লালগড় আন্দোলন এবং তার মোকাবিলায় পুলিশি অভিযান একুশ শতকের প্রথম দশকে এরাজ্যের রাজনীতিতে বলা যেতে পারে সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ এবং রোমহর্ষক ঘটনা। দিনের পর দিন এই আন্দোলন এবং পুলিশ-প্রশাসনের নানা কর্মকাণ্ড চোখের সামনে দেখে ভাবনা ছিল তাকে লিপিবদ্ধ করার। কারণ, এই ঘটনা বাংলার রাজনীতিতে এক মূল্যবান দলিল। এর বছর বাদে কেন তা নিয়ে বই লিখলাম, সেই প্রশ্নও তুলছেন কেউ কেউ। আসলে ইতিহাসকে সমকালে বিচার না করে দেখে নিতে চেয়েছিলাম আরও কয়েকটা বছর। তাই এত বছর পর এই বই ‘অপারেশন কেবিসি’।
সে সময় চোখের সামনে রোজ যা ঘটে যেত, তার প্রত্যেকটা ঘটনা ধরেই এক একটা সিনেমা তৈরির মশলা ছিল। ২০০৮ সাল থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত যাঁরা লালগড় আন্দোলনের খবরাখবর রেখেছেন, তাঁরা জানেন, তৎকালীন শাসক দলের ব্যর্থতায় মাওবাদী আন্দোলন এরাজ্যে ঠিক কোন পর্যায়ে পৌছে গিয়েছিল। ছত্তিশগড়ের যে মাওবাদী আন্দোলনের সঙ্গে আমরা পরিচিত, রায়পুর থেকে তার দূরত্ব ছিল কমপক্ষে ৩০০ কিলোমিটার। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের আন্দোলনের আঁতুর ঘর গড়ে উঠেছিল মহাকরণ থেকে মাত্র ১৮০ কিলোমিটার দূরে। তার আগে প্রায় পাঁচ বছর ধরে মাওবাদীরা গোপনে যে কাজকর্ম চালিয়ে গিয়েছে তা গোয়েন্দা দপ্তরের ব্যর্থতায় সরকারের কানে পর্যন্ত পৌঁছোয়নি। অথচ মাওবাদী আন্দোলন যে গোকুলে বেড়ে উঠছিল, তার স্পষ্ট ইঙ্গিত ছিল ২০০৩ সালে বান্দোয়ানের ঘটনায়। পুলিশকে ফাঁদে ফেলে স্থানীয় থানার ওসি নীলমাধব দাসকে গুলি করে খুন করে জনযুদ্ধ গোষ্ঠী। এর ঠিক পরের বছর জনযুদ্ধ এবং এমসিসি (মাওয়িস্ট কমিউনিস্ট সেন্টার) একত্রিত হয়ে গড়ে ওঠে সিপিআই (মাওবাদী)। দলের পক্ষ থেকে পশ্চিমবঙ্গের দায়িত্ব দিয়ে পাঠানো হয় কোটেশ্বর রাও ওরফে কিষেণজিকে।
২০০৭ সালের নন্দীগ্রাম বা সিঙ্গুর আন্দোলনে মাওবাদীদের সক্রিয় উপস্থিতির কথা জানতে পেরেও সরকারি স্তরে কোনও কড়া পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। শেষ পর্যন্ত ২০০৮ সালের নভেম্বর মাসে মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের কনভয়ে মাওবাদীদের বিস্ফোরণের ঘটনা আরও একবার বেআব্রু করে দেয় পুলিশ প্রশাসনকে।
