মাত্র ৯৬ ঘণ্টা পেরিয়েছে ৫০ এ পা দিয়েছেন। জীবনের ৫০ বছর কাটানোর পর প্রকৃত অর্থেই এক নতুন জীবনে পা দিতে চলেছেন শুভেন্দু অধিকারী। কংগ্রেস ঘরানার রাজনীতির পাট চুকিয়ে এবার কাঁথির শান্তিকুঞ্জের বাসিন্দা শুভেন্দু অধিকারী নরেন্দ্র মোদীর দলে।
মুকুল রায় থেকে শুরু করে শোভন চ্যাটার্জি, তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে যোগদান নতুন কোনও ব্যাপার না। নতুনত্ব একটাই, শুভেন্দুর মাপের নেতা আগে পায়নি বিজেপি। কিন্তু কেন আলাদা শুভেন্দু অধিকারী? কেনই বা তাঁর তুলনা চলে না বাকিদের সঙ্গে?
১৯৭০ সালের ১৫ ডিসেম্বর জন্ম শুভেন্দুর। মা গায়ত্রী অধিকারী বাবা শিশির অধিকারী। ছোট থেকেই রামকৃষ্ণ মিশনের সঙ্গে যোগাযোগ। কিছুদিন আরএসএস শাখায় অংশ নিয়েছেন শিশির বাবুর মেজ ছেলে। কলেজে যোগ দিয়ে ছাত্র পরিষদ। সেই শুরু।
আটের দশকের শেষ দিকে কংগ্রেসি রাজনীতির তরুণ তুর্কি নেতা লড়েন মিউনিসিপ্যালিটি ভোটে। জেতেন। সেই প্রথম পা দেওয়া নির্বাচনী রাজনীতির ময়দানে। কিন্তু শুভেন্দুর যাত্রাপথ কোনওদিনই গোলাপ বিছানো ছিল না।
২০০১ সালে প্রথমবার পূর্ব মেদিনীপুর জেলার মুগবেড়িয়া বিধানসভায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন শুভেন্দু অধিকারী। তৎকালীন বামফ্রন্ট সরকারের মৎস্যমন্ত্রী কিরণময় নন্দের কাছে হারতে হলেও সম্ভাবনা দেখিয়েছিলেন ৩১ বছরের শুভেন্দু। ২০০৪ সালের লোকসভায় তমলুক থেকে শুভেন্দুকে প্রার্থী করেন মমতা। সামনে সিপিএমের হেভিওয়েট লক্ষ্মণ শেঠ। না, এবারও জেতা হয়নি শুভেন্দুর। কিন্তু পূর্ব মেদিনীপুরের রাজনীতিতে নিজের ছাপ রাখতে শুরু করেন শুভেন্দু।
২০০৭ সালের ৩ জানুয়ারি। পূর্ব মেদিনীপুরের নন্দীগ্রামে শুরু জমি উচ্ছেদ বিরোধী আন্দোলন। কাঁথি কলেজের প্রাক্তন জিএসের জীবন বদলে দিল যে আন্দোলন। ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটির ব্যানারে শুভেন্দু অধিকারী হয়ে ওঠেন আন্দোলনের একেবারে প্রথম সারির নেতা। প্রায় ২ বছরের আন্দোলনে এসেছে অনেক উত্থান পতন, রক্ত ঝরেছে বহু। কিন্তু সাহস হারাননি শুভেন্দু অধিকারী।
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা বলেন, নন্দীগ্রাম আন্দোলন কাঁথির শুভেন্দুকে নেতা শুভেন্দু অধিকারী করে তুলতে সাহায্য করেছিল। ২০০৯ সালে তমলুক লোকসভা থেকেই আবার লড়েন তিনি। সেবারও সামনে সিপিএমের লক্ষ্মণ শেঠ। কিন্তু এবার আর হার নয়, প্রায় ২ লক্ষ ভোটে হেভিওয়েট লক্ষ্মণ শেঠকে উড়িয়ে দেন তৃণমূল প্রার্থী শুভেন্দু অধিকারী। তারপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি শিশির অধিকারীর মেজ ছেলেকে।
২০১১ সালে রাজ্যে তৃণমূল সরকার তৈরি হয়। শুভেন্দু তখন দিল্লিতে মনমোহন সরকারের জাহাজ দফতরের প্রতিমন্ত্রী। শুভেন্দু আরও বেশি মন দেন সংগঠনে। পূর্ব মেদিনীপুর ছাড়িয়ে শুভেন্দুর দায়িত্বে আসতে থাকে পুরো জঙ্গলমহল। সেই অর্থে প্রথম রাজ্যজুড়ে কাজ শুরু করেন শুভেন্দু।
২০১৬ বিধানসভা ভোটের আগে মমতা নন্দীগ্রাম গিয়েছিলেন। সেখানে ভিড়ে ঠাসা সমাবেশে ঘোষণা করেন, নন্দীগ্রাম থেকে বিধানসভায় পাঠাতে চান শুভেন্দুকে। ২০১৬ সালে নন্দীগ্রামে জিতে বিধানসভায় পা রাখেন শুভেন্দু অধিকারী। ততদিনে শুভেন্দু হয়ে উঠেছেন দল নেত্রীর অত্যন্ত আস্থাভাজন। মন্ত্রিসভাতেও ঢুকে পড়েন। পরিবহণমন্ত্রী হিসেবে কাজ শুরু করেন নন্দীগ্রামের বিধায়ক। সংগঠনের দায়িত্বও ক্রমেই বাড়তে থাকে। নেত্রী শুভেন্দুকে মুর্শিদাবাদের ভার দেন। গোটা বাংলায় একমাত্র মুর্শিদাবাদেই তখনও ছাপ ফেলতে পারেনি তৃণমূল। দায়িত্ব পেয়েই সিরাজের শহরে ঘাঁটি গাড়েন শুভেন্দু। এক নাগাড়ে পড়ে থাকেন অধীর চৌধুরির খাস তালুকে। তার ফলও মেলে। শুভেন্দুর নেতৃত্বে মুর্শিদাবাদে ক্রমশ বড়ো শক্তি হয়ে উঠতে থাকে তৃণমূল।
মুর্শিদাবাদের সাফল্য শুভেন্দুর মুকুটে অন্যতম পালক। এদিকে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মন্ত্রিসভাতেও দায়িত্ব বেড়েছে। পরিবহণের পাশাপাশি সেচ ও জলসম্পদ উন্নয়ন দফতরের মন্ত্রী হন শুভেন্দু। তারপর গঙ্গা দিয়ে অনেক জল বয়ে গেছে। বিভিন্ন ইস্যুতে দলের সঙ্গে মতপার্থক্য হয়েছে, হয়েছে মনমালিন্য। শেষমেশ ২৭ নভেম্বর মন্ত্রিপদ থেকে ইস্তফা।
এক নতুন মোড়ের মুখে দাঁড়িয়ে একসময়ের মমতা ব্যানার্জির সবচেয়ে বিশ্বস্ত শুভেন্দু। শনিবার, ১৯ ডিসেম্বর মেদিনীপুর কলেজের মাঠ থেকে শুরু হওয়া সেই নয়া পথ যে গোলাপ বিছানো হবে না, খুব ভালো জানেন ৫০ বছরের শুভেন্দু অধিকারী। কিন্তু হাল ছাড়ার পাত্র তিনি নন।
Comments are closed.