Corona impact: সঞ্চয় করতে শিখুন, করুন হেলথ ইনস্যুরেন্স! আপৎকালীন ফান্ডই ভবিষ্যতে এই ধরনের পরিস্থিতি থেকে বাঁচাবে

লকডাউন। বিশ্বব্যাপী মহামারি থেকে বাঁচার একটাই উপায়। আমরা সবাই এখন বাড়িবন্দি। একদিকে যেমন আমাদের কাজকর্ম ও অন্যান্য বিষয়বস্তুতে বাধা পড়েছে, তেমনই এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে আমাদের অনেকের আয়ও সংকুচিত হয়েছে। এর ফলে যে শুধুমাত্র ব্যবসায়ীরাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন এমনটা নয়। যাঁরা চাকুরীজীবী, তাঁরাও একইভাবে সমস্যায় পড়েছেন। খবরের কাগজ বা টিভির চ্যানেল খুললে খবর পাচ্ছি, লকডাউনের জেরে অনেক চাকুরীজীবীও তাঁদের রোজগারের সংস্থান হারিয়েছেন বা অনেক সংস্থার কর্মীর বেতন কাটছাঁট হচ্ছে।
কিন্তু এই লকডাউনের জেরে আয়ে ঘাটতি পড়লেও আমাদের খরচ কিন্তু কমেনি। একমাত্র কমেছে আমাদের রোজ কাজে বেরনোর বা অফিসের যাতায়াতের খরচ। এছাড়া বাকি সব আগের মতোই রয়েছে। ইলেকট্রিসিটি বিল, বাড়ি ভাড়া, রান্নার গ্যাস থেকে শুরু করে চাল, ডাল, আটা, টুথপেস্টের খরচ, সব আগের মতোই রয়েছে। কিন্তু আপনার ইনকাম তো প্রায় বন্ধ। অনেক মানুষ সরকারি সাহায্যের উপরই এখন নির্ভরশীল হয়ে পড়েছেন। আর মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো নিজেদের সঞ্চয়ের টাকা ভাঙিয়েই দিন কাটাচ্ছেন।
এই করোনাভাইরাসের জেরে গত এক মাসের উপর যে লকডাউন গোটা দেশ দেখেছে, তা আমাদের অনেক কিছুই শিখিয়েছে। এর থেকে পাওয়া শিক্ষাগুলোর অন্যতম হল সঞ্চয় করার শিক্ষা। আমরা সবাই রোজগার তো করি, কিন্তু সঞ্চয় করি কতটুকু? প্রাচীনকালে কৌটিল্যের লেখা অর্থশাস্ত্রের কথাই ধরা যাক। সেখানেও কিন্তু রাজাকে আপৎকালীন পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য একটি তহবিল তৈরি করার পরামর্শ দিয়েছিলেন। কিন্তু আপৎকালীন পরিস্থিতির মোকাবিলার জন্য নিজেদের সঞ্চয়ের কতটুকুই বা তুলে রাখছি আমরা? আশা করছি এই মহামারি থেকে শিক্ষা নিয়ে এবার কিছুটা হলেও সতর্ক হব আমরা। করোনাভাইরাসের এই মহামারি পরবর্তী সময়ে কী ধরনের আর্থিক সংকটের মুখে আমাদের পড়তে হবে তা কেউ জানি না। কাজেই এই পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পেলে আমাদের সবার প্রথম কাজ নিজের ও পরিবারের কথা ভেবে একটি আপৎকালীন তহবিল তৈরি করা। যেখান থেকে এই ধরনের পরিস্থিতি মোকাবিলা করার জন্য অর্থের যোগান বজায় রাখা যায়।
অনেকেই বলবেন, তাঁরা প্রভিডেন্ড ফান্ডে টাকা রাখেন। বা মাসে মাসে এলআইসিতে প্রিমিয়াম দেন। হ্যাঁ, সেটা সঞ্চয়ই বটে। সেটা অবশ্যই দরকার। তবে, আপৎকালীন পরিস্থিতিতে খুব সহজেই কি সেখান থেকে আপনার জমানো অর্থ তুলতে পারবেন? হয়ত না।
