নন্দীগ্রাম আসলে যা ঘটেছিল #৯: কৃষকসভার ব্রিগেড ১১ মার্চ, সেদিনই নন্দীগ্রামে পুলিশ পাঠানোর সিদ্ধান্ত বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের

আগের পর্বে যা ঘটেছিল: ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটির মোকাবিলায় গড়বেতা, কেশপুর থেকে সশস্ত্র বাহিনী নন্দীগ্রামে নিয়ে এল সিপিআইএম, তাদের মোতায়েন করা হল নন্দীগ্রাম ও খেজুরিতে

 

 

নন্দীগ্রামের ২ নম্বর ব্লক এবং খেজুরি রক্ষার পাশাপাশি সিপিআইএমের সশস্ত্র শিবিরগুলির ওপর মূল দায়িত্ব ছিল আস্তে আস্তে বেদখল হওয়া এলাকা পুনরুদ্ধার করার। সেই কাজেরও প্রস্তুতি চলছিল একই সঙ্গে। সিপিআইএমের এই সংসদ বহির্ভূত কার্যকলাপের পাশাপাশি চুপ করে বসে ছিল না সরকারও। ২০০৭ সালে জানুয়ারির ৭-৮ তারিখের পর নন্দীগ্রাম ১ নম্বর ব্লকে আর ঢোকেইনি পুলিশ। বন্ধ ছিল পঞ্চায়েত অফিসও। কোনও প্রশাসন ছিল না বিরাট এলাকায়। বহু জায়গায় রাস্তা কাটা। নন্দীগ্রামে প্রশাসনিক কাজকর্ম ফের চালু করার এবং রাস্তা সারাইয়ের জন্য বারবার সরকারের ওপরে চাপ দিচ্ছিলেন পূর্ব মেদিনীপুরের সিপিআইএম নেতারা। এই চাপ দেওয়া শুরু হয় জানুয়ারির মাঝামাঝি থেকেই। কিন্তু জেলা পুলিশ কর্তারা বারবার মহাকরণে জানাচ্ছিলেন, নন্দীগ্রামের পরিস্থিতি খুব খারাপ। জোর করে ঢুকতে গেলে সমস্যা হবে। একদিকে পার্টির দাবি, অন্যদিকে পুলিশের রিপোর্ট, দুইয়ের মাঝে পড়ে দিশেহারা হয়ে গেলেন প্রশাসক বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। দেখছি, দেখব করে সময় কাটাতে শুরু করেন তিনি। কোনও সিদ্ধান্তই বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য সরকার নিতে পারছিল না নন্দীগ্রাম নিয়ে। এইরকম পরিস্থিতিতে নন্দীগ্রামে পুলিশ অভিযান চেয়ে বারবার দলের রাজ্য নেতৃত্বের ওপর চাপ দিতে থাকেন লক্ষণ শেঠ। এমনকী একদিন বিধানসভায় নন্দীগ্রামের ঘরছাড়াদের বিষয় নিয়ে সরাসরি বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে প্রশ্নও করেন তমলুকের সাংসদের স্ত্রী এবং মহিষাদলের বিধায়ক তমালিকা পন্ডাশেঠ। মুখ্যমন্ত্রী তাঁকে জবাব দিয়েছিলেন, ‘তিনি বিষয়টা দেখবেন’। আশ্বাস দিয়েছিলেন নন্দীগ্রামে পুলিশ পাঠানোর ব্যাপারে।

 

