দিল্লির অবস্থা অসহনীয়, আতঙ্ক নিয়ে বেঁচে আছি আমরা

কালীপুজো এবং দিওয়ালিতে রাত এগারোটা পর্যন্ত তেমন ভাবে বাজি ফাটেনি ময়ূর বিহারের আশপাশে। দিল্লিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অনেক চেনা পরিচিতকে ফোন করে জানলাম, সেই সব এলাকাতেও অন্যবারের তুলনায় বাজি কম ফেটেছে। যাক। নিশ্চিন্ত হলাম, দিল্লি শহরের মানুষ বোধ হয় সচেতন হয়েছে। কিন্তু রাত এগারোটার পর থেকেই শুরু হল শব্দ ও আলোর বাজির তাণ্ডব। প্রচণ্ড শব্দে কান পাতা দায়। ধোঁয়ায় ঢেকে গিয়েছে গোটা তল্লাট। সকালে উঠতেই শুরু হল চোখ জ্বালা, মাথা ব্যথা আর নিঃশ্বাসের কষ্ট। আমার মেয়ে বলল, মা, চোখে অসম্ভব জ্বালা করছে, সমানে জল পড়ছে। পরের দিন সকাল থেকে চারিদিকে অন্ধকার। ধোঁয়া, ধোঁয়া সব। রাস্তায় গাড়িঘোড়া চলছে হেড লাইট জ্বালিয়ে। মনে পড়ল রবীন্দ্রসঙ্গীতের কয়েকটা পংক্তি: ‘গহন ঘন ছাইল গগন ঘনাইয়া, স্তিমিত দশদিশি, স্তম্ভিত কানন, সব চরাচর আকুল — কী হবে
কে জানে।’
সামান্য দূর থেকেও ইন্ডিয়া গেট দেখা যাচ্ছে না। চারিদিকে অন্ধকার। তার মধ্যে মানুষ মুখোশ পরে নাকে রুমাল চাপা দিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। মনে পড়ল গত দু বছর আগের কথা। গত বছরও দিল্লির দূষণ মাত্রা ছাড়িয়েছিল। দিল্লির আপ সরকার এই দূষণ আটকানোর জন্য অনেক চেষ্টা করেছে। কিন্তু প্রতিবেশী রাজ্য পাঞ্জাব এবং হরিয়ানায় ফসল তোলার পরে অবশিষ্ট খড় পোড়ানোর রীতি রয়েছে, তার জন্য রাজধানী দিল্লিতেও প্রচুর মাত্রায় বায়ুদূষণ বেড়ে যায়। সঙ্গে কুয়াশা ও ধোঁয়া মিলিয়ে দিল্লির বুকে যেন পাথর চাপা পড়ে এই সময়।
গত কয়েক দিন ধরে শহরে একই অবস্থা। এই প্রথম দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল জনস্বাস্থ্য সংক্রান্ত জরুরি অবস্থা জারি করেছেন। শহরের সমস্ত স্কুল ৫ নভেম্বর পর্যন্ত ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। এটা স্বস্তির বিষয়। যাক বাবা। মেয়েকে স্কুলে পাঠাতে হবে না। গত কয়েকদিন ধরেই দিল্লির রাস্তায় গাড়ি কম চলছে। বাচ্চাদের বাড়ির বাইরে বেরোতে দিচ্ছেন না বাবা মায়েরা। আমিও গাড়ি বার করছি না। অফিসে যাচ্ছি মেট্রোয় চেপে। ফেরার পথে মেট্রো স্টেশন থেকে বাড়ি আসার পথটুকু আসতেও কষ্ট হচ্ছে। বুকে কেমন চাপ চাপ লাগছে। বয়স্ক এবং বাচ্চাদের ভয়ানক সমস্যা। বাড়িতে আমার বৃদ্ধা শাশুড়ি আছেন। তিনিও কষ্ট পাচ্ছেন। এমন অবস্থা, বাড়িতেও মাস্ক পরে থাকতে হচ্ছে। এয়ার পিউরিফায়ার লাগানো হচ্ছে ঘরে ঘরে। তাতেও কাজ হচ্ছে না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই ভয়ানক দূষণের জন্য দিল্লির মানুষের আয়ু গড়ে আট বছর কমে যেতে পারে।
ভাবতে অবাক লাগছে। এক শ্রেণির মানুষের জন্যই আজ আমাদের এই দুরবস্থা। চারিদিকে এত প্রচার হচ্ছে। তবু মানুষ সচেতন হচ্ছে কই?
আমাদের কি সত্যিই কিছু করার নেই? নিশ্চয়ই রয়েছে। আমরা বাজি পোড়ানো বন্ধ করতে পারি। আমরা জমিতে খড় পোড়ানো বন্ধ করতে বিকল্প ব্যবস্থা করতে পারি। দিল্লির মানুষ বিত্তশালী হলেও অশিক্ষার শিকার হয়ে প্রথাগুলো নিষিদ্ধ করার কথা ভাবছেন না। তার ফল ভুগতে হবে আমাদেরই। শেষের সেদিন ভয়ঙ্কর। প্রতিকার খুঁজতে হবে এখন থেকেই। টাইটানিক কিন্তু ডুবতে চলেছে। অথচ বাজনদাররা বাজনা বাজিয়েই চলেছে। কবে যে আমাদের হুঁশ ফিরবে, দেবা ন জানন্তি।

(লেখিকা একটি বহুজাতিক সংস্থার উচ্চপদস্থ কর্ত্রী)

 

Comments are closed.