মোটামুটিভাবে ১৬৯০ সাল নাগাদ কলকাতা শহরের গোড়াপত্তন করেন জোব চার্নক মহাশয়। ১৬৯৮ সালে ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তৎকালীন জমিদার সাবর্ণ চৌধুরীর কাছ থেকে কিনে নিল হুগলি নদীর তীরের তিন তিনটি গ্রাম সুতানুটি, গোবিন্দপুর আর কলকাতা। হ্যাঁ, কলকাতাকে তখন গ্রাম বলেই চিহ্নিত করা হোত। তার ঠিক পর থেকেই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কলকাতাকে আধুনিক করার জন্য পরিকল্পনা গ্রহণ করল। মূল লক্ষ্য ছিল, কলকাতাকে প্রেসিডেন্সি শহর হিসেবে গড়ে তোলা। এর পাশাপাশি প্রয়োজনের তাগিদে গড়ে উঠতে থাকল একের পর রাস্তা। আজকের কলকাতার মতো এত রাস্তা অবশ্য তখন গড়ে ওঠেনি, কিন্তু তা সত্ত্বেও আজকের কলকাতার একাধিক রাস্তা সেই দিনেও বিদ্যমান ছিল। পরবর্তীকালে এই সব রাস্তার সংকোচন-প্রসারণ ঘটেছে মাত্র।
এই যেমন পার্ক স্ট্রিট, যা আজকের বাঙালির খানা-পিনার আঁতুড়ঘর। কিন্তু সেদিনের পার্ক স্ট্রিট কেমন ছিল?
এলিজা ইম্পের নাম শুনেছেন? সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি ছিলেন এই ইম্পে সাহেব। ইম্পে সাহেব এক সুবৃহৎ উদ্যান বাড়িতে বসবাস করতেন, আর এই বাড়ি ঘিরে ছিল এক বিশাল পার্ক, যা থেকেই এই রাস্তার নাম হয় পার্ক স্ট্রিট। কিন্তু জানেন কি, ইম্পে সাহেবের এই উদ্যান বাড়ি কোনটি? এই বিশাল উদ্যান বাড়িই আজকের লরেটো স্কুল। এই চত্বরটিতে তখন ছিল ঘন জঙ্গল। ইম্পে সাহেবের বাড়ির পরিচারকরা রাত হলে ভয়ে বাইরে বেরোতেন না, আর এখন যত রাত বাড়ে পার্ক স্ট্রিট তত আলোকিত হয়। শুধু কি তাই! যেমন ধরুন, সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ, যা পার্ক স্ট্রিটে অবস্থিত। এক কালে এখানে নাকি একটা থিয়েটার ছিল, যার নাম ছিল ‘sans souci’। মিসেস লিচ নামে এক অভিনেত্রীর কথা জানা যায়, যিনি ছিলেন এখানকার নামজাদা অভিনেত্রী।
আচ্ছা, বহুবার তো থিয়েটার রোড দিয়ে যাতায়াত করা হয়েছে। নাম শুনে এটুকু বোঝা যেতেই পারে, এই নামের উৎপত্তির মূলে রয়েছে থিয়েটার। ঠিকই, এখানে একটা বিরাট থিয়েটার ছিল। ১৮১৯ থেকে ১৮৩৯ সাল পর্যন্ত যেখানে নিয়মিত নাটকের আসরও বসতো। যাঁরা অভিনয় করতেন, তাঁদের থাকার ব্যবস্থাও ছিল এখানে। কিন্তু কী নির্মম পরিহাস, একদিন থিয়েটারটি গেল পুড়ে, তারপর আর নতুন করে থিয়েটার গড়ে তোলা হল না। কিন্তু তাতে কী, সেই সময় থেকেই এই রাস্তার নাম হয়ে গেল থিয়েটার রোড!
