অনুরাগিণী

 

এক

মেয়েটার নাম যে রাগিণী রেখেছিলো তার আর কিছু না হলেও একটা জ্যোতিষ রত্ন টাইপের কিছু পাওয়া উচিত ছিল। ছোটবেলার সেই শান্তশিষ্ট, সদা হাস্যময় এবং আপাত নিরীহ মেয়েটা যে বড় হয়ে এমন রাশভারী, নীতিজ্ঞান সম্পন্ন এবং জাঁদরেল হয়ে উঠবে, সেটা বাড়ির লোকও ধারণা করতে পারেনি। যৌথ পরিবারে কোলে-পিঠে বেড়ে ওঠা রাগিণীর এই পরিবর্তন সবাই লক্ষ্য করলো সে যখন স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে মেডিকেল কলেজে ভর্তি হলো ডাক্তারি পড়বে বলে।
রাগিণীর বাবা সুধাময় সেনগুপ্ত চেয়েছিলেন মেয়ে এমবিএ করে তাঁদের পারিবারিক বই প্রকাশনার ব্যবসায় যোগ দিক। যেমন দিয়েছে তাঁর মেজ ভাই, অর্থাৎ রাগিণীর মেজকা সুখময় সেনগুপ্তর ছেলে অনির্বাণ।
রাগিণী সুধাময়বাবুর মেয়ে। বাড়িতে রাগিণীর মা শর্বরী ছাড়া আর থাকে মেজকা, ভাই অনির্বাণ বা অনি, মেজ কাকিমা সুজাতা, ছোট কাকিমা ছন্দা, তাঁর ছেলে অর্ঘ্য বা গোগোল আর ঠাকুমা বিভাবতী দেবী। হ্যাঁ ঠিক ধরেছেন, ছোট কাকা সাগরময় মিসিং। কেউ জানে না তিনি কোথায়। নিন্দুকেরা বলে, ছন্দার অত্যাচারে আর দুর্ব্যবহারে অতিষ্ঠ হয়ে তিনি গৃহত্যাগ করেছেন। রাগিণীর খুব আবছা মনে আছে ছোটকাকে। কোলে তুলে ছোটকা গান গাইত ‘লাল ঝুঁটি কাকাতুয়া ধরেছে যে বায়না।’
এ ছাড়া বাড়িতে যাদের সে জন্ম থেকে দেখে যাচ্ছে তারা হলো ড্রাইভার গুরুপদ আর বিনুদা। বিনুদার কোনও নির্দিষ্ট কাজ নেই। রাগিণীর দেশের বাড়ি মেদিনীপুর থেকে গড়বেতা হয়ে এক প্রত্যন্ত গ্রাম। নাম চাঁপামুড়ি। বিনুদা সেই গ্রামেরই লোক। সুধাময় তাকে এনে রেখে দিয়েছে নিজের কাছে। ফাই ফরমাশ খাটে।
এ তো গেলো তার বাড়ির কথা। রাগিনী মেডিকেল কলেজে ফাইনাল ইয়ারে পড়ে। ডাক্তার হওয়া এবার সময়ের অপেক্ষা। বাড়িতে সাজো সাজো রব। সুখময়বাবু নিজে দাঁড়িয়ে থেকে একটা গ্যারেজ ঘর মেরামত করছেন। ওটাই হবে রাগিণীর চেম্বার।