পুলিশ অভিযান, ১৪ মার্চ 

একদিকে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য বলছিলেন, নন্দীগ্রামের মানুষ না চাইলে সেখানে কেমিক্যাল হাব হবে না। আর অন্যদিকে সিপিআইএম বাহিনী নন্দীগ্রামের চারিদিকে সশস্ত্র শিবিরের ব্যারিকেড করছে। একদিকে শিল্প গড়ার ডাক দিয়ে ব্রিগেড সমাবেশ করছে সিপিআইএমের কৃষক সংগঠন। আর অন্যদিকে, নন্দীগ্রামে পুলিশি অভিযানের প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে সরকার। মার্চের গোড়া থেকে সরকার এবং সিপিআইএমের এই পরস্পর বিরোধী নানান কাণ্ডকারখানা আরও বিভ্রান্ত করে তোলে নন্দীগ্রামের মানুষকে। গড়বেতা, কেশপুরের বাহিনী পৌঁছনোর পর সিপিআইএম নন্দীগ্রাম, খেজুরিতে স্বাভাবিকভাবেই অনেক শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল। বহিরাগতদের আনাগোনার খবর পৌঁছেছিল ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটির কাছেও। তাদেরও রসদ তখন নেহাত কম নয়। নন্দীগ্রামের এক্স-আর্মিম্যানেদের কাছে শুধু লাইসেন্সপ্রাপ্ত বন্দুকই ছিল কম-বেশি ৫০ টা। সব না হলেও তার বেশিরভাগই ব্যবহৃত হয়েছিল জমি রক্ষার লড়াইয়ে। এবং সামনাসামনি বন্দুকের লড়াইয়ে এই এক্স-আর্মিম্যানেদের মরচে পড়ে যাওয়া দক্ষতা কোনও অংশেই কম ছিল না সিপিআইএম ক্যাডার বাহিনীর তুলনায়। বরং অনেক ক্ষেত্রে বেশিই ছিল। প্রাথমিকভাবে আন্দোলনকারীদের একমাত্র ঘাটতি ছিল গুলির। তাও পরে জোগাড় হয়ে যায়।
সিপিআইএম বাহিনীর সঙ্গে লড়তে ৭ মার্চ সকালে ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটির সঙ্গে গিয়ে যোগ দেয় ৬-৭ জন যুবক। আলিপুর আদালত চত্বরে পুলিশ ভ্যানে বসে মধুসূদন মন্ডল সেই ঘটনা বলেছিলেন। ‘সেই সময় সিপিআইএম বাহিনীর সঙ্গে আমাদের মাঝে মধ্যেই লড়াই শুরু হয়ে যেত। আমরা কোনও প্রস্তুতি নেওয়ার আগেই জানুয়ারির ৫ এবং ৬ তারিখ সিপিআইএম আক্রমণ চালিয়েছিল। কিন্তু জানুয়ারির মাঝামাঝি থেকে আমরাও প্রস্তুতি নিতে শুরু করি। অনেক ছেলেকে ট্রেনিং দিতে শুরু করি। সিপিআইএমের আক্রমণ ঠেকাতে আমাদের এলাকাও বাড়তে শুরু করে।
কিন্ত আমরা বুঝতে পারছিলাম সিপিআইএম সহজে এই লড়াই ছাড়বে না। তাই বন্দুক এবং গুলির যোগানের জন্য টাকা তোলা শুরু হয়। সিপিআইএমের সঙ্গে একটা বড়ো লড়াই হয়েছিল ৭ মার্চ। তৃণমূল কংগ্রেসের পূর্ব মেদিনীপুরের এক প্রভাবশালী নেতা আমাদের সাহায্য করতে ৬-৭ জন ছেলেকে পাঠিয়েছিলেন। সবার কাছেই ছিল রাইফেল। সেই দিন মুখোমুখি লড়াই হয়েছিল। কিন্তু যে ছেলেরা আমদের সাহায্য করতে বাইরে থেকে এসেছিল, তারা সিপিআইএমের বৃষ্টির মতো গুলির সামনে দাঁড়াতে পারেনি। দেড়-দু’ঘন্টার মধ্যে তারা বন্দুক ফেলে লড়াইয়ে ময়দান ছেড়ে পালায়। সেই দিনের লড়াইয়ে বাইরের ওই ছেলেদের সঙ্গে আমরাও ছিলাম, কিন্তু কিছুক্ষণ লড়াইয়ের পরই ওরা ভয় পেয়ে যায়। সিপিআইএম বাহিনীর সঙ্গে লড়ার মতো মানসিক শক্তি ওদের ছিল না। সিপিআইএমও বুঝে যায় ওরা পালাচ্ছে। আমার হাতেও বন্দুক ছিল। আমি মাঠে একটা আলের আড়ালে শুয়েছিলাম, যাতে দেখা না যায়। তখন আমাদের ছেলেদের বলি, বাইরের ছেলেদের ফেলে যাওয়া বন্দুকগুলো উঁচু করে মাধার ওপরে ধরে তাড়াতাড়ি পিছন দিকে পালাতে। আমাদের ৫-৬ জন তাই করে। বন্দুক উঁচু করে আকাশের দিকে ধরে দ্রুত পিছোতে শুরু করে। সিপিআইএমের বাহিনী ওই ফাঁদে পা দেয়। ওরা ভাবে আমরা সবাই লড়াই ছেড়ে পালাচ্ছি। দু’পক্ষই মাঠের উঁচু আল, বাড়ির আড়ালে ছিলাম। কেউই কাউকে দেখতে পাচ্ছিলাম না। সিপিআইএম বাহিনী দেখে, আমাদের ছেলেরা বন্দুক নিয়ে পিছু হঠছে। ওরা শুধু বন্দুকের নল দেখতে পাচ্ছিল। যুদ্ধ জয়ের উত্তেজনায় নিজেদের সামলাতে পারেনি। আমাদের গালাগাল করতে করতে ওদের ২-৩ জন আলের আড়াল থেকে উঠে দাঁড়ায়। আর সেটাই আমি চাইছিলাম। চাইছিলাম, ওরা ভাবুক আমরা ভয় পেয়ে সব পালিয়ে যাচ্ছি। তখনও আমি আলের আড়ালে বন্দুক তাক করে শুয়ে আছি। সিপিআইএম বাহিনীর ২-৩ জন তখন পুরোপুরি আমার টার্গেটের মধ্যে চলে এসেছে। পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছিলাম তাদের। পরপর গুলি চালাই টার্গেট করে। দু’জনের গায়ে গুলি লাগে। আকস্মিক এই ঘটনার জন্য ওরা প্রস্তুত ছিল না। আহতদের নিয়ে দ্রুত পালায় সিপিআইএম বাহিনী।

