আগের পর্ব যেখানে শেষ হয়েছিল: নন্দীগ্রামে শেষ লড়াইয়ের কথা বলছিলেন সিপিআইএম সশস্ত্র বাহিনীর নেতা মাস্টারদা। ১০ নভেম্বর সকালে মহেশপুর স্কুলে বসে খবর পেলেন সোনাচূড়া থেকে মিছিল নিয়ে আসছে ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটি……
‘১০ নভেম্বর সকালে ঘুম থেকে উঠতে আমার একটু দেরি হয়ে গিয়েছিল। আগের দিন প্রচণ্ড ধকল গিয়েছি, শুতেও রাত হয়। মহেশপুর হাইস্কুলে তখন প্রচুর লোক। আমাদের গড়বেতা, কেশপুরের প্রায় দেড়শো ছেলে, সেই সঙ্গে নন্দীগ্রামের স্থানীয় সিপিআইএম সমর্থকরা, যারা ঘরছাড়া হয়েছিল অনেক দিন ধরে।
হঠাৎ খবর পেলাম প্রচুর মানুষের মিছিল আসছে স্কুলের দিকে। স্কুলের সামনেই রাস্তা, তার সামনে বিরাট মাঠ। আমরা হাইস্কুলের ছাদ থেকে দেখতে পেলাম, গ্রামের মধ্যে দিয়ে আল এবং মাঠ ধরে বড়ো মিছিল আসছে। একবার ওই বিশাল মিছিল মাঠ পেরিয়ে হাইস্কুলের কাছে রাস্তার ওপর চলে এলে আমাদের আর কিছু করার থাকত না। মিছিল দূরে থাকতেই ওদের ভয় দেখাতে আমাদের ছেলেরা আকাশে গুলিও চালায়। কিন্তু তাতে পিছু না হঠে মিছিল এগিয়ে আসতে থাকে হাইস্কুলের দিকে। এরপরই আমরা বুঝতে পারি ওদের প্ল্যান। সাধারণ গ্রামবাসীদের সামনে রেখে ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটি মহেশপুর দখল করতে আসছে। বাধ্য হয়েই আমাদের ছেলেরা হাইস্কুলের ছাদ থেকে গুলি চালিয়েছিল। এবং মিছিলে গুলি চলতেই সব মানুষ এদিক ওদিক ছুটতে শুরু করল। ছত্রভঙ্গ হয়ে গিয়েছিল মিছিল। ওদের সশস্ত্র বাহিনীও কিছু গুলি চালিয়েছিল। কিন্তু ওদের থেকে আমাদের ছেলেরা অনেক ভাল পজিশনে ছিল। ওরা ছিল মাঠে। আমাদের ছেলেরা ছাদের ওপর। কিছুক্ষণের মধ্যেই ওদের প্রতিরোধ থেমে গিয়েছিল। ঠিক সংখ্যা বলা কঠিন, তবে সেই দিন গুলিতে মিছিলে থাকা অন্তত ৭-৮ জন গ্রামবাসীর মৃত্যু হয়েছিল।’
১০ নভেম্বর ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটির এই শেষ প্রতিরোধের চেষ্টার ঘটনা বলে থামলেন মাস্টারদা। ৬ নভেম্বর যে অপারেশন শুরু করেছিল সিপিআইএম বাহিনী, তা শেষ হল ১০ তারিখ দুপুরে।
১০ নভেম্বর ২০০৭, দুপুর সাড়ে ১২ টা-১ টার মধ্যে সরকারিভাবে শেষ হয়েছিল সিপিআইএমের সশস্ত্র বাহিনীর নন্দীগ্রাম পুনর্দখল অভিযান। হলদিয়ায় শ্রমিক ভবন থেকে কলকাতার আলিমুদ্দিন স্ট্রিটে সিপিআইএম রাজ্য দফতরে খবর পৌঁছেছিল, নন্দীগ্রাম মুক্ত। দীর্ঘদিনের ঘরছাড়ারা সব নন্দীগ্রাম ফিরতে শুরু করে দিয়েছে। নন্দীগ্রামে আবার উড়ছে লাল পতাকা, আগের থেকেও বেশি সংখ্যায়। ৩১ আলিমুদ্দিন স্ট্রিটে খবর এসেছিল, ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটির আন্দোলন শেষ। অবশ্য, এখবর এসে পৌঁছায়নি, সেদিন দুপুরে তাদের বাহিনীর ছোড়া গুলিতে কত মানুষের মৃত্যু হয়েছে মহেশপুরে। এই খবরও পূর্ব মেদিনীপুরের সিপিআইএম নেতারা কলকাতায় রাজ্য দফতরে জানাননি, তাঁদের সশস্ত্র বাহিনী নন্দীগ্রামের প্রায় ৪০০ মানুষকে বন্দুক দেখিয়ে খেজুরিতে নিয়ে গেছে। এই খবর এসে পৌঁছোয়নি, অন্তত ৯ জন জখম, গুলিবদ্ধ আন্দোলনকারীকে মেরে মৃতদেহ গুম করে দেওয়া হয়েছে। লক্ষ্মণ শেঠ সহ সিপিআইএমের তাবড় নেতারা, এমনকী কলকাতার রাজ্য নেতারাও ১০ নভেম্বর দুপুরে ভেবেছিলেন, নন্দীগ্রাম চ্যাপ্টার ক্লোজড। এবং ভুল ভেবে ছিলেন।
