দলের নীতি নিয়ে নেতৃত্বকে আক্রমণে প্রাক্তন সিপিএম সাংসদ মইনুল হাসান। বললেন, মমতাকে নিয়ে দলের মূল্যায়ন ভুল।
১৮ এপ্রিল শুরু হচ্ছে সিপিএমের পার্টি কংগ্রেস। তার আগে দলের রাজনৈতিক লাইন এবং নেতৃত্বকে তীব্র আক্রমণ করে বিস্ফোরক সিপিএমের প্রাক্তণ সাংসদ মইনুল হাসান। thebengalstory.com কে এক exclusive ইন্টারভিউয়ে বললেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিয়ে সিপিএমের মূল্যায়ন ভুল। তা পাল্টাতে হবে, নয়তো বাংলায় শুন্য হয়ে যাবে সিপিএম। এবছর দলের সদস্য পদও রিনিউ করেননি মইনুল।
প্রশ্নঃ আপনি দলের সদস্যপদ রিনিউ করালেন না কেন?
মইনুল হাসানঃ প্রথমত রাজনৈতিক কারণ। সিপিএম যে লাইন নিয়েছে, ‘তৃণমূল কংগ্রেসকে হারাতে হবে, বিজেপিকে ঠেকাতে হবে’, এটা আদ্যোপান্ত ভুল। শুধু ভুল না, অবাস্তব এবং দ্বিচারিতায় ভরা। দ্বিতীয়ত, সাংগঠনিক। সামনের লোকসভা ভোটে দেশে কুড়ি কোটি নতুন ভোটার হবে। আর সিপিএমে এখনও রাজ্য কমিটির সদস্যের বয়সের সর্বোচ্চ লিমিট ৭৫, কেন্দ্রীয় কমিটিতে ৮০ বছর। এ হয় নাকি? আর তিন নম্বর কারণ, সামাজিক। যুগের পর যুগ দল বলে আসছে, সামাজিক বিন্যাস দেখে দলে নেতৃত্ব তুলে আনা হবে। এত বছরে পশ্চিমবঙ্গে একটা জেলাতে মুসলমান সম্পাদক করা গেল না? বীরভূমে ৩৫ শতাংশ আদিবাসী, সেখানে আদিবাসী জেলা সম্পাদক করা হল। অথচ, মুর্শিদাবাদে ৬৯, মালদহে ৫২, উত্তর দিনাজপুরে ৫৩ শতাংশ মুসলমান। কোথাও কিন্তু মুসলমান জেলা সম্পাদক করা হয়নি।
প্রশ্নঃ দলের লাইন অবাস্তব এবং দ্বিচারিতায় ভরা বলছেন কেন?
মইনুল হাসানঃ তৃণমূল আর বিজেপিকে এক ব্র্যাকেটে ফেলা মানে, বিজেপি বিরোধী লড়াইকে দুর্বল করা। কেউ যদি মনে করে, আগে তৃণমূলকে হারিয়ে তারপর বিজেপিকে ঠেকাবে, তা হচ্ছে মূর্খের প্রলাপ। সিপিএমের এই থিওরি রাজ্যের মানুষের অভিজ্ঞতার সঙ্গে মিলছে না। তাই মানুষ তা বিশ্বাসও করছে না। তৃণমূল নিয়ে কী অবস্থান হবে তা পরে ভাবা যাবে। সিপিএমের এখনই বলা উচিত, বিজেপিকে ঠেকাতে সব ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক দলের এক হওয়া দরকার। কারণ, এরাজ্যের মানুষ কিন্তু তৃণমূল আর বিজেপিকে এক করে দেখছেন না। তাছাড়া, সিপিআইএমে কেউ হয়তো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ব্যক্তিগতভাবে পছন্দ করেন না, কিন্তু তাঁর সেই মতামত তো দলের রাজনৈতিক লাইন হতে পারে না। আজ কেউ কেউ মনে করছেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে পছন্দ করি না, তাই বিজেপি এবং তৃণমূলকে এক ব্র্যাকেটে ফেলতে হবে। এই তত্ত্বে দলের মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে। এমনিতেও এখন আর সিপিআইএমের ওপর রাজ্য বা দেশ নির্ভর করছে না। কিন্তু এটা আমি বলছি, তৃণমূল কংগ্রেস নিয়ে সিপিআইএম যে মূল্যায়ন করেছে তা পাল্টাতে হবে।
প্রশ্নঃ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ব্যক্তিগতভাবে অপছন্দ করার থিওরি দলের রাজনৈতিক লাইনকে প্রভাবিত করবেই বা কেন?