সেদিনের মতো যুদ্ধ থামে। কিন্তু সেদিন আমাদের লাভ হয়েছিল অনেক। বাইরের ছেলেরা ৬-৭ টা রাইফেল ফেলে পালিয়েছিল। সেগুলো আমাদের কাছে থেকে যায়। পরে লড়াইতে খুবই কাজে লেগেছিল।’
সেই ৭ মার্চই সন্ধ্যায় নন্দীগ্রামের মহেশপুরে ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটির সমর্থকদের হাতে আক্রান্ত হয়েছিলেন সিপিআইএমের স্থানীয় বেশ কয়েকজন নেতা। ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটির সঙ্গে সিপিআইএমের সংঘর্ষ, লড়াই যত বাড়ছিল, ততই রাজনৈতিক মেরুকরণ তীব্র হচ্ছিল নন্দীগ্রামে।
একদিকে লড়াই, সংঘর্ষ, রাজনৈতিক আক্রোশ। অন্যদিকে মুখ্যমন্ত্রী তখনও বলে চলেছেন, ‘নন্দীগ্রামের মানুষ না চাইলে সেখানে জমি অধিগ্রহণ হবে না।’ কিন্তু তাঁর এই বক্তব্য বিশ্বাস করেননি নন্দীগ্রামের মানুষ। তার একটা বড়ো কারণ, শাসক দলের স্থানীয় নেতা, কর্মীদের ভূমিকা। মার্চ মাসের গোড়া থেকেই নন্দীগ্রাম কার্যত একটা যুদ্ধক্ষেত্রের চেহারা নেয়। সংবাদপত্রে রোজ সংঘর্ষ, লড়াই, এলাকা দখল, পালটা দখলের খবর। নন্দীগ্রাম নিয়ে রাজ্যের সামনে একটা ভিন্ন ছবি তুলে ধরতে তখন মরিয়া শাসক দল। নন্দীগ্রামের সাধারণ মানুষ জমি অধিগ্রহণের বিরুদ্ধে আন্দোলন করছেন, তা মানতেই চাইতো না মুজফফর আহমেদ ভবন। মধুসূদন মন্ডল, এক্স-আর্মিম্যান এবং গ্রামের অধিকাংশ পুরুষ-মহিলার সম্মিলিতভাবে সিপিআইএমের সশস্ত্র বাহিনীর মোকাবিলা তখন শাসক দলের কাছে মাওবাদী আন্দোলনের তকমা পেয়ে গেল। মাওবাদী মানেই নাশকতা। সরকারের বিরুদ্ধে চক্রান্ত।
নন্দীগ্রাম আন্দোলনে কৃষকদের যে কোনও ভূমিকা নেই, সবই বহিরাগত মাওবাদীদের চক্রান্ত, তা রাজ্যের মানুষের কাছে প্রমাণে মরিয়া সিপিআইএম মাঠে নামাল প্রাদেশিক কৃষক সভাকে। ১১ মার্চ ২০০৭, ব্রিগেড সমাবেশের ডাক দিল পশ্চিমবঙ্গ প্রাদেশিক কৃষক সভা। ব্রিগেড মানে শক্তি প্রদর্শন। ব্রিগেড মানে সরকারের থাকার সুবিধে নিয়ে মাঠ ভরিয়ে বিরোধীদের দেখিয়ে দেওয়া, রাজ্যে আমরাই শেষ কথা। আমরা সর্বশক্তিমান। তখন ব্রিগেড মানে লক্ষ লোকের জমায়েত থেকে বিরোধীদের প্রচ্ছন্ন হুঁশিয়ারি, আমরা ২৩৫।
মাত্র দু’মাস আগে, ২০০৭ সালের ৭ জানুয়ারি ব্রিগেড সমাবেশের ডাক দিয়েছিল সিপিআইএমের যুব সংগঠন ডিওয়াইএফআই। সেখানেও একপ্রস্থ শিল্পায়নের বার্তা দিয়েছিলেন ৩১ আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের নেতারা। প্রাক্তন যুব নেতা এবং রাজ্যের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য ৭ জানুয়ারির ব্রিগেড সমাবেশ বলেছিলেন, ‘শিল্পায়নের কাজে রাজ্যের মানুষের সমর্থন রয়েছে। তাই বিরোধীরা যতই বাধা দেওয়ার চেষ্টা করুক রাজ্য সরকার শিল্পায়নের পথ এগোবেই।’ মুখ্যমন্ত্রী সেই দিন ভরা ব্রিগেডে ডিওয়াইএফআই সদস্য, কর্মী এবং সমর্থকদের উদ্দেশে আরও বলেন, ‘এখনই রাজ্যে শিল্পায়ন না করলে রাজ্যের সর্বনাশ হয়ে যাবে। তবু বিরোধীরা বাধা দিয়ে চলেছে। ওদের বাধা ভেঙে দিন। আপনারাই তা করতে পারেন।’ যে ৭ জানুয়ারি দুপুরে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী যুব সংগঠনের ব্রিগেড সমাবেশে এ’কথা বলছেন, তার আগের রাত থেকেই খেজুরির সশস্ত্র যুব বাহিনী বন্দুক হাতে নন্দীগ্রামে নেমে পড়েছে বিরোধীদের বাধা ভেঙে দিতে। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য কি জানতেন না, যেদিন দুপুরে তিনি একথা বলছেন, তার কয়েক ঘণ্টা আগে ভোররাতে তাঁর পার্টি ক্যাডারদের ছোড়া গুলিতে নন্দীগ্রামে মৃত্যু হয়েছে তিন তরতাজা যুবকের। ৭ জানুয়ারি ব্রিগেডে যখন মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা করছেন, ‘শিল্পের কাজে রাজ্যের মানুষের সমর্থন রয়েছে…,’ তখনই শিল্পায়নের জন্য জমি অধিগ্রহণের বিরোধিতা করতে গিয়ে নন্দীগ্রামের প্রথম তিন শহিদ  ভরত মন্ডল, বিশ্বজিৎ মাইতি এবং শেখ সেলিমের মৃতদেহ তাঁদের বাড়িতে গিয়ে পৌঁছেছিল। কান্নায় ভেঙে পড়া তাঁদের পরিবার, তিন তিনটে জলজ্যান্ত মানুষের অকস্মিক এই মৃত্যুতে হতবাক হয়ে যাওয়া নন্দীগ্রাম, নিশ্চই সেদিন ব্রিগেডের সমাবেশে সিপিআইএম নেতাদের বক্তৃতা শুনে প্রতিশোধের প্রহর গুনছিলেন।
৭ জানুয়ারি যাঁদের মৃত্যু হয়েছিল, তাঁরা কেউ মাওবাদী ছিলেন না, ইতিহাস এর কী বিচার করবে তা তখনও কারও জানা ছিল না। নন্দীগ্রামের মানুষ ঐতিহাসিকদের হাতে বিচারের দায়িত্ব ছেড়ে না দিয়ে নিজেরাই হাতে অস্ত্র তুলে নিয়েছিলেন আত্মরক্ষার জন্য।
৭ জানুয়ারির পর ১১ মার্চ, ব্রিগেডে আবার শাসক দলের শক্তিপ্রদর্শন। প্রাদেশিক কৃষক সভার সমাবেশে আবারও প্রধান বক্তা বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। তার আগে শেষ কবে কৃষকসভা ব্রিগেডে সমাবেশ করেছে সাধারণ মানুষ তো বটেই, সিপিআইএমের বহু নেতাও ভেবে বের করতে পারবেন না। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য ছাড়াও প্রাদেশিক কৃষক সভার তৎকালীন সভাপতি রামনারায়ণ গোস্বামী, সাধারণ সম্পাদক সমর বাওরা, সহ সভাপতি বিনয় কোঙার এবং সহকারী সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্ররা ব্রিগেডে ঘোষণা করলেন, বিরোধীদের ষড়যন্ত্রকে মোকাবিলা করে, উন্নয়ন বিরোধীদের জোট ভেঙে দিয়ে সামনের দিকে এগোতে হবে। সামনের দিকে মানে শিল্পায়ন। সামনের দিকে এগনোর বার্তা দিলেন মুখ্যমন্ত্রী, কিন্তু তাতে কোনও বাধা এলে? না, তার উত্তর তিনি দেননি। কারণ, সেই দাওয়াই তো পার্টি আগেই ঠিক করে নিয়েছে। আর তা প্রয়োগও শুরু হয়ে গিয়েছে সেই ৫ জানুয়ারি রাত থেকে। পূর্ব মেদিনীপুর পার্টি তখন মুজফফর আহমেদ ভবনকে বুঝিয়ে চলেছে, রোগটা একটু কঠিন, তাই সারতে একটু সময় লাগবে। আমরা নিজেরা যতটা পারছি করছি, বাইরে থেকেও ওষুধ এনেছি। কিন্তু রোগটা একটু বেয়াড়া ধরনের। আপনারাও কিছু করুন।
আপনারা কিছু করুন মানে? মানে খুব সহজ, পুলিশ পাঠান। প্রশাসন তো থাকবে একটা, নাকি নন্দীগ্রাম রাজ্যের বাইরে?
ব্যাস হয়ে গেল। সব দিক থেকেই সবুজ সঙ্কেত মিলেছে। দু’মাস আগে যুব সংগঠন ব্রিগেডে ঘোষণা করেছে, বিরোধীদের শিল্প বিরোধী চক্রান্ত ভাঙতে হবে। এবার ব্রিগেডে এই কথা জানিয়ে দিল কৃষক সভাও। এক বছরও হয়নি, রাজ্যের মানুষ রায় দিয়েছে, আমরা ২৩৫। এরপরেও এত প্রশ্ন? এত সাহস? কোনও কোনও সভাসদ আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের হীরক রাজের দরবারে আবার এমনও নিদান দিলেন, বিধানসভা ভোটের এই রায়, এত মানুষের সমাবেশ, এত মানুষের স্বপ্ন, এর পরেও আমরা যদি সিঙ্গুর, নন্দীগ্রামে কয়েকটা মাওবাদী আন্দোলনে পিছু হঠি, মানুষ আমাদের ক্ষমা করবে না। ইতিহাস আমদের ক্ষমা করবে না।
এরপর তো আর কোনও কথা হয় না। মানুষ এবং ইতিহাস ক্ষমা না করলে মারাত্মক একটা সংসদীয় বিপদ হয়ে যাবে! তাই কৃষক সভার বিপুল সমাবেশের পর ৩১ আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের সিপিআইএম রাজ্য দফতর ঠিক করে ফেলল, একটা দিনও সময় নষ্ট মানে পিছিয়ে যাওয়া। যা করতে হবে আজই। পারলে এখনই। এই মূহুর্তে। হাল্লার রাজা তো তাও চিঠিপত্র পাঠিয়ে, আগাম নোটিশ দিয়ে যুদ্ধে যেতেন। কিন্তু আমাদের হাতে সময় নেই একেবারে। বিধানসভা শুরু হয়ে গিয়েছে, কোনও বড়ো গোলমাল হলে বিরোধীদের চিৎকার করার অটোমেটিক প্ল্যাটফর্ম রেডি, কুছ পরোয়া নেই। দু’দিন বাদে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা শুরু হচ্ছে। কোনও ঝামেলা হলে অনেক ছেলে-মেয়ে বিপদে পড়ে যাবে, কুছ পরোয়া নেই। মানুষের রায় আমাদের সঙ্গে। আর ওরা তো কয়েকটা মাওবাদী মাত্র। ওখানকার সাধারণ মানুষ, কৃষক, মহিলা, বাচ্চা সব আমাদের সঙ্গে আছে। নন্দীগ্রামের কৃষক সভার নেতা তো সেই কবে জানিয়ে দিয়েছেন, সেখানে মোড়ে মোড়ে লোক শিল্প চাইছেন। বাধা দিচ্ছে শুধুমাত্র কিছু বহিরাগত। অতএব সময় বিন্দুমাত্র নষ্ট করা যাবে না। ১১ মার্চ কৃষক সভার সমাবেশ হল, আর পরদিই ১২ তারিখ মহাকরণে মিটিংয়ে বসে গেলেন রাজ্যের পুলিশ কর্তারা।

