লেগাসী, অ্যা রয়্যাল লেগাসী!
হ্যাঁ সত্যি, লেগাসীই বটে। কলকাতা তথা ভারতবর্ষে হর্স রেসের একটা রাজকীয় ব্যাপার তো আছেই। যাকে বলা যেতে পারে, ‘অ্যা রয়্যাল লেগাসি’।
সালটা ১৯৬৬, এপ্রিল মাসের ১ তারিখ। কলকাতায় প্রচণ্ড গরম পড়েছে, শহরে তাপমাত্রার পারদ চড়ছে। মাথা ঠান্ডা রাখা রীতিমতো কঠিন। আর মাথাটা ঠান্ডা রাখতে না পেরেই কলকাতার রেসকোর্সের গ্যালারি ভর্তি দর্শকের সামনে দাঁড়িয়ে উত্তম কুমারকে সপাটে চড় কষিয়েছিলেন সুপ্রিয়া দেবী। ভাবছেন, এরকম কোনও ঘটনা আদৌ কি ঘটেছিল? অথচ ঘটলেও আপনার গোচরে নেই!
প্রথমত, তারিখটা ১ লা এপ্রিল, আর দ্বিতীয়ত, সিনেমাটির নাম ‘শুধু একটি বছর’। যেটি আবার মুক্তি পেয়েছিল ১৯৬৬ সালের ১ লা এপ্রিল। উপরের ঘটনাটি উক্ত সিনেমার শুধু একটা দৃশ্যমাত্র।
কিংবা, দিদির বাড়িতে ঘুরতে এসে জামাইবাবুর সঙ্গে সশরীরে কলকাতা রেসকোর্সে উপস্থিত হয়েছিলেন শর্মিলা ঠাকুর। জামাইবাবু অবশ্য প্রায়শই যেতেন রেসের মাঠে আর ঘোড়ার ওপর বাজিও ধরতেন। তিনি ছিলেন পাক্কা খিলাড়ি। কিন্তু শর্মিলা দেবী তো আর পাকাপোক্ত খেলোয়াড় নন, তাই ঘোড়ার নাম দেখে বাজি ধরলেন। এতে যা হয় আর কী, সেটাই হল। তিনি গেলেন হেরে, আর তারপরই বলে উঠলেন, ‘আবার খেলবো’। মণি শংকর মুখার্জির উপন্যাস ‘সীমাবদ্ধ’ অবলম্বনে সত্যজিত রায় পরিচালিত সীমাবদ্ধ সিনেমার একটা ছোট্ট দৃশ্য এটি। তাছাড়া হালফিলের ‘ওয়ান্স আপন অ্যা টাইম ইন মুম্বই’ ফিল্মের কথাই ধরুন, সেখানেও রেসকোর্সের দৃশ্য দেখা গেছে। এক্ষেত্রে রেসকোর্সের দৃশ্যের প্রেক্ষাপট অবশ্য মুম্বই শহর। এরকম অসংখ্য সিনেমায়, গল্পে, উপন্যাসে বারবার রেসকোর্সের দৃশ্য দেখানো হয়েছে। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে ঘোড়-দৌড়ের নানান ছবি। এক সময় তো বটেই, আজও বহু মানুষ বা পরিবারের কাছেই রেসের মাঠ এক ‘নিষিদ্ধ’ শব্দ। কিন্তু কেন তা নিষিদ্ধ? রেসের মাঠ মানে কি স্রেফ জুয়া খেলা? শুধু বাজি ধরা আর তারপর সর্বস্বান্ত হওয়ার গল্প? না। আসলে কলকাতার রেসের মাঠের পরতে-পরতে জড়িয়ে রয়েছে এক ইতিহাস, ঐতিহ্য, বড়লোকি মেজাজ আর একদিনে ফকির বা নবাব বনে যাওয়ার অজস্র কাহিনী। আর সবার ওপরে সেই ‘রয়্যাল লেগাসী’, যা এক গম্ভীর সম্ভ্রমের মায়াজাল তৈরি করে রেখেছে, যা ভেদ করার সাহস নেই সবার। আর তাই তো বছরে ৩২০ দিন রেসের মাঠের পাশ দিয়ে যাতায়াত করেছেন, অথচ মাঠে ঢোকেননি এমন মানুষের সংখ্যা, যাঁরা মাঠে ঢুকেছেন তার চেয়ে ঢের ঢের বেশি।
তবে আমাদের ফেলু মিত্তিরকে খুব একটা ঘোড়ার রেসের মাঠের কথা উল্লেখ করতে দেখা যায়নি। কিন্তু হ্যাঁ, ব্যোমকেশ বক্সী অবশ্য রাখঢাক না রেখে যথার্থই বলেছিলেন, তৎকালীন সময়ে কলকাতায় মদের ঠেকের থেকেও বড় নেশা ছিল রেসের মাঠের জুয়া।
