প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের আরএসএস সদর দফতরে যাওয়া এবং তাদের প্রশিক্ষণ শেষে দীক্ষান্ত ভাষণের বিষয়বস্তুকে ‘সঙ্ঘের ধ্যাণ ধারণার প্রতি জাতীয়তাবাদী অভিব্যক্তি’ বলে বর্ণনা করা হলো তাদের মুখপত্র অর্গানাইজার এবং পাঞ্চজন্যে। সঙ্ঘের সদর দফতরের ভাষণে প্রণববাবু যে দেশের সুপ্রাচীন বহুত্ববাদের উল্লেখ করে প্রাচীন মূল্যবোধ এবং জাতীয়তাবাদের কথা বলেছিলেন সংগঠনের মুখপত্রে প্রাক্তন রাষ্ট্রপতির সেই বক্তব্যকেই ‘হিন্দু ধর্ম সুপ্রাচীন সেই বহুত্ববাদের কথাই যুগ যুগ ধরে বলে আসছে। অথচ ইসলাম বা খ্রিষ্ট ধর্ম সেই বহুত্ববাদের কথা বলে না’ বলে আর এস এসের পক্ষ থেকে মন্তব্য করা হয়েছে।
আর এস এসের সদর দপ্তরে গিয়ে প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি প্রণববাবু যে সঙ্ঘীয় ঘরানায় কথা বলবেন না- এ বিষয়ে সকলেই নিশ্চিত ছিলেন। প্রণববাবু সঙ্ঘের অভিব্যক্তির দ্বিরুক্তি না করলেও তাঁর কথাগুলোকে যে সঙ্ঘ তাদের সামাজিক প্রযুক্তির কাজে সবরকমভাবে ব্যবহার করবে- এই আশঙ্কাও ধর্মনিরপেক্ষ শিবিরের মানুষজনের ছিল। সেই আশঙ্কা যে সত্য হতে চলেছে, তা সঙ্ঘের হিন্দি মুখপত্র ‘পাঞ্চজন্য’ র সাম্প্রতিক সংখ্যা পড়লেই বোঝা যায়।
‘পাঞ্চজন্যে’র সাম্প্রতিক সংখ্যার মূল নিবন্ধটিতে বলা হয়েছে, “আরএসএস আশা করেনি, প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি সঙ্ঘের ভাষাতেই কথা বলবেন। অথবা সঙ্ঘের কর্মকাণ্ডের জন্যে আমাদের পিঠ চাপড়ে দেবেন। তবে আমরা গভীর আগ্রহের সঙ্গে লক্ষ্য করেছি যে, প্রাক্তন রাষ্ট্রপতির কথার সঙ্গে সঙ্ঘের শিক্ষার মূল নির্যাসের আশ্চর্যজনক সাদৃশ্য আছে। একজন কংগ্রেসি হিসেবে নিজের পরিমণ্ডলের ভিতরে থেকেই যা বলার তা সঙ্ঘের প্রশিক্ষণ শিবিরে প্রণববাবু বলেছেন। যে ধরনের বৌদ্ধিক অস্পৃশ্যতা আমাদের চারিপাশে আচ্ছন্ন হয়ে আছে, প্রণববাবুর নাগপুরে সঙ্ঘের সদর দপ্তরে সাম্প্রতিক সফরে তা অনেকটা কাটবে বলে আমাদের বিশ্বাস।”
আরএসএসের মুখপত্রে প্রাক্তন রাষ্ট্রপতির সঙ্ঘের সদর দপ্তর কেশব ভবন সফর ও বক্তব্যকে “ভারতবর্ষের উদ্দেশে ভাষণ” হিসেবেই বর্ণনা করা হয়েছে। এইভাবে কৌশলের সঙ্গেই ভারতবর্ষ এবং আরএসএসকে একাত্ম করে দেওয়া হলো প্রণববাবুর কেশব ভবন সফর উত্তর সঙ্ঘের সামাজিক প্রযুক্তির একটি উল্লেখযোগ্য পর্যায়ে। প্রাক্তন রাষ্ট্রপতির সঙ্ঘের সদর দপ্তরের ভাষণে নাকি আরএসএসের প্রতি বিশ্বাস এবং প্রশংসাই ছত্রে ছত্রে ফুটে উঠেছে। এইভাবেই প্রণববাবুর নাগপুর সফর এবং তাঁর ভাষণকে ঘিরে নিজেদের সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা তৈরির কাজটি রাজনৈতিক হিন্দুরা করতে শুরু করেছেন। প্রণববাবু সঙ্ঘের সদর দপ্তরে ভাষণে বলেছিলেন, “আপনারা তরুণ এবং শৃঙ্খলাবদ্ধ। আপনারা প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত এবং উচ্চ শিক্ষিত। এইসব বৈশিষ্টগুলিই আমাদের মাতৃভূমির জন্যে বিশেষভাবে প্রয়োজন।”