২০০৬ সালের ২৯ ডিসেম্বর নন্দীগ্রাম বাজারে তাঁর জনসভার পরে সোনাচূড়ায় কী ঘটেছিল তা জেনেও যেমন সে ঘটনাকে আমল দেননি, একইভাবে পরের বছর ১০ নভেম্বর মহেশপুরে কয়েকজন গ্রামবাসীর মৃত্যু এবং নন্দীগ্রামজুড়ে লাল পতাকা দেখে লক্ষণ শেঠ এবং স্থানীয় সিপিআইএম নেতারা মনে করেছিলেন, এলাকা দখল সম্পূর্ণ, ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটির সব আন্দোলন শেষ। কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতি ছিল একেবারেই ভিন্ন। সিপিআইএমের এই ধারণার গোড়ায় সজোরে টান দিয়েছিল নন্দীগ্রামের মানুষ। সশস্ত্র বাহিনী দিয়ে নন্দীগ্রামে এলাকার দখল নিয়েছিল সিপিআইএম, নন্দীগ্রামজুড়ে উড়ছিল লাল পতাকা, সবই ঠিক। কিন্তু সিপিআইএম নেতারা দেখতে পাননি, সেই লাল পতাকার দিকে সাধারণ মানুষের কোনও ভালোবাসা নয়, প্রচণ্ড ভীতি আর আক্রোশ ভরা চোখে তাকিয়ে রয়েছে। অল্প কিছু সশস্ত্র বহিরাগত দিয়ে কোনও এলাকায় দখলদারি করা, আর হাজার হাজার মানুষের হৃদয়ে পাকা জায়গা করে নেওয়ার মধ্যে যে আকাশ-পাতাল ফারাক, তা বোঝার বিন্দুমাত্র চেষ্টা সেদিন করেননি সিপিআইএমের নেতারা। অথচ এমন নয় যে, সংসদ বহির্ভূত কার্যকলাপে কোনও অভিজ্ঞতা এ’রাজ্যে সিপিআইএমের কোনও নেতার ছিল না। বরং ভারতবর্ষের প্রায় সব পার্টির থেকে তাদের অনেক নেতার এই অভিজ্ঞতা বেশিই ছিল। কিন্তু দীর্ঘদিন ঘরছাড়া থাকা নন্দীগ্রাম পুনরুদ্ধারের সঙ্কল্প তখন এতোটাই দৃঢ় ছিল, এই সশস্ত্র অভিযানের ফলাফল নিয়ে অগ্র-পশ্চাৎ বিবেচনা করার সময় মুজফফর আহমেদ ভবনের ছিল না তখন।
১৯৭৭ সালে ক্ষমতায় আসার পর কৃষক সভা যেভাবে গ্রামের পর গ্রামে সাধারণ মানুষ, বর্গাদারকে সামনে রেখে মূলত জোতদারের জমি দখল অভিযান পরিচালনা করেছিল, তা গোটা দেশেই সংসদ বহির্ভূত কার্যকলাপের এক ব্যতিক্রমী এবং সফল দৃষ্টান্ত। সেই আন্দোলন থেকেই জেলায় জেলায় উঠে এসেছিলেন একাধিক কিংবদন্তি কৃষক নেতা। যাঁদের অনেকের নাম হয়তো রাজ্যের মানুষ জানতেন না, কিন্ত নিজেদের এলাকায় তাঁদের প্রভাব ছিল অপরিসীম। ১৯৭৭ সালের পর সংসদ বহির্ভূত কার্যকলাপের মাধ্যমে মানুষকে জমি দেওয়ার যে উদ্যোগ কৃষক সভা নিয়েছিল, তাতে অধিকাংশ সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ ছিল স্বতঃস্ফূর্ত। লক্ষ লক্ষ মানুষ মনে করেছিলেন, পার্টি যা করছে, সবই তাঁদের জন্য। কিন্তু ৩০ বছরেরও বেশি সরকার চালিয়ে ২০০৭ সালে পশ্চিম বাংলায় সিপিআইএম শুধুমাত্র একটা দল নয়, প্রতিষ্ঠান। তাই সাধারণ মানুষের প্রতিষ্ঠান বিরোধী লড়াই সেই সময় শাসক দলের অনেক নেতার কাছেই সরকার উৎখাত করার একটা ভয়ঙ্কর ষড়যন্ত্র এবং অসৎ প্রচেষ্টা ছাড়া আর কিছুই নয়। আর এই প্রচেষ্টা বরদাস্ত করা মানে আত্মমর্যাদায় আঘাত! তাই সিপিআইএমের অনেকেই তখন ভেবেও দেখেননি, মন না রাঙিয়ে শুধু বসন রাঙালে তা কত দিন স্থায়ী হতে পারে?