মইনুল হাসানঃ দেখুন, তা বলতে পারব না। তবে, কাউকে পছন্দ করা, না করার একটা শিকড় সিপিএমে আছে। এখানে দল, মানে শীর্ষ নেতৃত্ব চায়, সবাই তাদের মতো করে ভাবুক। কেউ অন্য কিছু ভাবলে তাঁকে দলের ভেতরেই অপছন্দ করা শুরু হয়। এই যে নিজের চিন্তায় অন্যকে ভাবতে বাধ্য করা, এতে ভারতের মতো বহুত্ববাদের দেশে দলের ক্ষতি হয়েছে।
প্রশ্নঃ একটু আগে বলছিলেন, সিপিএম নেতাদের বক্তব্য মানুষের অভিজ্ঞতার সঙ্গে মিলছ না। এত সংগঠিত পার্টি, এত বছর সরকার চালিয়েছে, এটা কেন হচ্ছে?
মইনুল হাসানঃ এর পেছনেও সেই একই কারণ। নিজের ভাবনা অন্যের অপর চাপিয়ে দেওয়া। তা থেকেই এটা হয়েছে যে, মানুষ যা ভাবছে পার্টি তা বুঝতে পারছে না, আর পার্টি যা বলছে মানুষ তা বিশ্বাস করছে না। এই যে ২০১৬ বিধানসভা ভোটে সিপিএম-কংগ্রেস জোট হল। সমস্ত তৃণমূল বিরোধী মানুষ তো এটাকে জোটই বলছিলেন। অথচ সিপিএম আজ পর্যন্ত স্পষ্ট করে বলতে পারল না, জোট হয়েছে। এবং এটা করতে গিয়ে নেতারা এত নিম্নরুচির পরিচয় দিলেন, ভাবা যায় না।
বিধানসভা ভোটের আগে সিঙ্গুরে সিপিএম-কংগ্রেসের যৌথ মিটিং ছিল। দু’দলের লোকই গেছে মিটিংয়ে। সীতারাম ইয়েচুরি প্রধান বক্তা। অধীর চৌধুরীও থাকবেন। কিন্তু সিপিআইএম নেতারা আগেই ঠিক করে রেখেছিলেন, স্টেজে অধীর আর সীতারামকে একসঙ্গে রাখবেন না। সেভাবে টাইমিং করা হয়েছিল। সীতারাম কলকাতা থেকে রওনা দিয়ে প্রায় সিঙ্গুরে পৌঁছে গিয়েছেন, জানা যায় অধীর চৌধুরী তখনও মঞ্চে। রাস্তায় থামিয়ে দেওয়া হয় সীতারামের গাড়ি। চায়ের দোকানে বসানো হয় তাঁকে। যখন খবর আসে অধীরের ভাষণ শেষ হয়েছে, তখন আবার রওনা দেন সীতারাম। মঞ্চের কাছাকাছি গিয়ে খবর পেলেন, অধীর তখন মঞ্চে বসে চা খাচ্ছেন। আবার থামানো হয় সীতারামের গাড়ি। অধীরকে ফোন করে বলা হয় পুরো ব্যাপার। অধীর চৌধুরী সব বুঝে স্টেজ থেমে নেমে যান। তারপর সিপিআইএম নেতারা সীতারামকে নিয়ে পৌঁছন স্টেজে। পার্টি এই নিম্নরুচির কাজ করবে, আর মানুষ তাদের বিশ্বাস করবে, এটা হয় না।
প্রশ্নঃ পার্টি কংগ্রেস শুরু হচ্ছে। এখন সিপিআইএমের ভবিষ্যত কী?
মইনুল হাসানঃ পার্টি যদি তৃণমূল আর বিজেপিকে একসঙ্গে হারানোর লাইন নেয় তবে মানুষ তা বিশ্বাস করবে না। এখন লোকসভায় এই রাজ্য থেকে দুটো সিট আছে। এই লাইন নিলে রাজ্যে শুন্য হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হবে।