সঞ্চয়ের জন্য কেন আমরা অর্থ রাখতে পারি না? ভবিষ্যতের কথা ভেবে সঞ্চয় কেন জরুরি?

কেউ রোজগার শুরু করেন অল্প বয়সে কেউ একটু দেরিতে। অফিসার থেকে কেরানি, দোকানদার থেকে টোটোওয়ালা, সবাইকে রোজগার করতে হয় জীবন ধারনের তাগিদে। মানুষ রোজগার করে তিনটি জিনিস দিয়ে, Body, Mind এবং Time। একজন শ্রমিক তাঁর উপার্জন আনেন কায়িক পরিশ্রম দিয়ে, একজন ইঞ্জিনিয়র আয় করেন মেধা কাজে লাগিয়ে। তবে এঁদের প্রত্যেকের কাছে কমন ফ্যাক্টর হল টাইম বা সময়।

কেন রোজগার করি আমরা? এই প্রশ্নের সহজ উত্তর হল জীবন চালাতে। একটু ঘুরিয়ে বললে, আমরা ব্যয়ের জন্য আয় করি। নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত থেকে ধনী, সবাই রোজগার করে প্রথমে ব্যয় করি। তারপর conserve (সঞ্চয়) করি, যাতে ভবিষ্যতে অসুবিধেয় পড়তে না হয়। তারপর আসে ব্যক্তিগত লক্ষ্য (goal)। কেউ সঞ্চয়ের একটা অংশ তুলে রাখি বাড়ি তৈরির জন্য, কিংবা অন্যান্য শখ পূরণ করতে ব্যক্তি বিশেষে এই লক্ষ্য ভিন্ন। কিন্তু এই ধাপগুলি মেনে হাঁটতে গিয়ে বেশিরভাগ মানুষই goal-এ পৌঁছতে পারি না। কেন?

আসলে বেশিরভাগ মানুষ যে সঞ্চয় করেন তার কোনও দিশা নেই। কোন লক্ষ্যে এবং সেই লক্ষ্যপূরণে কীভাবে এগোতে হবে তা না জেনেবুঝেই আমরা অন্ধের মতো রোজগারের একটা ছোট্ট অংশ সঞ্চয় করি। এবং কোন খাতে সেই সঞ্চয় হলে আমার পক্ষে বেশি উপযোগী হবে সেটাও না ভেবে সবাই যেখানে টাকা রাখছে সেখানেই বিনিয়োগ করি। এটা একটা মস্ত বড়ো ভুল। আমাদের প্রত্যেকের পারিবারিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতি আলাদা, কাঁধে দায়িত্বের ভারও ভিন্ন। কিন্তু আমরা প্রত্যেকেই ভাবি, আমার ভারটা অন্যের চেয়ে বেশি। তাই ওঁর মতো সঞ্চয় আমি করতে পারছি না। আমি বলব এটা স্রেফ অজুহাত। আমাদের প্রত্যেকেরই কোথাও না কোথাও দায়বদ্ধতা আছে, সমস্যারও অন্ত নেই। তা সত্ত্বেও নিজের এবং পরিবারের ব্যয় মিটিয়ে চাইলে সবাই সঞ্চয় করতেই পারি। কিন্তু আমরা খুঁজি একটা Ideal Time বা আদর্শ সময়। যা আসতে পারে আবার নাও আসতে পারে। তাহলে করণীয় কী? জীবনের লক্ষ্য ও শখ পূরণের জন্য, বার্ধক্যে কিংবা অসময়ে যাতে অসুবিধার মুখে না পড়তে হয় রোজগারের পরই আমাদের প্রথম কর্তব্য হল সঞ্চয়। যত ক্ষুদ্র অংশই হোক, রোজগার করেই সেটা conserve করতে হবে, তারপরে সেই রোজগার থেকে দৈনন্দিন ও সাংসারিক খরচ সরিয়ে রাখুন। এতে সঠিক সময়ে ব্যক্তিগত লক্ষ্যমাত্রা যেমন পূরণ হবে তেমনি ভবিষ্যতে পরের উপর নির্ভরশীল হতে হবে না।

 

সংসারের অনেক খরচ, এখন বিনিয়োগ সম্ভব না

ভেবে দেখুন, যখন আপনার স্বল্প রোজগার ছিল তখনও আপনার কাছে সঞ্চয় খাতে বিনিয়োগের অর্থ ছিল না। তখনও সাংসারিক দায় দায়িত্ব ছিল, এখনও আছে। কিন্তু কয়েক বছর পর রোজগার বাড়লেও আপনি বলবেন সঞ্চয়ের অর্থ নেই। অর্থাৎ, রোজগার বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে আপনি একটা কমফোর্ট জোনে ঢুকে গিয়েছেন, একটা নির্দিষ্ট লাইফ স্টাইল মেনে চলছেন। কিন্তু আজীবন সেই জীবনধারা বজায় রাখতে যে সঞ্চয় দরকার সেদিকে নজর দিচ্ছেন না। আপনি বিনিয়োগের জন্য চেয়ে আছেন একটা ‘আইডিয়াল টাইম’ এর দিকে। যখন আপনার সাংসারিক ব্যয় কিছুটা কম হবে। কিন্তু এই আইডিয়াল সময় যে আসবেই, এমন নিশ্চয়তা নেই।