২০০৭ সালের নভেম্বরে নন্দীগ্রাম পুনরুদ্ধারের প্রায় সাত বছর বাদে পার্টির সংসদ বহির্ভূত কার্যকলাপ নিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলাম সূর্যকান্ত মিশ্রকে। নির্দষ্টভাবে ২০০০-২০০১ সালের গড়বেতা, কেশপুর কিংবা ২০০৭ সালের নন্দীগ্রাম মডেল নিয়ে নয়, এই গণতান্ত্রিক কাঠামোর মধ্যে অত্যন্ত শক্তিশালী সংবাদমাধ্যমের যুগে সংসদ বহির্ভূত কার্যকলাপ কতটা প্রাসঙ্গিক জানতে চেয়েছিলাম। বিধানসভায় নিজের ঘরে বসে সিপিআইএমের পলিটব্যুরো সদস্য সূর্যকান্ত মিশ্র আমাকে সেদিন বলেছিলেন, ‘অধিকাংশ মানুষকে যুক্ত না করে শুধুমাত্র অস্ত্রের জোরে সংসদ বহির্ভূত কার্যকলাপ পরিচালনা করলে, তা কখনোই সফল হয় না। সাময়িক সাফল্য হয়তো মেলে, কিন্তু অল্প দিনের মধ্যেই তা হাতছাড়া হয়। সশস্ত্র বিপ্লব সাফল্যের একমাত্র ভিত্তি, তাতে অধিকাংশ সাধারণ মানুষকে যুক্ত করা। পারলে সব মানুষকে যুক্ত করা। নয়তো তা ব্যর্থ হতে বাধ্য।’
কিন্তু নন্দীগ্রামের অধিকাংশ সাধারণ মানুষের থেকে তো সিপিআইএম বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল বহুদিন আগেই। তাই ১০ নভেম্বর ২০০৭, পুরো নন্দীগ্রামে লাল পতাকা উড়লেও, তা ছিল সেখানকার বসন রাঙানোরই সামিল, আর গোটা এলাকার মনে পাকাপাকি গেঁথে গিয়েছিল মহেশপুরের ধান ক্ষেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকা সাধারণ গ্রামবাসীর মৃতদেহের লাল রঙ। যে মাটি রক্তে ভিজে গিয়েছে বহিরাগত সিপিআইএম বাহিনীর চালানো গুলিতে, সেখানে আর যাই হোক, দলীয় কার্যকলাপের অনুশীলন যে সম্ভব নয়, তা বোঝার মতো সময় তখনও ব্যয় করতে চাননি সাময়িক সাফল্যের আনন্দ মশগুল দলীয় নেতারা। তাই ১০ নভেম্বর হলদিয়ার শ্রমিক ভবন থেকে মুজফফর আহমেদ ভবনের হিসেবে খাতায়কলমে নন্দীগ্রাম উদ্ধার হল বটে, কিন্তু সেই দিনই সিপিআইএমের রাজ্য বেদখল হওয়ার পক্রিয়া শুরু হয়ে গেল পাকাপাকিভাবে।
১৪ মার্চ পুলিশের অভিযানে ১৪ জনের মৃত্যুর ঘটনায় এ’রাজ্যে প্রায় চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করে ফেলা বামফ্রন্ট সরকারকে বেআব্রু করে দিয়েছিল। আর ১০ নভেম্বরের অভিযান সরকারের মৃত্যু পরোয়ানায় শেষ পেরেক পুঁতে দিল। আর একা হনুমানে রক্ষে নেই, সুগ্রীব দোসর! একেই সকালে মহেশপুরে এত লোকের মৃত্যু, সেই খবরের রেশ কাটার আগে, সেই রাতেই আরও বড়ো ধাক্কা খেল সিপিআইএম। দলের জন্য বড়সড় বিপদে পড়ে গেল বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সরকার। ১০ নভেম্বর রাতে পূর্ব মেদিনীপুরের অন্য একটি ঘটনা ঘটে, যা সেইদিন সকালের মহেশপুরের সংঘর্ষের থেকে কোনও অংশে কম নাটকীয় কিংবা রোমহর্ষক নয়। যদিও সেখানে কেউ হতাহত হননি, কিন্তু নানা নাটকীয় ঘটনায় জড়িয়ে পড়েছিলেন রাজ্যের এক মন্ত্রী, রাজ্যের পুলিশ, সিপিআইএম এবং মুখ্যমন্ত্রী নিজে। এবং অবশ্যই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
১০ তারিখ সকালে মহেশপুরে গ্রামবাসীদের মিছিল গুলি চালিয়ে ছত্রভঙ্গ করে দেওয়ার পর সিপিআইএম কর্মীরা তখন বিশ্রাম নিচ্ছেন। গড়বেতা-কেশপুর বাহিনীর মানসিক প্রস্তুতি ছিল, সেই দিন সকালে বেরিয়ে যাবে নন্দীগ্রাম থেকে, ফিরে যাবে পশ্চিম মেদিনীপুরে। কিন্তু আচমকা ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটির মিছিল তাদের পরিকল্পনায় জল ঢেলে দেয়। সিপিআইএমের নেতৃত্ব সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলেন না, কী করা হবে। এমনই সময় দুপুরে মহেশপুরে গিয়ে হাজির হলেন সিপিআইএমের গড়বেতার দুই প্রভাবশালী নেতা তপন ঘোষ এবং শুকুর আলি। দুজনেই ২০০১ সালের গোড়ায় গড়বেতার ছোট আঙারিয়ায় যে হত্যাকাণ্ড ঘটেছিল, তাতে মূল অভিযুক্ত ছিলেন। সিবিআই তদন্ত