আচ্ছা জিন ডিয়াস-এর নাম শোনা আছে? জন্মসূত্রে তিনি আমেরিকার অধিবাসী, আর পেশাগতভাবে তিনি ছিলেন একজন ব্রিজ প্লেয়ার। ভারতবর্ষের সঙ্গে তাঁর দূর-দূরান্ত পর্যন্ত কোনও সম্পর্ক ছিল না। কিন্তু ভারতবর্ষের ঘোড়ার দৌড়ের ইতিহাস নিয়ে লিখে ফেললেন একখানা গোটা বই, যার নাম দিলেন ‘Horse Racing in India: A Royal Legacy’।
ইতিহাস তো কথা বলে। আর সেই ইতিহাস বলছে, প্রাচীন ভারতবর্ষে ঘোড়ার আমদানি হত পারস্য থেকে। চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের সেনাবাহিনীতে ছিল প্রায় ৮০ হাজার অশ্বারোহী। সুলতানী যুগে আলাউদ্দিন খলজীর আমলে সুলতান স্বয়ং বাজারে ঘোড়ার দাম বেঁধে দিয়েছিলেন। এই যেমন, উৎকৃষ্ট ঘোড়ার দাম ছিল ১০০ থেকে ১২০ টঙ্কা, নিকৃষ্ট ঘোড়ার দাম ছিল ৮০ থেকে ৯০ টঙ্কা। আর টাট্ট ঘোড়ার দাম ছিল মাত্র ১০ থেকে ২৫ টঙ্কা। মধ্য যুগে দক্ষিণ ভারতের অন্যতম প্রসিদ্ধ নগরী ছিল বিজয়নগর সাম্রাজ্য, আর এখানে ঘোড়া আসতো সুদূর পর্তুগাল থেকে। অর্থাৎ, ভারতের ইতিহাসে ঘোড়ার স্থান সব সময় একটা অন্য জায়গায় ছিল। আর হবে নাই বা কেন, যুদ্ধবিগ্রহে ঘোড়ার অবদান তো অনস্বীকার্য। তাছাড়া, রাজ-রাজাদের অবসর সময়ে বিনোদনের জন্য তো ঘোড়ার দৌড় আয়োজন করা ছিল তখনকার দিনের এক রেওয়াজ।
অবশ্য ভারতে হর্স রেসের প্রবণতা বৃদ্ধি পেতে শুরু করল ব্রিটিশ আমলে। প্রথম ঘোড়ার দৌড় শুরু হল মাদ্রাজে, সালটা ১৭৭৭। আর ১৭৯৯ সাল নাগাদ ঘোড়ার দৌড়ের জন্য তৈরি করা হল আলাদা রেস ট্র্যাক। ১৮০০ সালে বোম্বাইতে চার্লস ফোবস, জি হল প্রমুখেরা মিলে প্রতিষ্ঠা করলেন বোম্বাই টার্ফ ক্লাবের। ১৮১৯ সালে পুনেতে প্রথমবারের মতো ঘোড়ার দৌড় আয়োজন করা হয়েছিল। বাঙ্গালোর টার্ফ ক্লাবের প্রতিষ্ঠা অবশ্য অনেকটাই দেরিতে, ১৯২০ সাল নাগাদ। ১৮৪৬ সাল নাগাদ আগা খানের পরিবারে ছিল তখনকার দিনে বেশ সুপ্রতিষ্ঠিত একাধিক ঘোড়সওয়ার, যাঁরা ভাইসরয় কাপের মতো গুরুত্বপূর্ণ টুর্নামেন্ট জিতেছিলেন। ইন্দোরের মহারাজা প্রতাপ সিংহ নিজেই ছিলেন তৎকালীন যুগে দেশের বিখ্যাত ঘোড়সওয়ারদের মধ্যে একজন।
পলাশির যুদ্ধের পর থেকেই বাংলায় ইংরেজদের আগমন বৃদ্ধি পেতে থাকে। সেনাবাহিনীর জন্য বেস ক্যাম্পও তৈরি করা হয়। এই সেনাবাহিনী অবসর সময়ে বিনোদনের জন্য ঘোড়ার দৌড়ের প্রতিযোগিতা শুরু করেছিল। কলকাতার নিকটে আকরা নামক জায়গায় মোটামুটিভাবে ১৭৬৯ সালের জানুয়ারি নাগাদ একটা ঘোড়ার দৌড় আয়োজন করা হয়েছিল, কিন্তু এটা ছিল শুধুমাত্র খেলার ছলে। এরপর এইভাবেই প্রায় চার দশক ধরে হর্স রেস চলতে থাকল, আর সময়ের সাথে সাথে ঘোড়দৌড়ের জনপ্রিয়তাও বাড়তে থাকল। ইতিমধ্যে