সমীক্ষা বলছে, আমাদের মাস মাইনের প্রায় ৩০ শতাংশ টাকা সংসারের খরচ চালাতে ব্যয় হয়। বাকি ৩০ শতাংশ বিভিন্ন ধরনের ইএমআই থেকে শুরু করে প্রিমিয়াম দিতেই চলে যায়। দেখা যাচ্ছে, পড়ে থাকা বাকি ৪০ শতাংশের প্রায় ৩০ শতাংশ আমাদের লাইফস্টাইল মেন্টেন করতেই চলে যায়। বাকি পড়ে থাকা ১০ শতাংশ আমরা জমাই। কিন্তু না! এবার এই পরিস্থিতে বদল আনতে হবে। অন্তত ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ টাকা আমাদের জমাতেই হবে। তবেই আগামীতে এই ধরনের কিছু অদেখা দুর্যোগের মোকাবিলা শক্ত হাতে করতে পারব আমরা।
মূলত চার ধরনের রোজগার আমরা করি। অ্যাকটিভ ইনকাম, সেমি অ্যাকটিভ ইনকাম, প্যাসিভ ইনকাম গ্যারান্টেড ও প্যাসিভ ইনকাম নন-গ্যারান্টেড। আমারা চাকরি বা ব্যবসা থেকে যা রোজগার করি সেটা আমাদের অ্যাকটিভ ইনকাম। আপনি ধরুন কাউকে বাড়ি ভাড়া দিলেন, বা কাউকে কোনও যন্ত্রপাতি ভাড়া দিলেন, সেটা আপনার সেমি অ্যাকটিভ ইনকাম। ধরুন আপনি এলআইসি বা অন্য কোন সংস্থার এমন কোন স্কিমে ইনভেস্ট করলেন যেখান থেকে মাসে কিছু টাকা আসে। সেটা হচ্ছে আপনার প্যাসিভ ইনকাম গ্যারান্টেড। এবার ধরুন আপনি শেয়ার বাজারে টাকা খাটালেন বা মিউচুয়াল ফান্ডে টাকা রাখলেন, সেটি আপনার প্যাসিভ ইনকাম নন-গ্যারান্টেড। কারণ, সেখানে থেকে আপনার ইনকাম হবেই তাঁর কোনও গ্যারান্টি নেই। শেয়ারের দর পড়ে গেলে বা মিউচুয়াল ফান্ড লস খেলে আপনিও লস খাবেন।
কাজেই এরপর থেকে যখনই টাকা জমানোর কথা ভাববেন, এই জিনিসগুলি অবশ্যই মাথায় রাখবেন। কোন নতুন জায়গায় যাওয়ার আগে যেমন আপনি সেখানকার ম্যাপটি ভাল করে দেখে নেন, তেমনই ইনভেস্ট গোল সেট করার আগে সেই সংক্রান্ত একটি রুট ম্যাপ অবশ্যই আপনার হাতে থাকা দরকার। কোথায়, কত টাকা টাকা রেখে কত টাকা ইনকাম করতে চাইছেন তার একটা স্পষ্ট ধারণা আপনার থাকা দরকার। আর হ্যাঁ, অবশ্যই ফিনান্সিয়াল এক্সপার্টদের মতামত নিয়েই টাকা রাখবেন। কারণ, ঠিক যেমন পাহাড়ে চড়ার সময় পর্বতারোহীরা শেরপার সাহায্য নেন বা নিজে গাড়ি চালাতে না জানলে আপনি ড্রাইভার রাখেন, তেমনই আপনার টাকা কোথায় রাখলে সঠিকভাবে লাভবান হবেন, তাঁর উত্তর কিন্তু একজন প্রফেশনাল এক্সপার্টই দিতে পারবেন।