নন্দীগ্রামে অভিযানের পরিকল্পনার শুরু করল রাজ্য পুলিশ। তখন পূর্ব মেদিনীপুরের পুলিশ সুপার অনিল শ্রীনিবাস, ডিআইজি মেদিনীপুর রেঞ্জ এন রমেশবাবু, আইজি পশ্চিমাঞ্চল অরুণ গুপ্তা। নন্দীগ্রাম থানার অফিসার ইন চার্য শেখর রায় এবং খেজুরি থানার অফিসার ইন চার্জ অমিত হাতি। অতিরিক্ত পুলিশ সুপার হলদিয়া তন্ময় রায়চৌধুরি। রাজ্য পুলিশের ডাইরেক্টর জেনারেল অনুপভূষণ ভোরা এবং আইজি আইন-শৃঙ্খলা রাজ কানোজিয়া। ১৯৭৭ সাল থেকে শুরু হওয়া বাম শাসনে বহু পুলিশি অভিযান হয়েছে রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায়। পুলিশি অভিযান হয়েছে তার আগেও বহুবার। তাতে বহু মানুষের মৃত্যুও হয়েছে। কিন্তু নন্দীগ্রামে ১৪ মার্চের অভিযান বাংলার রাজনৈতিক ইতিহাসে নতুন দিক নির্দেশ করল। একুশ শতকে প্রবল শক্তিশালী সংবাদমাধ্যমের যুগে নন্দীগ্রাম নামক পরীক্ষাগারে যৌথ অভিযান চালালো পুলিশ ও সিপিআইএম। যার প্রভাব কত সুদূরপ্রসারী হতে পারে তা আঁচ করতে পারলেন না পুলিশ কর্তারা। এই যৌথ অভিযানের ফল কী মারাত্মক হতে পারে বুঝতে পারলেন না সিপিআইএম নেতারাও। যদিও ১৪ মার্চ যে অন্যায় পুলিশ করেছিল তার বিশেষ কোনও মাশুল তাদের দিতে হয়নি। কিন্তু সংসদ বহির্ভূত কার্যকলাপে বিশ্বাসী সিপিআইএম নেতৃত্বও সেই সময় বুঝতে পারেননি, এই হঠকারী সিদ্ধান্তের মাশুল তাদের কতদিন, কীভাবে দিতে হবে।