আমি প্রথমবার লালগড় আন্দোলন কভার করতে গিয়েছিলাম ২০০৮ সালের নভেম্বর মাসে। তখন থেকেই বলতে গেলে মাওবাদীরা আন্দোলনের রাশ নিজেদের হাতে তুলে নিয়েছিল। সেটাও অবশ্য যতটা দ্রুততার সঙ্গে হয়েছিল রাজনৈতিক অথবা প্রশাসনিক স্তরে কার্যত কোনও বাধা না পেয়ে। বিষয়টা এতটাই লাগামছাড়া ছিল যে, ২০০৯ সালের লালগড়ে মাওবাদীরা ধরমপুরে তিনদিন ধরে সিপিএমের ‘হার্মাদ’ বাহিনীর সঙ্গে গুলির লড়াই চালিয়ে এলাকার দখল নিয়ে নেয়। স্থানীয় সিপিএম নেতারা সে সময় লুকিয়ে থাকা অবস্থায় আক্ষেপ করতেন এটা বলে যে, যখন ধরমপুরে তাঁদের সশস্ত্র লোকেরা লড়াই চালাচ্ছে সে সময় মহাকরণ থেকে নির্দেশ যায় পাল্টা প্রতিরোধ বন্ধ করতে। জেলা নেতাদের অনুরোধকে অগ্রাহ্য করে হার্মাদদের সরে যেতে বলায় মাওবাদী নেতা বিকাশের দল ওখানে ঘাঁটি গেড়ে ফেলে। সোজা কথায় বলতে গেলে পুলিশ বয়কটের ডাক দিয়ে প্রশাসনকে ঠুঁটো জগন্নাথ বানিয়ে দেওয়া হয়েছিল। সে বছর জুন মাসে বাধ্য হয়ে সরকার কেন্দ্রীয় বাহিনী নামায় জঙ্গলমহল এলাকায়। সেপ্টেম্বর মাসে পুজোর সময় কলকাতা পুলিশের এসটিএফ সাংবাদিক সেজে গ্রেপ্তার করে পুলিশি সন্ত্রাস বিরোধী জনসাধারণের কমিটির নেতা ছত্রধর মাহাতকে। সেই অপারেশন চালানো হয়েছিল সাংবাদিক সেজে। কিন্তু পুলিশ কি একজন সাংবাদিকের ছদ্মবেশ নিয়ে এই কাজ করতে পারে? প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। কিন্তু আর যাই হোক এর সঙ্গে এথিক্স বলে শব্দটা জুড়লে তা সম্ভবত ভুল ব্যাখ্যা করা হবে। প্রেমে আর যুদ্ধে অন্যায় বলে কিছু হয় না।
মাওবাদী এবং পুলিশ এই যুযুধান দু’পক্ষ সেসময় যেভাবে লড়াই করেছে তা কোনও নিয়ম মেনে হয়নি। সত্যি কথা বলতে গেলে, ওই সব রক্তঝরা দিনে চোখের সামনে যা যা ঘটেছে তা নিয়ে প্রায় ১১ বছর পর সিনেমা তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সিনেমাটি প্রযোজনা করা শুধু নয়, অভিনয় করছেন অভিনেতা দেব। পরিচালক অনিকেত চট্টোপাধ্যায়। আর এই সিনেমা তৈরি হবে আমারই লেখা ‘অপারেশন কেবিসি’ বইটিকে ঘিরে। মূলত কলকাতা পুলিশের এসটিএফের কাজকর্ম নিয়ে বইটি লেখার সময় উঠে এসেছে এই অপারেশনের বৃত্তান্ত।
অনেকেই আমাকে প্রশ্ন করেছেন, এখন এই বই কেন? আসলে প্রতিটি আন্দোলন এবং তার পরবর্তী রাজনৈতিক প্রভাব কাটাতে খানিকটা সময় কেটে যায়। আর পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে বিষয়টা তো আরও গুরুত্বপূর্ণ এই কারণে যে, এর ঠিক পর পর সরকারে পরিবর্তন আসে। সব মিলিয়ে বেশ কিছু বিস্ময়কর তথ্যও এই বইতে সামনে আনা হয়েছে। কেন সরকার কিষেণজিকে ধরতে তেমন সক্রিয় হয়নি? কেন বারবার ভুল স্ট্র্যাটেজি নেওয়া হয়েছে জঙ্গলমহলের ক্ষেত্রে? বহু প্রশ্নের জবাব তখন যেমন পাওয়া যায়নি। আজও সে বিষয়ে কখনও ব্যাখ্যা দেয়নি সেই সরকার, যারা এখন আর ক্ষমতায় নেই। তবু লোকে অনেক কিছু জানতে চায়। তাদের জন্যই আমার এই বই লেখা।
Comments are closed.