্দীগ্রামে আমাদের যত লোক ঘরছাড়া ছিল তারা তিনটে জায়গায় আলাদা আলাদা করে থাকছিল। নন্দীগ্রামের ২ নম্বর ব্লকের রেয়াপাড়া, খেজুরির কুঞ্জপুর এলাকায় এবং হলদিয়ায়। সময় নষ্ট না করে সেদিনই হলদিয়ায় থাকা ছেলেদের সঙ্গে দেখা করলাম। তারপর গেলাম রেয়াপাড়া এবং খেজুরির কামারদায় আমাদের পার্টি অফিসে। রেয়াপাড়াতে আমাদের নেতা অশোক গুড়িয়া, স্বপন বেরা এবং খেজুরিতে হিমাংশু দাস, বিজন রায়ের সঙ্গে দেখা হল। হলদিয়া, রেয়াপাড়া এবং কামারদা, তিন জায়গাতে অনেকের সঙ্গে কথাবার্তা বলে কম বয়সী প্রায় ২০০ জনকে বাছলাম। বেশিরভাগই বাছলাম সোনাচূড়া ও গড়চক্রবেড়িয়া এলাকার ছেলেদের। কারণ, আন্দোলনটা মূলত ওই দুই জায়গা থেকেই শুরু হয়েছে এবং ওখানেই ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটির শক্ত ঘাঁটি। তাই সোনাচূড়া, গড়চক্রবেড়িয়া দখল করতে হবে পুরো ব্লক পুনরুদ্ধারের জন্য। ওখানকার ছেলেদের বাছার সুবিধে হচ্ছে, ওরা ওই এলাকার সব রাস্তা চেনে, সমস্ত লোককে চেনে। এই সব করতে করতে সন্ধে হয়ে গেল। ঠিক হল, দু’একদিন পর থেকে অস্ত্র প্রশিক্ষণ শুরু হবে। আমার থাকার ব্যবস্থা হল রেয়াপাড়া পার্টি অফিসে। কিন্তু অস্ত্র প্রশিক্ষণ কোথায় হবে? ফাঁকা, বড়ো জায়গা দরকার। শুধু তাই নয়, পুরো ব্যাপারটা করতে হবে চূড়ান্ত গোপনীয়তায়। নন্দীগ্রাম নিয়ে তখন মিডিয়াতে প্রচুর হইচই হচ্ছে। তাই অস্ত্র প্রশিক্ষণের কথা কোনওভাবে জানাজানি হয়ে গেলে সর্বনাশ হবে। লক্ষ্মণবাবুর সঙ্গে সেই রাতেই ফোনে কথা বললাম। অনেক আলোচনার পর ঠিক হল, অস্ত্র প্রশিক্ষণ হবে নয়াচরে।’ টানা কথা বলে থামলেন মাস্টারদা। মাঝে একবার সিগারেট ধরিয়েছেন।
চারমিনার স্পেশাল। ‘আগে গোল্ড ফ্লেক খেতাম, এখন এত দাম বেড়ে গেছে!’ লড়াই, বন্দুক, এলাকা দখল থেকে শুরু করে সিগারেটের দাম, কোনও ব্যাপারেই কোনও গৌরচন্দ্রিকা নেই মাস্টারদার কথায়।
হলদিয়ার পাশ দিয়ে বয়ে গিয়েছে হুগলি নদী। হলদিয়া বন্দর। আর হুগলি নদীর ওপারে একটা দ্বীপ বহু বছর আগে জেগে উঠেছিল। নয়াচর। প্রায় ১৭-১৮ হাজার একর এলাকা নিয়ে। বহু বছর আগে কোনও মানুষই থাকত না, পুরো দ্বীপটাই ছিল ফাঁকা। বছর কয়েক আগে সামান্য কিছু মৎস্যজীবী পরিবার সেখানে থাকতে শুরু করেন। তার পরেও বেশিরভাগ এলাকা খালিই পড়েছিল। অনেক পরে নন্দীগ্রামে পেট্রোরসায়ন শিল্প তালুক প্রকল্প আন্দোলনের জেরে বাতিল হয়ে গেলে, বামফ্রন্ট সরকার ঠিক করেছিল, তা হবে নয়াচরে। হলদিয়া নদীর পারে দাঁড়িয়ে নয়াচর দেখা যায় না। লঞ্চে করে নয়াচরে যেতে সময় লাগে আধ ঘণ্টা থেকে এক ঘণ্টা। সময় নির্ভর করে নদীর জোয়ার-ভাটার ওপর।