বাড়ির ছোট বউ ছন্দার এই গ্যারেজকে চেম্বার করাতে ঘোর আপত্তি। কিন্তু সেটা বলার মতো সাহস তার নেই। একদিন রাতে চুপি চুপি অর্ঘ্যকে সেই কথা জানালো সে। ছেলেকে একা পেয়ে সে বললো, ‘নিজের অধিকার ছাড়িস না বাবু। তোর বাপ নেই। তোকে নিজের লড়াই নিজেকেই লড়তে হবে।’
পরদিন অর্ঘ্য ঠাকুমার কাছে গিয়ে ইনিয়ে বিনিয়ে কথাটা পাড়লো। বিভাবতী দেবী বুদ্ধিমতী মহিলা। তিনি হেসে বললেন, ‘এ বুদ্ধি তো তোমার নয় দাদুভাই। তোমায় এটা কেউ শিখিয়েছে। তার নামটা চটপট বলো দেখি। অর্ঘ্য অপ্রস্তুত হয়ে বললো, ‘কে শেখাবে? আমি এখন যথেষ্ট বড় হয়েছি। দিদিয়া তো আজ বাদে কাল বিয়ে করে শ্বশুর বাড়ি চলে যাবে। তখন কী হবে এই চেম্বারের? তার থেকে আমার কাছে থাক। আমি একটা ব্যবসা শুরু করবো।’
নাতির কথা সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে বিভাবতী দেবী রায় দিলেন, ‘ওই ঘর রাগিণীই পাবে।’
ঠাকুমার প্রতি একটা শ্যেন দৃষ্টি হেনে বেরিয়ে গেলো অর্ঘ্য। সে খেয়াল করলো না, দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে পুরো কথাগুলো শুনেছে রাগিণী।
রাগিণী ডাক্তারি পাশ করেছে। বাড়িতে বড় পার্টি। কেক কাটার পর সুধাময়বাবু গ্যারাজের চাবিটা মেয়ের হাতে তুলে দিয়ে একটা ছোট খাটো ভাষণ দিয়ে দিলেন। কিন্তু রাগিনী যেটা করলো তার জন্য কেউ প্রস্তুত ছিল না। অর্ঘ্যকে ডেকে ওর হাতে চাবিটা দিয়ে বললো, ‘আমি ঠিক করেছি গ্রামে গিয়ে প্র্যাকটিস করবো। শহরে তো অনেক ডাক্তার। কিন্তু অনেক গ্রাম আছে যেখানে চিকিৎসা না পেয়ে বহু মানুষ মারা যাচ্ছে। আমি সেখানে গিয়ে তাদের পাশে দাঁড়াতে চাই।’
ব্যাপারটা সুধাময়ের ভালো লাগলো না। তিনি পার্টি ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন। শুধু মেজকা সুখময় রাগিণীর মাথায় হাত রেখে বললেন, ‘আশীর্বাদ করি, তুমি তোমার লক্ষ্যে যেন স্থির থাকতে পারো।’
চাঁপামুড়ি গ্রামে সে কখনও যায়নি। ঠিক করলো সেখানেই যাবে। বিনুদা সব ব্যবস্থা করে দিলো।

