১১ ডিসেম্বর, ২০১৯ সংসদে পাশ হয় নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন বা সিএএ। তারপর কেটে গিয়েছে ৩ মাসেরও বেশি। অথচ সিএএ লাগু হওয়া তো দূরের কথা, মোদী সরকার আজও এর জন্য বিধি প্রণয়ন করেনি। কিন্তু যে আইনকে হাতিয়ার করে বিজেপি তার রাজনৈতিক ডিভিডেন্ড তুলবে ভেবেছিল, তা নিয়ে এই বিলম্বের কারণ কী? সত্যিই কি সিএএ চালু করা নিয়ে কোনও জটিলতা তৈরি হয়েছে, যার জন্য এর বিধি তৈরিতে এই বিলম্ব?
ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা ইন্টেলিজেন্স ব্যুরোর তরফে জানানো হয়েছিল, যাঁরা ধর্মীয় অত্যাচারের কারণে পাকিস্তান, আফগানিস্তান এবং বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে এসে ভারতের নাগরিকত্ব চাইছেন, তাঁদের পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্ত প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে যেতে হবে। কিন্তু এটা পরিষ্কার নয়, ধর্মীয় অত্যাচারের কারণে যাঁরা পালিয়ে এসেছেন তাঁরা কীভাবে অত্যাচারের প্রমাণ দেবেন। বিশেষত, যখন এ বিষয়ে ওই তিন দেশের প্রশাসনের তরফে কোনও সহায়তা ভারত পাবে না।
আরও জানতে ক্লিক করুন, নাগরিকত্ব প্রমাণ কতটা কঠিন, কী বলছে অসমের অভিজ্ঞতা?
আইবির তরফে আরও জানানো হয়েছিল, শরণার্থীদের এ দেশে প্রবেশের সময়ই অত্যাচারের বিবরণ নথিভুক্ত করতে হবে। যদি তা না করা হয় তাহলে এখন সেই দাবি করা এবং তা প্রমাণ করা অত্যন্ত কঠিন। এর ফলে সিএএ-তে উপকৃত মানুষের সংখ্যা এক ধাক্কায় তলানিতে ঠেকবে। কারণ, এ দেশে প্রবেশের সময় অতি সামান্য সংখ্যক মানুষই এই ঘোষণা করেছেন।
পরের প্রশ্ন আইনের গঠনগত বৈশিষ্ট নিয়ে। সমালোচকদের প্রশ্ন, আইনটি যদি নথিপত্রহীন শরণার্থীদের নাগরিকত্ব প্রদানের জন্যই প্রণয়ন করা হয়, তাহলে তাঁরা ধর্ম, কোন দেশ থেকে এসেছেন কিংবা ভারতে প্রবেশের তারিখের (সিএএর ক্ষেত্রে কাট অফ ২০১৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর) সত্যাসত্য প্রমাণ করবেন কী করে?
অসমে এনআরসিতে বিপুল সংখ্যক মানুষ বাদ পড়ার পর বিজেপির দাবি ছিল, যে সমস্ত হিন্দু বাঙালি এনআরসি থেকে বাদ গিয়েছেন, তাঁদের সিএএতে সুবিধা হবে। কিন্তু অসম এনআরসি থেকে বাদ পড়া তালিকা দেখলে বোঝা যায়, কোপ পড়েছে বেশিরভাগ হিন্দু বাঙালির উপরই। এই তথ্য শঙ্কায় ফেলেছে বিজেপিকে। কারণ, এখন বিজেপির পাখির চোখ পশ্চিমবঙ্গ। পাশাপাশি এখানেও রয়েছে মস্ত বড় একটি প্রশ্ন। এনআরসির জন্য হিন্দু বাঙালিরা জানিয়েছিলেন তাঁরা ভারতীয়। কিন্তু তাঁরাই যখন সিএএতে আবেদন করতে যাবেন, তাঁদের লিখতে হবে তাঁরা বাংলাদেশ, পাকিস্তান বা আফগানিস্থান থেকে পালিয়ে এসেছেন। কীভাবে এই বিতর্কের নিষ্পত্তি হবে তা সবচেয়ে বড় মাথাব্যথা মোদী সরকারের।
আরও জানতে ক্লিক করুন, কেন নাগরিকপঞ্জিতে সবচেয়ে সমস্যায় মহিলারা?