চলছিল তাঁদের বিরুদ্ধে। আগের দিনই তপন ঘোষ, শুকুর আলিরা খবর পেয়েছিলেন, দীর্ঘ ১০ মাসের লড়াইয়ে পর অবশেষে তাঁদের এলাকার ছেলেরা নন্দীগ্রাম দখল করেছে। যুদ্ধ জয় সম্পূর্ণ। কিন্তু ১০ তারিখের এই মিছিল, তাতে গুলি, ৭-৮ মৃত্যু এবং বহু লোকের গুলিবিদ্ধ হওয়ার খবর তাঁরা কিছুই জানতেন না। জানার কথাও নয়। সেদিন সকাল সকাল গড়বেতা থেকে এই দুই নেতা নিজেদের এলাকার ছেলেদের দেখতে এবং অভিনন্দন জানাতে নন্দীগ্রামের দিকে রওনা দিয়েছিলেন। সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিলেন প্রচুর মিষ্টি। দুপুর নাগাদ তাঁরা মহেশপুরে গিয়ে পৌঁছন। গিয়ে দেখেন এলাকায় পরিস্থিতি খুবই উত্তেজিত। তপন ঘোষ এবং শুকুর আলি মহেশপুর হাইস্কুলে পৌঁছানোর পর মাস্টারদা তাঁদের বলেন, ‘আপনারা কেন এসেছেন, ফিরে যান এখনই।’ তখনও মহেশপুরের মাঠে, রাস্তায় প্রচুর লোক জখম হয়ে পড়েছিল। মাঠে পড়েছিল মৃতদেহ। ছেলেদের মিষ্টি দিয়ে তাড়াতাড়ি এলাকা ছাড়েন গড়বেতার দুই নেতা। সোজা চলে গিয়েছিলেন তেখালি ব্রিজ পেরিয়ে খেজুরির কলাগেছিয়ার সিপিআইএম পার্টি অফিসে। সেখানে একটু বিশ্রাম করে খাওয়া-দাওয়া করে সন্ধ্যার মুখে তপন ঘোষ এবং শুকুর আলি রওনা দেন গড়বেতার দিকে।
এদিকে, সকালে মহেশপুরে গ্রামবাসীদের মিছিলে সিপিআইএমের গুলি চালানোর খবর দুপুর থেকেই ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে রাজ্যজুড়ে। কতজন মারা গিয়েছে তা নিয়ে নানা জল্পনাও শুরু হয়ে যায়। মৃতদেহ উদ্ধার হয়েছিল দু’জনের। তাড়াহুড়োয় সিপিআইএম ক্যাডাররা ওই দুই মৃতদেহ খুঁজে পায়নি। বাকি মৃতদেহ তারা সরিয়ে দেয়। বিকেল থেকেই রাজ্যজুড়ে খবর ছড়িয়ে পড়ে, নিরীহ মানুষের মিছিলে গুলি চালিয়ে সিপিআইএম নন্দীগ্রাম দখল করে নিয়েছে। বহু মানুষ মৃত এবং জখম। প্রচুর লোককে সিপিআইএম ধরে নিয়ে গেছে খেজুরিতে। এই ঘটনার প্রতিবাদে সন্ধে থেকেই পূর্ব মেদিনীপুর বিভিন্ন জায়গায় রাস্তা অবরোধ শুরু করে দিয়েছিল তৃণমূল কংগ্রেস। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সন্ধেবেলা কলকাতা থেকে রওনা দিলেন নন্দীগ্রামের উদ্দেশে, সেই ঘটনায় পরে আসব।
সেই দিন মহেশপুরে গুলিতে জখম অনেককেই অ্যাম্বুলেন্সে করে বিভিন্ন হাসপাতালে পাঠানো হয়েছিল। অন্যদিকে, সন্ধ্যায় খেজুরি থেকে একটা অ্যাম্বাসাডার গাড়িতে চেপে এগরার রাস্তার ধরে পশ্চিম মেদিনীপুরের দিকে রওনা দিয়েছিলেন গড়বেতার দুই সিপিআইএম নেতা তপন ঘোষ এবং শুকুর আলি।
এগরার কাছাকাছি তপন ঘোষ এবং শুকুর আলির গাড়ি ব্যাপক যানজটে আটকে যায়। তাঁদের গাড়ির পিছনে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল একটা অ্যাম্বুলেন্স, যাতে নন্দীগ্রামের ৩ জন জখম ব্যক্তি ছিলেন। মহেশপুরে গুলি চালানোর প্রতিবাদে তৃণমূল কংগ্রেসের রাস্তা অবরোধের জন্যই সেখানে লাইন দিয়ে আটকে পড়েছিল বহু গাড়ি। তপন ঘোষ বা শুকুর আলি কেউই জানতেন না এই অবরোধের খবর। তাঁরা গাড়ি থেকে রাস্তায় নামেন, একটু এগিয়ে খোঁজ-খবর নিচ্ছিলেন, কেন সব গাড়ি আটকে গিয়েছে। সেই সময় তাঁদের পিছনের অ্যাম্বুলেন্সকে যানজট থেকে বের করার জন্য অল্প কিছু লোকজন জড়ো হয়ে যায়। দু’চারজন পুলিশ কর্মীও সেখানে পৌঁছে যান অ্যাম্বুলেন্স বের করার জন্য। পুলিশ এবং অবরোধকারীরাও জানতেন না, ওই অ্যাম্বুলেন্সে নন্দীগ্রামের সংঘর্ষে জখম লোক রয়েছেন। ভিড়, জটলার মধ্যে অ্যাম্বুলেন্সের লোকেরা জানান, তাঁদের বাড়ি নন্দীগ্রামে। দুপুরে মহেশপুরে তাঁরা গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। একথা জানাজানি হতেই আগুনে ঘি পড়ে। মূহুর্তের মধ্যে তৈরি হয়ে যায় উত্তেজনা, জটলা বাড়তে শুরু করে। অ্যাম্বুলেন্সের চালককে ঘিরে ধরে শুরু