পার্ক স্ট্রিট ক্রসিং থেকে পার্ক স্ট্রিট ধরে কিছুটা এগিয়ে বাঁ দিকে গেলে পড়বে ফ্রি স্কুল স্ট্রিট। নামের মধ্যেই যেন কীরকম একটা স্কুল স্কুল গন্ধ। আসলে মশাই ১৭৮০ সালে এখানে ছিল বাঁশের জঙ্গল। তবে স্কুল? হ্যাঁ, সেটাও ছিল। ১৭৮৯ সালে সাহেবরা এখানে একটা ফ্রি স্কুল গড়ে তুলল। তা থেকেই রাস্তার এমন নাম। উপন্যাসকার উইলিয়াম থ্যাকার তো এই ফ্রি স্কুল স্ট্রিটেরই একটি বাড়িতে জন্মেছিলেন। ১৭৮৭ সালে বোটানিক্যাল গার্ডেনের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন কিড সাহেব। তাঁর নামেই কিড স্ট্রিট বলেও একটা রাস্তা আছে। যে রাস্তায় এমএলএ হস্টেলে।
কলকাতার অন্যতম পরিচিত জায়গা ধর্মতলা। কিন্তু কখনও একবার ভেবে দেখেছেন, এমন নামের কারণ কী? ইতিহাস বলছে, এখন যেখানে মসজিদ রয়েছে তার পাশেই আগে একটা ঘোড়ার আস্তাবল ছিল। এই বাড়ির জমিতেই আরও একটা মসজিদ তৈরি হল, কিন্তু সেই মসজিদ এখন আর নেই। অনেকে বলেন, এই ধর্ম সংক্রান্ত কারণেই এলাকার এমন নাম। আবার কর্ণেল হল মনে করেছেন, ধর্মতলা-জানবাজার এলাকায় বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের একটা আড্ডা বসতো। সেখান থেকেই সম্ভবত ধর্মতলা নাম হয়েছে। এখানে আগে মেম্বা পীড়ের বাজারও ছিল বলে জানা যায়।
ভারতবর্ষের প্রথম গভর্নর জেনারেল ছিলেন উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক। আর বেন্টিঙ্ক সাহেবের নামে রাস্তা হবে না, সেটা কী করে হয়! বেন্টিঙ্ক স্ট্রিট তো সবারই চেনা। আগে এই জায়গার নাম ছিল কসাইটলা। কসাই সম্প্রদায়ের মানুষদের বসবাস ছিল এখানে। চিৎপুর থেকে একটি জঙ্গলময় রাস্তা পেরিয়ে চৌরঙ্গীর বন্যপথ হয়ে সেকালে কালীঘাট যাওয়া হোত। তৎকালীন যুগের নকশাতেও যার উল্লেখ রয়েছে। ১৭৮০ সালের একটি নথি বলছে, বৃষ্টির ফলে এই রাস্তার অবস্থা কাদাময় হয়ে উঠেছিল।
চৌরঙ্গী এলাকাটি নাকি এক সময়ে জঙ্গলে ঢাকা ছিল। রাত্রিবেলা আবার বাঘ, ডাকাতের ভয়। জঙ্গলগিরি চৌরঙ্গী নামে এক সন্ন্যাসী এখানে বসবাস করতেন, তাঁর নাম থেকেই নাম হয়েছে চৌরঙ্গী। ১৭১৪ সালের বিভিন্ন নথিতে চৌরঙ্গীর নাম উল্লেখ রয়েছে। অন্যদিকে হলওয়েল সাহেব চৌরঙ্গীর রাস্তাকে ‘Road to Colligot’ নামেও উল্লেখ করেছেন, কারণ এটাই তো তখন কালীঘাট যাওয়ার একমাত্র রাস্তা।
লালবাজার এলাকা দিয়ে হাঁটলেই তো পুলিশ পুলিশ গন্ধ আসে। ভাবুন, একদিন ভিড়ে ঠাসা ভরদুপুরে আপনি লালবাজার দিয়ে হাঁটছেন। হঠাৎই দেখলেন, ঘোড়ার পিঠে চড়ে তলোয়ার সমেত একদল সৈন্য আপনার দিকে ধেয়ে আসছে। ভাবছেন, আজকের কলকাতায় এটাও সম্ভব নাকি? আসলে এটা একটা ভ্রম, আর এই ভুল আপনার তখনই হবে যদি আপনার জানা থাকে, এখানে এককালে সিরাজের সৈন্যের সাথে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সৈন্যদের যুদ্ধ হয়েছিল। আজ্ঞে হ্যাঁ, যুদ্ধ। ১৭৫৬ সালে সিরাজ কলকাতা আক্রমণ করেন। লালবাজার এবং মিশন রো–এর কোণে একটা বাড়িতে থিয়েটারের আসর বসত, সেই বাড়িতেই নবাবের সৈন্যরা আশ্রয় নিয়েছিল। তারপর চলেছিল এক ভয়ানক যুদ্ধ।
লালবাজারের পিছন দিকে রয়েছে টিরীটি বাজার। চাইনিজ ব্রেকফাস্টের জন্য যা খ্যাত। ১৭৮৮ সালে ভেনিস দেশীয় এডওয়ার্ড টিরেটা এই বাজারের প্রতিষ্ঠা করেন। ১৭৮৮ সালের কলকাতা গেজেটে দাবি করা হয়েছে, সুবিশাল বাড়ি, পাকা দোকান সমেত এই বাজারের নিলাম হয়েছিল, তখন এর মালিক ছিলেন টিরেটা সাহেব। সেই নিলামে এই বাজারের দাম ওঠে ১ লক্ষ ৯৬ হাজার টাকা, আর এখান থেনে টিরেটা সাহেবের মাসিক আয় হত ৩৫০০ টাকা। পরেরবার যখন চাইনিজ খেতে যাবেন, একবার না হয় টিরেটা সাহেবকে স্মরণ করবেন, ইতিহাস বলে কথা!
