গত ডিসেম্বর মাসে দক্ষিণ ২৪ পরগনার কুলতলির যে ‘হিন্দু বিদ্যালয়’ স্কুলে আরএসএসের অস্ত্র প্রশিক্ষণ হয়েছিল, তখন তার বিরোধিতা করার জন্য সেখানকার প্রধান শিক্ষককে সম্প্রতি অপসারিত করল বিশ্ব হিন্দু পরিষদ নিয়ন্ত্রণাধীন স্কুলের পরিচালন কমিটি। আর এই অপসারণকে কেন্দ্র করে গত সপ্তাহখানেক ধরে কুলতলির ওই এলাকায় সৃষ্টি হয়েছে তীব্র বিতর্ক এবং চাঞ্চল্যের। স্থানীয় তৃণমূল নেতৃত্ব এই অপসারণের বিরোধিতা করে প্রধান শিক্ষকের পাশে দাঁড়ানোয় গোটা ঘটনায় নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে। আরএসএসের অস্ত্র প্রশিক্ষণ থেকে শুরু করে লাগাতার বিতর্কের জেরে এই স্কুলের পঠনপাঠন প্রায় শিঁকেয় উঠতে বসেছে। স্কুলে হু-হু করে কমছে ছাত্র সংখ্যা।
প্রধান শিক্ষক মহিমারঞ্জন মন্ডল
বিশ্ব হিন্দু পরিষদের শাখা সংগঠন ‘মানব সেবা প্রতিষ্ঠান’ এই ‘হিন্দু বিদ্যালয়’ স্কুলটি চালায়। স্থানীয় কিছু মানুষ এবং শিক্ষকদের নিয়ে গঠিত কমিটি আগে স্কুলটি পরিচালনা করত। অভিযোগ, স্কুলের আধিপত্য নিজেদের হাতে নিতে গত বছর নভেম্বর মাসে এই পরিচালন কমিটি ভেঙে বিশ্ব হিন্দু পরিষদের শাখা ‘মানব সেবা প্রতিষ্ঠান’ স্থানীয় আশ্রম কমিটিকে স্কুল পরিচালনার দায়িত্ব দেয়। তারপর থেকেই স্কুলে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ এবং আরএসএসের প্রভাব বাড়তে শুরু করে।
এরপর মূল ঘটনার সূত্রপাত গত বছর ডিসেম্বর মাসে। পরীক্ষা শেষ হয়ে যাওয়ার পর গত বছর ১৫ থেকে ২৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত কুলতলির এই ‘হিন্দু বিদ্যালয়’ স্কুলটি বন্ধ ছিল। ছুটির মধ্যে ১৭ থেকে ২৩ ডিসেম্বর স্কুল পরিচালনার দায়িত্বে থাকা জালাবেড়িয়া আশ্রম কমিটি আরএসএসের একটি অস্ত্র প্রশিক্ষণের আয়োজন করে স্কুলে। স্কুল খোলার পর বিষয়টি জানাজানি হয় এবং গোটা রাজ্যে খবরের শিরোনামে উঠে আসে। সংবাদমাধ্যম থেকে অস্ত্র প্রশিক্ষণের কথা জানতে পেরে স্কুল খোলার পরই তার বিরোধিতা করেন প্রধান শিক্ষক মহিমারঞ্জন মন্ডল। শুধু অস্ত্র প্রশিক্ষণেরই নয়, যেভাবে স্কুলের দখল নেওয়া চেষ্টা হচ্ছে তারও সরাসরি বিরোধিতা করেন তিনি। মহিমারঞ্জন মন্ডলের অভিযোগ, অস্ত্র প্রশিক্ষণের বিরোধিতা করার পর থেকেই স্কুলের পরিচালন কমিটি প্রকাশ্যেই তাঁকে চূড়ান্ত নির্যাতন করে। ছাত্র এবং অন্য শিক্ষকদের সামনে তাঁকে হেনস্থাও করা হয়। মেরে হাত-পা ভেঙে দেওয়ার হুমকি দেওয়া হয় তাঁকে। এর জেরে সেই সময় মহিমারঞ্জন মন্ডল স্কুলের পরিচালন কমিটির বেশ কয়েকজনের বিরুদ্ধে কুলতলি থানায় অভিযোগ দায়ের করেন। শুধু তাই নয়, শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে দেখা করে তাঁকেও অভিযোগ জানান।
এরপর পরিস্থিতি খানিকটা স্বাভাবিক হয়। কিন্তু সম্প্রতি বিশ্ব হিন্দু পরিষদের শাখা সংগঠন ‘মানব সেবা প্রতিষ্ঠান’ ফের তৎপর হয়ে ওঠে বলে অভিযোগ। গত ৭ জুলাই স্কুলের পরিচালন কমিটি প্রধান শিক্ষক মহিমাঞ্জন মন্ডলকে অপসারিত করে তাঁকে চিঠি দেয়। সাদা কাগজে লেখা এই অপসারণের চিঠি তাঁর বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। আরএসএসের অস্ত্র প্রশিক্ষণের বিরোধিতা করার জন্য প্রধান শিক্ষককে স্কুল থেকে অপসারিত করা হচ্ছে, এই খবর চাউর হতে স্বাভাবিকভাবে চাঞ্চল্য ছড়িয়ে পড়ে স্থানীয় এলাকায়। স্কুলের ছাত্রদেরও একটা বড় অংশ প্রধান শিক্ষকের পাশে দাঁড়ায়। এরপর স্থানীয় তৃণমূল নেতৃত্বের কাছে অভিযোগ জানান প্রধান শিক্ষক। গত শুক্রবার, ১৩ জুলাই সন্ধ্যায় ব্লকের তৃণমূল কংগ্রেস নেতা গোপাল মাঝি স্কুলের সামনে এক জনসভা করেন এবং সেখানে সরাসরি প্রধান শিক্ষকের পাশে দাঁড়ান। স্কুলের পরিচালন কমিটি প্রধান শিক্ষককে সরিয়ে দিলে তিনি দেখে নেবেন বলেও হুমকি দেন।
প্রধান শিক্ষককে অপসারণের চিঠি
মহিমারঞ্জন মন্ডল জানান, ‘আরএসএসের অস্ত্র প্রশিক্ষণের বিরোধিতা করার পর থেকেই মানব সেবা প্রতিষ্ঠান আমাকে নানাভাবে হেনস্থা করে সরানোর চেষ্টা করছে। আমাকে সরিয়ে ওরা ফের অস্ত্র প্রশিক্ষণ থেকে শুরু করে সিলেবাস পর্যন্ত বদল করতে চায়। শিক্ষামন্ত্রীর কাছে এবং থানায় অভিযোগ জানানোর পর কিছুদিন চুপচাপ ছিল। গত সপ্তাহে আমাকে অপসারণের চিঠি দিতে এসেছিল ওরা। আমি নিইনি। তারপর তা বাড়িতে পাঠিয়েছে। যদিও স্থানীয় তৃণমূল নেতৃত্বের হস্তক্ষেপে তিন-চারদিন ওরা একটু চুপচাপ আছে, কিন্তু কী হবে বুঝতে পারছি না’। তিনি আরও বলেন, ‘অস্ত্র প্রশিক্ষণের পর ছাত্রের সংখ্যা অনেক কমে গেছে। আমরা চাই সরকার হস্তক্ষেপ করুক এবং স্কুলে যেন শুধু পড়াশোনাই বজায় থাকে, তার ব্যবস্থা করুক’।