হয় জিজ্ঞাসাবাদ। সেই সময় তপন ঘোষ এবং শুকুর আলি রাস্তায় দাঁড়িয়ে। যে দু’চারজন পুলিশকর্মী সেখানে ছিলেন তাঁর মধ্যে একজন কয়েক বছর আগে পশ্চিম মেদিনীপুরে কাজ করেছিলেন। তিনি আগে থেকেই গড়বেতার প্রভাবশালী সিপিআইএম নেতা তপন ঘোষকে চিনতেন। রাস্তার ধারে তপন ঘোষকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেন তিনি। আর সঙ্গে সঙ্গে তিনি একথা জানিয়ে দেন এক স্থানীয় তৃণমূল নেতাকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই অবরোধকারীরা স্থানীয় তৃণমূল কংগ্রেসের নেতা এবং কর্মীদের মারফৎ কাঁথিতে শিশির অধিকারী, শুভেন্দু অধিকারীর কাছে খবর পৌঁছোয়, গড়বেতার তপন- শুকুর নন্দীগ্রামের জখম লোকেদের নিয়ে পশ্চিম মেদিনীপুর পালিয়ে যাচ্ছে। সিপিআইএমের দুই নেতা কিছু বুঝে ওঠার আগেই অবরোধকারীরা ঘিরে ফেলে তাঁদের। শুরু হয়ে যায় ধাক্কাধাক্কি, মারধর। মারধর যখন প্রায় গণপিটুনির চেহারা নিচ্ছে তখন পুলিশ গড়বেতার দুই দোর্দণ্ডপ্রতাপ সিপিআইএম নেতাকে উদ্ধার করে থানায় নিয়ে যায়। উত্তেজিত লোকজন পেছন পেছন যায় থানা পর্যন্ত। পুলিশ দু’জনকে থানায় নিয়ে গিয়ে বসালে তৃণমূল কংগ্রেস লোকজন তখনই তপন ঘোষ এবং শুকুর আলির গ্রেফতারের দাবি করে। এগরা থানার ভিতরে-বাইরে শুরু হয়ে যায় প্রবল উত্তেজনা। অনবরত ওখানকার তৃণমূল নেতৃত্বের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ রাখছিলেন কাঁথির অধিকারী পরিবারের দুই সদস্য। দু’জনেই বুঝে যান, সিপিআইএমের পশ্চিম মেদিনীপুর বাহিনীর নন্দীগ্রাম আক্রমণের অকাট্য প্রমাণ তপন ঘোষ এবং শুকুর আলির উপস্থিতি। এই নিয়ে রাজ্যে উত্তাল হবে। সেই সময় গড়বেতার এই দুই নেতাকে গ্রেফতারের দাবিতে রীতিমতো ঝামেলা শুরু হয়ে যায় এগরা থানায়। বাধ্য হয়ে পুলিশ দুজনকে লকআপে ঢুকিয়ে দেয়। থানার বাইরে তখন হাজার তৃণমূল কংগ্রেস কর্মী-সমর্থকের জটলা।
তপন ঘোষ, শুকুর আলিকে থানায় আটকে রাখার খবর ততক্ষণে পৌঁছে গিয়েছে গড়বেতার প্রভাবশালী নেতা এবং রাজ্যের মন্ত্রী সুশান্ত ঘোষের কাছে। সুশান্ত ঘোষ সেদিন সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত ছিলেন কলকাতায় সিপিআইএম রাজ্য দফতর মুজফফর আহমেদ ভবনে। মহেশপুরের লড়াই গণ্ডগোল সব থেমে যাওয়ার পর সন্ধ্যায় তিনি রওনা দিয়েছিলেন পশ্চিম মেদিনীপুরের দিকে। তাঁর গাড়ি যখন উলুবেড়িয়া পেরোচ্ছে তখন মোবাইল ফোনে খবর আসে, তাঁর দুই বিশ্বস্ত সেনাপতিকে এগরা থানা আটকে রেখেছে। সঙ্গে সঙ্গে ওই মন্ত্রী তৎপর হয়ে ওঠেছিলেন তাঁর এলাকার দুই নেতাকে ছাড়াতে। এদিক-ওদিক ফোন করে বুঝতে পারছিলেন পরিস্থিতি জটিল। তখন রাজ্যজুড়ে খবর হয়ে গিয়েছে, নন্দীগ্রাম দখল করতে গিয়ে ফেরার সময় গ্রেফতার হয়েছেন তপন ঘোষ এবং শুকুর আলি। অবস্থা বেগতিক দেখে ওই মন্ত্রী ফোন করেন আলিমুদ্দিন স্ট্রিটে, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সঙ্গে কথা বলার জন্য। কিন্তু বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য নন, তাঁর আপ্ত সহায়ক জয়দীপ মুখোপাধ্যায় ওই মন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেন। জয়দীপ মুখোপাধ্যায় কিছুক্ষণ পর ওই মন্ত্রীকে আশ্বাস দেন, মুখ্যমন্ত্রী এবং পুলিশের সঙ্গে কথা হয়ে গিয়েছে। একটু রাত বাড়লেই তপন ঘোষ এবং শুকুর আলিকে ছেড়ে দেওয়া হবে। ততক্ষণে ওই মন্ত্রীর কনভয় প্রায় পশ্চিম মেদিনীপুর পৌঁছে গিয়েছে। এরপর ওই মন্ত্রী একাধিকবার ফোন করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রীর আপ্ত সহায়ককে। প্রতিবারই তিনি আশ্বাস দিচ্ছেলেন তপন ঘোষ, শুকুর আলিকে ছেড়ে দেওয়ার ব্যাপারে। কখনও বলছিলেন, দেখছি।