অ্যান্টনি বাগান লেন শুনলেই তো ফিরিঙ্গি অ্যান্টনির কথা মনে পড়ে যায়। হ্যাঁ, এই অ্যান্টনি’র নামেই এই অ্যান্টনি বাগান লেনের নামকরণ হয়েছে, সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। অ্যান্টনি সাহেব ছিলেন সাবর্ণ রায়চৌধুরীর কাছারি বাড়ির ম্যানেজার। রায়চৌধুরীদের সেই সময় বড়িশা বাগান ও ডিহি কলকাতায় দুটি কাছারি বাড়ি ছিল। তিনি আসলে ছিলেন জোব চার্ণকের সময়ের লোক এবং ইনিই সেই বিখ্যাত কবিওয়ালা ফিরিঙ্গি অ্যান্টনির দাদু, যাঁর নামে এই অ্যান্টনি বাগান লেন।
উত্তর কলকাতার অন্যতম জায়গা শ্যামবাজার। কখনও মনে প্রশ্ন জেগেছে, এইরকম নামের মানে কী? আসলে ব্যাপারটি হল, পলাশীর আমলে সুপ্রসিদ্ধ ব্যবসায়ী ছিলেন শোভারাম বসাক এবং তাঁর প্রসিদ্ধ শ্যামরায়ের মূর্তি থেকেই নাকি এই শ্যামবাজার নাম এসেছে। আবার হলওয়েল সাহেবের তালিকায় এই অঞ্চল চার্লস-বাজার নামে পরিচিত ছিল। কিন্তু প্রাণকৃষ্ণ দত্ত মহাশয় অন্য ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তাঁর মতে, শ্যামচরণ মুখোপাধ্যায় নামে একজন ব্রাহ্মণ এই অঞ্চলে বাস করতেন। যিনি নিজ খরচায় একটি দীঘি খনন করেন ও সেটির নাম দেন শ্যামপুকুর, এই শ্যামবাজারও নাকি তাঁরই সম্পত্তি।
মজার কথা হল, আদতে বাগবাজারের সঙ্গে দূর-দূরান্ত পর্যন্ত বাঘের কোনও সম্পর্ক নেই। বাগ অর্থে বাগান, সেখান থেকেই এই নামের উৎপত্তি। পলাশীর যুদ্ধের আগে এখানে পেরিনার্স গার্ডেন ছিল, যা কিনা ছিল ইংরেজদের ভ্রমণের একটা প্রধান জায়গা। ১৭৫২ সালে হলওয়েলের বিবরণে কিংবা ১৭৮৪ সালের উড সাহেবের মানচিত্রে এই অঞ্চলটি বাগবাজার নামেই চিহ্নিত করা হয়েছে।
শিয়ালদহ–মৌলালি চত্বরের ক্রীক রো নিশ্চই চেনেন। এখন যেখানে ক্রীক রো রয়েছে, মনে করা হয়ে থাকে এককালে সেখানে এক বিশাল খাল ছিল। সেটা অবশ্য পলাশীর যুদ্ধের আগের ঘটনা। যুদ্ধের পরে এই খাল বুজিয়ে ফেললেও রাস্তার নাম ক্রীক রো থেকে যায়। এই ক্রীক রোতেই অবস্থিত ডিঙ্গা ভাঙা পল্লি। ইতিহাস বলছে, বর্ষাকালে খালে বেশ জল ঢুকত এবং যার জন্য নাকি অনেক ডিঙ্গা বা নৌকা ডুবে যেত, যা থেকেই এই নাম এসেছে।
এতো হল গুটিকয়েক রাস্তার বিবরণ। এরম অসংখ্য রাস্তা শহরজুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে, সেগুলি দিয়ে আমরা নিয়মিত যাতায়াত করি। কিন্তু তার ইতিহাস আমাদের অনেকেরই জানার বাইরে। নথি বলছে, কলকাতায় মোটামুটি ভাবে ১৭৯৪ সাল থেকে পাকা রাস্তার কাজ শুরু হয়, রাস্তা তৈরির ইট, পাথর আসত বীরভুম থেকে। আসল কথা, সব রাস্তার মধ্যে কিছু না কিছু ইতিহাস নিহিত রয়েছে, শুধু প্রয়োজন একটু ধুলো ঝেড়ে ইতিহাসটকে উলটে দেখা।
তথ্য সংগ্রহ: কলিকাতা সেকালের ও একালের, হরিসাধন মুখোপাধ্যায়
A History of Calcutta’s Streets
P. Thankappan Nair
Comments are closed.