অস্বীকার করতে পারি না যে, সব ভারতীয়র মতোই কোভিড-১৯ এর খুঁটিনাটি ও প্রভাব বুঝতে আমাদেরও কিছুটা সময় লেগেছিল। করোনাভাইরাসকে এড়িয়ে চলার জন্য যে সামাজিক দূরত্বের কথা বলা হয়, ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহে ভারতে প্রথম কিছু সংক্রমনের খবর আসে, কার্যক্ষেত্রে তা প্রয়োগ করতে আমাদের বেশ দেরি হয়ে যায়। কারণ, এটি আমাদের জীবনে একটি নতুন, অচেনা মহামারি।
মার্চের মাঝামাঝি সময়ে যখন মিডিয়ার মাধ্যমে দ্রুত নিউজ ছড়াতে থাকে এবং একই সাথে রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকার সবাইকে করোনাভাইরাস সম্পর্কে সচেতন ও শিক্ষিত করতে শুরু করেন, তখন ৬০০ র বেশি সিদ্ধা টিম মেম্বার, সিদ্ধা ফ্যামিলি ও সাইটগুলিতে কর্মরত আমাদের হাজার হাজার শ্রমিকের সম্বন্ধে আমরাও চিন্তিত হয়ে উঠি।
মার্চের তৃতীয় সপ্তাহ নাগাদ এই ভাইরাসের সংক্রমক চরিত্র সম্পর্কে একটা স্পষ্ট ধারণা পাই। সঙ্গে সঙ্গে সাইট ও অফিসগুলিতে হাত ধোয়া ও হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহার করার সতর্কতা নেওয়া হয়। যদিও তখনও পর্যন্ত সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে কত সময়ের জন্য কাজ বন্ধ করতে হবে তা আমরা জানতাম না।
১৯ মার্চ নাগাদ সামাজিক দূরত্বের প্রস্তুতির ব্যাপারে আমরা স্বচ্ছ ধারণা পাই। তারপর যেদিন সন্ধ্যায় প্রধানমন্ত্রী ২২ মার্চ রবিবার স্ব-আরোপিত কারফিউ-এর কথা ঘোষণা করেন, সেদিন থেকেই আমরা সিদ্ধা টিম মেম্বারদের অফিস থেকে দূরে রাখার সিদ্ধান্ত নিই।
২১ মার্চ থেকে অফিস না যেতে পেরে প্রথম ৭-১০ দিন খুব অনিশ্চিত ও উদ্বিগ্ন ছিলাম। মনে হচ্ছিল এই আইসোলেশন মেনে চলা যথেষ্ট কঠিন ও অবাস্তব। একই সময়ে খুঁজছিলাম এর থেকে বেরিয়ে আসার উপায়।
এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহের আশেপাশে আমরা নিশ্চিত হলাম, সামাজিক দূরত্ব সাবধানে মেনে চললে করোনাভাইরাস সংক্রমণের খুব অল্প বা শূন্য সম্ভাবনা থাকে। ইউটিউবের একটি ওয়েবিনার-এর মাধ্যমে আমরা ৬০০ র বেশি টিম মেম্বারকে আত্মবিশ্বাসী ও বর্তমান পরিস্থিতিতে ভয় না পাওয়ার বার্তা দিলাম। এই সময়ে তাঁদের বাড়িতে থাকতে হবে, সামাজিক দূরত্ব মানতে হবে ও মেডিক্যাল প্রাকটিশনারদের দ্বারা নির্দেশিত সব সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। আর প্রোডাকটিভ ভাবতে হবে। আমি তাঁদের এও ভরসা দিলাম, আমরা যদি সতর্ক থাকি এবং প্রশাসনের পরামর্শগুলি মেনে চলি, তবে কেউ এই ভাইরাস দ্বারা সংক্রমিত হবে না, আমরা সুস্থ থাকলে দেশও থাকবে সুস্থ।
ওই ৭-৮ দিন এই বিশ্বব্যাপী মহামারি কবে শেষ হবে ও কোভিড-১৯ এর পরে ব্যবসা কোথায় দাঁড়াবে, সেই ব্যাপারে কোনও দুশ্চিন্তা করিনি। আমি পুরো সময়টা বাড়িতে পরিবারের সাথে কাটিয়েছি। কোনও জরুরি কাজে বাইরে বেরতে হলে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখেছি ও টিমকেও তাই মানতে বলেছি।
৭-৮ দিনের আইসোলেশন ও বিশ্রামের পর অনুভব করলাম পরিস্থিতি নিয়ে আরও না ভেবে, লকডাউন উঠলে কাজকর্ম আবার কীভাবে শুরু করা যায় সেই বিষয়ে প্ল্যানিং করা দরকার। একটি দৃঢ় বিশ্বাস তৈরি হল, আমাদের টিম মেম্বার, তাঁদের পরিবারের আড়াই হাজারের বেশি সদস্য ও একই সাথে ৫ হাজারের বেশি ফ্ল্যাট ক্রেতা, যাঁদের সময় মতো ডেলিভারির কথা দেওয়া হয়েছিল, তা নিশ্চিত করতে এই সংকটের সময় পেরতেই হবে।
