লাল কেল্লা ‘বেচে’ দিলেন মোদী। সিমেন্ট কোম্পানি ডালমিয়া ভারতকে।
মনে পড়ে গেল বড় লাট উইলিয়ম বেন্টিঙ্ককে। সতীদাহ প্রথা বন্ধ করার সঙ্গে যাঁর নাম জড়িয়ে আছে। বড় যুদ্ধবাজ রুস্তম ছিলেন তিনি। বড় লাট হয়েই লাট সাহেব বেন্টিঙ্ক শাহজাহানের বেগম মমতাজের সমাধি তাজমহল বিক্রি করে দেওয়ার পরিকল্পনা করেছিলেন। তাজের অন্দরে যে অপূর্ব মোতি মসজিদ ছিল, তা তিনি এক মাড়োয়ারি ব্যবসায়ীকে এক লক্ষ পঁচিশ হাজার টাকায় বিক্রিও করে দিয়েছিলেন। তখন নিলামে তাজমহলের দাম উঠেছিল মাত্র দু লক্ষ টাকা। ঊনবিংশ শতকের প্রথমার্ধের কথা। তাজমহল কিনবেন বলে এসেছিলেন এক ভক্ত। সমাধির শ্বেত পাথর দিয়ে বৃন্দাবনে নিজের দেবতার মন্দির বানাতে চান তিনি। শাহজাহান যখন এই স্মৃতিসৌধ তৈরি করেন, সেই আমলে এটি বানাতে খরচ হয়েছিল পঞ্চাশ লক্ষ টাকা! বেন্টিঙ্ক ভাবলেন, মাত্র দু লক্ষ টাকায় কালের কপোলতলে শুভ্র সমুজ্জ্বল এই তাজমহল তিনি বিক্রি করে দেবেন? বড্ড শস্তা হয়ে যাচ্ছে যে! সেই খবর পৌঁছে গিয়েছিল ব্রিটেনের রাজা চতুর্থ জর্জের কাছে। তিনি নাকি সব কথা শুনে মন্তব্য করেছিলেন, যুদ্ধ করে করে, মানুষ খুন করে করে ওই বেন্টিঙ্ক নামক জওয়ানের মাথা খারাপ হয়ে গেছে। সরকার কোম্পানিকে বলো, সকাল বিকেল বড় লাটের মাথায় বরফ দিতে। তখন রাজার এক পার্ষদ বলেছিলেন, হুজুর বেন্টিঙ্ককে বিলেতে ফিরিয়ে আনুন। রাজা জর্জ উত্তর দিয়েছিলেন, আমার মাথা তো খারাপ হয়নি, ও এখানে এলে ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবে মানে রাজা সপ্তম হেনরির চ্যাপেল বেচে দেবে! এই রোগের নাম নেক্রোম্যানিয়া!
শাহজাহানের বানানো লাল কেল্লা কিন্তু নেক্রোম্যানিয়ার হাত থেকে মুক্তি পেল না। আর এক রুস্তম নরেন্দ্র মোদী, ভারতের বড় লাট, থুড়ি, প্রধানমন্ত্রী, পঁচিশ কোটি টাকায় ‘বিক্রি’ করে দিলেন ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী সৌধ কিলা-ই-মুবারক—আশীর্বাদধন্য দুর্গ। শাহজাহানের রাজপ্রাসাদ। পরে অবশ্য বাদশা তাঁর রাজধানী নিয়ে গিয়েছিলেন আগ্রায়। মোদিজিও নিশ্চয় লাল কেল্লা ছেড়ে এবার আগ্রায় মন দেবেন।
তাজমহল। তা কেনার জন্য সিগারেট কোম্পানি মুখিয়ে আছে। আরও কত সব কোম্পানি জুলজুল করে তাকিয়ে আছে কোনার্কের সূর্য মন্দির, অজন্তা গুহা আর চারমিনারের দিকে। আহ! যদি বাবরি মসজিদ বেঁচে থাকত, তবে সেও দত্তক মাতা বা পিতা হিসাবে পেয়ে যেত কোনও ফোন কোম্পানি কিংবা গুটখা প্রস্তুতকারক সংস্থাকে।
ঊনিশ শতকের মাঝে, ১৮৫৭ সালে, এই লাল কেল্লা থেকে ভারতের প্রথম স্বাধীনতার যুদ্ধের ডাক দেওয়া হয়েছিল। দ্বিতীয় বাহাদুর শাহকে এই লাল কেল্লা থেকে পাঠানো হয়েছিল রেঙ্গুনে, নির্বাসনে। তাঁর যুবরাজ পুত্র ফখরু মির্জার সৎ ছেলে মশহুর কবি দাগ দেহলবি এই লাল কেল্লায় বড় হয়েছিলেন। আইএনএ-র যুদ্ধবন্দীদের বিচার হয়েছিল এই সৌধে। কত স্মৃতি! একবার শিখরা দখল করেছিল কয়েক দিনের জন্য। ইংরেজ কোম্পানির ফৌজ তছনছ করেছিল এই সৌধ, লুটপাট করেছিল দামি রত্ন জহরত। তাদের সামরিক দুর্গও ইতিহাসের অতলে ডুবে গিয়েছিল। মাথা তুলে দাঁড়িয়েই ছিল লাল কেল্লা।
নোটবন্দীর পরে নতুন যে পাঁচশো টাকার নোট ছাপা হয়, তার এক দিকে এই লাল কেল্লার ছবি। বছর ঘোরার পরেই সেই লাল কেল্লার দত্তক পিতা মহামান্য ডালমিয়া। এ কি কাকতালীয়, না, এই ছবির আছে অন্য কোনও গূঢ় তাৎপর্য?
পি এন ওক যেমন প্রচার করেছিলেন, তাজমহল আসলে তেজো মহালয়া—শিবমন্দির, কারণ ওই এলাকায় আছে বেল আর হরশৃঙ্গার বৃক্ষ। আদালত মুখে ঝামা ঘষে দিলেও ওক বৃক্ষরা থামেননি। লাল কেল্লা নাকি লালকোট—নির্মাণ করেছিলেন অনঙ্গপাল টোমার—সেই একাদশ শতকে। এমন বিকৃত ইতিহাস প্রচারের পাশাপাশি স্বয়ং মোদিজি লাল কেল্লা যে ডালমিয়া গোষ্ঠীকে ‘দিলেন’, এর কারণও খুঁজে বের করা দরকার।
খুব শীঘ্র আসছে স্বাধীনতা দিবস! ১৫ অগস্ট। বার বার কি লাহোর গেট দিয়ে ঢুকে শাহজাহানের লাল কেল্লায় পতাকা তুলতে ভাল লাগে! এই বার নরেন্দ্রজি পতাকা তুলবেন ডালমিয়া ভারতের লালকোটে। তবে এই কি শেষ বার? লাল কেল্লা বড় খতরনক সৌধ। সে কাউকে ছাড়ে না। এক সুফি ফকির বলেছিলেন। লাল কিলা আদতে ছিল শুভ্র, বহু রক্ত লেগে আছে তার গায়ে। তাই সে রক্তিম। বহু শ্রমজীবী, স্বাধীনতা সংগ্রামীর খুন মেখে সে নিজেই এই দেশের ইতিহাস। সময়, ইতিহাস ও ঐতিহ্য-‘বিক্রেতা’-কে ছেড়ে কথা বলবে না!
(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)