সুজাত বুখারির মৃত্যুর এক বছরে বাবার স্মৃতিচারণায় ছেলে, কেন ধরা পড়ল না খুনিরা? প্রশ্ন সিদ্ধার্থ বরদারাজনের
বাবা বলতেন, বোর্ড পরীক্ষায় ৯৫ শতাংশ নম্বর পাবে। আমি জানতে চাইতাম, তুমি কীভাবে আগেই জেনে গেলে! বাবা মুচকি হেসে শুধু বলতেন, মিলিয়ে নিস। গত বছর বোর্ডের পরীক্ষার ঠিক আগে বাবা মারা গেলেন। পরীক্ষা দেওয়া হল না আমার। তখন ভেবেছিলাম, বাবার আশা কি পূর্ণ করতে পারব? এই এক বছর পড়াশোনাকেই পাখির চোখ করে এগিয়ে গিয়েছি। কয়েকদিন আগেই রেজাল্ট বেরিয়েছে। এবার আমার অবাক হওয়ার পালা। দেখি বোর্ডের পরীক্ষায় ঠিক ৯৫ শতাংশ নম্বরই পেয়েছি আমি। কী আশ্চর্য ব্যাপার বলুন?
কাশ্মীর উপত্যকার অন্যতম সেরা সাংবাদিক ও সম্পাদক ডক্টর সৈয়দ সুজাত বুখারির মৃত্যুর এক বছর পূর্ণ হওয়ার পর, বুখারির হাতে তৈরি রাইজিং কাশ্মীর সংবাদপত্রে বাবাকে নিয়ে এমনই লিখলেন ডক্টর বুখারির ছেলে তামহিদ বুখারি। সদ্য বোর্ড পরীক্ষায় পাশ করেছেন তামহিদ।
২০১৮ সালের ১৪ ই জুন, শ্রীনগরের হাই সিকিউরিটি জ়োনে আততায়ীদের হাতে গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যু হয় রাইজিং কাশ্মীর সংবাদপত্রের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক সৈয়দ সুজাত বুখারির। তারপর এক বছর অতিক্রান্ত। কিন্তু আজও ধরা পড়েনি ডক্টর বুখারির আততায়ীরা।
প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদকের মৃত্যুর এক বছর পূর্ণ হওয়ার দিন, শ্রীনগরের ঐতিহ্যবাহী টেগোর হলে আয়োজিত হয়েছিল এক বিশেষ অনুষ্ঠান। সেখানে উপস্থিত হয়ে সাংবাদিক তথা নিউজ পোর্টাল thewire এর প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক সিদ্ধার্থ বরদারাজন প্রশ্ন তুলেছেন হত্যা তদন্তের গতি প্রকৃতি নিয়ে। বলেছেন, এক বছর সময়ের মধ্যে আমরা দু’জন অসাধারণ সম্পাদককে হারালাম, গৌরি লঙ্কেশ এবং সুজাত বুখারি। গৌরি লঙ্কেশের ক্ষেত্রে মামলার নিষ্পত্তি না হলেও জানা গিয়েছে কোন নেপথ্য শক্তির অঙ্গুলিহেলনে মরতে হল তাঁকে। কিন্তু দেশের অন্যতম সেরা সম্পাদক সুজাত বুখারির ক্ষেত্রে তদন্ত যেন জগদ্দল পাথর। বরদারাজন বলেন, সুজাত বুখারির হত্যা মামলা কী অবস্থায় রয়েছে, তা নিয়ে কোনও তথ্যই নেই সাংবাদিকদের কাছে। তাঁর প্রশ্ন, প্রকাশ্যে একজন প্রথম সারির সম্পাদককে হাই সিকিউরিটি জ়োনে গুলিতে ঝাঁঝরা করে মেরে ফেলা হল, তারপর এক বছর পেরিয়েও গেল, কিন্তু হত্যাকারীরা ধরা পড়ল না, এটা কীভাবে মেনে নেব?
অনুষ্ঠানে উঠে আসে বুখারির চরিত্রের নানা দিক। কীভাবে বুখারি কাশ্মীরের আম জনতার কথা বলায় আপোসহীন ছিলেন। কীভাবে দিল্লির লাল চোখ উপেক্ষা করে, সন্ত্রাসবাদীদের বন্দুকের নলকে পাত্তা না দিয়ে কাশ্মীরিয়তের সাধনায় মত্ত ছিলেন ডক্টর বুখারি, সেই আলোচনা চলে। বুখারির চলে যাওয়া আসলে ভারত-পাক দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কেও প্রভাব ফেলেছে, এমনটাই মনে করছেন একদা বুখারির সহকর্মী দেশের বিভিন্ন প্রান্তের সিনিয়র সাংবাদিকরা। ভারত-পাক দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের শৈত্য কাটাতে ডক্টর বুখারির লাগাতার উদ্যোগের কথাও উঠে আসে স্মৃতিচারণায়। তবে ঐতিহ্যবাহী টেগোর হলে সবচেয়ে বেশি যেটা নিয়ে আলোচনা হল, তা হল, কাশ্মীরের সাধারণ মানুষের প্রতি সুজাত বুখারির টান। তিনি ছিলেন প্রকৃতই কাশ্মীরের আত্মার একনিষ্ঠ পূজারি।
বুখারি প্রতিষ্ঠিত রাইজিং কাশ্মীর দৈনিকে The World is not same to me anymore শীর্ষক লেখায় ডক্টর বুখারির ছেলে তামহিদ বুখারি স্মৃতিচারণ করেছেন, বাবার সঙ্গে কাটানো সময়ের। বাবার অনুপস্থিতিতে জীবনের বদল এবং অবশ্যই যে মানুষ তামহিদের বাবার অভাব পূরণ করেছেন, তাঁর মায়ের সম্বন্ধে লিখেছেন সুজাত বুখারি পুত্র। বলেছেন, এই একটা বছর আমাদের কাছে প্রতিদিনই ছিল পরীক্ষার মতো। একদিকে আর্থিক টানাটানি, অন্যদিকে বাবার ঘটনা আমাদের নাড়িয়ে দিয়েছিল। কিন্তু মা ভরসা হারাননি। বারবার বলে গেছেন, এমনটা চিরকাল চলবে না। বদল আসবেই। ঠিক এই কথাই বলতেন আমার বাবা। সেই বদল আনার লড়াই করতে করতেই তো চিরকালের মতো আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন বাবা। কিন্তু লড়াই থামবে না। সেই লড়াই এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব এবার আমাদের কাঁধে, লিখছেন তামহিদ। তিনি জানেন, বাবা না থাকলেও, মা আছেন তাঁর পাশে, বদল আনার লড়াইয়ে তাঁকে যে জিততেই হবে।
Comments are closed.