সংসদের বাদল অধিবেশনের শুরুতেই বিরোধী পক্ষের আনা অনাস্থা প্রস্তাব তুমুল বিতর্কের পর খারিজ হয়ে গেল। এতে সরকার পক্ষ স্বস্তি পেলেও, এই বিশেষ অনাস্থা প্রস্তাবের তাৎপর্য কিন্তু সুদূর প্রসারী। অনাস্থা প্রস্তাব সাধারণত দুই ধরণের হয়। এক, যেখানে সরকার পক্ষের স্পষ্ট সংখ্যাগরিষ্ঠতা নেই। এখানে বিষয়টি একান্তই নাম্বার গেম। দুই, যেখানে সরকারের নির্দিষ্ট সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকা সত্ত্বেও অনাস্থা প্রস্তাব আনা হয় সরকারি নীতি ও কার্যকলাপের বিরুদ্ধাচরণ করে। দ্বিতীয় ক্ষেত্রে বিষয়টি অধিক তাৎপর্যপূর্ণ, কারণ এখানে নীতির প্রশ্নটি জড়িয়ে আছে। সংসদে আনা সাম্প্রতিক অনাস্থা প্রস্তাবের সাথে জড়িত ছিল বিরোধী ঐক্যের প্রশ্ন এবং সংসদের বাইরে একশো তিরিশ কোটি সাধারণ মানুষের অসামান্য সমস্যাগুলির কথা তুলে ধরার বিষয়। দ্বিতীয় ক্ষেত্রে অনেকটাই সফল হওয়া গেলেও বিরোধী ঐক্য ভোটাঙ্কে যতটা প্রতিফলিত বাস্তবে তা নয়।
গণতন্ত্রে ভোটাঙ্কই সর্বদা শেষ কথা বলে না। এটা প্রায় নিশ্চিতই ছিল যে, সংসদের অভ্যন্তরে বিরোধীরা জিতবেন না। তাঁরাও সেটা জানতেন । কিন্তু তাঁদের লক্ষ্য ছিল ভিন্ন। সংসদের বাইরে যে বিপুল জনসমষ্টি সরকারের বিবিধ কর্মকাণ্ডে বিক্ষুব্ধ তাঁদের কন্ঠস্বরকে তুলে আনা। এই বিষয়ে বিরোধীরা একশো শতাংশ সফল হয়েছেন। নোটবন্দির পরে সাধারণ মানুষের যে ভয়ঙ্কর অবস্থা হয়েছিল তার কথা যেমন এসেছে, তেমনি সামগ্রিক অর্থনীতিতে নোটবন্দির বিরূপ প্রভাবের কথাও বিরোধী নেতা-নেত্রীরা তুলে ধরেছেন। সাধারণভাবে সংগঠিত প্রাতিষ্ঠানিক অর্থনীতির প্রতিই সাধারণ মানুষ আস্থা হারিয়ে ফেলছেন। ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থার মেরুদণ্ড ভেঙে দেওয়া হয়েছে। রিজার্ভ ব্যাঙ্ক হারিয়েছে তার স্বাতন্ত্র। সর্বোপরি এত কিছুর পরেও দেশের অর্থনীতির কোনও বিশেষ উন্নতি হয়নি। প্রধানমন্ত্রী একের পর এক সরকারি বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে সারা পৃথিবীকে জানিয়েছেন যে, অধিকাংশ ভারতবাসী বাড়ির বাইরে প্রাতকৃত্য সারতে যায়। দেশের এত মহান পরিচয় এর আগে কেউ কখনও দিতে পারেননি।
গো-রক্ষার নামে ধারাবাহিক মানুষ খুন এখন যেন জলভাত হয়ে গেছে। কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী, তথাকথিত দেশপ্রেমের বহরে সাধারণ মানুষের জীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। সেই সব বহু বেদনার কথাও উঠে এসেছে বিরোধীদের বক্তব্যে। ব্যক্তিগত দুর্নীতির প্রশ্নও বাদ যায়নি। দেশের প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশে রাফাল চুক্তিতে দুর্নীতির অভিযোগ এনেছেন স্বয়ং রাহুল গান্ধী।
