নজরুল পরিচালিত ‘রবীন্দ্রসঙ্গীত’কে ‘না’ করে দিয়েছিল বিশ্বভারতী; ত্রাতার ভূমিকা নিয়েছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ

একজন অভিজাত পরিবারের সন্তান। শিক্ষা, সাহিত্য, সংস্কৃতির পীঠস্থান জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়িতে জন্ম, বেড়ে ওঠা। পরে যাঁর জন্য ঠাকুরবাড়িকে চিনবে গোটা বিশ্ব। অন্যজনের জন্ম বর্ধমানের চুরুলিয়া নামে এক অখ্যাত গ্রামের দরিদ্র পরিবারে। যাঁকে শৈশবেই ঘর ছাড়তে হয়। অন্ন সংস্থানের তাগিতে যোগ দিতে হয় সেনাবাহিনীতে। তারপর কলকাতার অনিশ্চিত জীবন। দু’জনের দেখা হওয়ার কথা নয়। কিন্তু একজন আরেকজনের জীবনবৃত্তে এসে পড়েছিলেন। কারণ যাপনের লড়াই সামলে দ্বিতীয়জনও  ইতিমধ্যেই হয়ে উঠেছিলেন বাংলা ভাষার অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি। এবং সেই সঙ্গে দ্বিতীয়জনের ছিল অসীম রবীন্দ্রপ্রীতি। রবীন্দ্রনাথ এবং নজরুল ইসলাম। যাঁদের ব্যক্তিসম্পর্কের নানান ঘটনা নিয়ে পরবর্তীকালে পাতার পর পাতা লেখা হবে। বিদ্রোহী কবির জন্মদিনে ফিরে দেখা যাক তেমনই এক মুহূর্ত। 

নজরুল ইসলাম রবীন্দ্রসঙ্গীত এতটাই ভালোবাসতেন যে ঘন্টার পর ঘন্টা তিনি রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতেও ক্লান্ত হতেন না। তাঁর রবীন্দ্রসঙ্গীত প্রীতি দেখে মুজফফর আহমেদ বলতেন নজরুল রবীন্দ্রসঙ্গীতের হাফিজ (কোরান যাদের কণ্ঠস্থ তাদের ‘হাফিজ’ বলা হয়)। সেই নজরুল ইসলাম পরিচালিত রবীন্দ্রসঙ্গীতে ‘খুঁত’ আছে বলে আটকে দিয়েছিলে বিশ্বভারতী। 

সেটা ১৯৩৮ সাল। তখন সংগীত পরিচালকের ভূমিকায় নজরুল ইসলাম। ইতিমধ্যেই ‘ধ্রুব’, ‘পাতালপুরী’ ‘মুক্তি’, ‘সাপুড়ে’, ‘বিদ্যাপতির’ মতো বেশ কয়েকটি ছবিতে সঙ্গীত পরিচালনা করে ফেলেছেন। এরপরেই ‘দেবদত্তা’ ফিল্মের ‘গোরা’ সিনেমায় সঙ্গীত পরিচালনার দায়িত্ব পেলেন নজরুল। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উপন্যাস নির্ভর করে ছবি। সে সময়ে রবীন্দ্রনাথের গান রেকর্ড করতে গেলে বা কোনও ছবিতে ব্যবহার করতে গেলে ‘বিশ্বভারতী’ সঙ্গীত বোর্ডের অনুমতি নিতে হত। এদিকে নজরুল ভাবতেও পারেননি তিনি যখন ‘সঙ্গীত’ পরিচালকের দায়িত্বে, বিশ্বভারতীর তরফে কোনও আপত্তি আসবে। তাই আর আলাদা করে অনুমতিও নেওয়া হয়নি। 

‘গোরা’ মুক্তি পায় ১৯৩৮ সালের ৩০ জুলাই। তার দিন দুয়েক আগে ছবির এক বিশেষ প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করা হয়। তাতে বিশ্বভারতীর সঙ্গীতবোর্ডের এক পরিদর্শক ছবিটি দেখতে আসেন। ছবিতে নজরুল পরিচালিত রবীন্দ্রসঙ্গীত গুলোর নানা ‘খুঁত’ খুঁজে পেলেন তিনি। আর তাতেই ছবিতে গান ব্যবহারের অনুমতি দিল না ‘বিশ্বভারতী’। আটকে গেল ছবি মুক্তি। ছবির প্রযোজকের তখন মাথায় হাত। 

স্বভাবে জেদি নজরুলও ছাড়বার পাত্র নন। তাঁর পরিচালনা করা রবীন্দ্রসঙ্গীত বিশ্বভারতী অনুমোদন দেবে না, এটা যেন মানতেই পারলেন না আজীবন রবীন্দ্রভক্ত মানুষটা। ছবির ‘ফিল্মটির’ একটি কপি এবং একটি ছোট প্রজেকশন মেশিন নিয়ে সটান রওনা দিলেন শান্তিনিকেতনে। উদ্দেশ্য স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকে গানমুক্তির অনুমতি আদায় করে নিয়ে আসবেন। 

এদিকে নজরুলের এই হঠাৎ হাজির হওয়াতে অবাক হলেও বেশ খুশিও হলেন রবীন্দ্রনাথ। তার আগে অনেকবারই নজরুলকে শান্তিনিকেতনে আসার অনুরোধ করেছেন তিনি। এবারে ক’দিন থেকেও যেতে বললেন। ওদিকে ওদিকে নজরুল জানালেন তিনি কী বিপদে পড়ে শান্তিনেতনে ছুটে এসেছেন। সবটা শুনে রবীন্দ্রনাথ যথেষ্ট বিরক্ত। বাঁধন সেনগুপ্তর ‘রবীন্দ্রনাথের চোখে নজরুল’ রচনা থেকে জানা যায়, কবি নজরুলকে বলেছিলেন, ‘কী কাণ্ড বলতো? তুমি শিখেয়েছ আমার গান আর ওরা কোন আক্কেলে তার দোষ ধরেন? তোমার চেয়েও আমার গান কি ওরা বেশি বুঝবে? আমার গানের মর্যাদা ওরা বেশি দিতে পারবে?’ কবিগুরুর কথায় নজরুল আশ্বস্ত হলেন। সেই সঙ্গে রবীন্দ্রনাথকে জানালেন, লিখিত অনুমতি না পেলে ছবি মুক্তি হবে না। তাই তিনি ফিল্মটি সঙ্গে করেই এনেছেন গুরুদেবকে দেখবেন বলে। রবীন্দ্রনাথ যেন একটিবার ছবিটি দেখে অনুমতি দিয়ে দেন। 

নজরুলের কথায় কবির উত্তর, ‘ছবি দেখাতে চাও, সকলকেই দেখাও, সবাই আনন্দ পাবে’ আপাতত দাও কিসে সই করতে হবে’। বিশ্বভারতীর আপত্তি খারিজ করে নজরুল পরিচালিত রবীন্দ্রসঙ্গীতকে অনুমোদন দিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। নির্দিষ্ট দিনে মুক্তি পেল ‘গোরা’ ।অনুজের প্রতি এতটাই স্নেহ, ভরসা করতেন রবীন্দ্রনাথ। আর ঠিক তেমনই, কারণে অকারণে রবীন্দ্রনাথের কাছে ছুটে যেতে পারতেন নজরুল। এতটাই স্নেহ, প্রশ্রয় পেতেন অগ্রজের কাছে। 

Comments are closed.