সাবরীমালা মন্দিরের উন্নয়নে কেরল সরকারের বরাদ্দ ৭৩৯ কোটি টাকা, ইএমএস নাম্বুদ্রিপাদের রাজ্যে বিজয়ন এটা কী করলেন!
বিজয়ন আপনিও! আপনিও নরম হিন্দুত্বের লাইন অনুসরণ করছেন? বিজেপির তাণ্ডব থেকে কেরালাকে বাঁচাতে, থুরি নিজের গদি বাঁচাতে নরম হিন্দুত্বের পথে হাঁটলেন! সাবরীমালা মন্দিরের উন্নতির খাতে এক লপ্তে ৭৩৯ কোটি টাকা বরাদ্দ করে ফেললেন পিনারাই বিজয়ন। রুল অফ ল বা আইনের শাসন জারি করার যে তেজ এবং জোশ বিজয়নের কমিউনিস্ট সরকার গত তিন মাস ধরে দেখিয়ে আসছিল, তা স্রেফ ঠোঙা হয়ে গেল!
জানুয়ারি মাসের শেষ দিনে কেরালার ২০১৯-২০ আর্থিক বছরের বাজেট পেশ করেন রাজ্যের অর্থমন্ত্রী টমাস আইজ্যাক। সেই বাজেটে সাবরীমালা মন্দিরের উন্নতি প্রকল্পে ৭৩৯ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। বাজেট পেশ করতে গিয়ে টমাস আইজ্যাক বলেন, সাবরীমালা মন্দিরের উন্নতিতে সরকারের বিশেষ নজর রয়েছে। তিরুপতি মডেল ডেভলপমেন্ট প্রজেক্টের আওতায় এনে সাবরীমালা মন্দিরের সৌন্দর্যায়ন ও সংরক্ষণে বিশেষ নজরে দেবে রাজ্য সরকার। তার জন্য মন্দির আর তার লাগোয়া এলাকার সামগ্রিক পরিকাঠামো উন্নয়নে বরাদ্দ করেছে সরকার। টমাস তাঁর বাজেট বক্তৃতায় বলেছেন, ‘বন্যার পরে রাজ্যকে ফের গড়ে তোলা আমাদের কাছে চ্যালেঞ্জ। বন্যার পর সাবরীমালার সন্ত্রাস রাজ্যের বড় বিপর্যয়।’ অর্থমন্ত্রীর ব্যাখ্যা, সাবরীমালা মন্দিরের আয় কমে যাওয়া যাতে অন্য মন্দিরগুলির ওপর প্রভাব ফেলতে না পারে তার জন্য বিশেষ দায়িত্ব নিতে হবে মন্দিরের বোর্ডগুলিকে। সাবরীমালার মূল মন্দিরে যাওয়ার আগে পাম্পা ও নীলাক্কলে দর্শনার্থীরা বিশ্রাম নেন। ওই দুটি জায়গার উন্নতি প্রকল্পে ১৪৭.৭৫ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। পাশাপাশি, সাবরীমালা মন্দিরের দেখভাল ও পরিচালনা করে যে ত্রাভাঙ্কোর দেবস্বম বোর্ড, তাকে ১০০ কোটি টাকা দেওয়া হবে বলে তিনি ঘোষণা করেন। ২০১৬-১৭ আর্থিক বছরে সাবরীমালা মন্দিরের আয় হয়েছিল ২৪৩.৬৯ কোটি টাকা। কিন্তু গত ২৮ শে সেপ্টেম্বর সুপ্রিম কোর্টের ঐতিহাসিক রায়ের পর সাবরীমালা ইস্যুতে ঘটে চলা একের পর এক অশান্তির ঘটনায় উল্লেখযোগ্যভাবে কমতে থাকে আয়। তাই মন্দির কমিটিকে এই অর্থ সাহায্য বলে সাফাই কেরালার অর্থমন্ত্রীর।
বাজেটে এই বরাদ্দ নিয়ে আমার কিছু বলার নেই। তোমার কুজো তুমি কাত করে জল ঢালবে না, তুলে নিয়ে উপুড় করে জল ভরবে তা তোমার ব্যাপার। কিন্তু এখানে প্রশ্নটা হচ্ছে, একটি দর্শন ও তার অনুশীলন নিয়ে। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী)র পলিটব্যুরোর সদস্য পরিচালিত একটি সরকার আর সব কল্যাণমূলক কাজকে সাইড লাইনে বসিয়ে রেখে ঝাঁপিয়ে পড়ল সাবরীমালা নিয়ে! এ কি নিছক একটি মন্দির ট্রাস্টের ঘাটতি পূরণ? বিশ্বাস করতে পারলে ভাল হত, কিন্তু পারছি না ‘কমরেড’ বিজয়ন। আসলে নরম হিন্দুত্বের সেবা করে বিজয়ন সরকার দক্ষিণপন্থার কাছে আত্মসমর্পণ করেছে। ভয় পেয়েছে আরএসএসের নেতৃত্বাধীন উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের।
