বিভিন্ন প্রজাতির গাছের জিপিএস যুক্ত অনলাইন ডেটা ব্যাঙ্ক তৈরির উদ্যোগ শিলিগুড়ির ‘সোয়ান’-এর

স্কাই ওয়াচার্স অ্যাসোসিয়েশন অফ নর্থ বেঙ্গল, সংক্ষেপে সোয়ান। এই অ্যামেচার অ্যাস্ট্রোনমি ক্লাব বা সংগঠনটি মূলত জ্যোতির্বিদ্যা সম্পর্কিত কাজকর্মের জন্য প্রসিদ্ধ হলেও, সম্প্রতি তারা বিভিন্ন প্রজাতির গাছ নিয়ে এমন এক অভিনব উদ্যোগ নিয়েছে, যা রীতিমতো নজিরবিহীন।  বিভিন্ন প্রজাতির (যার বেশ কয়েকটি দুস্প্রাপ্য) গাছের একটি তথ্য ভাণ্ডার গড়ে তোলার চেষ্টা করছে এই সংগঠনটি। গাছ নিয়ে তথ্য ভাণ্ডার বা ডেটা ব্যাঙ্ক তৈরি নতুন কিছু নয়, দেশের বিভিন্ন বোটানিক্যাল গার্ডেনে এনিয়ে অজস্র তথ্য রয়েছে। তবে সোয়ানের কৃতিত্ব অন্য জায়গায়। তারা গোটা তথ্য ভাণ্ডারটি অনলাইনে বা ইন্টারনেটের মাধ্যমে জন সাধারণের কাছে তুলে ধরতে চাইছেন, এবং সবচেয়ে চমকপ্রদ বিষয় হল, জিপিএস বা জিও ট্যাগিং এর মাধ্যমে প্রত্যেকটি গাছের আলাদা আলাদা তথ্য সাধারণ মানুষের সামনে তুলে ধরার পরিকল্পনা নিয়েছে ‘সোয়ান’। অর্থাৎ, শতাধিক গাছের মধ্যে থেকে আপনি যদি নির্দিষ্ট একটি গাছের বিষয়ে জানতে চান, আপনি স্মার্ট ফোন, কম্পিউটার, ল্যাপটপ বা ট্যাবের সাহায্যে জিপিএস প্রযুক্তির মাধ্যমে বাড়িতে বসেই তা জানতে পারবেন।

দেবাশিস সরকার

গোটা পরিকল্পনা ও পদ্ধতি ব্যাখ্যা করেছেন সোয়ান’ এর প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক দেবাশিস সরকার। তিনি জানিয়েছেন, শিলিগুড়ি থেকে ৮-১০ কিলোমিটার দূরে শাহুডাঙ্গি রামকৃষ্ণ মিশন আশ্রম রয়েছে। শহর থেকে কিছুটা দূরে হওয়ায় সেখানে আকাশ অনেক পরিষ্কার ও ধূলিকণামুক্ত। এই আশ্রমের পরিসর ব্যবহার করেই বেশ কিছু বছর ধরে জ্যোতির্বিদ্যা চর্চার কাজ চালাচ্ছে সোয়ান। দেবাশিসবাবু জানিয়েছেন, ১৯৫৯ সালে গড়ে ওঠা এই আশ্রমের প্রায় ২২ একর জায়গাজুড়ে কম-বেশি ২০০ প্রজাতির ৩৫০ টিরও বেশি গাছ রয়েছে। যার মধ্যে বেশ কিছু গাছ দুষ্প্রাপ্য বা দেশের অন্যান্য অংশে পাওয়া গেলেও এখানে সেরকম চোখে পড়ে না। পরে তাঁরা খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন, এত গাছ থাকলেও সেগুলি সম্পর্কে বিশেষ কোনও তথ্য আশ্রম কর্তৃপক্ষের কাছে নেই। মাস কয়েক আগে তাঁরা সিদ্ধান্ত নেন, গাছগুলির যাবতীয় তথ্য নিয়ে একটি ‘তথ্য ভাণ্ডার’ গড়ে তোলার। এই উদ্যোগে সম্মতি দেয় আশ্রম কর্তৃপক্ষ।

