জাতীয় ক্ষেত্রে বিজেপির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে কংগ্রেস-সিপিএমের সঙ্গে কোনও বিরোধিতা না থাকলেও, রাজ্যে এই দুই দল সম্পর্কে নিজের অবস্থান বুধবারই যন্তর মন্তরের সভায় স্পষ্ট করে দিয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ২০১৬ সালে সিপিএম-কংগ্রেস জোটকে পর্যুদস্ত করে বিধানসভা নির্বাচনে জয়ের পর সেই বছরই ২১ শে জুলাইয়ের সমাবেশে তৃণমূল নেত্রী তাঁর রাজনৈতিক লাইন এবং কৌশল ঘোষণা করেছিলেন। বলেছিলেন, ‘যে যেখানে শক্তিশালী, সে সেখানে লড়বে বিজেপির সঙ্গে।
এই লাইনকেই আরও এগিয়ে নিয়ে বুধবার দিল্লির সমাবেশে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নাম করেই জানিয়ে দেন, পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির বিরুদ্ধে লড়বে তৃণমূল কংগ্রেস। উত্তর প্রদেশে সপা-বিএসপি, দিল্লিতে আপ, রাজস্থান, মধ্য প্রদেশ, গুজরাত, ছত্তিশগড়ে কংগ্রেস, বিহারে আরজেডি, তামিলনাড়ুতে স্ট্যালিন, কেরলে সিপিএম লড়বে বিজেপির বিরুদ্ধে।
কিন্তু এখানেই প্রশ্ন উঠছে, আসন্ন লোকসভা নির্বাচনে বাংলার ক্ষেত্রে নির্বাচনের রাজনৈতিক সমীকরণটা কী হবে? রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, বুধবার যন্তর মন্তরে তৃণমূল নেত্রীর বক্তব্যের পর এরাজ্যে আরও প্রসারিত হয়েছে কংগ্রেস-সিপিএম সমঝোতার রাস্তা। এবং তিনটি ফর্মুলা মাথায় রেখে তার দিকেই এগোচ্ছে এই দুই দল। সূত্রের খবর, ২০১৬ সালের পুনরাবৃত্তি করে আসন্ন লোকসভা ভোটেও বাংলায় আসন সমঝোতা হতে চলেছে সিপিএমের সঙ্গে কংগ্রেসের।
সেক্ষেত্রে প্রথম ফর্মুলা হবে, ২০১৪ সালের লোকসভার নিরিখে যে ৬ টি আসন কংগ্রেস-সিপিএম পেয়েছিল (মালদহ উত্তর, মালদহ দক্ষিণ, জঙ্গিপুর এবং বহরমপুর কংগ্রেস এবং রায়গঞ্জ ও মুর্শিদাবাদ সিপিএম) সেখানে এই দুই দল কেউ কারও বিরুদ্ধে প্রার্থী দেবে না। অর্থাৎ, এখনও পর্যন্ত যা পরিস্থিতি, এই ৬ টি লোকসভা কেন্দ্রে কংগ্রেসের সঙ্গে বামেদের আসন সমঝোতা প্রায় নিশ্চিত। এর মধ্যে বহরমপুর আসনটি আরএসপি’র। তারা যেন ওই আসনের জন্য চাপাচাপি না করেন তাই চাইছে আলিমুদ্দিন স্ট্রিট। কংগ্রেসের দখলে থাকা বাকি ৩ টি আসন নিয়ে কোনও সমস্যা নেই সিপিএমের অন্দরে। এই ৬ টি আসনে কংগ্রেস এবং বামেরা কেউ কারও বিরুদ্ধে প্রার্থী না দেওয়ার বিষয়টি সিপিএমের গত রাজ্য কমিটির মিটিংয়ে কার্যত জানিয়েও দেওয়া হয়েছে।
আলিমুদ্দিন স্ট্রিট এবং সোমেন মিত্রর নেতৃত্বে প্রদেশ কংগ্রেস এখন আলোচনা শুরু করেছেন, দ্বিতীয় এবং তৃতীয় ফর্মুলা নিয়ে। রাজ্যের বাকি ৩৬ টি আসনে কীভাবে নিজেদের মধ্যে ঐক্য গড়ে জোট বা আসন সমঝোতা করা যায় তা নিয়ে শুরু হয়েছে কথাবার্তা। সূত্রের খবর, প্রাথমিক আলোচনায় দুই দলের নেতারাই বুঝতে পারছেন, বাকি ৩৬ টি আসনে খুব মসৃণভাবে আসন সমঝোতা করা মুশকিল। এখানে দাঁড়িয়েই রফা সূত্রের খোঁজ করছে আলিমুদ্দিন স্ট্রিট।
দ্বিতীয় ফর্মুলা হিসেবে ঠিক হয়েছে, বিজেপির বিরুদ্ধে লড়াইটাকে যে তাঁরা দুর্বল করতে চান না সেই বার্তা দিতে দার্জিলিং এবং আসানসোল, যে দুটি আসনে বিজেপির সাংসদ রয়েছেন, সেই দুই আসনে কমন প্রার্থী চাইছেন সিপিএম এবং কংগ্রেস নেতৃত্ব।
তৃতীয় ফর্মুলা হচ্ছে, উত্তর এবং দক্ষিণবঙ্গ মিলে ৮-১০ টি এমন আসন চিহ্নিত করতে চাইছেন সিপিএম এবং কংগ্রেস নেতৃত্ব, যেখানে গত ৩ বছরে বিজেপির ভোট উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে কোচবিহার, জলপাইগুড়ি, আলিপুরদুয়ার, কৃষ্ণনগর, বনগাঁ, বীরভূম, বাঁকুড়া, কলকাতা উত্তর, পুরুলিয়া আসন। এই আসনগুলিতেও আসন সমঝোতা চাইছেন সিপিএম নেতৃত্ব। কথাবার্তাও অনেকটাই এগিয়েছে প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি সোমেন মিত্র এবং তাঁর সঙ্গীদের সঙ্গে। সিপিএম নেতৃত্ব চাইছেন, রাজ্যে ৪২ টির মধ্যে অন্তত ১৪-১৫ টি আসনে তৃণমূল এবং বিজেপির বিরুদ্ধে এক জন প্রার্থী দিতে। সেক্ষেত্রে কোথাও সিপিএমের, কোথাও কংগ্রেসের বা কোথাও ঐক্যমত্য না হলে নির্দল প্রার্থীও দেওয়া যেতে পারে।
আগামী এক-দেড় সপ্তাহের মধ্যেই এই তিন ফর্মুলায় কংগ্রেসের সঙ্গে আসন সমঝোতার বিষয়টি রাজ্যস্তরে চূড়ান্ত করতে চাইছে আলিমুদ্দিন স্ট্রিট। কারণ, আগামী মাসের শুরুতেই, ৩-৪ মার্চ সিপিএমের সেন্ট্রাল কমিটির মিটিং। সেখান থেকেই শেষ পর্যন্ত রাজ্যের এই নির্বাচনী কৌশলের ছাড়পত্র আনতে হবে সূর্যকান্ত মিশ্রদের। আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের নেতারা আশাবাদী, রাজ্যে তৃণমূল এবং বিজেপির বিরুদ্ধে একযোগে লড়াইয়ের যে ডাক তাঁরা দিয়েছেন, তাতে নিজেদের জেতা এবং বিজেপির শক্তিশালী আসনগুলিতে সমঝোতার বিষয়টি তারা চূড়ান্ত করিয়ে আনতে পারবেন কেন্দ্রীয় কমিটি থেকে।
Comments are closed.