আবার বলতে শুরু করলেন মাস্টারদা। ‘সেই দিন ঠিক হয়েছিল, সব ছেলেকে নিয়ে রোজ সকালে লঞ্চ করে চলে যাব নয়াচরে। আবার সন্ধে নামার পর ফিরে আসব। সেদিন রাতে আমি পশ্চিম মেদিনীপুরে ফিরে গেলাম। আবার গেলাম একদিন বাদে। ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহেই নন্দীগ্রামের ছেলেদের অস্ত্র প্রশিক্ষণ শুরু করে দিলাম নয়াচরে। প্রতিদিন লঞ্চে চেপে নয়াচরে যাওয়া, খাওয়া থেকে শুরু করে ছোটখাটো সমস্যা, সব ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব ছিল আমাদের হলদিয়ার নেতা অনন্ত বেরার ওপর। আমি ৫-৬ টা বন্দুক পশ্চিম মেদিনীপুর থেকে নিয়ে গিয়েছিলাম ট্রেনিংয়ের জন্য। ৩১৫ রাইফেল। দুটো ৩০৩ রাইফেলও ছিল (মাস্টারদা ৩০৩ রাইফেলের কথা বলার পরই তাঁর দিকে খানিকটা কৌতূহলী হয়ে তাকিয়েছিলাম। বন্দুকের ব্যাপারে অভিজ্ঞ মাস্টারদা বুঝলেন এই তাকানোর মানে। বললেন, ‘৩০৩ বন্দুক কীভাবে পেয়েছি জিজ্ঞেস করবেন না। তাছাড়া ৩০৩ র ব্যাপারটা না প্রকাশ করাই ভাল।’)
আসলে রাষ্ট্রের ভাষায় ৩০৩ রাইফেল প্রহিবিটেড বা নিষিদ্ধ অস্ত্র। মানে পুলিশ, সেনাবাহিনীর, আধা সামরিক বাহিনী বা কোনও সরকারি নিরাপত্তারক্ষী ছাড়া সাধারণ মানুষের ব্যবহার নিষিদ্ধ। সাধারণের জন্য বিক্রিও হয় না কোনও প্রহিবিটেড অস্ত্র। এমনকী এই অস্ত্র সরকারি কর্মচারী ছাড়া কেউ ব্যবহার করলে দেশের আইন অত্যন্ত কড়া। যদি প্রমাণ হয় কোনও সাধারণ মানুষ ৩০৩ রাইফেল, এ কে ৪৭, ৯ মিলি মিটার পিস্তল বা যে কোনও প্রহিবিটিড অস্ত্র দিয়ে কাউকে খুন করেছে তবে সাজা ফাঁসি। এই সব ব্যাপরই জানতেন মাস্টারদা।
ফের শুরু করলেন তিনি। ‘প্রশিক্ষণের জন্য আমি কিছু গুলি নিয়ে গিয়েছিলাম। পরে গুলি সাপ্লাই করেছিল পূর্ব মেদিনীপুর জেলার পার্টি। কথা বলতে বলতে মাঝে-মধ্যে একটু থামছিলেন মাস্টারদা। কয়েক বছরের পুরনো ঘটনা। মনে করে করে বলছেন। কিন্তু যা বলছেন একদম সিকুয়েন্স অনুযায়ী। মাঝে মাঝে শুধু সিগারেট ধরাচ্ছেন। অল্প একটু থামছেন। একটু ভেবে আবার শুরু করেছেন বলতে। কথার মাঝেই একজন এসে দরজায় টোকা দিল, চা এনেছে। চা নিয়ে ফের দরজা বন্ধ করে বলতে শুরু করলেন মাস্টারদা। কথার স্টাইল দেখে মনে হচ্ছে, চোখ বন্ধ করে দেখতে পাচ্ছেন পুরো ঘটনাটা। জিজ্ঞেস করলাম, ‘এতগুলো আনকোরা ছেলে। মাওবাদীদের সঙ্গে লড়বে। শুধু তো গুলি চালালেই হবে না। কীভাবে ট্রেনিং দিলেন এতজনকে?’
