কে বলে বিজেপির ‘মাইনরিটি’ প্রেম নেই। গোয়া, মণিপুর, মেঘালয়ের পর কর্ণাটকে মাইনরিটি থেকে অর্থাৎ সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পেয়েও যেভাবে রাজভবনের সং(ঘ)বিধানের জোরে শাসন ক্ষমতা দখল করলো, তাতে সন্দেহ জাগে, বিজেপি-আরএসএস ভবিষ্যতে কী করতে চাইছে?
বামেদের মতোই পদাতিক সৈন্যে সবল সংঘ পরিবার বস্তুত ২০১৪ সালের পর থেকে ভারতবর্ষের অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানে নিজেদের আধিপত্য কায়েম করেছে। কেন্দ্র ও ২২টি রাজ্যের সরকারি দফতরে আরএসএস নিজেদের ও শাখা সংগঠনের সভ্যদের পাকাপাকি বা অস্থায়ীভাবে নিযুক্ত করে সার্বিক সরকারি নীতি তৈরি ও রূপায়নের উপর নিজেদের মতামত প্রতিষ্ঠিত করেছে। যদিও, তারা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে না। বামেদের থেকে এক্ষেত্রে তারা আলাদা।
মোদী জমানায় দুর্নীতিদমন, মূল্যরোধ, অর্থনীতি, শিল্প, শিক্ষা, কৃষি, বাণিজ্য, বিদেশনীতি,,আভ্যন্তরীণ প্রতিরক্ষার যতই খাস্তা হালত হোক না কেন, এখনও অবধি ২০১৯ এ মোদী যাচ্ছে বলার মতো হিম্মত মমতা বন্দোপাধ্যায় ছাড়া আর কারও নেই। তাই প্রশ্ন জাগে, লোকসভা নির্বাচনের আগে কর্ণাটকে ইয়েদুরাপ্পাকে মুখ্যমন্ত্রীর আসনে যেন তেন প্রকারেণ বসিয়ে তাদের কী লাভ? তারা কী পেতে চাইছে ভবিষ্যতে?
রাজনৈতিক মহলের মতে, বিজেপির এখন ‘ইন্দিরা পর্ব’ চলছে। ১৯৬৬ থেকে ১৯৭৬ অবধি ইন্দিরা গান্ধী এইভাবেই রাষ্ট্রপতি ও রাজ্যপালের পদে কংগ্রেসি নেতাদের বসিয়ে নিজের মর্জি মতো সরকার ভেঙেছেন, পছন্দমতো পুতুল মুখ্যমন্ত্রী বসিয়েছেন, কেন্দ্রীয় এজেন্সিগুলিকে কাজে লাগিয়ে বিরোধী রাজনীতির জায়গা ছোট করে এনেছেন, সংবিধান সংশোধন করে যুক্তরাষ্ট্রীয় গঠনকে দুর্বল করেছেন এবং অবশেষে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে একনায়কতন্ত্রের দিকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন ৩০ বছরের যুবক রাষ্ট্র ভারতকে।
সঙ্ঘ পরিবারও তাঁর অত্যাচারের শিকার হয়েছে। যদিও ইন্দিরার প্রতি তাদের অতটা ঘৃণা ছিল না, যতটা ছিল তাঁর পিতা ‘কমিউনিষ্ট ও সেক্যুলার’ নেহরুর প্রতি। বাংলাদেশ যুদ্ধে জয়ের নায়িকা ইন্দিরাকে ১৯৭৭ এ দেশ কঠিন শাস্তি দেয় এবং জনসংঘ সরকারে যোগদান করে। বাজপেয়ী, আদবাণী মন্ত্রী হন। মজার কথা, ১৯৭৭ এ দেশের অধিকাংশ রাজ্যে কংগ্রেসই ক্ষমতায় ছিল, যেমন আজ বিজেপি আছে। কিন্তু ইতিহাসে মনোযোগী আরএসএস সেই ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিতে চাইছে না কেন? সংবিধানের অভিনব ব্যখ্যা করে, তার ফাঁকফোকর দিয়ে যে কোনও মূল্যে কর্ণাটকে ক্ষমতা দখল করে আসলে কোন লক্ষ্যে পৌঁছতে চায় তারা?
