পড়ানোর জন্য বাড়ি বিক্রি করেছেন বাবা, পেট্রল পাম্প কর্মচারীর ছেলে প্রদীপ সিংহ প্রথম চেষ্টাতেই ইউপিএসসি টপার

ছেলের স্বপ্নপূরণ করতে বাড়ি বিক্রি করেছেন বাবা, আর ছেলেও মাত্র ২২ বছর বয়সে প্রথম চেষ্টাতেই ইউপিএসসি পাশ করে বাবার ভরসা আর স্বপ্নের দাম দিলেন।
৫ এপ্রিল ২০১৯। চলতি বছরে যে লক্ষ লক্ষ ছেলে-মেয়ে ইউপিএসসি পরীক্ষা দিয়েছিলেন, তার মধ্যে ৭৫৯ জনের জীবনে এক উল্লেখযোগ্য দিন। এই দিনেই গোটা দেশের ৫৭৭ জন পুরুষ ও ১৮২ জন মহিলা ইউনিয়ন পাবলিক সার্ভিস কমিশনের পরীক্ষায় কৃতকার্য হয়েছেন। এঁদের মধ্যেই ২০১৮ ইউপিএসসির অন্যতম কনিষ্ঠ পরীক্ষার্থী ছিলেন মধ্য প্রদেশের ইন্দোরের প্রদীপ সিংহ। মাত্র ২২ বছর বয়সে প্রথমবার পরীক্ষা দিয়েই ইউপিএসসিতে টপার হলেন প্রদীপ সিংহ।
১৯৯৬ সালে বিহারের গোপালগঞ্জে এক কৃষক পরিবারে জন্ম প্রদীপ সিংহের। পরিবারের আর্থিক সম্বল বলতে ছিল কিছু চাষের জমি। তাও ঋণ নিয়ে চাষ-আবাদ করে সংসারের খরচ যোগাতে পারছিলেন না প্রদীপের বাবা মনোজ সিংহ। তাই জীবিকার খোঁজে ইন্দোরের একটা পেট্রল পাম্পে কাজ জুটিয়ে পাড়ি দেন ভিন রাজ্যে। সেই সঙ্গে ছেলেকে বড় করার লক্ষ্যে নিজের কাছে নিয়ে যান মনোজবাবু। আর গোপালগঞ্জের গ্রামের বাড়িতে পরিবারের মহিলারা সামলাতে থাকেন চাষের কাজ।
এদিকে ইন্দোরেই স্কুল শেষ করার পর বাণিজ্য বিভাগে স্নাতক হয়ে গিয়েছেন প্রদীপ। কিন্তু এবারে কী করবেন? যে ইউপিএসসির মতো কঠিন পরীক্ষায় প্রথমবারেই সফল হয়েছেন, সেই পরীক্ষা নিয়ে তেমন ধারণাই ছিল না প্রদীপের। তাঁর কথায়, বাবা-মা সব সময় বড় ‘আফসার্স’ (অফিসারদের) নিয়ে কথা বলতেন। দেখতেন, বড় অফিসারদের নিয়ে কথা বলার সময় কেমন উজ্জ্বল হয়ে উঠত বাবার চোখ। যাঁরা ইউপিএসসি ‘ক্র্যাক’ করেন, সংবাদপত্রে তাঁদের বাবা-মায়ের গর্বিত ছবি দেখে, সেই একই খুশি নিজের বাবা-মায়ের চেহারায় দেখার স্বপ্ন দেখে ফেলেন সদ্য কলেজ পাশ করা প্রদীপ। সেই স্বপ্ন বুকে নিয়েই ইউপিএস পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে দিল্লি পাড়ি দেন প্রদীপ সিংহ।
কিন্তু ইউপিএসসির কোচিং ক্লাস, দিল্লিতে থাকা-খাওয়ার খরচ যে অনেক! একদিকে গোপালগঞ্জে পরিবার, অন্যদিকে দিল্লিতে থাকা ছেলের বড় অফিসার হওয়ার স্বপ্ন, দু’দিক সামলাতে চরম আর্থিক সমস্যায় পড়তে হয় প্রদীপের বাবা মনোজ সিংহকে। আর্থিক অবস্থা ফেরাতে কয়েকবার নিজস্ব ব্যবসা শুরু করে বিফল হন মনোজ সিংহ। শেষে ইন্দোরের বাড়িটিই বিক্রি করে দেন ছেলেকে আইএএস অফিসার বানানোর লক্ষ্যে।
ছেলেরও ছিল কঠিন অধ্যাবসায়। প্রদীপের কথায়, ‘সম্পূর্ণ নতুন এক ক্ষেত্রে তৈরি করছিলাম নিজেকে, আমার মতো হাজার হাজার ছেলে-মেয়ের আইএএস অফিসার হওয়া স্বপ্ন। আর আমি ছিলাম তাঁদের মধ্যে নতুন একজন।’ তবে হাল ছাড়ার কোনও কারণ খুঁজে পাননি প্রদীপ। তাঁর কথায়, বাবা অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছেন তাঁকে বড় অফিসার করার জন্য। তাঁর প্রথমবার ইউপিএসসিতে বসাকে নিজের একমাত্র ও শেষ সুযোগ হিসেবে দেখেছিলেন প্রদীপ। রোজ ঘুম থেকে ওঠা, স্নান-খাওয়া,পড়া এবং পড়া। গত দু’বছর ধরে এই ছিল তাঁর রোজকার রুটিন। নিজেকে সরিয়ে রেখেছেন সব আনন্দ উৎসব, আড্ডা থেকে। কঠিন পরিশ্রমের ফলও মিলেছে হাতেনাতে। প্রথমবার সর্বভারতীয় পরীক্ষায় বসেই আআইএস অফিসার হওয়ার স্বপ্ন হাসিল করে নিয়েছেন প্রদীপ সিংহ।
প্রদীপের স্বীকারোক্তি, তাঁদের কোনও দূর সম্পর্কের আত্মীয়ও ইউপিএসসির ‘প্রিলিমিনারি’ও পাশ করেননি কখনও। তাই ফল ঘোষণার পর টানা তিন দিন পরিবার ও বন্ধুদের নিয়ে সাফল্য উদযাপন করেছেন প্রদীপ। যে খুশি বাবার চোখে দেখতে চেয়েছিলেন, তা সত্যি করতে পেরে গর্বিত, তৃপ্ত ২২ বছরের যুবক। এখন আইএএস অফিসার হিসেবে সাধারণ মানুষের সেবা করাই তাঁর পরবর্তী চ্যালেঞ্জ বলে জানান ‘আফসার্স’ প্রদীপ সিংহ।

Comments are closed.