এই সময়েই বিভিন্ন রিয়েল এস্টেট, মেডিক্যাল প্রফেশনাল, রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধান ও দেশের বহু বিশেষজ্ঞ করোনাভাইরাস কী, করোনা থেকে বাঁচার উপায়, লকডাউন পরবর্তী অর্থনৈতিক অবস্থা ও কেমন মন্দা আসতে পারে তা নিয়ে অনেক কথা বলছিলেন। আমিও সেসব শুনলাম।
আমাদের কোম্পানির ভবিষ্যৎ পরিকল্পনায় নিযুক্ত হয়েই , ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মগুলির মাধ্যমে কথা হল কোর টিম মেম্বার ও বিভাগীয় প্রধানদের সাথে। লকডাউনের পরে আবার কাজ শুরুর প্রস্তুতি ও পরিকল্পনা এবং এর মাঝে নিজেদের সাংগঠনিক কাজ সেরে ফেলার ব্যাপারে সবাই একমত হলাম।
১০ এপ্রিল থেকে বাড়ি থেকেই আমরা পুরোদমে কাজ করছি। সময়ের ৭০ শতাংশ কাজে ও বাকিটুকু পরিবারের জন্য, এভাবেই ভাগ করা ছিল। দিনে ৫-৭ ঘণ্টা প্রত্যেক সিদ্ধা সদস্য লকডাউনের পরে ব্যাবসায়িক কার্যপ্রণালী কী হবে, তার প্রস্তুতি ও পরিকল্পনায় ব্যবহার করেন। এর মধ্যে আমরা সবাইকে মনে করিয়েছি যে, আমাদের সবরকমের সতর্কতা মেনে চলতে হবে, যা রাজ্য সরকার বারে বারে আমাদের মানতে বলছেন।
আমাদের ইঞ্জিনিয়ারিং টিমের হিসেব, বাজেট, রিকনসিলিয়েশন ও লকডাউন উঠলে ভবিষ্যৎ ব্যবসার টাইম প্ল্যান বানাতে ও কনট্রাক্টরদের কীভাবে কাজে যোগ দেওয়ানো যায়, সেই বিষয়েও ভাবা শুরু হয়। সাইটগুলির কাজের একটি স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রোসিডিওর তৈরি করা হয়। যেখানে ভিডিও বানানো হচ্ছে শ্রমিকদের সতর্কতা পদ্ধতি জানানোর জন্য, যেগুলি মেনে লকডাউন উঠলে তাঁরা কাজ করতে পারবেন। এখন আমরা কাজ শুরু হওয়ার পরে যে সব কষ্ট সামলাতে হবে, তাঁর জন্য নিজেদের প্রস্তুত করছি।
আমার ধারণা, এই প্যানডেমিকের তিনটি পর্যায় বা ফেজ হবে। প্রথম পর্যায় হল, এই চলতে থাকা লকডাউন পিরিয়ড। যার সময়কাল আমার মতে অনিশ্চিত। এই সময়ে আমাদের কাজকর্মের বিভিন্ন ভার্টিকালগুলির পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি নিচ্ছি, যেমন ইঞ্জিনিয়ারিং, মার্কেটিং, কাস্টমার সার্ভিস, লিগাল ইত্যাদি। আর এই সময় আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা যতটা সম্ভব কম রাখতে সব নিয়ম ও বিধান মেনে চলতেই হবে। এতে নতুন কেসের সংখ্যা তাড়াতাড়ি কমবে ও লকডাউন শেষ হওয়ার দিকে আমরা এগোব।
লকডাউনের পর আসবে দ্বিতীয় পর্যায়, যখন কর্তৃপক্ষের নির্দেশ অনুসারে গাইডলাইন, স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিওর ও সামাজিক দূরত্ব মেনে ধাপে ধাপে কাজকর্ম শুরু হবে। শুরু হওয়ার পরে দ্বিতীয় পর্যায়টি তিন থেকে ছয় মাস পর্যন্ত চলবে বলেই আশা করি। এইটিই হবে সবচেয়ে কঠিন সময়। তবুও আমি আশাবাদী যে, মাদার নেচার এই অকল্পিত ভীতির থেকে বেরিয়ে আসার রাস্তা ঠিক দেখাবেন ও তৈরি করবেন।
দ্বিতীয় পর্যায়ে ঢোকার সময়ে আমাদের কিছু সমস্যার ব্যাপারে মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকতে হবে। যেমন আর্থিক কষ্ট, শ্রমিকদের অনুপস্থিতি, পরিবহণ, বিশেষ করে গণপরিবহণ যাঁরা ব্যবহার করেন তাঁদের অসুবিধা এবং একই সময়ে দূরত্ব বজায় রাখা। আমাদের নিশ্চিত করতে হবে আমরা, কোনও সিদ্ধা টিম মেম্বার ও তারও বাইরে অনেক সংখ্যক শ্রমিক, কনসালটেন্ট ও কাস্টমারের কেউ যেন আক্রান্ত না হই। এই সময়টি সাফল্যের সাথে সবাই মিলে পেরিয়ে গেলে আসবে তৃতীয় পর্যায়, যেটি আমার মনে হয় শুরু হবে খুবই পজিটিভভাবে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, এই কঠিন সময় পেরিয়ে আবার এক সুন্দর পৃথিবী ও শক্তিশালী অর্থনীতি গড়ে উঠতে পারে।
বাড়িতে থাকুন। নিরাপদে থাকুন।
Comments are closed.