করোনাভাইরাসের নতুন নতুন চরিত্র নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন চিকিৎসক ও বিজ্ঞানীরা। জ্বর, শুকনো কাশি, মাথা ব্যথা, গন্ধ ও স্বাদ চলে যাওয়ার মতো উপসর্গ সত্ত্বেও বহু করোনা আক্রান্তের আগেভাগে চিকিৎসা সম্ভব হচ্ছে না। কারণ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তাঁদের মধ্যে প্রাথমিক কোনও রোগ লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। যদিও কোভিড-১৯ এর টেস্ট, র্যাপিড টেস্ট ইত্যাদির সঙ্গে সঙ্গে নানা রকম electronics device -এর মাধ্যমে প্রাথমিক পর্যায়ে করোনা আক্রান্তকে চিহ্নিত করা সম্ভব হচ্ছে।
How Are Electronics Being Used in the Fight Against the Coronavirus Pandemic?
বেশিরভাগ ক্ষেত্রে করোনা আক্রান্ত রোগীর কোনও রোগ লক্ষণ না দেখা গেলেও এর সংক্রমণ রুখতে জ্বর, কাশি, ঠোঁট নীলচে হয়ে যাওয়ার মতো কিছু লক্ষণ দেখে আগেভাগে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। তাই প্রাথমিকভাবে এয়ারপোর্ট, দেশের সীমানা, দোকান-বাজার ইত্যাদি যে জায়গাগুলিতে মানুষের ভিড় অপেক্ষাকৃত বেশি সেখানে নানাবিধ ইলেক্ট্রনিক যন্ত্রের মাধ্যমে পরীক্ষানিরীক্ষা বা স্ক্রিনিং করে নেওয়া হয়। যেখানে অসংখ্য মানুষের ভিড় থাকে, electronic monitoring device সেই জায়গায় করোনা আক্রান্তদের চিহ্নিত করতে মূল ভূমিকা পালন করছে। এটিই প্রাথমিকভাবে করোনা আক্রান্তকে চিহ্নিত করতে বড় ভরসার জায়গা।
কীভাবে তাপমাত্রা মাপা হচ্ছে? ( How Temperature is Being Recorded)
কোভিড-১৯ সংক্রমিতকে চিহ্নিত করতে বিভিন্ন প্রকার ইলেকট্রনিক ডিভাইস ব্যবহৃত হয়। একসঙ্গে বিশাল পরিমাণ মানুষ যেখানে ভিড় করছেন, সেই জায়গায় সবার শরীরের তাপমাত্রা মাপার জন্য ইনফ্রারেড রশ্মির মাধ্যমে চটজলদি বহু মানুষের শরীরের তাপমাত্রা দেখে নেওয়া হচ্ছে। এর মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য ইলেক্ট্রনিক যন্ত্রের নাম ইনফ্রারেড থার্মোমিটার।
নন–কন্টাক্ট ইনফ্রারেড থার্মোমিটার (Non-Contact Infrared Thermometer)
নন ইনভেসিভ (non-invasive) এবং দাম তুলনামূলক কম হওয়ায় নিরাপদ দূরত্ব থেকে প্রচুর মানুষের শরীরের তাপমাত্রা মাপা হচ্ছে ইনফ্রারেড থার্মোমিটার দিয়ে। একজনের শরীরে তাপমাত্রা যত বেশি, ইনফ্রারেড রশ্মি নির্গমণের মাত্রাও তত বেশি। লেজার এবং ইনফ্রারেড রশ্মির মাধ্যমে কোন স্পর্শ ছাড়াই যে কোনও স্থানের বা মানবদেহের তাপমাত্রা মুহূর্তেই বের করা সম্ভব। যা চলতি ভাষায় থার্মাল গান (thermal gun) নামে পরিচিত।