অথচ এমনটা তো হওয়ার কথা ছিল না। সাবরীমালা মন্দিরে ঋতুমতী মহিলাদের প্রবেশ রূপায়ণ করতে গিয়ে বিজয়ন সরকার যে দৃঢ়তার পরিচয় দিয়েছে, তা তো ‘ঝান্ডা উচা রহে হামারা’, এই মনোভাবের স্পষ্ট নিদর্শন। এর বিপ্রতীপে মন্দিরের ঐতিহ্য ও ধর্মীয় ভাবাবেগ রক্ষার নাম করে বিজেপি, আরএসএসসহ দক্ষিণপন্থী দলগুলির আন্দোলন প্রায় যুদ্ধের ময়দানে পরিণত করে সাবরীমালা মন্দির প্রাঙ্গণকে। তবু গদি রক্ষার তাগিদে দুর্বলতা দেখায়নি বামপন্থী সরকার। আমাদের মতো অবিশ্বাসীদের মনে হয়েছিল যেন সরকার কুরবানি দেওয়ার জন্য প্রস্তুত বিজয়ন। মানছি, এই অশান্তির জেরে প্রাচীন এই মন্দিরে কমতে থাকে দর্শনার্থীর সংখ্যা।
তাই বলে ঈশ্বর ‘আয়াপ্পা’র আর্থিক ক্ষয়ক্ষতি পূরণ করতে প্যাকেজ দিতে হবে কমিউনিস্ট সরকারের অর্থমন্ত্রীকে! এটাই যদি একটি বাম সরকারের চল হয়, তবে আমার বিনীত জিজ্ঞাসা, তাহলে আপনাদের বাংলা সংস্করণ, পশ্চিমবঙ্গের সিপিএম মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের এই সব ভরতুকিমূলক প্রকল্পের নিন্দামন্দ করে কেন? কেন সর্বজনীন দুর্গাপুজো কমিটিকে ১০ হাজার টাকা করে অনুদান দিলে, সাধারণ মানুষের করের টাকায় খয়রাতি করা হচ্ছে বলে আদালতে মামলা ঠোকে? কিংবা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার তারকেশ্বর মন্দিরের সার্বিক উন্নতির জন্য প্যাকেজ ঘোষণা করলে আলিমুদ্দিনের ‘লেনিন’, ‘স্ট্যালিন’রা বক্রোক্তি করেন কেন? কেন বলা হয়, নরম হিন্দুত্বের খেলা হচ্ছে। আসলে এসবই প্রচ্ছন্নভাবে বিজেপির এগোনোর রাস্তা করে দেওয়া! শুধু তাই নয়, এ রাজ্যের সিপিএম নেতারা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ইমাম ভাতা দেওয়া নিয়েও কম শোর করেননি। যদিও আলিমুদ্দিনের নেতাদের এই শোরগোল নিয়ে ব্যক্তিগতভাবে আমি খুশিই, কেননা, কোনও দেবতা বা দেবালয় এবং স্বঘোষিত ঈশ্বরের পেয়াদাদের ইহজীবন ভোগ করার সহায়ক মূল্য ধরে দেওয়ায় আমার তীব্র আপত্তি আছে। কিন্তু বিজয়ন সরকার কোন আক্কেলে বন্যা বিধ্বস্ত কেরালাকে নতুন করে গড়ার বছরেই সাবরীমালা নিয়ে এত হাতখোলা হয়ে গেল? এ কি আতঙ্ক, না ভিতরে ভিতরে আত্মসমর্পণ? কী তফাত রইল মুণ্ডমস্তক, গেরুয়া বসনের যোগী সরকারের সঙ্গে মার্কসবাদী বিজয়ন সরকারের? কী তফাত, এখানে, ওখানে শিব মন্দিরে ঢুকে পড়া, গলায় উপবীত ধারণ করে ব্রাহ্মণ সাজা রাহুল গান্ধীর সঙ্গে মার্কসবাদী পিনারাই বিজয়নের!