আমি অনেক মধ্যবিত্ত পরিবার দেখেছি যারা বাড়ির ছোট সদস্যের জন্মদিনে বিশাল পার্টির আয়োজন করে, কিন্তু সেই ছেলে বা মেয়ে যখন বড় হয়ে উচ্চশিক্ষার জন্য তৈরি হচ্ছেন, তখন অভিভাবকরা তাঁকে এডুকেশন লোন নিতে বলছেন! এটাই পরিকল্পনার অভাবের ফল।

এই অতিমারি পরিস্থিতিতে বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠান ও সংস্থায় ছাঁটাই চলছে। আবার কোথাও ছাঁটাই হয়নি বটে, কিন্তু স্যালারি ২০, ৩০ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত কমে গিয়েছে! এই পরিস্থিতিতে সবাই অসহায়। কিন্তু বাজার খরচ, ছেলেমেয়ের পড়াশোনা, ওষুধ ও চিকিৎসার খরচ তো যোগাতেই হচ্ছে। এবং সেটা কিন্তু বহনও করতে পারছেন এই কম স্যালারি থেকেই। তাহলে এখন কীভাবে সম্ভব হচ্ছে? উত্তরটা সহজ। আমরা বাড়তি খরচের বহর কাটছাঁট করে কোনটা আবশ্যিক এবং জরুরি প্রয়োজন, সেই খাতে খরচ করছি। তাই বিনিয়োগের ‘আইডিয়াল টাইম’ বলে কিছু হয় না। আপনি নতুন চাকরি করুন বা পুরনো কর্মী হন, মিতব্যয়ী হলে মুশকিল। মাথায় রাখা দরকার, এখন যে লাইফস্টাইলে আমি অভ্যস্ত হয়েছি, তা যেন আজীবন আমি বা আমার পরিবার চালিয়ে যেতে পারি। আগামীতে আরও একটু বেশি এই সব খাতে ব্যয় করতে পারি। কিন্তু পরে যদি সেই লাইফস্টাইল থেকে ক্রমে নীচে নেমে আসতে হয় সেটা বড়ো সমস্যার। তখন আসে ডিপ্রেশন, রাগ, ক্ষোভ, সাংসারিক অশান্তি ইত্যাদি।

ভেবে দেখুন, বয়সকালে কিংবা অবসরজীবনে ছেলেমেয়ের উপর নির্ভর করে বাঁচা, আত্মীয়বন্ধুদের কাছ থেকে সাহায্য প্রার্থনা করা, সরকারি সাহায্যের আশায় তাকিয়ে থাকা না কী নিজে যেভাবে জীবন কাটিয়ে এসেছেন, সেভাবে থাকতে পারা, কোনটা সম্মানজনক।

 

আমার স্বল্প রোজগার, কোথায় বিনিয়োগ করব? 

ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ স্বল্প রোজগার দিয়ে সংসার চালান এবং সঞ্চয়ও করেন। একই পরিমাণ রোজগার করা দুজনের ব্যয়ের বহর আলাদা। কারণ, তাঁদের পারিবারিক পরিস্থিতি ও দায়িত্ব ভিন্ন। তাই সেখানে দাঁড়িয়ে কার জন্য কোন বিনিয়োগ জরুরি, কোথায় সঞ্চয় করলে পরবর্তী সময়ে অধিক লাভ, তার জন্য দরকার গাইডের। একজন ফিনান্সিয়াল গাইড। একথা সত্যি, আপনি যে উড়োজাহাজে চড়লেন তা গন্তব্যে পৌঁছনোর আগে নানা বাধা, বিঘ্ন ও দুর্ঘটনার আশঙ্কা থাকে। কিন্তু প্লেনের পাইলট আপনাকে আগে থেকে বলে দিতে পারেন, আবহাওয়া খারাপ কিংবা যান্ত্রিক গোলমাল হচ্ছে, সিট বেল্টটা বেধে নিন। একজন ফিনান্সিয়াল অ্যাডভাইজর অনেকটা এমনই দায়িত্ব পালন করে থাকেন। তিনি অনেকটা পাহাড়ে ওঠার গাইডের মতো। যিনি আপনাকে দেখিয়ে দেবেন কোন রাস্তা অধিক নিরাপদ, কীভাবে গেলে শিখরে পৌঁছতে পারবেন। কিন্তু  রাস্তাটা পার করতে হবে আপনাকেই। আর বিনিয়োগের জন্য যদি আদর্শ পরিস্থিতির জন্য অপেক্ষা করে থাকেন, তা হবে অনেকটা ‘সমুদ্রে ঢেউ কমলে স্নান করব’ ভাবনার মতো। কবে সেই সময় আসবে তা কেউ বলতে পারবেন না।

 

(লেখক বিশিষ্ট ফিনান্সিয়াল প্ল্যানার। বিমা বা বিনিয়োগ সংক্রান্ত যে কোনও পরামর্শের জন্য যোগাযোগ করুন: 98363 74487, 98356 66559, [email protected])

Comments are closed.