এরই মধ্যে এগরায় যখন এই ঘটনা ঘটেছে, প্রায় সেই সময়েই মহেশপুরের হাইস্কুল থেকে গড়বেতা, কেশপুরের প্রায় ১৫০ ছেলেকে নিয়ে মাস্টারদা খেজুরির কলাগেছিয়া পার্টি অফিসে গিয়ে পৌঁছন। মাস্টারদা ঠিক করেছিলেন, সেই রাতেই সবাইকে নিয়ে পশ্চিম মেদিনীপুরে ফিরে যাবেন। কারণ, ততক্ষণে খবর পৌঁছে গিয়েছে, সিআরপিএফ রওনা দিয়েছে নন্দীগ্রামে পৌঁছানোর জন্য। পরদিন ১১ তারিখ সিআরপিএফের তমলুক পৌঁছানোর কথা। তাই পূর্ব মেদিনীপুরে থাকা আর নিরাপদ নয়। কিন্তু কলাগেছিয়া পার্টি অফিসে ঢুকে টেলিভিশনে তপন ঘোষ, শুকুর আলির আটকের খবর দেখে মাস্টারদার মাথায় বাজ ভেঙে পড়ে। যত না নিজের আর দেড়শ ছেলের চিন্তায়, তার চেয়েও বেশি গড়বেতার দুই নেতাকে আটকের খবরে। সঙ্গে সঙ্গে মাস্টারদা খেজুরি থেকেই ফোন করেছিলেন সুশান্ত ঘোষকে। মন্ত্রী তখনও রাস্তায়, গাড়িতে। মাস্টারদা ফোনে বলেছিলেন, ‘আপনি অনুমতি দিন, আমি কিছু ছেলে নিয়ে ট্রেকারে চেপে এগরা যাচ্ছি। থানা থেকে বের করে নিয়ে আসব তপন ঘোষ, শুকুর আলিকে। পাবলিক, পুলিশ যে প্রতিরোধ করবে আমি বুঝে নেব। এগরা থানার ক্ষমতা নেই তপনদা, শুকুর আলিকে আটকে রাখে।’ ওই মন্ত্রী মাস্টারদাকে এই অনুমতি দেননি। তিনি তখনও আশা করেছিলেন, খোদ মুখ্যমন্ত্রীর আপ্ত সহায়ককে পুলিশ যখন কথা দিয়েছে ছেড়ে দেওয়ার ব্যাপারে, নিশ্চয়ই কোনও একটা সুরাহা হবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত থানার বাইরে জনতার প্রবল চাপে এবং রাজ্য জুড়ে বৈদ্যুতিন সংবাদমাধ্যমে সেই খবর দেখানোর জেরে পুলিশ তপন ঘোষ এবং শুকুর আলিকে সেই রাতেই গ্রেফতার করে। বলা যায়, গ্রেফতার করতে বাধ্য হয়। তখন পূর্ব মেদিনীপুরের পুলিশ সুপার সত্যশঙ্কর পাণ্ডা। কয়েকমাস ধরেই তিনি সিপিআইএমের কথা শুনে প্রায় চোখ বন্ধ করে জেলা চালাচ্ছিলেন। তাই সেই সময় শাসক দলের বড়ো ভরসা ছিল জেলা পুলিশের ওপর। তপন ঘোষ এবং শুকুর আলিকে গ্রেফতার করার খবর পেয়ে রাত প্রায় সাড়ে ১১ টা নাগাদ ওই মন্ত্রী শেষবারের মতো ফোন করেছিলেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের আপ্ত সহায়ক জয়দীপ মুখোপাধ্যায়কে। তিনি জবাবে বলেছিলেন, ‘আর আমার কিছু করার নেই, পুলিশ ফোন ধরছে না।’
গভীর রাতে তপন ঘোষ, শুকুর আলির গ্রেফতার রক্তচাপ বাড়িয়ে দিয়েছিল পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার পার্টির। এমনকী মুজফফর আহমেদ ভবনেও। একদিকে নন্দীগ্রাম নিয়ে রাজ্য উত্তাল। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজে তমলুকে উপস্থিত। সংবাদমাধ্যমের কয়েকশো প্রতিনিধি সেই জেলায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছেন। সারাদিন টেলিভিশনে শুধুই নন্দীগ্রামের খবর। এরই মধ্যে যে কোনও সময় এসে পড়বে সিআরপিএফ। এ হেন পরিস্থিতিতে খেজুরিতে আটকে রয়েছে মাস্টারদার নেতৃত্বে গড়বেতা, কেশপুরের প্রায় ১৫০ যোদ্ধা। ঠিক ছিল ১০ তারিখ গভীর রাতেই তারা ফিরে যাবে পশ্চিম মেদিনীপুরে। কিন্তু তপন ঘোষ, শুকুর আলির গ্রেফতার এবং পূর্ব মেদিনীপুর জেলার চারদিকে তৃণমূল কংগ্রেসের রাস্তা অবরোধে সেই রাতে খেজুরি থেকে বেরোতে পারেনি গড়বেতা-কেশপুরের কেউই। কারণ, দুই নেতা নন্দীগ্রাম থেকে বেরনোর সময় ধরা পড়ে গেছেন, এখন প্রায় দেড়শো লোক, সঙ্গে এত বন্দুক গুলি। ধরা পড়ে গেলে সর্বনাশ হবে। সিপিআইএম রাজ্য নেতারা বুঝে যান, গড়বেতা, কেশপুর বাহিনীর একজনও অস্ত্রসমেত ধরা পড়ে গেলে আর সরকার চালানো যাবে না। তৃণমূল কংগ্রেস পুরো ঘাড়ে চেপে বসবে।
