এটা ঘটনা যে হরিপদ কেরানি এখন ল্যাপটপে বেশি সময় কাটায়। তার মনোযোগ থাকে মোবাইল ফোনে ও সোশ্যাল মিডিয়ায়। গুলু ওস্তাগর লেনের ঘরে সে আর থাকে না এখন, সে থাকে অভিজাত এলাকার আবাসনে, ফ্ল্যাট বাড়ির সাজানো ঘরে, বাইপাসের ধারে অথবা এ হেন আধুনিক মনস্ক মানুষের নিরাপদ আশ্রয়ে।
চোখের নিমেষে হরিপদ দুনিয়ার তথ্য হাতে পায়, আর ততোধিক দ্রুততায় নিজের মতামত তৈরি করে। তা প্রকাশও করে নানা প্ল্যাটফর্মে। সোশ্যাল মিডিয়া হল হরিপদবাবুর প্রিয় জায়গা, কারণ সেখানে লক্ষ লক্ষ হরিপদ নিজেকে খুঁজে নেয়। আর দল বেঁধে আকবর বাদশার বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে দেয়। আপিসে যাওয়ার সময় ক্যাবে বসে অথবা লোকাল ট্রেনে, বাসে একই কাজে লেগে পড়ে।
এবার হরিপদরা আবাসন প্রমুখ হবে। কিন্তু সেটা আবার কী?
রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের (আরএসএস) নানা স্তরে নানা ‘প্রমুখ’ বা পদাধিকারী আছেন। প্রমুখরা হলেন সঙ্ঘের বিভিন্ন কাজকর্মের দায়িত্বপ্রাপ্ত পদাধিকারী। জাতীয় এবং কয়েকটি রাজ্যের জন্য যৌথভাবে খণ্ড (গ্রামীণ) কিংবা নগর সর্বত্র প্রমুখরা কর্মরত। সেবা প্রমুখ, সম্পর্ক প্রমুখ, প্রচার প্রমুখ, শারীরিক প্রমুখ, বৌদ্ধিক প্রমুখ ইত্যাদি বহুবিধ প্রমুখের উপর সঙ্ঘ চলছে। তাঁদের কাজই সমাজের নানা স্তরে মানুষের মধ্যে সঙ্ঘের ভাবধারা প্রচার করা। তো হঠাৎ করে এখন আবাসন প্রমুখের দরকার পড়ল কেন? এই আবাসন প্রমুখদের কাজ কী হবে?
দিল্লি, নয়ডা, গুরুগ্রামে সঙ্ঘের শাখা মাঠে মাঠে দেখা যায়। কিন্তু আবাসনের মানুষরা সেখানে আসেন না। কারণ, তাঁদের অনেকের কাছে আবাসনটাই সমাজ। ওখানেই হোলি থেকে দিওয়ালি পালন। এই কায়দা এখন শিলিগুড়ি থেকে শুরু করে আসানসোল, দুর্গাপুর, বর্ধমান, বহরমপুর, বারাসত, সোনারপুর কিংবা বাইপাসের ধারের শহর, শহরতলি অঞ্চলেও। দেশজুড়ে শহরাঞ্চলে মোট লোকসভা আসনও নেহাত কম নয়।
সুতরাং আবাসনের মানুষ বাইরের শাখায় না এলে, আবাসনের ভিতরে শাখা চালু করতে হবে। কারণ, এত অল্প পরিসরে এত বেশি ভোট বস্তি এলাকা ছাড়া আর কোথাও নেই। শুধু তাই নয়, চাঁদা তোলা, পত্রিকা বিক্রি, বিজ্ঞাপন পাওয়া ইত্যাদি সব ক্ষেত্রেই এঁরা অনেক বেশি কাজে লাগেন। তাছাডা,সঙ্ঘের পত্রিকা পড়লে, বিভিন্ন বিষয়ে সঙ্ঘের মতামতের দ্বারা প্রভাবিত হলে বিজেপির ভোট বাড়বে, হিন্দুত্ব আন্দোলন জোরদার হবে। সেই কারণেই এবার দিল্লি, নয়ডায় আবাসন প্রমুখ নিয়োগ শুরু করেছে আরএসএস। সঙ্ঘের বিস্তার বাড়াতে বিভিন্ন আবাসনে যেতেও শুরু করেছেন তাঁরা।
মোটামুটি সিপিএমের রাস্তায় হেঁটে গণশক্তি, দেশহিতৈষীর বদলে অরগানাইজার বিক্রি করতে চায় গেরুয়া শিবির। কিন্তু সাইবার যুদ্ধের সময় পদাতিক সেনানীর দরকার হল কেন?
প্রথমত, সঙ্ঘ জানে নোট বন্দি, শিল্প, ব্যবসা ও আর্থিক মন্দা, দেশে সাম্প্রদায়িক অশান্তির পরিবেশ, দলিত বিক্ষোভ, যুবকদের জন্য প্রতিশ্রুতি মতো কাজের ব্যবস্থা করতে না পারা, শরিক হারানো ইত্যাদি নানান কারণে মোদীর পক্ষে আবার জিতে আসা খুব একটা নিশ্চিত নয়।
দ্বিতীয়ত, কংগ্রেস রাহুল গান্ধীর নেতৃত্বে কিছুটা হলেও উজ্জীবিত। এমন কী, সোশ্যাল মিডিয়াতে লড়াই করার কৌশলও কংগ্রেস ভালোভাবে রপ্ত করে ফেলেছে। তার ওপরে বিপ্লব দেবদের কল্যাণে প্রায় রোজই বিজেপি হাস্যস্পদ হচ্ছে।
তৃতীয়ত, মুসলমানদের রাস্তায় নামাজ পড়া, আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ে জিন্নাহর ছবি ইত্যাদি নিয়ে খোলাখুলি সাম্প্রদায়িক রাজনীতি আঁকড়ে ধরা বিজেপির কাছে ব্যাক্তিগত স্তরে বিষ ছড়ানো ছাড়া আর কোনও রাস্তা নেই।
চতুর্থত এবং গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, মধ্যবিত্তকে হাত করতে পারলে নীচের দিকে সমর্থন পেতে সুবিধে হয়। বাবু রাজি হলে বাবুর বাড়ির কাজের লোক বাবুর কথাই মানবে। এখানেই হরিপদরা আজ আকবর বাদশার বিরুদ্ধে খুব গুরুত্বপূর্ণ।
মনে আছে, ২০১৩র শেষ দিক থেকে হরিপদদের কাজ বাড়ে। দিল্লির রাজীব চক মেট্রো স্টেশনে সৌম্যদর্শন কয়েকজন হরিপদ ট্রেনে চেপে বসল। যাত্রীদের হাতে মোদীর সমর্থনে লিফলেট তুলে দিল, শান্তভাবে কিছু কথা বলল, তারপর নেমে গেল দু একটা স্টেশন পরে। তারপর আবার অন্য ট্রেনে।
তখন না হয় উন্নয়ন ছিল মূল বক্তব্য। কিন্তু এখন তো হিন্দু রাষ্ট্র গঠনের কাজ চলছে। হরিপদরা জানে, এ কাজে লোক জোটান সহজ। আগে, পশ্চিমবঙ্গের হরিপদরা বিশ্ব শান্তি দিবস বা কিউবা, নিকারাগুয়ার জন্য হেঁটেছে, তাই আকবর তাড়াতে হরিপদ খুন্তি নিয়েও বেরোতে পারে।
(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)