থার্মোমিটারটি থেকে ইনফ্রারেড রশ্মির বিকিরণ ঘটে। অনেকটা বন্দুকের মত দেখতে ইনফ্রারেড থার্মোমিটারের ভিতরে রয়েছে একটি লেন্স যা, মূলত যে বস্তুর তাপমাত্রা নির্ণয় করতে হবে তাকে ফোকাস করে। কোনো বস্তুর উপর ইনফ্রারেড রশ্মি পড়ার পর সেখান থেকে তাপ বিকিরণের উপর ভিত্তি করে কাজ করে এই ইনফ্রারেড থার্মোমিটার।
করোনার আগে ২০১৪ সালে ইবোলা ভাইরাসের সংক্রমণের সময় অনেক দেশে এই যন্ত্র বহুল ব্যবহৃত হয়।
কোভিড–১৯ পরীক্ষায় ব্যবহৃত কিছু ডিভাইস (Electronic Devices on the Frontline of COVID-19)
বিমানবন্দর থেকে রেল স্টেশন বিভিন্ন জায়গায় স্ক্রিনিং এর জন্য প্রধানত ইনফ্রারেড লেজার থার্মোমিটার (infrared laser thermometer) বা ইনফ্রারেড লেজার গান (infrared laser gun) ব্যবহার হচ্ছে। যদিও একসঙ্গে বহু মানুষের পরীক্ষা করতে গিয়ে অনেক সময়ই এর ফল ভুল আসছে বলে অভিযোগও উঠেছে। বিমানবন্দরে স্ক্রিনিংয়ে বোঝা যায়নি অথচ বাড়ি ফিরে ওই ব্যক্তি করোনা পজিটিভ এসেছে, এমন উদাহরণ বহু।
এক্ষেত্রে ইনফ্রারেড লেজার গানের থেকেও উন্নত ডিভাইস, থার্মাল ইমেজিং ক্যামেরা ব্যবহারের পরামর্শ দিচ্ছেন অনেকে। এছাড়া চিন, আমেরিকা প্রভৃতি দেশে করোনা নির্ধারণে ড্রোন, রোবটিক ডিভাইস ও ব্যবহার হচ্ছে যা, এক মিনিটের মধ্যে একসঙ্গে ২০০ জনের শরীরের তাপমাত্রা বলে দিতে পারে।
তাপমাত্রা মাপার যন্ত্র ছাড়া অন্যান্য ইলেক্ট্রনিক যন্ত্রের ব্যবহার
ড্রোন, ক্যামেরা ইত্যাদির মাধ্যমে থার্মাল স্ক্রিনিং ছাড়াও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা Artificial Intelligence (AI), ইন্টারনেট অফ থিংস (IoT) ইত্যাদির সাহায্যে করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগীর পরীক্ষা নিরীক্ষা হচ্ছে। মহামারির উপর নজরদারি, বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ায় করোনাভাইরাস নিয়ে গবেষণা থেকে পূর্বাভাস, একে ট্র্যাক করা- সহ বহু কাজ হচ্ছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (AI) সাহায্যে।
এছাড়া ডায়াগনস্টিক টুল হিসেবে বিভিন্ন প্রকারের বায়ো-সেন্সর ব্যবহার হচ্ছে হাসপাতালে। যার মাধ্যমে চিকিৎসকরা নিশ্চিত হচ্ছেন কেউ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত কি না। তাই করোনার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে টেম্পারেচার সেন্সর ছাড়াও বহু ইলেকট্রনিক ডিভাইস, সফটওয়্যার প্রোগ্রাম ব্যবহার করছেন সারা বিশ্বের চিকিৎসক ও গবেষকরা। থেরাপি, ভ্যাকসিন প্রস্তুতিতেও বিভিন্ন ইলেকট্রনিক ডিভাইস ব্যবহার হচ্ছে।
রোবট স্বাস্থ্যকর্মী (Medical Robots)