১১ তারিখ সকাল থেকে টেনশনে পড়ে যান পশ্চিম মেদিনীপুরের জেলা সিপিআইএমের নেতারা। একজনও যদি ধরা পড়ে যায় সর্বনাশ। প্রমাণ হয়ে যাবে বিরোধীদের দীর্ঘদিনের অভিযোগ, ‘বহিরাগত হার্মাদ নিয়ে নন্দীগ্রাম দখলে নেমেছে সিপিআইএম।’ একটা ভুলেই বিরোধীদের এই অভিযোগে শিলমোহর পড়ে যাবে পাকাপাকিভাবে। কীভাবে খেজুরির পার্টি অফিস থেকে মাস্টারদার নেতৃত্বে আটকে থাকা এতজনকে বের করে আনা হবে তা ভেবে মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছিল সিপিআইএমের শীর্ষ নেতাদের। এই গড়বেতা এবং কেশপুর বাহিনীকে আড়াল করতেই প্রবল সমালোচনা সত্বেও ১১ নভেম্বর বাইরের জগৎ থেকে নন্দীগ্রাম, খেজুরিকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছিল শাসক দল।
মূলত দুটো উদ্দেশ্যে। নন্দীগ্রাম পুর্নদখল খাতায়কলমে শেষ হলেও মাওবাদীরা তখনও কেউ সেখানে থেকে গিয়েছিল কিনা নিশ্চিত হতে পারেনি সিপিআইএম। সিপিআইএম জানত না, ১০ তারিখ সকালে মহেশপুরে মিছিল ছত্রভঙ্গ হয়ে যাওয়ার দু’ঘন্টার মধ্যেই তেলেগু দীপক এবং সুদীপ চোঙদার তাঁদের বিশ্বস্ত ৮-১০ জন সঙ্গীকে নিয়ে নন্দীগ্রাম ছেড়েছিলেন। তেরাপেখিয়া ঘাট হয়ে নদী পেরিয়ে। কিন্তু মাওবাদীদের খোঁজে সিপিআইএমের খেজুরির বাহিনী ১১ তারিখ সারাদিন নন্দীগ্রামের নানা জায়গায় তল্লাশি চালায়। দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ কারণ ছিল, মাস্টারদা এবং গড়বেতা, কেশপুরের ছেলেদের নিরাপত্তা। কীভাবে খেজুরি থেকে মাস্টারদা এবং এতজন ছেলেকে বের করা হবে তা ভেবে তখন পার্টির দিশেহারা অবস্থা। শুধু এতজন লোককে বের করলেই হবে না, তাদের সঙ্গে এত বন্দুক, গুলি, কোটি টাকার বেশি দাম। কীভাবে বের করে আনা হবে সেগুলোকে তা নিয়ে ১১ তারিখ সকাল থেকে দফায় দফায় আলোচনা শুরু হয়েছিল দুই মেদিনীপুর এবং সিপিআইএমের রাজ্য দফতরের গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের মধ্যে। শেষ পর্যন্ত মাস্টারদা তাঁর বাহিনী নিয়ে কীভাবে খেজুরি থেকে বেরিয়েছিলেন, তা বিস্তারিত লেখা সম্ভব নয়। কারণ, এই গোপন অপারেশনের কথা জানতেন মাত্র হাতে গোনা কয়েকজন। এটুকুই শুধু বলা যায়, ১১ তারিখও তাঁরা খেজুরি থেক বেরোতে পারেননি। পুরো পূর্ব মেদিনীপুর জেলা তখন উত্তাল। তার পরদিন, ১২ নভেম্বর রাতে রাজ্য পুলিশের মাঝের স্তরের ২-৩ জন অফিসার কালো কাচ লাগানো পুলিশের গাড়িতে চাপিয়ে মাস্টারদা এবং তাঁর পুরো বাহিনীকে খেজুরি থেকে বের করে চন্দ্রকোণা, গড়বেতায় পৌঁছে দিয়েছিলেন। এই ঘটনা যিনি আমাকে বলেন, তাঁর অনুরোধ ছিল, এই বিস্তারিত বিবরণ কোনওদিন কাউকে না বলতে।
বিরলতম ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা
কয়েকদিন ধরেই বিভিন্ন সূত্রে খবর আসছিল, সিপিআইএম বাহিনী বেপরোয়া আক্রমণ চালাচ্ছে নন্দীগ্রামে। তার সামনে যুদ্ধের রসদ ফুরিয়ে আসা তৃণমূল কংগ্রেস, মাওবাদী জোটের অবস্থা তখন ফাঁকা মাঠে একা পড়ে যাওয়া হরিণের মতো, যাকে চারদিকে ঘিরে ফেলেছে নেকড়ের দল। নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও হরিণ ছুটে বেড়াচ্ছে এদিক- ওদিকে। এরই মধ্যে ১০ তারিখ ভূমি উচ্ছেদ কমিটির মিছিলে সিপিআইএমের গুলি চালানো, তাতে কয়েকজনের মৃত্যু এবং সবশেষে গড়বেতার দুই নেতা তপন ঘোষ, শুকুর আলির গ্রেফতার, সিপিআইএমের সব প্ল্যানিংয়ে জল ঢেলে দিল। নভেম্বরের শুরু থেকে চারিদিক আড়াল করে যে অপারেশন শুরু হয়েছিল, তা নিয়ে রাজ্যজুড়ে আলোচনা শুরু হলেও, কোনও হতাহত না হওয়ায় বিশেষ প্রতিক্রিয়া হচ্ছিল না। বিরোধীরা অভিযোগ করছে, শাসক দল আক্রমণ চালাচ্ছে, এর বাইরে খুব একটা কিছু জানা যাচ্ছিল না নন্দীগ্রাম সম্পর্কে। স্বাভাবিকভাবেই বিশেষ কিছু জানতে পারছিলেন না রাজ্যের সাধারণ মানুষও। কিন্তু ১০ নভেম্বর দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া ভুমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটির কৌশল, নন্দীগ্রামবাসীর বেপরোয়া মিছিল এবং গ্রামবাসীদের হতাহতের ঘটনায় চরম বেকায়দায় পড়ে গেল শাসক দল।