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। বাংলাদেশ থেকে আসা শরণার্থীদের সিংহভাগেরই ভোটার আই কার্ড বা অন্য কোনও নথি রয়েছে। আইবিও জানিয়েছিল, বেশিরভাগ মানুষই বিভিন্ন উপায়ে নাগরিকত্বের নানা নথি পেয়ে গিয়েছেন। ফলে তাঁরা ইতিমধ্যেই ভারতের নাগরিক। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, তাঁদের কি নতুন করে সিএএতে আবেদন করতে হবে? কারণ, তা হলে তো স্পষ্ট হয়ে যাবে, তাঁরা নিজেরাই ঘোষণা করছেন যে তাঁরা এ দেশের নাগরিক নন। তা করতে কেউ রাজি হবেন কেন?
এই নানা জটিলতায় আপাতত জর্জরিত বিজেপি। বোঝার উপর শাকের আঁটির মত রয়েছে আইবির বার্তা। তারা জানাচ্ছে, এই সমস্ত সমস্যার কারণেই সিএএ থেকে সামান্য পরিমাণ মানুষই কেবল উপকৃত হবেন। ইন্টেলিজেন্স ব্যুরোর মতে সেই সংখ্যাটা মাত্র ৩০ হাজার!
আর এই তথ্যই রাতের ঘুম উড়িয়েছে কেন্দ্রের। যে সিএএ নিয়ে দেশজুড়ে উচ্চকিত প্রচার চালিয়েছে বিজেপি, লগ্নি করেছে বিপুল রাজনৈতিক পুঁজি, এবার তা নিয়েই চিন্তায় গেরুয়া শিবির। জানুয়ারি মাসে মোদী সরকারের তরফে সংবাদমাধ্যমের একাংশকে জানানো হয়, সিএএতে নাগরিকত্ব পেতে ধর্মীয় অত্যাচারের প্রমাণ দেওয়ার দরকার নেই। কিন্তু ভারতে প্রবেশের তারিখ এবং ধর্মীয় পরিচয় দেখাতেই হবে। তারপর কেটে গিয়েছে অনেকটা সময়। কিন্তু এ বিষয়ে পরিষ্কার করে কিছুই জানাতে ব্যর্থ মোদী সরকার। ফলে সংবাদমাধ্যমের একাংশে জানানো মোদী সরকারের তথ্য আদৌ সঠিক কিনা জানার উপায় নেই।
আরও জানতে ক্লিক করুন, এনআরসিতে নাম তুলতে অসমবাসীর খরচ প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকা!
এ বছরের শুরুতে যোগী রাজ্য উত্তরপ্রদেশে বিশেষ অভিযান চালিয়ে কারা কারা সিএএতে উপকৃত হবেন তার তালিকা তৈরি করা হয়। সেই অভিযানে কী বেরোল তা এখনও অজানা। সর্বভারতীয় নিউজ চ্যানেল এনডিটিভির একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, সম্ভাব্য উপকৃত ব্যক্তিদের ভোটার কার্ড, রেশন কার্ড রয়েছে। যা আইবির রিপোর্টকেই মান্যতা দিচ্ছে। আইবি জানিয়েছিল, বেশিরভাগ শরণার্থীর কাছেই নাগরিকত্ব প্রমাণের বিভিন্ন নথি রয়েছে। তাই তাঁদের ক্ষেত্রে সিএএ অপ্রাসঙ্গিক।
সিএএ আইন পাশের পর ৩ মাস পেরিয়েছে বটে, তবে মোদী সরকারের হাতে বিধি প্রণয়নের (রুল ফ্রেমিং) জন্য এখনও আরও ৩ সময় রয়েছে। এখন দেখতে হবে এই সময়ের ব্যবহার মোদী সরকার কীভাবে করে।
Comments are closed.