প্রতিকূল পরিস্থিতেও যাতে আপনার আয় একেবারেই বন্ধ না হয়ে যায়, সেই বিষয়ে কিন্তু আপনাকেই নজর দিতে হবে। এর পর যখনই ইনভেস্টমেন্টের কথা মাথায় আনবেন, তখনই এই সময়টার কথাও আপনাকে মাথায় রাখতে হবে। আমরা অনেকেই হেলথ ইনস্যুরেন্স করাই না। ৬০ বছর বয়সের পর যখন আপনি রিটায়ার করবেন, তখন আপনার আনুষাঙ্গিক খরচ কমলেও ডাক্তারি বা চিকিৎসাজনিত খরচ কিন্তু বেড়েই যাবে। কাজেই সেই দিকে কিন্তু এখন থেকেই খেয়াল রাখতে হবে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায়, মানুষ ৪৫ বছরের পর রিটায়ারমেন্ট প্ল্যানিং শুরু করেন। তখন দেখা যায় ১৫ বছর জমিয়ে তাঁরা যেই অঙ্কটি ৬০ বছরের পর আশা করেন, তা কোনওভাবেই পূরণ করা সম্ভব নয়। তাই এখন থেকেই রিটায়ারমেন্টের প্ল্যানিং শুরু করুন।
মিউচুয়াল ফান্ড বা শেয়ার বাজারে যদি টাকা রাখেন, সব দিক বিবেচনা করে রাখবেন। কোথায় তারা টাকা খাটাচ্ছে বা কোম্পানির প্রোফাইল সব দিকগুলো অবশ্যই দেখবেন। আমরা অনেক সময়ই একটু বেশি লাভের আশায় কোনও কিছু ভাবনা-চিন্তা না করেই বেশি সুদ বা ডিভিডেন্ডের প্রতিশ্রুতি দেওয়া কোম্পানিগুলিতে টাকা রাখি। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় ভবিষ্যতে গিয়ে এই কোম্পানিগুলো মুখ থুবড়ে পড়ে। মার যায় আপনার টাকা। আর তখন কিছু করারও থাকে না। তাই সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়াটা খুব দরকার। বিশেষত বন্ড বা শেয়ারে ইনভেস্ট করার সময় সব কিছু খুঁটিয়ে দেখে নেবেন। কোম্পানির হিস্ট্রি ও বাজারে তাঁদের নির্ভরযোগ্যতা যাচাই করে নেবেন। কিছু ইনভেস্টমেন্ট আপনার শর্ট টার্মে রিটার্ন দেয়, আবার কিছু আছে লং টার্ম ইনভেস্টমেন্ট। নিজের দরকার বা পরিকল্পনা অনুযায়ী আপনার ইনভেস্টমেন্ট প্ল্যানগুলো বাছুন। তাহলে দেখবেন আপনার টাকাও সুরক্ষিত থাকেবে আর পরবর্তীতে রিটার্নও ভাল পাবেন। আর অবশ্যই কোনও ভাল কসালটেন্টের পরামর্শ নিন। তবে সব কিছুই তাঁর উপর ছেড়ে দেবেন না। নিজের টাকার গ্রাফের উপর কিন্তু তীক্ষ্ণ নজর অবশ্যই রাখবেন। তিনি শুধুই আপনার ইনভেস্টমেন্ট-এর পর্যবেক্ষণের দায়িত্বে থাকবেন। মনে রাখবেন, টাকা আপনার, তাই সেটা সামলানোর দায়িত্বও আপনার। আপনার কনসাল্টেন্টের দায়িত্ব শুধু আপনার ইনভেস্টমেন্টকে সঠিক পথে চালনা করা।
তবে এই মুহূর্তে যা পরিস্থিতি তাতে কোথাও ইনভেস্ট করার আগে জমান। সব কিছু আবার আগের মতো হয়ে গেলে অন্তত ৬ মাস থেকে এক বছর টাকা জমান এই ধরনের আপৎকালীন পরিস্থিতি মোকাবিলা করার জন্য। যাতে বিপদের সময় অন্যের কাছে হাত না পাততে হয়। আর তারপর নিজের ও পরিবারের জন্য অবশ্যই ইনভেস্টমেন্ট প্ল্যান করুন। আর হেলথ ইনস্যুরেন্স করাতে অবশ্যই মনে রাখবেন। সেটাই এখন সবচেয়ে বেশি দরকার, সে আপনি যে বয়সেরই হন না কেন।

(অনুলিখন: অভিজিৎ দাস)

 

Comments are closed.