দেবাশিস সরকার জানিয়েছেন, দেশের বিভিন্ন বোটানিক্যাল গার্ডেনে (এরাজ্যের হাওড়া শিবপুর ও দার্জিলিং-এও রয়েছে এরকম দুটি বাগান) সেখানকার উদ্ভিদ সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য থাকলেও, সেগুলি জানতে সাধারণ মানুষকে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়। মূলত সংশ্লিষ্ট বিষয়ে জড়িত ছাত্র-ছাত্রী, গবেষক-অধ্যাপক-শিক্ষকদের সেগুলি ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া হয়। তাই তাঁরা পরিকল্পনার করেন, আধুনিক প্রযুক্তির সহায়তায় এই তথ্য ভাণ্ডার গড়ে তুলবেন এবং তা যাতে সাধারণ মানুষ সহজেই জানতে পারেন তার ব্যবস্থা করা হবে।
চলতি বছরের ২২ এপ্রিল থেকে শুরু হয় কাজ। দেবাশিসবাবু জানিয়েছেন, এই আশ্রমের প্রায় ৩০০ টি গাছের প্রত্যেকটির তথ্য (বৈজ্ঞানিক নাম, গণ, গোত্র, প্রজাতি, বয়স, গাছের ফুল-ফল-পাতা-ছালের প্রকার ইত্যাদি) আলাদা আলাদাভবে নথিভুক্তির কাজ চলছে। পাশাপাশি, প্রতিটি গাছের আলাদা আলাদা ‘নাম্বারিং’ করে সেগুলির গায়ে বসানো হচ্ছে সেই গাছটি সম্পর্কিত বিভিন্ন তথ্য। যার ফলে নিখুঁত জিপিএস প্রযুক্তির মাধ্যমে যে কেউ যেখান থেকে ইচ্ছে ইন্টারনেটের মাধ্যমে নির্দিষ্ট এক বা একাধিক গাছের তথ্য জানতে পারবেন। এই গোটা প্রক্রিয়ায় ‘সোয়ান’কে সাহায্য করছেন শিলিগুড়ি কলেজের বোটানির তৃতীয় বর্ষের ছাত্র কৌশল আগরওয়াল, আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র সায়েন্স কলেজের  ফিজিক্সের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র জন্মেঞ্জয় সরকার। সংগঠনের কার্যকরী সভাপতি শিশির রায়নাথও এই কাজে যথেষ্ট উৎসাহ দেখিয়েছেন।


কিন্তু কী করে আমি আপনি বাড়িতে বসে এই যাবতীয় তথ্য নিজেদের হাতের মুঠোয় পাব? তারও ব্যাখ্যা দিয়েছেন দেবাশিসবাবু। তিনি জানিয়েছেন, জিও ট্যাগিং ও জিপিএস-এর মাধ্যমে তাঁরা ওই আশ্রমের ম্যাপ ও গাছগুলির তথ্য ‘গুগল ম্যাপ’এ সংযুক্ত করছেন। তথ্য জানার জন্য থাকছে কিউ-আর কোড। ওই কোডের ছবি মোবাইল, ল্যাপটপ বা ট্যাবের মাধ্যমে স্ক্যান করলেই স্বয়ংক্রিভাবে গুগল ম্যাপের মাধ্যমে আপনি ওই নির্দিষ্ট এলাকার ছবি দেখতে পাবেন। এরপর গাছগুলির নির্দিষ্ট সংখ্যা (নাম্বারিং) ধরে ধরে জানতে পারবেন সেই গাছটির অজানা তথ্য। দেবাশিসবাবু জানিয়েছে, ২০১৮ সালের অগাস্ট মাসের মধ্যে এই কাজ শেষ হবে বলে তাঁরা আশাবাদী। আপাতত সংগঠনের সদস্যরা নিজেরাই এই কাজে অর্থ সাহায্য করছেন।
১৯৮৭ সাল থেকে পথ চলা শুরু করেছে স্কাই ওয়াচার্স অ্যাসোসিয়েশন অফ নর্থ বেঙ্গল। সংঠনটির মূল কার্যালয় শিলিগুড়িতে হলেও জলপাইগুড়ি, কলকাতা, গুজরাতের মতো বিভিন্ন জায়গায় তাদের শাখা রয়েছে। এছাড়াও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও রয়েছেন সোয়ানের সদস্যরা। ‘নাসা’র অ্যাকাডেমিক শাখারও সদস্য ‘সোয়ান’। তবে সংগঠনটির তরফ থেকে জানানো হয়েছে, তারা পাকাপাকিভাবে জ্যোতির্বিদ্যা ছেড়ে উদ্ভিদ চর্চা করছেন না। দেবাশিসবাবু জানিয়েছেন, আকাশের দিকে চোখ রাখলেও দাঁড়াতে হয় সেই মাটিতেই। আর গাছ কমে গেলে বাতাসে ধূলিকণার পরিমাণ বাড়ে, ফলে অসুবিধা হয় আকাশ পর্যবেক্ষণে। তাই মাটির গাছেদের কথা ভেবে তাঁরা এই উদ্যোগ নিয়েছেন।

Leave A Reply

Your email address will not be published.