‘দেখুন, আমি পার্টি সদস্য। আমি জানি, আমি যা করছি, যা করেছি পার্টির জন্য। গড়বেতা, কেশপুরে যে লড়াই করেছিলাম তাও আমার পার্টির প্রতি দায়বদ্ধতা থেকেই। কিন্তু আমি জানতাম, নন্দীগ্রামের ছেলেরা সবাই পার্টির সদস্য নয়। যারা পার্টির সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত, তাদেরও সহজে বোঝানো মুশকিল যে, লড়াইটা দলের স্বার্থে করতে হবে। আমি পার্টির জন্য লড়াইটা করেছি অনেকটা আদর্শগত কারণে। কিন্তু এই আদর্শবোধ ওদের মধ্যে ঢুকিয়ে তারপর লড়াইয়ের জন্য তৈরি করা কঠিন। তাই আমি ওদের প্রথম দিনেই ট্রেনিংয়ে চারটে কথা বলেছিলাম। প্রথম বলেছিলাম, নিজেকে রক্ষা করতে হবে। যুদ্ধের সময় নিজেকে রক্ষা করা সবচেয়ে জরুরি। অযথা যেন প্রাণহানি না হয়। তার জন্য উপযুক্তভাবে প্রশিক্ষণ নিতে হবে। দ্বিতীয়ত, সম্পদ রক্ষা করতে হবে। যুদ্ধে সম্পদ মানে বন্দুক, তা যেন কোনওভাবে হাতছাড়া না হয়। পশ্চিম মেদিনীপুরের অভিজ্ঞতা থেকে আমরা জানি, যুদ্ধের সময় অস্ত্র ছিনতাই করা ছিল মাওবাদীদের প্রধান টার্গেট। তৃতীয়ত বলেছিলাম, জনগণকে রক্ষা করতে হবে। মানে, তোমরা তোমাদের গ্রামের, পাড়ার মানুষের জন্য এই লড়াই করতে যাচ্ছ। মাওবাদীদের হাত থেকে এই মানুষকে বাঁচাতে হবে। যুদ্ধে সাধারণ মানুষের যেন কোনও ক্ষতি না হয়। যাঁদের জন্য তোমরা লড়াই করবে তাঁদের যেন ক্ষতি না হয় তোমাদের জন্য। আর একদম শেষে বলেছিলাম, পার্টিকে রক্ষা করতে হবে। বলেছিলাম, নন্দীগ্রামে আমাদের পার্টি আক্রান্ত। কয়েক হাজার মানুষ শুধু সিপিআইএম করে বলে ঘরছাড়া হয়েছে। পার্টিকে রক্ষা করতে না পারলে সব শেষ হয়ে যাবে। যে করেই হোক পার্টিকে রক্ষা করতেই হবে। পার্টিই প্রথম এবং শেষ কথা। পার্টি না থাকলে আমরা কেউই বাঁচব না। ‘
মাস্টারদার সঙ্গে কথা বলতে বলতে শুধু ভাবছি, স্বাধীন রাষ্ট্রের একটি রাজ্যের দুই এলাকা। মাঝখানে হলদি নদী। বছরের পর বছর নৌকায় নদী পারাপার করে দুই এলাকার মানুষ। নদীর এক পাড়ে দাঁড়িয়ে খালি চোখে দেখা যায় অন্য পাড়। নন্দীগ্রাম এবং হলদিয়া। নন্দীগ্রামে জমি রক্ষার জন্য যখন মদুসূদন মন্ডলের নেতৃত্বে শুরু হয়েছে স্থানীয় ছেলেদের অস্ত্র প্রশিক্ষণ, তার কিছুদিনের মধ্যেই হলদিয়ার কাছে নয়াচরে সিপিআইএম বাহিনীরও একই প্রশিক্ষণ শুরু হল মাস্টারদার নেতৃত্বে। দুই শত্রু পক্ষের শিবিরে অস্ত্র প্রশিক্ষণ হল একই জায়গার বাসিন্দা কয়েক’শো যুবকের। প্রশিক্ষকই শুধু আলাদা। নন্দীগ্রামের স্থানীয় ছেলেরা সব যোদ্ধা বনে শুধু একে অন্যের বিরুদ্ধে লড়বে!
