ইলাহাবাদ শহরের নাম বদল হবে। করবেন উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ। সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে ফেলেছেন। নতুন নাম হবে প্রয়াগ—গঙ্গা, যমুনা ও সরস্বতীর সঙ্গমস্থল। যদিও সরস্বতী আর নেই!
ইলাহাবাদ শহরের পত্তন করেছিলেন মহামতি আকবর। কেল্লা বানান সেখানে, সেই সৌধ এখন সামরিক বিভাগের অধীনে। গঙ্গা, যমুনা ও সরস্বতীর সঙ্গমের তীরে অক্ষয়বটের পাশে এই কেল্লা। শোনা যায়, মুমুক্ষু মানুষরা এখানে আত্মহত্যা করতেন। আকবর সেই স্ববধ রোধে এই কেল্লা নির্মাণ করেছিলেন। স্থানীয় লোকজন কিসসা বলে থাকেন, সম্রাট আকবর তাঁর পূর্বজন্মে ধার্মিক হিন্দু ছিলেন, তখন তাঁর নাম ছিল মুকুন্দ ব্রহ্মচারী। একদা ভ্রান্তিবশত গোদুগ্ধ পানকালে একটি গোকেশ তাঁর উদরে চলে গেলে তিনি পাপভয়ে আত্মহত্যা করেন। পরজন্মে মুকুন্দ আকবর হয়ে জন্মান ও সঙ্গমস্থলে আত্মহত্যা নিবারণে সচেষ্ট হন। সেই সময় কেল্লা নির্মাণেও বার বার ব্যর্থ হচ্ছিলেন সম্রাট আকবর। স্থানীয় এক ব্রাহ্মণ তাঁকে কেল্লা নির্মাণে সাহায্য করলে ওই ব্রাহ্মণদের উত্তরপুরুষদের তিনি ‘প্রয়াগবাল’ ব্রাহ্মণ উপাধি দিয়ে সঙ্গমে পূজা-আর্চার নিরঙ্কুশ অধিকার প্রদান করেন।
এই সেই ইলাহাবাদ! ‘ইলাহ’ মানে হল উপাস্য। উপাস্যের সেই পীঠ এবার বদলে যাবে। যোগী আদিত্যনাথ তার নতুন নাম দেবেন প্রয়াগ। কিন্তু ‘প্রয়াগ’ শব্দের অর্থ কী? কী তার ব্যঞ্জনা! প্রকৃষ্ট যাগ যেখানে, তাই প্রয়াগ। মতান্তরে, প্রকৃষ্ট যাগ যার, সেই প্রয়াগ। কী সেই ‘যাগ’? কেউ বলেন, যাগ হল দান; কারও মতে, বলি বা হোমদ্রব্য হল যাগ। যজ্ঞশালাকেও যাগ বলা যায়। কী এই নতুন যজ্ঞশালা? হিন্দুত্বের নতুন ফর্মুলা কি!
যখন দেশের মানুষ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের অগ্নিসম মূল্যে নাজেহাল, পেট্রপণ্যের দাম প্রতিদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে, মানুষের বাঁচার অধিকার খর্ব হচ্ছে, সংখ্যালঘুদের মৌলিক অধিকার ভারতীয় সংবিধানের মতোই ভূলুন্ঠিত হচ্ছে, তখন এই নতুন যজ্ঞশালার প্রয়োজন অত্যন্ত বেশি। মানুষ এই সব নিয়ে মেতে থাকবেন। ঔরঙ্গজেবের বদলে রাস্তার নাম হবে এপিজে আব্দুল কালাম, আকবরকে সরিয়ে নিয়ে আসা হবে রাণা প্রতাপকে। উপাস্যের শহর ইলাহাবাদ হবে যজ্ঞশালা। মৌর্য রাজা দিলুর নামে যে দিল্লি, তার বদলে রাজধানী হবে ইন্দ্রপ্রস্থ।
মহাভারতের আদিপর্বের শেষে খাণ্ডবদহন আছে। সেখানে অগ্নি নামক দেবতার পেটের রোগ হয়েছে, তিনি খাণ্ডব বন দগ্ধ করে ভক্ষণ করার বায়না ধরলেন ভগবান কৃষ্ণ ও অর্জুনের কাছে। জন্তু-জানোয়ার ও পক্ষীসমেত সেই বন পোড়ানো হল। বেঁচে গেল মাত্র ছয় জন প্রাণী, তাদের একজন ময় দানব। সেই ‘ময়’ নামক দানব ওই ভস্মের উপর বানালেন সভাগৃহ—নাম দেওয়া হল ইন্দ্রপ্রস্থ। যুধিষ্ঠিরকে সম্রাট বানানো হল। এর পর হবে জুয়া খেলা, বনবাস ও মহারণ।