১১ মার্চ পার্টি চূড়ান্ত করল, নন্দীগ্রামে পুলিশি অভিযান হবে। বার্তা গেল সরকারের কাছে। পরদিন ১২ তারিখ আইজি অরুণ গুপ্তা, ডিআইজি এন রমেশবাবু এবং এসপি অনিল শ্রীনিবাসকে ডেকে পাঠানো হল মহাকরণে। আইজি আইন-শৃঙ্খলা রাজ কানোজিয়ার ঘরে হল প্রথম মিটিং। অফিসারদের রাজ কানোজিয়া বললেন, ‘পরদিন, মানে  ১৩  তারিখ অভিযান করতে হবে নন্দীগ্রামে।’  যেখানে আড়াই মাস ধরে পুলিশ ঢুকতে পারছে না, একটা বিরাট এলাকা অবরুদ্ধ, ভিতরে কী পরিস্থিতি তা পুলিশ কর্তারা জানেনই না, সেখানে এত বড়ো একটা অভিযান হবে, অথচ কোনও পরিকল্পনা নেই। হঠাৎ ঠিক হয়ে গেল এক দিনের নোটিশে, পুলিশ যাবে নন্দীগ্রামে। শুধু তাই নয়, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সরকার যে নন্দীগ্রামের পুলিশ অভিযানকে কতটা ছেলেখালা হিসাবে নিয়েছিল, তার সবচেয়ে বড় উদাহরণ, ১২ মার্চ যেদিন মহাকরণে পুলিশ অফিসারদের এই মিটিং হচ্ছে, সেই দিন রাজ্যেই নেই ডিজি অনুপভূষণ ভোরা। ব্যক্তিগত কাজে তিনি দিল্লিতে, কলকাতায় ফেরার কথা ১৩ তারিখ। রাজ কানোজিয়ার ঘরে মিটিংয়ে অরুণ গুপ্তা বললেন, ‘এরকম একদিনের নোটিশে অভিযান চালানো কঠিন। খুব তাড়াহুড়ো থাকলে, অভিযান একদিন পিছিয়ে ১৪ তারিখ করতে। প্রস্তুতিতে কিছু সময় লাগবে।’ তাই ঠিক হল। নন্দীগ্রামে পুলিশ পাঠানোর বিস্তারিত প্ল্যানিং এরপর অফিসাররা জানালেন স্বরাষ্ট্র সচিব প্রসাদরঞ্জন রায় এবং মুখ্য সচিব অমিতকিরণ দেবকে। অভিযান নিয়ে প্রশাসনের চূড়ান্ত অনুমোদন নিয়ে পুলিশ কর্তারা মহাকরণ ছাড়লেন। অভিযান কবে হবে, কীভাবে হবে কিছুই কেউ সরকারিভাবে জানালেন না। শুধু স্বরাষ্ট্র সচিব প্রসাদরঞ্জন রায় মহাকরণে জানিয়েছিলেন, ‘নন্দীগ্রামের পাঁচটি পঞ্চায়েত এলাকায় পুলিশ যাবে।’
সেদিনের মিটিংয়ে পর আইজি পশ্চিমাঞ্চল অরুণ গুপ্তা থেক গেলেন কলকাতায়। ডিআইজি এন রমেশবাবু এবং এসপি শ্রীনিবাস ফিরে গেলেন পূর্ব মেদিনীপুর। তারপর যুদ্ধকালীন তৎপরতায় কলকাতা সংলগ্ন কয়েকটি জেলার কয়েকজন অফিসারকে ১৩ তারিখ বিকেলের মধ্যে তমলুক পৌঁছানোর নির্দেশ দিল মহাকরণ। কেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সরকার এত তাড়াহুড়ো করছিলেন তার কোনও যুক্তিগ্রাহ্য উত্তর কেউই কখনও দেননি। ওই অপারেশনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন বা মহাকরণে বড় পদে ছিলেন এমন অনেক পুলিশ অফিসারকে আমি জিজ্ঞেস করেছি। সবাই মোটামুটি এক উত্তর দিয়েছেন, তাঁরা জানতেন না, কেন এত চটজলদি এত বড়ো একটা সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। তবে দু’একজন বলেছিলেন, পার্টির চাপ আর নিতে পারছিলেন না মুখ্যমন্ত্রী। তাই একদিন হঠাৎই বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য মহাকরণে মুখ্য সচিব, স্বরাষ্ট্র সচিবকে ঘরে ডেকে নির্দেশ দিয়েছিলেন, যাই হোক না কেন, যত দ্রুত সম্ভব নন্দীগ্রামে পুলিশ পাঠাতে হবে। কোনও অগ্র-পশ্চাৎ না ভেবে সেদিন মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশ পালনে ছুটেছিল পুলিশ। কেউ মেরুদণ্ড সোজা রেখে বলেননি, এভাবে তাড়াহুড়ো করে অপারেশন করা ঠিক হবে না। অথচ, ইতিহাসের চাকা এত দ্রুত ঘোরে, ওই ঘটনার দু’বছরের মধ্যে এই নন্দীগ্রাম নিয়ে একাধিকবার খোদ মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশ পালন করতে সরাসরি অস্বীকার করছিলেন অনেক আইপিএস অফিসার। তার মধ্যে একটি ঘটনার উল্লেখ করে ১৪ মার্চের পুলিশি প্রস্তুতির বিষয়ে ঢুকব।

মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশ অস্বীকার

এই ঘটনাটা ২০০৯ সালে লোকসভা ভোটের ঠিক তিন দিন আগের। নন্দীগ্রামের সোনাচূড়া থেকে মোরামের রাস্তা ধরে অধিকারীপাড়া, গোকুলনগর গ্রামের ওপর দিয়ে তেখালি ব্রিজের কাছে যাওয়া যায়। সোনাচূড়া প্রথম দিন থেকেই তৃণমূল কংগ্রেস এবং আন্দোলনকারীদের শক্ত ঘাঁটি। আর ওই রাস্তা দিয়ে তেখালি ব্রিজ পর্যন্ত গেলে ডানদিকে বা উত্তর দিকে ঘুরলে নন্দীগ্রামের মহেশপুর, আমগেছিয়া। যে এলাকাগুলোতে তৃণমূল কংগ্রেসের প্রভাব বেশি। আবার তেখালি ব্রিজ থেকে বাঁদিকে বা দক্ষিণ দিকে ঘুরলেই খেজুরি, সেখানে তখন সিপিআইএমের আধিপত্য চূড়ান্ত। সোনাচূড়া এবং অধিকারীপাড়ার মধ্যে একটা কাঠের সেতু ছিল। সেই সময় তেখালি এবং ভাঙাবেড়া ব্রিছের কাছে নন্দীগ্রামের ভুমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটি এবং খেজুরির সিপিআইএম ক্যাডারদের মধ্যে গুলি বিনিময়, সংঘর্ষ ছিল প্রায় রোজকার ঘটনা। লোকসভা ভোটের আগে উত্তেজনা আরও বেড়ে যায়। পরিস্থিতি রীতিমতো উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। তমলুকের সাংসদ লক্ষ্মণ শেঠ জানতেন, নন্দীগ্রামের বিস্তীর্ণ এলাকায় তাঁর সংগঠন ভেঙে তছনছ হয়ে গিয়েছে। পঞ্চায়েত ভোটে যে ধাক্কা হয়েছে, নন্দীগ্রাম দখল করতে না পারলে লোকসভায় জেতার কোনও আশা নেই।
অন্যদিকে, তৃণমূল কংগ্রেস প্রার্থী শুভেন্দু অধিকারীও তখন জেতার স্বাদ পেয়ে গিয়েছেন। ২০০৭ থেকে টানা লড়াই করে তিনি তখন বুঝে গিয়েছেন, সিপিআইএমের খেজুরির বাহিনীকে আর কয়েকটা দিন রুখে দিতে পারলেই প্রথমবার সাংসদ হওয়া নিশ্চিত। সেই সময় অধিকারীপাড়ার সিপিআইএমের প্রভাব বেশি ছিল। ওই সেতুর কাছে ছিল পুলিশের একটা ক্যাম্প।