নয়াচরে প্রায় দু’ সপ্তাহ টানা চলেছিল সিপিআইএম বাহিনীর ট্রেনিং। মাস্টারদা জানতেন, ওদের পক্ষে অস্ত্র চালানোতে অব্যর্থ নিশানা আয়ত্ত করা সম্ভব নয়, কিন্তু আক্রমণ হলে সাহস করে সোজা দাঁড়িয়ে গুলি চালানোর ট্রেনিংটা অন্তত দিতে হবে। যাতে সহজেই নতুন করে এলাকা দখল করতে না পারে ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটি। বন্দুক সোজা করে ধরার এবং গুলি চালানোর প্রাথমিক প্রশিক্ষণের পর নন্দীগ্রামের ওই ২০০ ছেলেকে ১০-১১ টা দলে ভাগ করে দিলেন মাস্টারদা। প্রতিটা দলে ১৬-২০ জন করে ভাগ করে দেওয়া হল। সেই সময় নন্দীগ্রামের ১ নম্বর ব্লক দখলের পর ২ নম্বর ব্লকের দিকে নজর দিয়েছে ভুমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটি। খেজুরি এবং নন্দীগ্রাম ২ নম্বর ব্লক রক্ষা করা তখন সিপিআইএমের আছে কঠিন চ্যালেঞ্জ। ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটি যাতে আর এগোতে, এলাকা বৃদ্ধি করতে না পারে, তার জন্য নন্দীগ্রাম ১ নম্বর ব্লকের সীমানা বরাবর এই ১০-১২ টা দলকে পোস্টিং করে দিলেন মাস্টারদা। প্রতিটা দলের সঙ্গে ছিল ৫-৬ টা করে রাইফেল। পূর্ব এবং পশ্চিম মেদিনীপুরের সিপিআইএম যৌথ ভাবে সমস্ত রাইফেলের ব্যবস্থা করেছিল। দুটো দলকে রাখা হয়েছিল খেজুরিতে। একটা দল ছিল কুঞ্জপুরে, অন্যটা তালপাটি খালের পাশে ভাঙাবেড়া ব্রিজের কাছে। এই দুই দলের দায়িত্ব ছিল খেজুরি আক্রমণ হলে তা প্রতিহত করা। খেজুরিতে ভাঙাবেড়া ব্রিজের কাছে যে দলটি ছিল তার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল নবকুমার সামন্তকে। মাঝ তিরিশের নবকুমার সামন্ত সম্পর্কে শঙ্কর সামন্তর নিজের ভাই। যে শঙ্কর সামন্তকে ৭ জানুয়ারি সকালে প্রকাশ্যে পুড়িয়ে খুন করেছিল ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটি।
অন্যদিকে, বাকি দলগুলোকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল নন্দীগ্রামের ২ নম্বর ব্লক রক্ষা করার। রানীচক, ঘোলপুকুর, রেয়াপাড়া, আমদাবাদ, সাতেঙ্গাবাড়ি, কমলপুর, মামুদপুর সহ মোট ৯-১০ টা জায়গায় ক্যাম্প করে থাকতে শুরু করল সিপিআইএমের সশস্ত্র বাহিনী। এর মধ্যে সিপিআইএম নেতাদের সবচেয়ে চিন্তা ছিল সাতেঙ্গাবাড়ি নিয়ে। লক্ষ্মণ শেঠ এবং নন্দীগ্রাম ২ নম্বর ব্লকের নেতা অশোক গুড়িয়াদের আশঙ্কা ছিল, ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটি সাতেঙ্গাবাড়ি আক্রমণ করবে। কারণ, সাতেঙ্গাবাড়ির ভৌগোলিক অবস্থানটা এমনই, তা দখল হয়ে গেলে ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটি সহজেই রানীচক হয়ে রেয়াপাড়া পৌঁছে যাবে। আর রেয়াপাড়া হাতছাড়া হলে পুরো নন্দীগ্রামই বেদখল। এই আশঙ্কা থেকেই সাতেঙ্গাবাড়িতে সবচেয়ে প্রশিক্ষিত বাহিনীকে রাখা হল। সেই দলটার কাছে ছিল ৫-৬ টা রাইফেল, তার সঙ্গে অন্তত বেশ কিছুক্ষণ লড়াই চালিয়ে যাওয়ার মতো গুলি। এই প্রশিক্ষণ থেকে শুরু করে নন্দীগ্রামের ১ নম্বর ব্লকের সীমানা বরাবর সবকটি বাহিনীকে পোষ্টিং করতে করতে হয়ে গেল প্রায় ফেব্রুয়ারির শেষ।
‘কেমন হয়েছিল পুরো ট্রেনিংয়ের প্রস্তুতি?’ জিজ্ঞেস করলাম মাস্টারদাকে।
‘লড়াই না হলে বলা মুশকিল কেমন ট্রেনিং হয়েছে। অতটুকু সময়ে বিশেষ কিছু করা সম্ভব ছিল না। বেশিরভাগ ছেলেই কিছু জানতো না। বন্দুক চালানোর প্রাথমিক প্রাকটিস হয়েছিল। কিন্তু যুদ্ধের সময় আসল হচ্ছে সাহস। আমার সন্দেহ ছিল, ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটির সশস্ত্র বাহিনী আক্রমণ করলে আমাদের ছেলেরা মোকাবিলা করতে পারবে না। আমি নিজে সেই সময় রোজ সবকটা ক্যাম্পে যেতাম। আমদের ছেলেদের সাহস দিতাম। সেই সময় আমরা খবর পাচ্ছিলাম, ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটিও সোনাচূড়া, গড়চক্রবেড়িয়ার স্থানীয় ছেলেদের জেলিংহামের কাছে হলদি নদীর ধারে অস্ত্র প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। বুঝতে পারছিলাম, যে কোনও দিন ওরা বড়ো আক্রমণ করবে। আমি পূর্ব মেদিনীপুরের নেতাদেরও বলেছিলাম, আমাদের ছেলেরা একদম আনকোরা। বড়ো লড়াই হলে কিন্তু ভুল করে ফেলবে।’
সেই সময় কিছু জায়গায় সিপিআইএমের এই সশস্ত্র বাহিনীর সঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেসের নেতৃত্বে ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটির গুলি বিনিময় হয়। তাতে অবশ্য কোনও পক্ষেরই বিশেষ ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। কিন্তু সিপিআইএম নেতাদের যে আশঙ্কা ছিল তা ঘটতে বেশি সময় লাগল না। একদিন ভোরে সাতেঙ্গাবাড়ি আক্রমণ করল ভুমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটির সশস্ত্র বাহিনী। সিপিআইএমের ছেলেরা তৈরিই ছিল, কিন্ত লড়াইয়ে দাঁড়াতে পারল না সিপিআইএম। হাতে অস্ত্র থাকলেও তা চালাতে পারল না ঠিকমতো। মাস্টারদার আশঙ্কাই সত্যি হল। খালি মাঠে গুলি চালানোর অনুশীলন করা, আর মাঠে দাঁড়িয়ে যুদ্ধ করা যে এক নয় তা পরিষ্কার হয়ে গেল মার্চের গোড়ায় সাতেঙ্গাবাড়ির ওই