দু’দশক আগে ১৯৯৯ সালের ১৭ এপ্রিল এই রকমই এক গ্রীস্মের দিনে অনাস্থা প্রস্তাবে দীর্ঘ বিতর্কের পর মাত্র ১ ভোটে হেরে যান বিজেপি প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ী। হারের পর বিজেপি সাংসদরা ফ্লোর ম্যানেজার সাংসদ প্রমোদ মহাজনকে হারের জন্য দায়ী করেন, সংসদের মধ্যেই সাংসদ বিজয়রাজে সিন্ধিয়া কান্নায় ভেঙে পড়েন। কিন্তু বাজপেয়ী লোকসভার রেজাল্ট মনিটরে ফুটে ওঠা মাত্র মাথায় হাত ঠেকিয়ে পদত্যাগপত্র জমা দিতে চলে গেলেন। তাঁর সেই রাজকীয় হার স্বীকারই কয়েক মাস পরে তাঁকে সংখ্যাগরিষ্ঠতা দিয়ে ফিরিয়ে আনল পাঁচ বছরের জন্য প্রধানমন্ত্রী করে। অথচ ‘বিকাশ’ বা উন্নয়নের কথা বলে ভোটে জিতে আসা মোদী এবং আরএস এস ‘বিকাশ’কে তো ত্যজ্যপুত্র করলেনই, আবার ‘বিবেক’কেও ঘাড় ধাক্কা দিয়ে ঘর থেকে বার করতে দ্বিধামাত্র করলেন না।
নোটবন্দীর পরে আরএসএস থেকে উঠে আসা মোদীর ঘনিষ্ঠ বিজেপি নেতা রাম মাধব সগর্বে ঘোষণা করলেন, মোদীর পিছনে ‘মব’ বা উন্মত্ত জনতা আছে। জনতার উন্মাদনা সংঘ পরিবারের রাজনীতির জন্য খুব প্রয়োজনীয় এবং সেই উন্মাদনা সৃষ্টির প্রধান উপকরণ হলো রাগ, ঘৃণা এবং প্রতিহিংসার খিদে। এনডিএ জোটের বাধ্যবাধকতায় বাজপেয়ী সরকারের সময় সংঘ তাদের উন্মাদনাকে নিয়ন্ত্রিত রেখেছিল। ২০০৪ সালে আবার ক্ষমতায় ফিরলে কী হতো অবশ্য বলা যায় না।
আজ পাল্টে গেছে দেশবাসীর আলোচ্য বিষয়ের তালিকা। দেশের মানুষ অভ্যস্ত হয়ে উঠছে এমন সব ঘটনার সঙ্গে, যা কোনও দিন ভাবা যেত না। এখন গোমাংস ভক্ষণ করার সন্দেহে মুসলিম, দলিতদের খুন করা যায়। মুসলমানদের সাপ্তাহিক নামাজে গিয়ে তাদের বিরক্ত করা যায়। দলিত ছেলে বিয়ের সময় ঘোড়ায় চড়লে তাকে পিটিয়ে মেরে তাকে নারী নির্যাতনকারী অপবাদ দেওয়া যায়। রাণা প্রতাপকে হলদিঘাটের যুদ্ধে জিতিয়ে দেওয়া যায়। সাংবাদিকদের জন্য অলিম্পিকের আয়োজন করে কী কী লিখতে হবে, কোন ইতিহাস মানবে তা ঠিক করে দেওয়া যায়। রামনবমীর নামে অস্ত্র নিয়ে মিছিল করা যায়, দাঙ্গা লাগানো যায়, দাঙ্গার ও সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপের অভিযুক্তদের নির্বিবাদে মুক্ত করা যায়, জাল ভিডিও দেখিয়ে দেশদ্রোহী তকমা লাগিয়ে জেলে পোরা যায়, ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থা, বিচারব্যবস্থা, সংসদ, মিডিয়ার নিরপেক্ষতা নিয়ে ছেলেখেলা করা যায় এবং সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পেয়ে অখন্ড রংবাজিতে সরকার গড়া যায়। যেমন কর্ণাটকে হলো।
সাংগঠনিক দিক কংগ্রেস এত দুর্বল কখনও ছিল না। সোনিয়া গান্ধী প্রাক্তন সভাপতি আর রাহুল শিক্ষানবিশ সভাপতি। এঁদের ভরসা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, লালুপ্রসাদ, চন্দ্রবাবু নায়ডুর মতো শক্তিশালী আঞ্চলিক নেতারা। আরএসএস জানে, তাদের হিন্দু রাষ্ট্র গঠনের নাউ অর নেভার মোমেন্ট এখন। যে কোনও মূল্যে রাজ্যে রাজ্যে নিজেদের সরকার থাকলে, রাজভবনে শাখাধারীরা থাকলে কাজটা সহজ। একটা সংবিধান সংশোধনই তো দরকার! হয়ে যাবে। রাজ্য সরকারগুলি সম্মতিও দেবে। বাকি কাজ ৯০ বছর ধরে ‘জয় মা ভবানী’ বলে যারা লাঠি, তলোয়ার চালনার অনুশীলন করছে তারা করে দেবে। নির্বাচন কমিশনকে তখন জলসেচ উন্নয়নের কাজে লাগানো যেতে পারে।
ইয়েদুরাপ্পা আগে কর্ণাটকের মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন এবং দুর্নীতির অভিযোগে তাঁকে পদত্যাগ করতে হয়। সে তো অমিত শাহও খেটেছেন এবং তাঁকে মিডিয়ার ( অধুনা বাংলা চ্যানেলও) লোকজন চাণক্যের আসনে বসিয়ে দিয়েছে। সে কথা থাক! কিন্তু বিজেপির কাছে কি মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার যোগ্য আর কেউ ছিল না। উত্তরপ্রদেশে যেমন মন্দিরের গেরুয়াধারী পুরোহিতকে মুখ্যমন্ত্রী করা হলো, মুখ বাঁচাতে তাও তো করা যেত পারতো। তাতে মোদীর দুর্নীতিবিরোধী ইমেজ বাঁচতো। কিন্তু আরএসএস তো ইয়েদুরাপ্পার ব্যাপারে আপত্তি জানায়নি। কর্ণাটকে তো বিজেপি আগেও ক্ষমতায় ছিল, তাই দাক্ষিণাত্যে দলের প্রসার করার মোদীর যুক্তি ধোপে টেকে না। আপাতত দেখা যাক, বিজেপির ইন্দিরা পর্ব কোন অচ্ছে দিন নিয়ে আসে। দেশের পক্ষে, দলের পক্ষে আর ইন্দিরার নাতির পক্ষে।