লর্ড ওয়েলেসলি কলকাতায় আসলেন গর্ভনর জেনারেল হয়ে। ১৭৯৮ সাল নাগাদ পশুপ্রেমী ওয়েলসলি ঘোড়ার দৌড়ের যবনিকা টানলেন। বন্ধ হল ঘোড়ার দৌড়। কিন্তু বন্ধ বললেই কি বন্ধ করা যায়? খেলাপ্রেমী মানুষের কাছ থেকে খেলা কেড়ে নেওয়া কি অতই সহজ ব্যাপার? না। ১৮০৩ সালে প্রতিষ্ঠা করা হল বেঙ্গল জকি ক্লাব এবং এরা নিজেদের অনুশীলনের জন্য ময়দান চত্বরটা বেছে নিল। বেঙ্গল জকি ক্লাবের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল ইংল্যন্ডের জকি ক্লাবের। ১৮১২ সাল নাগাদ নতুনভাবে রেসকোর্স গড়ে তোলা হল বর্তমান রেস কোর্সের জায়গাতেই। কিন্তু কলকাতার রেসের ক্ষেত্রে সবথেকে যুগান্তকারী ঘটনা সম্ভবত তখনই হল, যখন প্রতিষ্ঠা করা হল ক্যালকাটা টার্ফ ক্লাবের। সালটা ১৮৪৭, ঠিক ভারত স্বাধীনতা পাওয়ার একশো বছর আগে। পাঁচ কমিটির সদস্য ক্লাব পরিচালনা করার দায়িত্বে ছিলেন। আর রেস তত্বাবধানের দায়িত্বে ছিলেন পাঁচজন স্টূয়ার্ড। এখনও পর্যন্ত অবশ্য এই স্টূয়ার্ডরাই রেস পরিচালনা করে আসছেন। ১৮৫৬ সালে ক্যালকাটা ডার্বি বন্ধ করে চালু করা হল ভাইসরয় কাপ। তখন এই কাপ দেখার সুযোগ পেতেন শুধুমাত্র তাঁরাই, যাঁদের আমন্ত্রণ করা হোত।
কিন্তু কলকাতায় হর্স রেসের এক ব্যাপক পরিবর্তন হল ১৮৬০ সাল নাগাদ। লর্ড উলরিখ ব্রাউন, অনেকের কাছেই এই নামটা অজানা। তৎকালীন সময়ে তিনি ছিলেন আইসিএস অফিসার। যাঁর একার উদ্যোগে কলকাতায় ঘোড়ার দৌড় এক অন্য মাত্রা লাভ করল। ১৮৭২ সাল নাগাদ প্রথমবার টোটে উপস্থাপিত করা হল এবং সেই বছরই প্রথম মুনসুন রেসও চালু হল। ১৮৮০ সাল থেকে সকালের বদলে দুপুরে রেস করার সিদ্ধান্ত নিল কর্তৃপক্ষ আর তার সঙ্গে সেই বছরই প্রথমবারের মতো পোলো খেলারও আয়োজন করা হয়েছিল। ইতিমধ্যে ক্যালকাটা টার্ফ ক্লাবের দায়িত্ব গ্রহণ করলেন স্যর উইলিয়াম ম্যাকফেরসন, রেসের মাঠে যাঁর অবদান অনস্বীকার্য।
সালটা ১৮৮৯, ক্যালকাটা টার্ফ ক্লাবের অধীনে চলে এল প্রায় নয় নয় করে দেশের বাহান্নটি রেসের মাঠ। অবশ্য দক্ষিণ ভারতের রেসের মাঠগুলো দেখাশোনা করত বোম্বাই টার্ফ ক্লাব। ইতিমধ্যে ভারতীয়দের জন্যও খুলে দেওয়া হয়েছিল রেসের মাঠের দরজা। ক্যালকাটা টার্ফ ক্লাবের মুকুটে আরও একটি স্বর্ণ পালক যুক্ত হল ১৯০৫ সালে, যখন ইংল্যন্ডের রাজা পঞ্চম জর্জ প্রথমবারের মতো ক্লাবে আসলেন। এর ঠিক বছর সাতেক পরে ১৯১২ সালে আবার রাণী মেরীকে সঙ্গে নিয়ে ক্লাবে এসেছিলেন রাজা স্বয়ং। আর সেই বছরই ক্যালকাটা টার্ফ ক্লাবের নামের আগে যুক্ত হল ‘রয়্যাল’ শব্দটি। ক্লাবের নতুন নাম হল ‘রয়্যাল ক্যালকাটা টার্ফ ক্লাব’।