লড়াইয়ে। এক-দেড় ঘন্টার মধ্যে সিপিআইএম বাহিনী পিছু হঠল। প্রায় বিনা বাধায় সাতেঙ্গাবাড়ির দখল করে নিল ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটি। নন্দীগ্রামের ২ নম্বর ব্লকে পা রাখল তৃণমূল কংগ্রেস। এর গুরুত্ব বুঝতে অসুবিধা হয়নি পোড়খাওয়া সিপিআইএম নেতা লক্ষ্মণ শেঠের। দীর্ঘদিনের তমলুকের সাংসদ লক্ষ্মণ শেঠ হাতের তালুর মতো চিনতেন নন্দীগ্রাম। জানতেন, ২ নম্বর ব্লক হাতছাড়া হয়ে গেলে তাঁর রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ প্রশ্নের মুখে পড়ে যাবে। সাতেঙ্গাবাড়ি বেদখল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তমলুকের সাংসদ ফোন করেন মাস্টারদাকে। সেই রাতেই লক্ষ্মণ শেঠের সঙ্গে কথা বলতে মাস্টারদা গেলেন হলদিয়া। রাতে থাকলেন সিপিআইএমের জোনাল কমিটির অফিস শ্রমিক ভবনে। সেই রাতেই নন্দীগ্রাম পুনর্দখলের বৃহত্তর পরিকল্পনা হয় হলদিয়ায়, যা সম্পূর্ণ হয়েছিল ২০০৭ সালের ১০ নভেম্বর। যাকে ৩১ আলিমুদ্দিন স্ট্রিট আখ্যা দিয়েছিল, ‘অপারেশন সূর্যোদয়’ বলে। যা সম্পূর্ণ হওয়ার পর ১৩ নভেম্বর, ২০০৭ মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য মহাকরণে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, ‘দে হ্যাভ বিন পেয়েড ব্যাক বাই দেয়ার ওন কয়েন’। সহজ মানে, যেমন কর্ম তেমন ফল।
নন্দীগ্রাম নিয়ে কী আলোচনা হয়েছিল সেই রাতে হলদিয়ায় শ্রমিক ভবনে? লক্ষ্মণ শেঠ এবং মাস্টারদা কী পরিকল্পনা করেছিলেন নন্দীগ্রাম পুনর্দখলের?
‘লক্ষ্মণ বাবু আমাকে বললেন, আমাদের ছেলেরা গুলি চালিয়েও তো কিছু করতে পারল না, এবার কী করা যায়। এভাবে চললে তো ওরা পুরো নন্দীগ্রাম দখল করে নেবে। দখল করবে খেজুরিও। আমি বললাম, মাওবাদীদের হাতে এসএলআর (সেলফ লোডেড রাইফেল), একে ৪৭ আছে। তাছাড়া ওরা যুদ্ধে অভ্যস্ত। আমাদের নন্দীগ্রামের ছেলেরা কিছুতেই পারবে না। এই যুদ্ধ লড়তে গেলে গড়বেতা, কেশপুর থেকে প্রশিক্ষিত ছেলে আনতে হবে। আপনি গড়বেতা, কেশপুরের ছেলে আনার অনুমতি নিন পার্টির কাছ থেকে। লক্ষ্মণবাবু বলেছিলেন, মাস্টার, তুমি এই যুদ্ধের চিফ কমান্ডর। তুমিই ব্যবস্থা কর গড়বেতা, কেশপুর থেকে ছেলে আনার। বললাম, ‘আমি বললে হবে না। পশ্চিম মেদিনীপুরের জেলা পার্টির অনুমতি নিতে হবে। আমার কথায় অনুমতি পাওয়া যাবে না। আমি জানতাম, লক্ষ্মণবাবুর সঙ্গে আমাদের জেলার এক শীর্ষ নেতার সম্পর্ক ভাল নয়। লক্ষ্মণবাবু তাঁকে নিজে বলবেন না লড়াইয়ের জন্য ছেলে পাঠাতে। তারপর আরও ওপরের নেতৃত্বের সঙ্গে দীর্ঘ কথা বলার পর বেশি রাতে চূড়ান্ত হয়, গড়বেতা, কেশপুরের ছেলেরা নন্দীগ্রামে আসবে লড়াই করতে।