দুই

গড়বেতা থেকে বাস ছাড়ে। সেটার একটায় চড়ে বসে সবে গল্পের বইটা বের করেছে, সাথে সাথে কোত্থেকে একটা উটকো ছেলে পরনে ময়লা ধুতি আর ফতুয়া, এসে রাগিণীর পাশে বসে পড়লো। আর ব্যাগ থেকে এক টিফিন বাটি বের করে ভর্তি মুড়ি চেবাতে লাগলো। খাবার সময় সে অবলীলাক্রমে রাগিণীকে ব্যাগটা ধরতে বলে কখনও নারকেল, তো কখনও কাঁচা লঙ্কা বার করতে থাকলো।
রাগিণী এবার বেশ বিরক্তি নিয়েই বললো, ‘খাওয়া হয়ে থাকলে ব্যাগটা নিয়ে নিন।’
ছেলেটা বত্রিশ পাটি দাঁত বের করে, ‘খুব ভারি না?’ এই বলে ব্যাগটা নিয়ে নিলো।
এটা কি খোঁচা মারলো? রাগিনী নিজেও বুঝতে পারলো না।
রাস্তা বেশ মসৃন। হু হু করে ছুটতে লাগলো বাস। রাগিণী বইয়ে মগ্ন। হঠাৎ ঘাড়ে কিছুর একটা স্পর্শ পেয়ে চমকে উঠলো। সেটা আর কিছুই না। ছেলেটা ঘুমোচ্ছে আর মাঝে মাঝে টাল সামলাতে না পেরে রাগিণীর ঘাড়ে মাথা দিয়ে দিচ্ছে। ডেকে তুলে কড়া ধমক দিলো রাগিণী। সুখময় আর সুধাময় বলেছিলো বাড়ির গাড়িতে আসতে। রাগিণী নেয়নি। তার জেদের কাছে বরাবরের মতো হার মানতে হলো বাবা ও মেজকাকে।
এর মধ্যে ছেলেটা ঘুম থেকে উঠে বসেছে। রাগিণীর দিকে তাকিয়ে একটা আড়মোড়া ভেঙে বললো, ‘কটা বাজে?’
রাগিণী মুখ না ফিরিয়েই উত্তর দিলো, ‘তিনটে দশ।’
ছেলেটি বললো, ‘ওহ, তাহলে আর মিনিট কুড়িতেই চাঁপামুড়ি ঢুকিয়ে দেবে।’
এবার রাগিণীকে তাকাতেই হলো।
চাঁপামুড়ি? ছেলেটা কি সেখানেই থাকে।
একটু ইতস্তত করে রাগিনী প্রশ্ন করলো, ‘আপনি চাঁপামুড়ি থাকেন?’
ছেলেটা মাথা নেড়ে হ্যাঁ বললো।
রাগিণী জিজ্ঞেস করলো, ‘গ্রামে হাসপাতালটা কোনদিকে জানেন?’
ছেলেটার মুখে আবার সেই বোকা বোকা হাসি। সে বললো, ‘তা জানবো না! ওর পাশেই তো আমার স্কুল।’
ততক্ষণে বাস চাঁপামুড়ি ঢুকে গেছে। দুজন মাত্র বাস থেকে নামলো। রাগিণী আর ওই ছেলেটা। বাস দুবার হর্ন দিয়ে চলে গেলো।
রাগিণী এতক্ষণে জেনেছে, ছেলেটার নাম অনুব্রত। গ্রামে সবাই অনু মাস্টার বলে ডাকে। সারা গ্রামে ওই একটা মাস্টার। রাগিণী বুঝলো যে গ্রামে মাস্টার এমন, সেখানে আর কী শিক্ষা থাকতে পারে।
অনুব্রত বললো, ‘চলুন আপনাকে হাসপাতালে পৌঁছে দিই।’
রাগিণী আপত্তি জানিয়ে বললো, ‘না না, আমি চলে যাবো।’
অনুব্রত একটু হালকা হেসে বললো, ‘গ্রামের নতুন ডাক্তার এসেছে। তার জন্য তো এটুকু করতেই হবে।’
রাগিণী একটা তির্যক দৃষ্টি দিয়ে বললো, ‘কী করে বুঝলে আমি ডাক্তার?’
অনুব্রত একটু থেমে উত্তর দিলো, ‘আপনার ব্যাগের চেনের ফাঁক দিয়ে যে কালো জিনিসটা উঁকি মারছে সেটা মনে হয়ে স্টেথোস্কোপের কানে দেওয়ার অংশটা।’
অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে রইলো রাগিণী। তবে কি অনুব্রতকে সে যতটা বোকা মনে করেছিল, ততটা সে নয়?
অনুব্রতর মুখে হাসি লেগে আছে। এই হাসিটা কিন্তু রাগিণীর বোকা বোকা বলে আর মনে হলো না।