প্রাক্তন রাষ্ট্রপতির এই কথাগুলিকেই সঙ্ঘের প্রতি প্রশংসামূলক বক্তব্য হিসেবে আরএসএস তাদের মুখপত্রে প্রচার করে সারা দেশে তা ছড়িয়ে দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে। সামাজিক প্রযুক্তির অঙ্গ হিসেবে নিজেদের মুখপত্রে আরএসএস দাবি করেছে, প্রাক্তন রাষ্ট্রপতির এই প্রত্যাশা একমাত্র পূরণ করতে পারে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘই। প্রণববাবু সঙ্ঘের সদর দপ্তরে তাঁর ভাষণে যে একটিবারের জন্যও নেহরু পরিবারের নামোচ্চারণ করেননি সেটির উল্লেখ করে সঙ্ঘের পক্ষ থেকে বর্তমান ভারতে নেহরু পরিবারের অপ্রাসঙ্গিকতার দিকটিই স্বভাবসুলভভাবে দেশবাসীর সামনে তুলে ধরা হয়েছে। সঙ্ঘের পক্ষ থেকে নিজেদের সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা তৈরির লক্ষ্যেই দাবি করা হয়েছে, ‘এই সব কথা বলবার উপযোগী একটি মঞ্চই প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি চাইছিলেন’। নিজের মানসিকতার সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ মঞ্চ তিনি আরএসএসের ভিতরে খুঁজে পেয়েছেন বলে আরএসএস দাবি করেছে। এই লক্ষ্যপূরণের উদ্দেশ্যেই আরএসএসের আমন্ত্রণ প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি গ্রহণ করেছেন বলে আরএসএস মনে করে বলে তাদের মুখপত্রে জানানো হয়েছে।
প্রণব মুখার্জির মতো বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বকে অবলম্বন করে আরএসএসের এই যে সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধির চেষ্টা-এটি হিন্দু সাম্প্রদায়িক শিবিরের রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন কিছু বিষয় নয়। অতীতে সাতের দশকে এইরকম প্রচেষ্টা তারা চালিয়েছিল লোকনায়ক জয়প্রকাশ নারায়ণের মাধ্যমেও। আজ প্রণববাবু সঙ্ঘের সদর দপ্তরে গিয়ে জাতির জনক মহাত্মা গান্ধী হত্যায় প্রাক্তন সঙ্ঘ কর্মী নাথুরাম গডসে সম্পর্কে একটি শব্দও উচ্চারণ করেননি। মুসোলিনীর সশস্ত্র প্রশিক্ষণের আদলে সঙ্ঘের প্রশিক্ষণ শিবিরের প্রবর্তক হেডগেওয়ারকে দেশমাতৃকার সুসন্তান আখ্যা দিয়েছেন। বহুত্ববাদের কথা বললেও গুজরাট গণহত্যা সম্পর্কে তিনি নীরব থেকেছেন।
দেশের সংবিধানের মূল পরিকাঠামো ধর্মনিরপেক্ষতাকে বিসর্জন দেওয়ার হিন্দুত্ববাদী প্রবণতা সম্পর্কেও প্রণববাবু নীরব ছিলেন। সাতের দশকে একদা গান্ধী হত্যায় সর্দার প্যাটেলের ভূমিকা নিয়ে তদন্ত দাবি করা জয়প্রকাশ কালিকটে সঙ্ঘের প্রশিক্ষণ শিবিরে গিয়ে তাদের ঢালাও প্রশংসা করেছিলেন জরুরি অবস্থার বিরুদ্ধে লড়াইতে সঙ্ঘকে সামিল করার তাগিদ থেকেই। সঙ্ঘের সেদিন গান্ধী হত্যার দায় থেকে নিস্তার পেতে দরকার ছিল জয়প্রকাশের সাহচর্য। আজও নরেন্দ্র মোদির সাম্প্রদায়িকতার জেরে যে ভারতবর্ষ তৈরি হয়েছে, তা থেকে মানুষের দৃষ্টি ঘোরাতে দরকার প্রণবের তৈরি করে দেওয়া সামাজিক বিস্তারের পথ।
(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)