কুন্তী এবং পঞ্চপাণ্ডব, বারণাবতের জতুগৃহে পাঁচ নিষাদ ও তাঁদের নিষাদী মাকে ভরপেট মদ-মাংস খাইয়ে গৃহে আগুন ধরিয়ে যে গোপন সুড়ঙ্গ দিয়ে পালিয়েছিলেন, সম্প্রতি সেই সুড়ঙ্গ ‘আবিষ্কৃত’ হয়েছে মীরাটের কাছে। ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণ সেই গোপন সুড়ঙ্গ খুঁজে পেয়ে যারপরনাই আহ্লাদিত। ‘বাঘপাত’ নামক স্থানে ওই সুড়ঙ্গের নাম দেওয়া হয়েছে ‘বারনবা’। এই ভাবে আরও বহু সুড়ঙ্গ আবিষ্কৃত হবে। আমরা একে একে জানতে থাকব, আমাদের খনক পূর্বপুরুষ কত উন্নত ছিলেন– জ্ঞান-বিজ্ঞান, ইন্টারনেট পরিষেবা, কৃত্রিম উপগ্রহ ইত্যাদি নিয়ে তাঁদের গবেষণার মান ছিল আকাশচুম্বী। আর আধুনিক-আমরা দেশের সংখ্যালঘু মানুষকে বাঁচতে দেব না। একের পর এক জনবিরোধী সিদ্ধান্ত নেব, দেশটাকে বেচে দেবে কতিপয় শিল্পপতির হাতে। সাধারণ মানুষকে কেবল ভয় দেখাব, পেটাব। কারা ওই আমরা? এই শিক্ষা কি মহাভারত আমাদের দিয়েছে?
মহাভারতের অন্তর্ভুক্ত যে ভারত, তা আমাদের দেশ ভারত নয়। ওই ভারত এসেছে ভারবত্ত্ব থেকে। মহৎ ও ভারবান বলে ওই মহাকাব্যের নাম মহাভারত। সেই বনস্পতির মূল ফল হল শান্তিপর্ব।
ইলাহাবাদ, দিল্লি যদি ম্লেচ্ছ-যবনদের স্মৃতি হয়, তবে কোন শাস্ত্রবলে প্রয়াগ বা ইন্দ্রপ্রস্থ হিন্দু-সংস্কৃতি? ‘হিন্দু’ শব্দই যেখানে নেই কোনও পুরাণ কিংবা বেদে। তার সন্ধান করতে গেলে যেতে হয় ম্লেচ্ছ ফারসির কাছে, সেই শব্দ আছে জেন্দাবেস্তায়। ম্লেচ্ছ-যবনরা বার বার উল্লিখিত হয়েছেন মহাভারতে, হিন্দুরা হননি; সেখানে সিদ্ধান্তী হলেন সেশ্বর সাংখ্য। নানা সংস্কৃতির সহাবস্থান আছে ওই মহাকাব্যে। এমনকী যোগী আদিত্যনাথ যে সম্প্রদায়ের মানুষ, তারাও ‘হিন্দু’ নন, হিন্দু নন অমিত শাহও। যে হিন্দু-সংস্কৃতিকে আমরা জানি এবং চিনি তা হল সহিষ্ণুতার ধর্ম—যেখানে ধর্ম মানে নৈতিকতা ও মানবতা। সেখানে পরমত উপড়ে ফেলে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করা লক্ষ্য নয়, লক্ষ্য হল অন্য মতকে আত্মস্থ করে এগিয়ে যাওয়া।
নাম বদলে দিলে ভাবের ঘরে চুরি করা হয়! মহাভারতের শেষে আমরা দেখেছি, ইন্দ্রপ্রস্থের নায়ক অর্জুনের গাণ্ডীব আর কাজ করছে না। ভগবান কৃষ্ণ তখন মৃত। দস্যুরা হরণ করে নিয়ে যাচ্ছে নারী ও সম্পদ। অর্জুন ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রয়েছেন। ক্ষমতাও শেষ হয় একদিন।
সব কিছুর এক্সপায়ারি ডেট থাকে!
(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)