বিশ্বের বিভিন্ন উন্নত দেশের পাশাপাশি ভারতের হাতে গোনা কয়েকটি হাসপাতালে শুরু হয়েছে medical robot -এর ব্যবহার। সংক্রমণ মারাত্মক আকার ধারণ করলে রোগীর কাছে যাওয়া বিপজ্জনক হতে পারে স্বাস্থ্যকর্মীদের। সে কথা ভেবে তৈরি হয়েছে বিশেষ রোবট। যা হাসপাতালে রোগীর পরিচর্চায় ব্যবহৃত হচ্ছে চুটিয়ে।
মোবাইল অ্যাপ ও সিসিটিভির ব্যবহার (Using Mobile app and CCTV)
কী কী করলে করোনা সংক্রমণ থেকে দূরে থাকা যায়, চিকিৎসা বিষয়ক উপদেশ সংক্রান্ত, আশেপাশে কোথায় কতজন আক্রান্ত এই সব তথ্য জানাতে বিভিন্ন দেশেই বিভিন্ন মোবাইল অ্যাপ আনা হয়েছে। যেমন ভারত সরকার তাদের নিজস্ব আরোগ্য সেতু অ্যাপ (Arogya Setu App) লঞ্চ করেছে। যার সাহায্যে যদি কেউ করোনা-পজিটিভ হয়ে থাকেন, কিংবা করোনা-ঝুঁকির মধ্যে থাকেন, তাহলে সেই সংক্রান্তে তথ্য সার্ভারে আপলোড করা হয়, স্বাস্থ্য দফতরে জানানো হয়। তারপরই কনট্যাক্ট চেনে থাকা সবাইকে এই ব্যাপারে জানানো হয়। এই অ্যাপে ১১টি ভাষায় ইউজারদের নির্দেশ দেওয়ার ব্যবস্থা আছে। এখানে ব্যবহারকারীর পরিচয় ও তথ্য গোপন থাকে। একইরকম চিনেও রয়েছে আলিবাবার তৈরি বিশেষ অ্যাপ, কোরিয়া থেকে আমেরিকা, সর্বত্রই মানুষকে এই মারণ ভাইরাস সম্পর্কে সাবধান করার জন্য মোবাইল অ্যাপ ডেভেলপ করা হয়েছে।
কেরলের পাথানামিত্থিতায় ইতালি ফেরত একই পরিবারের তিন ভারতীয় করোনায় আক্রান্ত হওয়ার প্রেক্ষিতে স্থানীয় প্রশাসন সন্ধান শুরু করে দেশে ফিরে কোথায় কোথায় ঘুরেছেন তাঁরা। এ জন্য রাস্তা, দোকান ইত্যাদির সিসিটিভি দেখে কয়েকশো মানুষকে কোয়ারেন্টিনে পাঠানো হয়। লকডাউনে বন্দি দেশে কেউ নিয়ম ভেঙে রাস্তায় বেরুচ্ছে কি না সিসিটিভির মাধ্যমে সেদিকে কড়া নজর রাখছে পুলিশ প্রশাসন।
ভবিষ্যতে ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ইলেকট্রনিক ডিভাইস (Electronic Devices Against Viruses in the Future)
করোনার আবহে ভবিষ্যতে ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়া, সহজে তাকে চিহ্নিত করার জন্য বিভিন্ন দেশে নানাবিধ electronic device আবিষ্কার ও প্রস্তুতের কাজ চলছে। এর মধ্যে স্প্যানিশ সংস্থা গ্রাফিনিয়া (Graphenea) গ্রাফিন নামে একটি বায়ো সেন্সর তৈরি করে চিকিৎসক ও গবেষকদের হাতে তুলে দিচ্ছে। এই একটি যন্ত্রের সাহায্যে একইসঙ্গে একাধিক ভাইরাস চিহ্নিত করা যাবে এবং ডিভাইসটির মূল্যও আয়ত্তের মধ্যে বলে দাবি করেছে ওই স্প্যানিশ সংস্থাটি। কোভিড-১৯ চিহ্নিত করতেও এটি ব্যবহার করা যেতে পারে বলে দাবি করা হয়েছে।
Comments are closed.