সিপিআইএম এবং তৃণমূল কংগ্রেসের এই রোজকার সংঘর্ষ ঠেকাতে পূর্ব মেদিনীপুর জেলা পুলিশ তখন এক কৌশল নেয়। দিনের বেলায় সশস্ত্র পুলিশ এবং ইএফআর জাওয়ানরা সেতুতে পাহারা দিত, যাতে তৃণমূল কংগ্রেস এবং সিপিআইএম কোনও পক্ষই এক দিক থেকে অন্য দিকে গণ্ডগোল করতে যেতে না পারে। কিন্ত রাতের বেলায় পুলিশ সেতুটার কাঠ খুলে রাখত, যাতে কেউ রাতে যাতায়াত করতে না পারে একদিক থেকে অন্যদিকে। দু’দলের সংঘর্ষ ঠেকাতেই পুলিশ এই বন্দোবস্ত করেছিল। জেলার পুলিশ অফিসারদের আশঙ্কা ছিল, রাতের অন্ধকারে এক পক্ষ অন্য দলের ওপর চড়াও হলে পুলিশের কিছু করার থাকেবে না। যেহেতু লোকসভা ভোট সামনে বড় সংঘর্ষ হলে নির্বাচন কমিশনের কাছে জবাবদিহি করতে হবে। তখন পূর্ব মেদিনীপুর জেলার এসপি  পল্লবকান্তি ঘোষ। লো-প্রোফাইলে থাকতেন, কিন্তু শাসক দলকে খুশি করাই চাকরির একমাত্র শর্ত বলে মনে করতেন না। তাঁর আশঙ্কা ছিল, ভোটের আগে রাতের অন্ধকারে সিপিআইএমের সশস্ত্র বাহিনী যে কোনও দিন নন্দীগ্রাম আক্রমণ করবে। তা রুখতে নন্দীগ্রাম এবং খেজুরির সীমানায় তালপাটি খালে যত সেতু রয়েছে সব জায়গায় পুলিশ মোতায়েন করা ছিল। কিন্ত রাতের অন্ধকারে মাঠ দিয়ে গিয়ে সিপিআইএম বাহিনী যাতে অধিকারীপাড়া হয়ে সোনাচূড়ায় ঢুকতে না পারে তার জন্য ওই কাঠের সেতু রাতে খুলে রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন এসপি। এই সেতু রাতের বেলায় চালু করার জন্য ভোটের প্রায় একমাস আগে থেকে জেলার সিপিআইএম নেতারা স্থানীয় পুলিকে বারবার চাপ দিচ্ছিলেন। কিন্তু এসপি কিছুতেই রাজি হচ্ছিলেন না। তিনি পরিষ্কার না করে দেন। পল্লবকান্তি ঘোষ পুরো বিষর়টা জানিয়ে রেখেছিলেন জেলার ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট চোটেন লামাকে। এসপি বলে রেখেছিলেন, ওই সেতু রাতে চালু রাখলে গোলমাল, সংঘর্ষ হতে পারে, তাতে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে। কারণ, কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশনের পরিচালনায় ভোট। তার আগে বড় রাজনৈতিক সংঘর্ষ হলে খুবই খারাপ হবে।

 

আগের পর্বে কী ঘটেছিল? পড়ুন: নন্দীগ্রাম আসলে যা ঘটেছিল #৮: গড়বেতা, কেশপুরের সশস্ত্র বাহিনী এনে নন্দীগ্রাম উদ্ধার করতে হবে, বললাম লক্ষ্মণ শেঠকে

 

