পঞ্চায়েত যার ভোট তার, এই স্লোগানে মালদহ, মুর্শিদাবাদে কংগ্রেস দুর্গ ভাঙতে মরিয়া তৃণমূল! লড়াই ঐতিহ্যের সঙ্গে গ্রামের ক্ষমতার
দেওয়াল লিখন যদি কোনও ইঙ্গিত বহন করে, তবে রাজ্যে কংগ্রেসের দীর্ঘ দিনের দুই শক্ত ঘাঁটি মালদহ এবং মুর্শিদাবাদে এবার উলটে যেতে পারে রাজনীতির সমস্ত হিসেব-নিকেশ। নানান ছোট-মাঝারি চিড় ধরা সত্ত্বেও কংগ্রেসের এই দুই দুর্গ যে এখনও অটুট আছে, তা হয়তো আর খুব বেশিদিন নাও থাকতে পারে। তার প্রধান কারণ, মালদহে গনির প্রতি মানুষের আবেগ কমে যাওয়া নয় বা অধীর চৌধুরীর প্রতি মুর্শিদাবাদ জেলাজুড়ে সম্পূর্ণ অনাস্থা নয়। আসল কারণ, পঞ্চায়েত।
গত কয়েক দশক ধরেই বাংলার নির্বাচনী রাজনীতিতে মুখ্য ভূমিকা নিয়েছে পঞ্চায়েত। পঞ্চায়েত যার ভোট তার, এই অমোধ নিয়মের ভরসাতেই দিনের পর দিন দিন রাজ্যে বিধানসভা এবং লোকসভা নির্বাচনে ডিভিডেন্ড পেয়েছে সিপিএম। অতীতে রাজ্যে কখনও কখনও বিধানসভা বা লোকসভা নির্বাচনে প্রবল হাওয়া সত্ত্বেও (১৯৯৬ বিধানসভা, ১৯৯৮-১৯৯৯ লোকসভা বা ২০০১ বিধানসভা) হাতে পঞ্চায়েত না থাকায় ভোট বাক্সে তার প্রতিফলন ঘটেনি বিরোধীদের পক্ষে। কিন্তু রাজ্যে ২০১১ সালে যে পরিবর্তন হল, তার আগাম ইঙ্গিত মিলেছিল ২০০৮ সালের পঞ্চায়েত ভোটে। যেখানে দক্ষিণবঙ্গের দুটি জেলা পরিষদ (দক্ষিণ ২৪ পরগনা এবং পূর্ব মেদিনীপুর) দখল করাই নয়, উত্তর ২৪ পরগনা, নদিয়া, হুগলি, হাওড়া, এমনকী পশ্চিম মেদিনীপুর, বর্ধমানেও গ্রাম পঞ্চায়েত স্তরে বহু আসন জিতেছিল তৃণমূল। আর তখনই বোঝা গিয়েছিল, পায়ের তলার মাটি সরছে সিপিএমের।
২০১৯ লোকসভায় ঠিক এই জায়গাতেই মালদহ এবং মুর্শিদাবাদে কংগ্রেসের দুর্গে আঘাত হানার প্রস্তুতি নিয়েছে তৃণমূল। রাজ্যে যে সময়ে নির্বাচনী রাজনীতিতে তৃণমূলের উত্থান, সেই ২০০৯ এবং ২০১১ সালে কংগ্রেসের সঙ্গে জোট থাকার ফলে এই দুই জেলা কার্যত কংগ্রেসের হাতে ছেড়ে দিয়েছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ২০১৪ সালের লোকসভা ভোটে চতুর্মুখী লড়াই হলেও, তার আগে এই দুই জেলায় নিচুতলার সংগঠনে সেভাবে প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি তৃণমূল। ২০১৬ সালে বামেদের আসন সমঝোতার সুফলও এই দুই জেলায় অনেকটাই গিয়েছিল কংগ্রেসের ভোট বাক্স। কিন্তু ২০১৮ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনের পর এক ভিন্ন রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে আগামী সপ্তাহে ভোট হতে চলেছে এই দুই জেলার ৪ লোকসভা কেন্দ্রে। তারপরে রয়েছে আসল লড়াই, বহরমপুরে।
মালদহ এবং মুর্শিদাবাদে পঞ্চায়েতের সর্বস্তরে তৃণমূলের জয়ের পর এই দুই জেলায় বুথ এবং গ্রাম লেভেলে রাজনৈতিক পরিস্থিতি আজ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পক্ষে অনেকটাই অনুকুল। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আরও একটা ফ্যাক্টর, এই দুই জেলার কিছু কিছু জায়গায় বিজেপির শক্তিবৃদ্ধি। যার ফলে একদিকে বাম-কংগ্রেসের আসন সমঝোতা ভেস্তে যাওয়া, অন্যদিকে বিজেপির শক্তিবৃদ্ধিতে রাজ্যে শাসক বিরোধী কিছু ভোট সেদিকে চলে যাওয়া, দুইয়ে মিলে খানিকটা বাড়তি সুবিধে পাবে তৃণমূল। আর এর সঙ্গে যুক্ত হবে পঞ্চায়েতের ক্ষমতাকে ব্যবহার করে গত এক বছরে গ্রাম স্তরে তৃণমূলের দাপট বৃদ্ধি। হ্যাঁ, নিছক শক্তি বা প্রভাব নয়, দাপট বৃদ্ধি। যে দাপট ভোটের দিন কত গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে তা আর কেউ না জানুন, অধীর চৌধুরী ভালই জানেন।
আর সেই কারণে এই দাপটকেই ভয় পাচ্ছে কংগ্রেস, সমীহ করছেন অধীর চৌধুরী। তিনিও জানেন, গ্রাম পঞ্চায়েত থেকে জেলা পরিষদ হাতে থাকার যে সুবিধে তিনি দীর্ঘ দিন লোকসভা, বিধানসভা ভোটে পেয়েছেন, তা এবার তাঁর সঙ্গে নেই। যে সুবিধের ওপর ভরসা করে ঘুঁটি সাজাচ্ছেন এই দুই জেলায় তৃণমূলের সেনাপতি, রাজ্যের মন্ত্রী শুভেন্দু অধিকারী। শুভেন্দু অধিকারীর দাবি, লোকসভা ভোটের পর মুর্শিদাবাদে প্রধান শক্তি হবে তৃণমূল।
কংগ্রেসের এই শেষ দুই দুর্গ রক্ষা হবে কিনা তা জানা যাবে ২৩ শে মে। রাজ্যজুড়ে সিপিএমকে ধূলিস্যাৎ করে কংগ্রেসের দুর্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অশ্বমেধের ঘোড়া আটকে যাবে কিনা জানা যাবে তাও। কিন্তু, পঞ্চায়েত ভোটের এক বছরের মাথায় গাজোল থেকে কালিয়াচক, সামশেরগঞ্জ থেকে ভরতপুর বা বেলডাঙার প্রত্যন্ত গ্রামের দেওয়াল লিখন বলছে, একদিকে ঐতিহ্য, অন্যদিকে গ্রাম স্তরে পঞ্চায়েত, এই লড়াইয়ে দুর্গা রক্ষা সহজ কাজ নয় কংগ্রেসের পক্ষে।
Comments are closed.