আগের পর্বে কী ঘটেছিল? পড়ুন: নন্দীগ্রাম আসলে যা ঘটেছিল #৭ সিপিআইএম নন্দীগ্রাম পুনরুদ্ধারের দায়িত্ব দিল গড়বেতার সশস্ত্র বাহিনীকে, যারা ২০০০ সালে পশ্চিম মেদিনীপুরের হাতছাড়া এলাকা উদ্ধার করেছিল
এর দু-তিন দিনের মধ্যেই পশ্চিম মেদিনীপুরের গড়বেতা, কেশপুর থেকে প্রায় ২৫০ জন প্রশিক্ষিত যোদ্ধা পৌঁছায় নন্দীগ্রামে। এরা প্রত্যেককেই বন্দুক চালানোয় ওস্তাদ। ১৯৯৮ সালে গড়বেতা, কেশপুর, চন্দ্রকোনা, পিংলা সহ বিস্তীর্ণ এলাকায় তৃণমূল কংগ্রেস, মাওবাদী এবং বিজেপির হাতে আক্রান্ত হওয়ার পর, এই সশস্ত্র বাহিনীকে তৈরি করেছিল সিপিআইএম। দু’বছরেরও বেশি সময় লড়াই করার পর ২০০০ সালের মাঝামাঝি থেকে নভেম্বরের মধ্যে কেশপুর, গড়বেতা, পিংলা, সবং পুনরুদ্ধার করেছিল সিপিআইএম। এই বাহিনীর বেশিরভাগই পার্টি সদস্য। যারা পার্টি সদস্য নয়, তারাও অনন্ত কৃষকসভার সদস্য। এই বাহিনীর প্রায় সবাইকে দীর্ঘদিন ধরে চিনতেন মাস্টারদা। এদের বেশিরভাগকে সঙ্গে নিয়েই তিনি গড়বেতা, চন্দ্রকোনা, কেশপুরে লড়েছিলেন। এই বাহিনী নন্দীগ্রামে যোগ দেওয়ার পর মাস্টারদা বাড়তি মনোবল পেয়ে গেলেন। যে ১০-১১ টা জায়গায় নন্দীগ্রামের ছেলেদের পোস্টিং করেছিলেন, সেই ক্যাম্পগুলোতে গড়বেতা, কেশপুরের ১৫-২০ জন করে ছেলে দিয়ে দিলেন। এর ফলে রাতারাতি সিপিআইএমের সশস্ত্র ক্যাম্পগুলোর চেহারা পালটে গেল। এক একটা ক্যাম্পে বন্দুক সংখ্যাও বাড়ানো হল। তখন সিপিআইএমের প্রতিটা ক্যাম্পে গড়ে ৩৫-৪০ জন করে ছেলে। তার মধ্যে ১৫-২০ জন রীতিমত প্রশিক্ষিত। প্রতিটা ক্যাম্পে গড়ে ৮-১০ টা রাইফেল। রোজ প্রতিটা ক্যাম্পে ঘুরে ঘুরে তদারকি করতেন মাস্টারদা। মাঝেমধ্যে গাড়িতে, বেশিরভাগ সময়ই মোটরসাইকেলে।
গড়বেতা, কেশপুরের ছেলেরা যোগ দেওয়ার পর নন্দীগ্রামের ছেলেরাও বাড়তি আত্মবিশ্বাস পেয়ে গেল। এক ধাক্কায় মনোবল বেড়ে গেল তাদের। প্রতিটা ক্যাম্পে একজন করে লিডার তৈরি করে দিলেন মাস্টারদা। মাস্টারদা নিজে থাকতেন সিপিআইএমের রেয়াপারা পার্টি অফিসের দোতলায়। তাঁর সঙ্গে সমসময় থাকত গড়বেতার ১৪-১৫ জন, যারা অস্ত্র চালানো এবং যুদ্ধে বিশেষ পারদর্শী।
চলবে
(১৮ সেপ্টেম্বর থেকে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হচ্ছে নন্দীগ্রাম আসলে যা ঘটেছিল। প্রতি পর্বে লাল রং দিয়ে আগের পর্বের লিঙ্ক দেওয়া থাকছে)
Comments are closed.