এই সবই ঠিকঠাক ছিল। কিন্তু বিরোধীদের আচরণে সমন্বয়ের অভাব লক্ষ্য করা গেছে। হয়তো যে পরিমান পারস্পরিক আলাপ আলোচনার প্রয়োজন ছিল তা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। নাহলে যে সংসদীয় গণতন্ত্রে বাঘে গরুতে এক ঘাটে জল খায়, সেখানে অতিনাটকীয় কিছু করার তো দরকার নেই। আমরা যে ব্রিটিশ ওয়েস্টমিনস্টার মডেলটিকে গ্রহণ করেছি সেখানে নির্দিষ্ট সাংবিধানিক সীমারেখার মধ্যেই সরকারকে সমর্থন বা বিরোধিতার ব্যবস্থা করা আছে। অর্থাৎ কেউ সরকারের বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক পরিসরে সোচ্চার হতেই পারেন। আইনসভার ভিতরে বা বাইরে। তার জন্য আলাদা করে ভয় পাওয়ার কিছু নেই আবার আবেগতাড়িত হয়ে প্রধানমন্ত্রীকে জাপ্টাজাপ্টি বা চোখ টেপাটেপিরও কিছু হয়নি। কেউ তো বলেনি যে, বিরোধিতা মানে ব্যক্তিগত বিদ্বেষ।
অপর দিকে প্রধানমন্ত্রী মোদী কিছুটা ব্যাকফুটে মনে হলেও কার্যত জল মাপছিলেন। আপাতভাবে মনে হল যে, তিনি বিরোধীদের তোলা কোনও প্রশ্নেরই সঠিক জবাব দিতে পারেননি। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী খুব নির্দিষ্টভাবে বিরোধীদের ঐক্যে ফাটল ধরাতে চেষ্টা করেছেন। সমর্থন প্রদানকারী দল হিসেবে কংগ্রেস যে যথেষ্ট নির্ভরযোগ্য নয়, তা অতীতের রেকর্ড ঘেঁটে বলার চেষ্টা করেছেন। চরণ সিংহ থেকে দেবগৌড়া পর্যন্ত কংগ্রেস বিশ্বাসভঙ্গ করেছে বলে মোদী উল্লেখ করেছেন। অর্থাৎ, তাঁর বক্তব্য হলো, যে বিরোধী নেতা-নেত্রীরা বিজেপিকে সরিয়ে কংগ্রেসের সমর্থনের কথা ভাবছেন তাঁরা ঐতিহাসিক ভুল করছেন । মোদী অত্যন্ত সচেতন ভাবেই প্রণববাবুর নাম নিয়ে এসেছেন। তিনি বোঝাতে চেয়েছেন যে, কংগ্রেস হাইকম্যান্ডের ক্ষমতালিপ্সার কাছে আঞ্চলিক দলগুলি আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হবে। অন্তত ঐতিহাসিক ঘটনাবলী তাই বলে।
মোদীর এই নিখুঁত চালটি কতটা কার্যকর হয় দেখা যাক। কিন্তু পারস্পরিক বিশ্বাসের বাতাবরণ একবার ভেঙে গেলে তা সরকার পক্ষের সুবিধা করে দেবে।
এছাড়া মোদীর ওই দিনের প্রতিভাষণে উগ্র জাতীয়তাবাদ বিশেষ আসেনি। বরঞ্চ তিনি নিজের একটি কৃষকদরদি ভাবমূর্তি তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। একথা স্পষ্ট যে, দেশজুড়ে কৃষক আত্মহত্যা বাড়ছে। কৃষক বিক্ষোভও তীব্রতা পাচ্ছে। বিজেপির গ্রামীণ ভোট কমছে। সেই সূত্রে সাম্প্রতিক অতীতে কৃষি পণ্যের সহায়ক মূল্য বৃদ্ধি এবং স্বনির্ভর গোষ্ঠীগুলির সাথে টেলিকনফারেন্স করে মোদী বোঝাতে চেয়েছেন যে, জাতীয়তাবাদ নয় এবারের ভোটে মূল ইস্যু গ্রামোন্নয়ন। সংসদের ভাষণেও সেই বিষয়টি বারবার উঠে এসেছে। বিরোধীরা এই বিষয়টি যত তাড়াতাড়ি বোঝেন ততই মঙ্গল ।
(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)