নন্দীগ্রামে সিপিআইএম বাহিনী যে তিনদিক দিয়ে ঘিরে সাঁড়াশি আক্রমণ চালাচ্ছে সেই খবর আমি পেয়েছিলাম নভেম্বরের ৫-৬ তারিখ নাগাদ। সিপিআইএম যে দু’চার দিনের মধ্যেই অপারেশন শেষ করে ফেলতে চাইছে তা আগে জানা কিংবা বোঝা যায়নি। কারণ, সিপিআইএম এবং ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটির মধ্যে গুলি বিনিময় মাঝে মধ্যেই হোত। নভেম্বরেরর ২-৩ তারিখ থেকেও সেরকমই হচ্ছিল, তাই সিপিআইএম যখন প্রায় বিনা বাধায় সাতেঙ্গাবাড়ি দখল করেছিল তখনও কলকাতায় বসে বুঝতে পারিনি, শাসক দলের আসল প্ল্যানিংটা কী। প্রথম বোঝা গেল ৫ তারিখ, যখন জেলার কিছু সাংবাদিক নন্দীগ্রামে ঢুকতে গিয়ে সিপিআইএমের কাছে বাধা পেলেন। নভেম্বরের ৪ বা ৫ তারিখ আমার জ্বর হয়। ভাইরাল ফিভার। তার আগে জানুয়ারি থেকে আমি বারবার অফিসের অ্যাসাইনমেন্টে নন্দীগ্রাম গিয়েছি। ছুটি নিয়ে বাড়িতে ছিলাম, ৬ তারিখ অফিস থেকে ফোন আসে, নন্দীগ্রাম যেতে হবে। যাওয়ার জন্য ছটফট করছি, কিন্তু শরীরের যা অবস্থা, যাওয়া অসম্ভব। অফিসে জানিয়ে দিলাম, একটু সুস্থ হলেই যাব। ২-৩ দিন সময় চাই। অফিস থেকে আমার সহকর্মী দীপক ঘোষ নন্দীগ্রামে যান।
বাড়িতে বসে হাত কামড়ানো ছাড়া আর কিছু করার নেই। ব্যক্তিগত আগ্রহেই বাড়িতে বসে অনবরত ফোনে নন্দীগ্রাম সহ পূর্ব মেদিনীপুরে আমার পরিচিতদের কাছে খবর নিতে শুরু করি। নন্দীগ্রাম এবং খেজুরিতে স্থানীয় স্তরে সিপিআইএমের বেশ কিছু কর্মীর সঙ্গে আমার ততদিনে রীতিমতো ভালো সম্পর্ক। তারা আমাকে নানা খবর দিয়ে সাহায্য করত। ৯ তারিখ সিপিআইএমের নন্দীগ্রামের এরকমই এক স্থানীয় কর্মীকে ফোন করেছিলাম। তিনি আমাকে যথেষ্ট বিশ্বাস করতেন। ফোনেই আমাকে গুলির শব্দ শুনিয়েছিলেন। তারপর বলেছিলেন, অপারেশন শেষ। পুরো নন্দীগ্রাম দখল শুধু সময়ের অপেক্ষা। সেইদিনই অফিসে ফোন করে জানালাম, পরদিন, মানে ১০ তারিখ নন্দীগ্রাম যাব। এরই মধ্যে দীপক এবং অন্য সংবাদমাধ্যমাধ্যমের প্রতিনিধিরা একাধিকবার নন্দীগ্রামে ঢোকার চেষ্টা করেন। একদিন পাহারা দেওয়ার ক্যাম্প থেকে বেরিয়ে সিপিআইএমের ছেলেরা দীপক এবং ওঁর ক্যামেরাম্যানকে তাড়া করে।
১০ তারিখ যখন মহেশপুরে মিছিল এবং তাতে গুলি চলে তার কিছু পরে আমি কলকাতা থেকে রওনা দিয়েছিলাম। সকালে বেরবো ঠিক করেছিলাম, কিন্তু অফিস থেকে বেরতে কিছুটা দেরি হয়ে যায়। এবার আমার সঙ্গী ক্যামেরাম্যান পার্থপ্রতিম রায়। বিকেলে আমার পৌঁছোই কোলাঘাট। কোলাঘাটের মোড় থেকে বাঁদিকে গাড়ি ঘুরিয়ে একটু এগোলেই মেচেদা। মেচেদা বাজারের ঠিক আগে রাস্তা বন্ধ। সিপিআইএমের কয়েক’শো ছেলে বাঁশ, লাঠি হাতে রাস্তা অবরোধ করেছে। মেচেদা থেকে নন্দীগ্রামে প্রবেশ পথ চন্ডিপুর অন্তত ৬০-৭০ কিলোমিটার দূর। বুঝতেই পারিনি অবরোধের কারণটা কী? দেখছি সিপিআইএমের ছেলেরা সব গাড়ি ঘুরিয়ে দিচ্ছে। প্রথমে ভেবেছিলাম, কোনও অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে, নিশ্চয়ই সংবাদমাধ্যমে গাড়ি যেতে দেবে। কিন্তু একটু এগোতেই ভুল ভাঙল, আমাদের গাড়িতে প্রেস স্টিকার দেখেই রে রে করে তেড়ে এল সিপিআইএমের ছেলেরা। কিছু বোঝার আগেই চিৎকার, গালিগালাজ। ‘মিডিয়ার জন্যই সমস্ত সর্বনাশ হয়েছে, নন্দীগ্রামে বাইরের লোক এনে গণ্ডগোল করছে মিডিয়া,’ আমাদের গাড়ি ঘিরে তখন বলতে শুরু করেছে সিপিআইএমের ক্যাডার বাহিনী। কিছু ছেলে তো রীতিমতো মারমুখী। তখনও আমার কাছে পুরো পরিষ্কার নয়, নন্দীগ্রাম থেকে এত দূরে মেচেদায় কেন বিক্ষোভ-অবরোধ করছে সিপিআইএম।
চলবে
(১৮ সেপ্টেম্বর থেকে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হচ্ছে নন্দীগ্রাম আসলে যা ঘটেছিল। প্রতি পর্বে লাল রং দিয়ে আগের পর্বের লিঙ্ক দেওয়া থাকছে)
Comments are closed.