লক্ষণ শেঠ যখন বুঝে যান জেলার পুলিশকে বলে কোনও লাভ হবে না, তখন তিনি চাপ দেন দলের রাজ্য নেতাদের। কলকাতায় মুজফফর আহমেদ ভবনের এক অত্যন্ত প্রভাবশালী নেতাকে তমলুকের সাংসদ বিষয়টা বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে জানাতে বলেন। ভোটের কয়েকদিন আগে সিপিআইএমের রাজ্য পার্টি বিষয়টাকে দেখতে বলে মুখ্যমন্ত্রীকে। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য রাজ্য পুলিশের ডিরেক্টর জেনারেল সুজিত সরকারকে নির্দেশ দেন, ওই সেতু রাতের বেলা চালু রাখার জন্য যেন জেলা পুলিশকে বলা হয়। মহাকরণের এক উচ্চপদস্থ পুলিশ অফিসার ভোটের ঠিক তিনদিন আগে ফোন করেন পল্লবকান্তি ঘোষকে। তখন পল্লবকান্তি ঘোষ বসেছিলেন তমলুকে ডিএমের অফিসে। মহাকরণ থেকে এক উচ্চপদস্থ পুলিশ অফিসার পল্লবকান্তি ঘোষকে ফোনে বলেন, ‘সরকার চাইছে সোনাচূড়া এবং অধিকারীপাড়ার মাঝের কাঠের সেতু ভোট পর্যন্ত রাতে খুলে রাখার কোনও দরকার নেই। কারণ, ওই সেতু দিয়ে ভোটাররা ভোট দিতে যাবে।’ পল্লবকান্তি ঘোষ ওই অফিসারকে সটান জানিয়ে দেন, ‘কোনওভাবেই তা সম্ভব নয়।’ তিনি জানান, ‘ভোটাররা দিনের বেলায় আইডেন্টিফিকেশন কার্ড নিয়ে যাবেন। পুলিশ দেখে ছেড়ে দেবে। ভোটার আইডেন্টিফিকেশন কার্ড ছাড়া কাউকে একদিক থেকে অন্যদিকে যেতে দেওয়া হবে না। তাছাড়া রাতে তো ভোট নেই, তাই সেতু চালু রাখার কোনও দরকারও নেই।’  পূর্ব মেদিনীপুরের পুলিশ সুপারের কথা শুনে মহাকরণের অফিসার আর কথা বাড়াননি। বুঝে যান এসপিকে দিয়ে এই কাজ হবে না। তিনি সঙ্গে সঙ্গে বিষয়টা জানান, মুখ্যমন্ত্রীর প্রিন্সিপাল সেক্রেটারি সুবেশ দাসকে। মিনিট পনেরোর মধ্যে সুবেশ দাস নিজে ফোন করেন পূর্ব মেদিনীপুরের ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট চোটেন লামাকে। সুবেশ দাসও একই অনুরোধ করেন ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেটকে। সামনেই বসেছিলেন এসপি। চোটেন লামা বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের প্রিন্সিপাল সেক্রেটারিকে জানান, তিনি বিষয়টা জানেন, ওই সেতু রাতে চালু রাখা যাবে না। তাতে ভোটের আগে বড়ো গণ্ডগোল হতে পারে। এরপর আর বিষয়টা নিয়ে এগোয়নি মুজফফর আহমেদ ভবন কিংবা মহাকরণ। জেলা সিপিআইএম নেতারাও বুঝে যান, মহাকরণের রাশ বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের হাতে আর নেই। কিন্তু এমন পরিস্থিতি ২০০৭ সালে মার্চ মাসে ছিল না। তখন পুলিশকে ধরে আনতে নির্দেশ দিলে, পুলিশ বেঁধে আনবে এমন পর্ব চলছে।
১৪ মার্চ যে নন্দীগ্রামে পুলিশ এবং সিপিআইএমের যৌথ অভিযান হতে চলেছে তা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল সেই দিনই ভোর পাঁচটা নাগাদ। যার ইঙ্গিত মিলেছিল তার আগের সন্ধ্যায়। ১৩ মার্চ সন্ধ্যায় তমলুক পার্টি অফিসে বসে লক্ষ্মণ শেঠের সেই প্রশ্ন, কী করবেন কাল নন্দীগ্রামে গিয়ে? আর ১৪ তারিখ ভোর থেকে, আরও নির্দিষ্টভাবে বললে, ১৩ মার্চ মাঝরাত থেকেই নন্দীগ্রামে ঢোকার সমস্ত রাস্তায় ব্যারিকেড করে দিয়েছিল শাসক দলের ক্যাডার বাহিনী। পুলিশের সঙ্গে সিপিআইএমের যৌথ অভিযানের এই ষড়যন্ত্র হঠাৎ সেদিন ভোরে আকাশ থেকে পড়েনি। পুলিশ নন্দীগ্রামে ঢুকবে রাস্তা সারাইয়ের অছিলায়, তার পিছন পিছন  সিপিআইএমের  বাছাই করা কিছু দুষ্কৃতী ঢুকবে এলাকা দখল করতে, এই ষড়যন্ত্র করা হচ্ছিল কয়েকদিন আগে থেকেই। এমন নয় যে এই ষড়যন্ত্রের কথা অভিযানের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন সমস্ত পুলিশ অফিসার বা সব সিপিআইএম নেতা বিষয়টা জানতেন। বরং এত বড়ো একটা অভিযান নিয়ে মহাকরণের পুলিশ অফিসারদের দায়িত্বজ্ঞানহীন ও দায়সারা পরিকল্পনার জন্যই এই ষড়যন্ত্র করতে পেরেছিল জেলা স্তরের পুলিশ ও সিপিআইএমের একটা প্রভাবশালী অংশ। এতে ৩১ আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের সরাসরি মদত না থাকলেও সিপিআইএম শীর্ষ নেতৃত্ব চাইলে এই ষড়যন্ত্র ঠেকাতে পারতেন। ১৪ তারিখ সকালে আধ-ঘণ্টার অপারেশন, ১৪ জনের মৃত্যুর পর সিআইডি তদন্ত হল, পাশাপাশি হাইকোর্ট নির্দেশ দিল সিবিআই তদন্তের।

চলবে

 

(১৮ সেপ্টেম্বর থেকে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হচ্ছে নন্দীগ্রাম আসলে যা ঘটেছিল। প্রতি পর্বে লাল রং দিয়ে আগের পর্বের লিঙ্ক দেওয়া থাকছে)

Comments are closed.