এরপর সময় গড়িয়েছে নিজের গতিতে। দেশ স্বাধীনতা পেয়েছে, রেসের মাঠেরও উত্থান-পতন ঘটেছে। প্রথমদিকে অবশ্য সমাজের এলিট গোষ্ঠীর মধ্যে ঘোড়ার রেস জনপ্রিয় ছিল। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তারও পরিবর্তন হয়েছে। কথায় আছে, কলকাতার অলিতে গলিতে ইতিহাস রয়েছে, আর এই রেসের মাঠ তো ইতিহাসের আঁতুড় ঘর। রেসের মাঠে গেলে আপনার ইচ্ছে করবেই ঘোড়ার উপর বাজি ধরতে। যদি এমনটা হয়, আপনার মন সায় দিল না বাজি ধরতে, তখন? তখন না হয় রয়্যাল ক্যালকাটা টার্ফ ক্লাবে ইতিহাসের গন্ধ মাখা সুবর্ণ অতীতটা অনুভব করলেন। রবি ঠাকুর বলে গিয়েছিলেন, ‘কোনওদিন এতো বুড়ো হবো নাকো আমি!’ না, কলকাতা রেসকোর্স দুশ বছরেও বুড়ো হয়নি, চাকচিক্য কিছু কমলেও, রেসকোর্স তার নীরব ইতিহাস আর আভিজাত্য আজও বহন করে চলেছে মাত্র।
কথায় আছে Everything is fair in love and war.This race is also none less than a war.
এই রেসের মাঠ তো একটা যুদ্ধক্ষেত্র বটেই। রেসের মাঠে ঢুকতে খরচ করতে হয় মাত্র কুড়িটি টাকা। গেটে ঢোকার মুখেই আপনি দেখতে পাবেন, সবাই একটা চটি বই হাতে নিয়ে পড়ার চেষ্টা করছে আর কিছু একটা লেখালিখি করছে। আসলে এই বইটিতে সারাদিনের রেসের বিবরণ দেওয়া রয়েছে। দিনে কতগুলো রেস হবে, কোন কোন ঘোড়া দৌড়াবে আর কোন ঘোড়সওয়ারই বা রেসে অংশগ্রহণ করবেন, তার সবই এই বইটিতে পেয়ে যাবেন। রেসের মাঠে মোবাইল ফোন নিয়ে ঢোকা যায় না। তা জমা রাখার ব্যবস্থাও রয়েছে। তবে যদি মোবাইল ফোনটি একান্তই সাথে রাখতে চান তার জন্য আপনার পকেট থেকে খসবে আরও দেড়শোটি টাকা। যার বিনিময়ে আপনি আপনার মোবাইল ফোন নিজের কাছে রাখতে পারেন এবং প্রমাণস্বরূপ কর্তৃপক্ষ আপনার হাতে একটা সাদা ব্যান্ড পরিয়ে দেবে।
কলকাতা রেসের মাঠে দু’রকমভাবে বাজি ধরা হয়। একে জুয়াও বলা যেতে পারে, তবে এই জুয়া অবশ্য আইনসিদ্ধ। রেসকোর্সের ভিতর ঢুকলেই সামনে একটা বিরাট জায়গা চোখে পড়বে আপনার, যেখানে অসংখ্য মানুষ উপস্থিত আর যাদের চোখে মুখে উত্তেজনার ছাপ স্পষ্ট। প্রায় সবার হাতে একটা বুকলেট, শেষ মুহূর্তে দেখা নেওয়া, কোন ঘোড়ার ওপর বাজি ধরা যায়! শুধু ঘোড়া কেন? জকিরাও এই রেসের অন্যতম এবং গুরুত্বপূর্ণ কারিগর। আর এখানেই গ্যাম্বল। ভালো জকির হাতে যে ভালো ঘোড়াটা পড়বে, তা নাও হতে পারে। কিংবা ঘোড়া ভালো অথচ জকিটি মাঝারি প্রকৃতির, এমন ঘটনা তো হামেশাই ঘটে থাকে। তাই দেখে-শুনে সব কিছু বিচার করেই বাজি ধরা হয়ে থাকে। অবশ্য যাঁরা প্রতিনিয়ত আসেন তাঁরা এবিষয়ে বেশ পাকাপোক্তও বটে।
(চলবে)
(কীভাবে হয় রেসের মাঠে খেলা, কী তার নিয়ম-কানুন, কারা নিয়মিত যান মাঠে, কেমন তাঁদের অভিজ্ঞতা? পড়ুন পরের পর্বে, আগামী মঙ্গলবার)
(ছবিঃ দিব্যরুপ রায় এবং সপ্তর্ষি চৌধুরী)
Comments are closed.