তিন

রাগিণী এখন চুটিয়ে ডাক্তারি করছে। সে বুঝেছে, এ হাসপাতালের গোড়ায় গলদ। অনেক কিছু ঠিক করতে হবে। তবে একবারে নয়, আস্তে আস্তে। প্রথমে যেটা ঠিক করতে হবে, সেটা হল লোকগুলোর মানসিকতা। কারও মধ্যে কোনও কাজের উৎসাহ নেই। আড্ডার বহর দেখে হাসপাতাল না ক্লাব বোঝা দায়।
অনেক ভেবে একদিন রাগিণী সুপারের ঘরে গিয়ে সব বললো। সুপার বয়স্ক মানুষ। কিছুদিন পরেই অবসর নেবেন ভাবছেন। সব শুনে বললেন, ‘আমি জানি সবই। কিন্তু কিছু করতে পারি না। এদের গ্রুপটা বড় ভয়ানক। আর কিছু ডাক্তার আর নার্সকেও এরা দলে টেনে নিয়েছে। আমার পরেই যে সুপার হবে বলে বসে আছে সেই ডঃ নীলমনি দাস এদের কলকাঠি নাড়ে। সুপার হওয়ার লোভে আমার বিরুদ্ধে কত উস্কেছে। এতদিন সেগুলো সামলেছি। আর পারবো না। এবার অবসর নেবো। তুমি যা ভালো বোঝো কর। তবে সাবধানে। পরে বলো না আমি তোমায় সাবধান করিনি।’
হতাশ হয়ে বেরিয়ে এলো রাগিণী। সে জানে যা করার তাকেই করতে হবে।
বিকেলে নদীর ধরে হাঁটতে বেরিয়ে দেখা হলো অনুব্রতর সাথে। প্রথম দর্শনে যতটা অসহ্য লেগেছিল পরে বুঝলো, সে ততটা অসহ্য নয়। বরং এই পান্ডব বর্জিত দেশে যদি কারও সাথে দু’দণ্ড কথা বলা যায় তাহলে সে এই অনুব্রতই।
রাগিণী একটু ভেবে ওকেই সব খুলে বললো সমস্যার কথা। অনুব্রত একটু থেমে বললো, ‘সুপারকেই কড়া হতে হবে। নাহলে কিছু করার নেই।’
রাগিণী জানাল, এই সুপার ভয়ে অবসর নেবে আর পরের সুপার ডঃ নীলমনি দাস ওই দলের পাণ্ডা।
অনুব্রত হেসে বললো, ‘বাহ তাহলে তো সোনায় সোহাগা। কিছু একটা করতে হবে। এখানে হবে না। চলুন ঘরে গিয়ে বসি। এক কাপ চা খেতে খেতে ভাবা যাবে।’
রাগিনী অন্য সময় হয়ত আপত্তি করতো, কিন্তু সে এতটাই বিচলিত ছিল যে, এক কোথায় রাজি হয়ে গেল।
রাগিণীকে ঘরে তক্তপোশের ওপর বসিয়ে স্টোভ জ্বালতে রান্না ঘরে ঢুকলো অনুব্রত। রাগিণী দেখল ঘরে আসবাবের চেয়ে বই বেশি। আর বিভিন্ন ধরনের বই। সে উঠে গিয়ে কয়েকটা বই নেড়েচেড়ে দেখতে লাগল।
হঠাৎ তার চোখে পড়লো ক্রাইম বিষয়ক একটা বই। সেই বইটা আলমারি থেকে পাড়তেই যে জিনিসটা চোখে পড়লো তাতে তার বুকের রক্ত জল হয়ে গেলো। বইয়ের পেছনে আড়াআড়ি ভাবে রাখা একটা কালো কুচকুচে পিস্তল। মুহূর্তের মধ্যে বইটা রেখে রাগিনী তাড়াতাড়ি ফিরে আসতে গিয়ে ধাক্কা খেয়ে টেবিল উল্টিয়ে কাচের জগ আর গ্লাস ভেঙে ফেললো।
আওয়াজ শুনে অনুব্রত দৌড়ে বেরিয়ে এলো রান্নাঘর থেকে। রাগিনী দাঁড়িয়ে রইলো হতভম্বের মতো।

(পরবর্তী পর্ব আগামী রবিবার)

Comments are closed.