এবছর অর্ধকুম্ভের আয়োজন করতে উত্তর প্রদেশ সরকার ৪ হাজার ২০০ কোটি টাকা রাজকোষ থেকে বরাদ্দ করেছে। বিজয়নের অর্থমন্ত্রী সাবরীমালা মন্দির ‘শোধন’ করতে ৭৩৯ কোটি বরাদ্দ করে যোগীদের পদচিহ্নময় পথে হাঁটলেন!
বিজয়নরা ঠিক সেই সময় এই নরম হিন্দুত্বের অবস্থান নিচ্ছেন, যখন কুম্ভমেলার ধর্ম সংসদ থেকে রাম মন্দির তৈরির দিন ঘোষণা করে হুমকি দেওয়া হচ্ছে। রাম মন্দির নির্মাণের কাজ শুরু হবে আগামী ২১ শে ফেব্রুয়ারি থেকে, ঘোষণা দ্বারকাপীঠের শঙ্কারাচার্য স্বামী স্বরূপানন্দ সরস্বতীর। তিনি বলেন, ১০ ফেব্রুয়ারি প্রয়াগরাজে কুম্ভমেলা শেষ হওয়ার পরেই অযোধ্যার উদ্দেশ্যে যাত্রা করবেন তাঁরা। অন্যদিকে, অযোধ্যায় সরকার অধিগৃহীত জমির যে অংশে বিতর্ক নেই, সেই অংশ রাম জন্মভূমি ন্যাস ট্রাস্ট’এর হাতে তুলে দেওয়ার জন্য মঙ্গলবার রিট পিটিশন সুপ্রিম কোর্টে দাখিল করল মোদী সরকার। একই সঙ্গে দক্ষিণ ভারতে রাম মন্দির মার্কা আন্দোলন গড়ে তুলতে সাধু-সন্তদের শিবির থেকে সাবরীমালা মন্দিরকে আশ্রয় করার কথা ভাবা হচ্ছে। সেই রকম ছকও শুরু হয়েছে গেরুয়াদের হেড কোয়ার্টার নাগপুরে। গত বৃহস্পতিবার আরএসএস প্রধান মোহন ভাগবত তাঁর ২০ মিনিটের ভাষণে সাবরীমালা নিয়ে অনেক বাক্য ব্যয় করেছেন। তাঁর ঘোষণা, সাবরীমালার ঐতিহ্য অস্বীকার করে হিন্দুদের বিশ্বাসে আঘাত করা হয়েছে।
এই হিন্দু জিগিরের আবহে স্রেফ কেরালার হিন্দু ভোট ধরে রাখতে বাজেটে এই তথাকথিত উদারতা! অথচ এদেশে প্রথম কমিউনিস্ট সরকারের কর্ণধার আপনাদের পূর্বসূরি ইএমএস নাম্বুদ্রিপাদ নিজের মসনদ কুরবানি দিয়েছিলেন নীতি আগলে রাখতে। সেই ১৯৫৭ সালে হিন্দু জাতীয়তাবাদ এখনকার মতো ফ্যাসিবাদী দাঁত-নখ বের করেনি, তবু ইএমএস আপস করেননি। আর আজ যখন সারা দেশের মানুষ চাইছে উগ্র হিন্দুয়ানা মুক্ত একটি উন্নয়নমুখী ভারত, আর যার জন্য ভরসা করতে চায় বিজয়ন আপনাদের ওপর, তখন এই ধর্মাশ্রিত রাজনীতি একটি বামপন্থী সরকার করতে পারে, এটা ভাবতেই অবাক লাগছে! হয়তো স্খলন হলে এরকমই হয়। যেমন, প্রয়াত সুভাষ চক্রবর্তী তারাপীঠের মন্দিরে পুজো দিয়েছিলেন। বাংলায় একটা কথা আছে, সব পাখিই মাছ খায় দোষ হয় মাছরাঙার!
(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)
Comments are closed.