ইউরেনিয়ামের সন্ধানে সঙ্কটে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম ব্যাঘ্র সংরক্ষণ প্রকল্প তেলেঙ্গানার অমরাবাদ, আপত্তি পরিবেশবিদদের
ইউরেনিয়ামের সন্ধানে কি এবার উচ্ছেদের মুখে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম ব্যাঘ্র সংরক্ষণ প্রকল্প? এই সন্দেহ দৃঢ় হচ্ছে, কারণ সম্প্রতি তেলেঙ্গানার অমরাবাদ ব্যাঘ্র সংরক্ষণ প্রকল্প এলাকায় ইউরেনিয়াম উত্তোলনে নীতিগত সম্মতি দিয়েছে কেন্দ্রীয় পরিবেশ মন্ত্রক। এর ফলে ব্যাঘ্র সংরক্ষণ প্রকল্পের কোর এরিয়ায় প্রায় ৮৩ বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে চলবে ইউরেনিয়াম উত্তোলন। যার জেরে কার্যত ধ্বংসের মুখে ভারতের জাতীয় পশুর দ্বিতীয় বৃহত্তম বিচরণ ক্ষেত্র।
পরমাণু চুল্লিতে বিদ্যুৎ তৈরির ক্ষেত্রে অপরিহার্য ইউরেনিয়াম। ভারতে বর্তমানে মোট ২২ টি পরমাণু চুল্লি রয়েছে। কিন্তু দেশে ইউরেনিয়াম বাড়ন্ত। ফলে পরমাণু চুল্লিগুলো উৎপাদন ক্ষমতার ধারে-কাছেও পৌঁছোতে পারছে না। ২০১৮ সালে সংশ্লিষ্ট সংসদীয় কমিটিকে পরমাণু শক্তি বিভাগ বা ডিএই জানায়, দেশে ইউরেনিয়ামের আকাল ক্রমেই বাড়ছে। এই পরিস্থিতিতে কানাডা, কাজাখস্তান এবং জাপান থেকে ইউরেনিয়াম আমদানির উপর নির্ভরতা আরও বাড়াতে বাধ্য হচ্ছে ভারত। ঝাড়খণ্ডের জাডুগুডা খনি থেকে সিংহভাগ দেশিয় ইউরেনিয়াম পাওয়া যায়। তবে ইউরেনিয়াম থাকে মাটির অত্যন্ত গভীরে। ফলে নির্দিষ্ট গভীরতা পর্যন্ত মাটি খুঁড়তে খরচ হু-হু করে বেড়ে যাচ্ছে। তাই বর্তমানে সেখানে ইউরেনিয়াম উত্তোলন অলাভজনক হয়ে পড়েছে। এদিকে অন্ধ্র প্রদেশ, বিশেষ করে তেলেঙ্গানার কুড্ডাপ্পা অববাহিকায় খোঁজ মিলেছে বিপুল পরিমাণ উচ্চ মানের ইউরেনিয়াম ভাণ্ডারের। যে ভাণ্ডারের দিকে তীক্ষ্ণ নজর সংশ্লিষ্ট সরকারি প্রতিষ্ঠান এবং কর্পোরেট সংস্থাগুলোর।
এবার সেই লক্ষ্যে পদক্ষেপও শুরু হয়ে গেল। তেলেঙ্গানার কুড্ডাপ্পা অববাহিকার মধ্যেই পড়ে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম ব্যাঘ্র সংরক্ষণ প্রকল্প অমরাবাদ। অবিভক্ত অন্ধ্র প্রদেশে অমরাবাদ ছিল দেশের বৃহত্তম নাগার্জুনসাগর শ্রীশৈলম ব্যাঘ্র সংরক্ষণ প্রকল্পের অধীন। কিন্তু রাজ্য ভাগের পর অমরাবাদকে পৃথক সংরক্ষণ প্রকল্পের মর্যাদা দেওয়া হয়।
বন দফতরের তথ্য অনুযায়ী, অমরাবাদ ব্যাঘ্র সংরক্ষণ প্রকল্পে রয়েছে অন্তত ১৮ টি পূর্ণবয়স্ক বাঘ। পাশাপাশি অন্যান্য বন্যপ্রাণীর এক বিপুল সমারোহ এবং তার ঠিক নীচেই রয়েছে উচ্চমানের ইউরেনিয়ামের এক বিশাল ভাণ্ডার। অমরাবাদ ব্যাঘ্র সংরক্ষণ প্রকল্পটি অবস্থিত নাল্লামালা পাহাড়ের পাদদেশে। এই এলাকা চেঞ্চু উপজাতির আদি বাসস্থান। অরণ্যে ইউরেনিয়াম খনি প্রকল্প হলে বন্যপ্রাণের পাশাপাশি যুগ যুগান্ত ধরে জঙ্গলে বসবাস করা চেঞ্চু আদিবাসীরাও চরম সঙ্কটের মুখে পড়বেন। তেজস্ক্রিয়তার ভয়াল বিপদের পাশাপাশি রয়েছে পরিবেশ দূষণের আশঙ্কাও।
হায়দরাবাদ ব্যাঘ্র সংরক্ষণ সমাজের সহ প্রতিষ্ঠাতা ইমরান সিদ্দিকি ব্যাঘ্র প্রকল্পের মধ্যে প্রস্তাবিত ইউরেনিয়ান খনন অভিযানের তীব্র বিরোধিতা করেছেন। তাঁর প্রশ্ন, সাধারণ মানুষের লাগাতার বিরোধিতা সত্ত্বেও কীভাবে এই প্রকল্প নীতিগত সম্মতি পায়? ইমরান সিদ্দিকির অভিযোগ, ২০১৫ সালে অমরাবাদ ব্যাঘ্র সংরক্ষণ প্রকল্পে ইউরেনিয়ামের খনি তৈরির জন্য পদক্ষেপ নিতে শুরু করে কেন্দ্র। তখন বলা হয়েছিল, এই খনির প্রকৃতি হবে নন ইভাসিভ এক্সপ্লোরেশন অর্থাৎ, বন্য প্রাণ কিংবা সবুজ ধ্বংস না করেই চলবে ইউরেনিয়াম উত্তোলন। কিন্তু পরবর্তীতে প্রকল্পের নকশায় দেখা যাচ্ছে, খনি করতে গভীর জঙ্গলে কমপক্ষে ৪ হাজার গভীর কুঁয়ো খুঁড়তে হবে। আর এখানেই আপত্তি পরিবেশবিদদের। তাঁদের দাবি, এর ফলে ভয়াবহ তেজস্ত্রিয়তা ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা বেড়ে যাবে বহুগুণ। অরণ্য উপদেষ্টা কমিটির সদস্যরাও বলছেন, ইউরেনিয়াম খনি তৈরির জন্য শুধু অমরাবাদই নয়, বলি দিতে হবে কার্যত অন্ধ্র-তেলেঙ্গানার বৃহত্তম মিষ্টি জলের ভাণ্ডার নাগার্জুনসাগর এবং কৃষ্ণা নদীকেও। দেশ যখন ভয়াবহ জলকষ্টে ভুগছে, তখন এই পদক্ষেপের যৌক্তিকতা নিয়েই প্রশ্ন তুলছেন তাঁরা। এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন, পরিবেশবিদদের আপত্তি কি আদৌ গ্রাহ্য করবে সরকার, নাকি নিজের গড় থেকেই উচ্ছেদ হতে হবে জাতীয় পশু বাঘকে?
Comments are closed.